সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর পরিচালন ব্যয় অনেক কমেছে। এর অন্যতম কারণ মন্ত্রী, এমপিসহ অনেকের পেছনে আগের মতো আর নিয়মিত ব্যয় হচ্ছে না। আবার এখন যেকোনো খরচ করার ক্ষেত্রে জবাবদিহি বাড়ানো হয়েছে। এসব কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে আগের সরকারের যে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল তা কমছে। এ ছাড়া আস্থার সংকটে দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমানত তুলে নেয়ার প্রবণতা অব্যাহত আছে। সেই আমানতের একটা অংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হিসেবে আসছে। আবার সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর প্রবণতাও কমেছে। শেয়ারবাজারেও দুর্দিন চলছে। সব মিলিয়ে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ সরকারের ঋণ হিসেবে গণ্য হয়। এটা বাজেট ঘাটতির অর্থায়নে ব্যবহার করে সরকার।
নিম্ন মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, মহিলা, প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলক বেশি মুনাফা (সুদ) দেয় সরকার। বর্তমানে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১.৭৬ শতাংশ। এ ছাড়া পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১.৫২ শতাংশ, ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সুদ ১১.২৮ শতাংশ ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১.০৪ শতাংশ।
সরকারি হিসাবেই দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখন ৯.৯২ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি ১০.৪০ শতাংশ। জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১.৬৬ শতাংশে উঠেছিল; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১৪.১০ শতাংশ। কিন্তু হঠাৎ করেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পুরো সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি ছিল ২ হাজার ১১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ঋণাত্মক। অর্থাৎ গত অর্থবছরে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, তার চেয়ে ২ হাজার ১১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বেশি সুদ-আসল বাবদ সরকারের কোষাগার থেকে পরিশোধ করতে হয়েছিল। অথচ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই তিন মাসে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধের পরও সরকারের কোষাগারে ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা জমা ছিল; এই টাকা সরকার ঋণ হিসেবে নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেশ কমে গিয়েছিল; বিক্রির চেয়ে সুদ-আসল পরিশোধে ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা বেশি চলে গিয়েছিল।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত দুই অর্থবছরে (২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪) সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার; উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল কোষাগারে থেকে পরিশোধ করেছে।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মানে হচ্ছে- এই তিন মাসে মোট যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা থেকে আগে বিক্রি হওয়া সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা ছিল; এই টাকা সরকার তার প্রয়োজনমাফিক খরচ করেছে। অথচ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই তিন মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-)। তার মানে হচ্ছে ওই তিন মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তার সঙ্গে ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা যোগ করে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই (জুলাই- সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল ধণাত্মক (+)। অর্থাৎ যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধের পরও সরকারের কাছে অবশিষ্ট থেকে।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৮৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ধণাত্মক। দ্বিতীয় মাস আগস্টে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে নিট বিক্রি ছিল জুলাই-আগস্ট দুই মাসের বিক্রির প্রায় দ্বিগুণ ৪ হাজার ১০৯ কোটি ৯ লাখ টাকা।
বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১লা জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপরও বাড়তে থাকে বিক্রি।
সর্বশেষ সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারকে যাতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে না হয়, সে জন্য বিক্রি কমাতে ২০২১ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এরপর থেকে বিক্রি কমতে থাকে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। নানা ধরনের কড়াকড়ি, সুদের হার হ্রাস এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের সঞ্চয়ে টান পড়ায় বিক্রি কমে যাওয়ায় এই খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণ পাচ্ছিল না সরকার। সে কারণে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্য কমিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে এক টাকাও ঋণ পায়নি সরকার; উল্টো আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধ বাবদ ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা কোষাগার থেকে অথবা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে হয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ না পাওয়ায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। কিন্তু গত অর্থবছরের এই খাত থেকে কোনো ঋণ নিতে পারেনি সরকার। উল্টো ২১ হাজার ১২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা কোষাগার থেকে গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছিল সরকার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা তিন মাসেই (জুলাই- সেপ্টেম্বর) নেয়া হয়ে গেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সামপ্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স অনেক বেড়েছে। রেমিট্যান্সের একটি অংশ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনেন অনেকেই। অন্যদিকে অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। সে কারণে আমানতের সুদের হার আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেলেও মানুষ এখন আর কোনো ব্যাংকেই টাকা রাখছে না। যতটুকু সঞ্চয় আছে, তা দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত সঞ্চয়পত্র কিনছে। আর দীর্ঘদিন ধরে পুঁজিবাজারে মন্দা চলছে। ফলে সবাই এখন সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে।
No comments