নারায়ণগঞ্জে ৫ খুন- আদালতে নৃশংস বর্ণনা ঘাতকের by বিল্লাল হোসেন রবিন
অবিশাস্য।
২০ বছরের যুবক মাহফুজই এক এক করে খুন করেছে ৫ জনকে। লোমহর্ষক এই ঘটনার
বর্ণনা সিনেমা বা রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। কাউকে ঘুমের মধ্যে, কাউকে
ঘুম থেকে তুলে হত্যা করেছে সে। প্রথমে মোশারফকে খুন করে লাশ কাঁথা দিয়ে
ঢেকে দেয়। তারপর তাসলিমাকে খুন করে দুই ভাই-বোনের লাশ এক সঙ্গে ফেলে রাখে।
লামিয়াকে খুন করতে বেগ পেতে হয়েছে তার। সময়ও লেগেছে। তবে শিশু সুমাইয়া ও
শান্তকে মারতে সময় লাগেনি। হত্যা মিশন শেষ করে শরীরের রক্ত ধুয়ে মুছে,
পরিধেয় কাপড় পাল্টে বাইরে থকে ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিই। এবং চাবি পানির
রিজার্ভ ট্যাংকিতে ফেলে দিয়ে কারখানায় গিয়ে ঘুমিয়ে থাকি। নারায়ণগঞ্জের
চাঞ্চল্যকর ফাইভ মার্ডারের মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ভাগ্নে মাহফুজ ওরফে মারুফ
(২০) আদালতে নিজের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে
৫ জনকে খুন করার লোমহর্ষক ঘটনার এভাবেই বির্ণনা দিয়েছে। গতকাল বেলা ১১টা
থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৫ ঘণ্টা তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন নারায়ণগঞ্জের
সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইদুজ্জামান শরীফ। জবানবন্দি শেষে আদালত
মাহফুজকে জেলহাজতে পাঠনোর নির্দেশ দেন।
শহরবাসী বলছে, দেশে এটাই কোনো প্রথম ঘটনা যে, ২০ বছরের একটি যুবক ঠাণ্ডা মাথায় ধীরেসুস্থে এক এক করে ৫টি মানুষকে হত্যা করেছে।
মাহফুজকে সোমবার ৭ দিনের রিমান্ডে নেয় মামলার তদন্ত সংস্থা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের ৪র্থ দিনের মাথায় তার এই জবানবন্দির মধ্য দিয়ে ৫ খুনের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে।
এদিকে আদালতে মাহফুজের জবানবন্দি চলাকালে দুপুর সোয়া ১টার দিকে জেলা পুলিশ সুপারের সম্মেলন কক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দীন ৫ খুনের তদন্তের আদ্যপান্ত বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজ একাই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে। এটা একটা বাজে ঘটনা। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মামলায় রিমান্ডে থাকা নাজমার কোনো সম্পৃক্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
যেভাবে ৫ জনকে খুন করা হয়:
মাহফুজের জবানবন্দির তথ্যমতে, ১৫ই জানুয়ারি শুক্রবার মাহফুজ নিশ্চিত হয় তার বড় মামা ও ছোট মামা বাসায় নেই। তাই সে মাগরিবের নামাজের আগ মুহূর্তে বাসায় আসে। দরজা নক করতেই তা খুলে দেয় শফিকুলের ছেলে শান্ত। এ সময় বাসার ভেতরে থাকা শফিকুলের স্ত্রী তাসলিমা ও মেয়ে সুমাইয়া এবং শরীফুলের স্ত্রী লামিয়া ভেতরের রুমে টিভি দেখছিল। তারা টিভি দেখায় মনোযোগী থাকায় বাসায় কে এসেছে টের পায়নি। এদিকে ঘরের ভেতরে ঢুকেই মাহফুজ পকেট থেকে ১০ টাকা বের করে শান্তর হাতে দিয়ে বলে ভাইয়া যে এসেছি তুমি কাউকে বল না। মাহফুজ এরপর লামিয়ার খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে। রাত ১০টার দিকে মোশারফ বাসায় আসে। খাওয়া-ধাওয়া করে সবাই আগের মতোই টিভি দেখতে থাকে। মোশারফ বাইরে যায় সিগারেট আনতে। ওদিকে টিভি দেখতে দেখতে লামিয়া একসময় তাসলিমার রুমেই ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে