মন্দিরের শহরে নায়ক ও খলনায়ক মোদি
ভোর ৪টা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন বারানসির একটি সরু
লেনে বাস যাদব পরিবারের। মা কমলা দেবির সহযোগিতায় একে একে গ্যাসের চুলায়
আগুন ধরাচ্ছেন বিজয় যাদব।
মোদির একনিষ্ঠ ভক্ত যাদব। গত ২৩ মে বৃহস্পতিবার ফল ঘোষণা শুরু হওয়ার আগেই ১০০ জন
মানুষের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ঘোষিত ফলে মোদি ও তার দল
বিজেপি নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। ১৫ শতাংশ মুসলমানের দেশের মোদি ও বিজেপি হিন্দু
জাতীয়তাবাদের কট্টর ধারক।
রাস্তার পাশে থাকা যাদবদের চায়ের দোকান। কয়েক দশক ধরেই দোকানটি চলছে।
বিজয় যাদবের বাবা সম্প্রতি মোদির সমর্থক হয়েছেন। তাদের দোকানে মোদির বেশ
কয়েকটি মলিন ছবি রয়েছে। ফ্রিজের পাশে কয়েকজন হিন্দু দেবতার পাশেও রয়েছে
মোদির ছবি। দোকানটির সাইনবোর্ডে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ডাক নাম: নমো টি
স্টল।
চুলা জ্বালাতে জ্বারাতে বিজয় যাদব বলেন, বিজেপি ও মোদিকে সমর্থনের জন্য
বাবাকে রাজি করাতে আমার পাঁচ বছর লেগেছে। তবে মা সব সময় সমর্থন করতেন।
আমাদের পরিবার মোদির পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। নির্বাচনের সময় আমাদের চায়ের
দোকান ১৫ দিন বন্ধ ছিল।
পাঁচ বছর আগে মোদি আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য
লক্ষ্য ঠিক করেন তখন তিনি মন্দির ও দেবতার শহর বারানসি থেকেই প্রার্থি ও
শুরু করার ঘোষণা দেন। বৃহস্পতিবার এই আসন থেকে তিনি পুনরায় নির্বাচিত
হয়েছেন প্রায় ৫ লাখ ভোটের ব্যবধানে। ভারতজুড়ে তার দলের সাফল্যের অর্থ হচ্ছে
আগামী পাঁচ বছর প্রভাবশালী ও বিভেদ সৃষ্টিকারী এই প্রধানমন্ত্রী দেশ
চালাবেন।
দলের হিন্দু জাতীয়তাবাদী শাখা থেকে গড়ে ওঠা মোদি গুজরাটের সবচেয়ে দীর্ঘ
সময় শাসন করা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। ভারতের বৃহত্তম রাজ্যগুলোর একটি হলো এই
গুজরাট। রাজ্যটিতে তিনি বাণিজ্যবান্ধব নীতি গ্রহণ করে উন্নয়ন ও হিন্দু
জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচারের জন্য পরিচিত।
বারানাসি- গঙ্গা নদীর তীরে প্রাচীন শহর, জাতীয় পর্যায়ে উন্নয়ন ও
হিন্দুত্ববাদের দর্শনকে হাজির করতে একেবারে উপযুক্ত জায়গা। প্রতি বছর
এখানে কয়েক লাখ তীর্থযাত্রী আসেন, আসেন পর্যটকও। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন,
গঙ্গায় গোসল করলে সব পাপ মুছে যায়।
বারানাসি থেকে প্রার্থী হওয়াকে ধর্মীয় ডাক হিসেবে হাজির করেছেন মোদি। এর
মধ্য দিয়ে পবিত্র শহরটির থেকে নিজের নাম জড়িয়ে নিয়েছেন। শহরটির
আধুনিকায়নের ভূমিকা রাখতে পারলে দেশজুড়ে মানুষের মুখে মুখে তার নাম ছড়িয়ে
পড়বে, সারাক্ষণ প্রচারণা চলবে।
এই আসন থেকে প্রার্থি হওয়ার বিষয়ে মোদি বলেছিলেন, আমি নিজ থেকে বা কেউ
আমাকে এখান থেকে প্রার্থি হতে পাঠায়নি। মা গঙ্গাই আমাকেই ডেকে পাঠিয়েছেন।
মোদির উগ্রজাতীয়তাবাদ ও উন্নয়ন জাতীয় পর্যায়ে হিন্দু ভোটারদের সমর্থন
স্থায়ী হয়েছে, যা তাকে অব্যর্থ করেছে। যদিও স্পষ্টভাবেই তার দল খুব
সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল না। অনেকেই বলছেন, দল ব্যর্থ হচ্ছে, কিন্তু মোদি?
বিজয় যাদব বলেন, নিজের পরিবারকেই তিনি সময় দিতে পারছেন না। কারণ এতে করে
অন্য রাজনীতিকদের সঙ্গে তার কোনও পার্থক্য থাকবে না। দেশের জন্য সবকিছু
ছেড়ে দেওয়ার মতোই ঘটনা।
এটা স্পষ্ট যে, মোদি বারানাসিতে নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছেন। সরু
রাস্তার তুলনায় ভয়াবহ যান চলাচলের শহরে উন্নয়ন ঘটানো ছিল কঠিন একটি কাজ।
রাস্তা নির্মাণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও রান্নার গ্যাস নিশ্চিত করার মতো অনেকগুলো
প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।
শহরটির সাবেক মেয়র রাম গোপাল মহাল বলেন, এখানে মানুষ ২৪ ঘণ্টাই যাতায়াত
করে। কাজ করা অসম্ভব। প্রতিমাসেই থাকে বিভিন্ন উৎসব, প্রতিদিন হাজার হাজার
মানুষ হাজির হন। দিনে আমরা মাত্র চার ঘণ্টা কাজের জন্য সময় পাই। প্রার্থনা
চলে ভোর ৩টা থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত। আর সারাদিনই চলে সমাধি দেওয়া।
গুজরাটে মোদির ব্যক্তিত্ব সমর্থকদের মধ্যে এতোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে সেখানে
একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে তার নামে। এছাড়া একটি পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্যও
নির্মাণ করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশের এক অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী জানিয়েছেন,
দ্বিতীয় মোদি মন্দির নির্মাণের জন্য তিনি অর্থ সংগ্রহ করছেন।
যাদব জানান, তিনি দুটি মন্দির সম্পর্কে জেনেছেন। মোদির প্রতি তার ভক্তিও
কম না। চায়ের দোকানে মোদির পোস্টার রাখা ছাড়াও বাসাতেও তিনি বড় একটি ছবি
রেখেছেন। বলেন, যখনি আমি তাকে দেখি, আমি অনুপ্রেরণা পাই।
কিন্তু মোদির উন্নয়ন ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের মিশ্রন জাতীয় পর্যায়ের জন্য
স্পষ্টত হলেও বারানাসিতে এটা প্রায়ই বিপজ্জনক উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে। কিছু
এলাকায় বিপজ্জনক বিদ্যুতের তার ভূ-গর্ভস্থ করেছেন কিন্তু একই সঙ্গে গভীর
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। গঙ্গায় তিনি প্রমোদতরী ব্যবস্থা
চালু করেছেন যাতে করে পর্যটকরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভ্রমণ করতে পারে। কিন্তু
এতে করে শত বছর ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলেরা পড়েছেন সংকটে।
সবচেয়ে বেশি বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রকল্প হচ্ছে বিখ্যাত কাশি বিশ্বনাথ
মন্দির থেকে গঙ্গা পর্যন্ত করিডোর নির্মাণ। এই প্রকল্পের জন্য
হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষ কয়েক হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ ও তাদের বাড়িঘর গুড়িয়ে
দেওয়া হয়েছে।
এই এলাকায় যে কয়েকটি ভবন অবশিষ্ট আছে সেগুলোর একটিতে কাপড়ের দোকান
চালাচ্ছেন দয়া শংকর শ্রীবাস্তব। তিনি বলেন, পূণ্য লাভের জন্য সারাবিশ্ব
থেকে মানুষ এখানে আসছে। অথচ আমাদের জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
হিন্দু নেতারা অভিযোগ করছেন, মোদির স্বপ্নের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য
অনেক ছোট মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। আর মুসলিম নেতাদের উদ্বেগের বিষয়টি
অন্যরকম। বিশ্বনাথ মন্দিরের একটি দেয়াল স্থানীয় মসজিদের সঙ্গে লাগোয়া। ফলে
মন্দিরের আয়তন বৃদ্ধির কারণে ক্রমশ তা ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
স্থানীয় একটি হিন্দু স্কুল শ্রী বিদ্যা মাঠের প্রধান স্বামী
অভিমুক্তেশ্বরানন্দ বিশ্বনাথ করিডোরের জন্য মন্দির ভাঙার বিষয়টিকে মুসলিম
রাজাদের দ্বারা হিন্দু দেবতাদের গুড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন। কিন্তু
একজন হিন্দু হয়ে মোদি কেন মন্দির ভাঙতে যাবেন- জানতে চাইলে মেজাজ হারিয়ে
ফেলেন এই স্বামী। ‘থামো’- ভক্তদের সামনে চিৎকার করে ওঠেন তিনি। এ সময় কোনও
একজন স্মার্টফোন দিয়ে তার কথা লাইভ শুরু করেন। স্বামী বলেন, ‘একজন হিন্দু
কি মন্দির ভাঙে? একজন হিন্দু কি দেবতার মূর্তি ভাঙে? তিনি হিন্দু না। তিনি
হিন্দু হতে পারেন না।’
স্থানীয় মসজিদ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এস. এম. ইয়াসিন জানান, গত
পাঁচ বছরে বেশ কয়েকবার রক্তাক্ত সংঘর্ষ হয়েছে। প্রায় ১ হাজার পুলিশ সদস্য
শান্তি ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করেছে। বারানাসিতে হিন্দু ও মুসলমানরা
দীর্ঘদিন ধরেই শান্তিপূর্ণভাবে বাস করে আসছে। কিন্তু মোদির সরকার
মুসলমানদের বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। তিনি বলেন, আজ কেউ কথা শুনতে রাজি না। যদি
মোদি ক্ষমতায় আবার আসেন তাহলে আত্মবিশ্বাস নিয়েই আসবেন।
যাদবের মতো তরুণ ভক্তের জন্য এটা হলো মোদির আত্মোৎসর্গ এবং কীভাবে তিনি
মানুষের সঙ্গে সহজে যুক্ত হতে পারেন। মোদির হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দু
জাতীয়তাবাদকেও সমর্থন করেন তিনি। বলেন, মোদির আগে মনে হতো হিন্দুত্ব মরে
গেছে।
২০১৪ সালে মনোনয়ন দাখিলের সময় প্রথমবার মোদির সঙ্গে দেখা হয় যাদবের,
এটাই তার সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি। মোদি যখন তার কাঁধে হাত রেখেছিলেন তখন তার
চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্মৃতিচারণ করে যাদব বলেন, “তিনি আমাকে বলেছিলেন,
তোমার মতো নিবেদিত কর্মী সব শহর, নগর ও রাজপথে দরকার”।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যখন গঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ প্রার্থনায় জড়ো
হচ্ছিলেন, তখন মোদির চৌদিকার স্লোগান লেখা কাগজ ভেসে বেড়াচ্ছিল নদীতে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রমোদ তরী পাশেই নোঙর করা। আর ছোট ডিঙি নৌকাগুলো
কাগজগুলো সরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।
এরপরই মোদির প্রত্যাশাকে যথার্থ রূপে বাস্তবায়ন করে প্রার্থনা এবং তার
বিজয়ের আতশবাজির শব্দের মিলিত ধ্বনিতে গঙ্গার আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে। সূত্র:
নিউ ইয়র্ক টাইমস।
No comments