তাসলিমা লামিয়ার রুমে ছোট ভাই মোশারফকে ঘুমানোর জন্য বিছানা করে দেয়। মোশারফ শুয়ে শুয়ে নিজের মোবাইলে নেটের মাধ্যমে হিন্দি ছবি দেখতে থাকে। খাটের নিচে বসে তা আঁচ করতে পারে মাহফুজ। রাত গভীর হয় কিন্তু মোশারফ ঘুমাচ্ছে না। রাত ২টার দিকে তার প্রস্রাবের বেগ হয়। কিন্তু খাটের নিচ থেকে বের হতে পারছে না। এক সময় বুঝতে পারে মোশারফ মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে। তখন সে খাটের নিচ থেকে বের হতে গেলে মাথায় আঘাতে খাটে শব্দ হয়। শব্দ পেয়ে মোশারফ লাইট জ্বালিয়ে খাটের নিচে মাহফুজকে দেখতে পেয়ে বকাঝকা করে। বোন তাসলিমাকে ডেকে আনে। তাসলিমা রাতের কথা চিন্তা করে বলে কী আর করা তোর সঙ্গে শুইয়ে রাখ। সকালে দেখা যাবে। পরে মাহফুজ বাথরুম থেকে এসে মোশারফের পাশে শুয়ে পড়ে। কিন্তু মোশারফ ঘুমাচ্ছে না। সে এপাশ ওপাশ করতে থাকে। একসময় মাহফুজের মনে হলো মোশারফ ঘুমিয়ে পড়েছে। সে উঠে রান্নাঘর থেকে মসলা বাটার পুতা (শিল) নেয়। এবং মোশারফের পাশে এসে পুতা নিয়ে শুয়ে থাকে। তার কাছে মনে হচ্ছে মোশারফ পুরোপুরি ঘুমায়নি। রাত ৩টার দিকে মাহফুজ খাটের উপর উঠে বসে। এবং পুতা দিয়ে সজোরে মোশারফের মাথায় আঘাত করে। চারদিকে রক্ত ছিটিয়ে পড়ে। তার শরীরেও রক্ত লেগে যায়। এ সময় মোশারফ চিৎকার দিলে শব্দ বাইরে যাওয়ার আগেই তার মুখ চেপে ধরে মোশারফ। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গোঙাতে থাকে মোশারফ। তখন পাশ থেকে একটা শার্ট এনে মোশারফের গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। কিন্তু পরক্ষণে মোশারফের রক্তাক্ত মুখ দেখে ভয় পেয়ে যায় মাহফুজ। তখন কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে রুমের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে। পরে লাশটা একটি কাঁথা দিয়ে ডেকে রেখে বাথরুমে যাওয়ার সময় দেখে কেউ টের পেয়েছি কী না? পরে আবার রান্না ঘরে যায়। রান্না ঘর থেকে সয়াবিন তেল নিয়ে কিছুটা নিজের মাথায় দেয় মাথা যেন ঠাণ্ডা হয়। কিছু তেল নিয়ে লাশের কাঁথার উপর দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে আবার দ্রুত নিভিয়েও ফেলে। যদি পুরো ঘরে আগুন লেগে যায় এই ভয়ে। এরপর শোকেসে দেখে মাথা ঠাণ্ডা করার তেল। তা নিয়ে আবার নিজের মাথায় দেয়। আবার পাঁয়চারি করে। আর চিন্তা করে আমি কী করলাম? কেউ দেখলে কী অবস্থা হবে। পাঁয়চারি করতে করতে ফজরের নামাজের সময় হয়ে যায়। তখন টের পায় কেউ একজন বাথরুমে গেছে। পরে বুঝতে পারে শান্ত বাথরুম থেকে আবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কখনো পাঁয়চারি কখনো বসে মাহফুজ। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঘড়িতে অ্যালার্ম বেজে উঠে। তখন তাসলিমা ঘুম থেকে জেগে যায় এবং শান্তকে বলে উঠো স্কুলে যেতে হবে। তাসলিমা রান্না ঘরে যায়। ছেলেকে খাবার খাইয়ে রেডি করে স্কুলে পাঠায়। মাহফুজ টের পায় বড় মামী (তাসলিমা) আবার শুয়ে পড়েছে। তখন সে পুতা হাতে নিয়ে দরজাটা একটু ভিড়িয়ে দিয়ে বের হয়। বড় মামীর (তাসলিমা) কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে তাকে ডেকে ঘুম থেকে তোলে। এবং বলে মোশারফ আপনাকে ডাকে। তাসলিমা উঠে মোশারফের রুমের সামনে গিয়ে বলে, এই মোশা! মোশা। ভাইয়ের শব্দ না পেয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে দেখে খাটের উপর কাঁথা দিয়ে ডাকা মোশারফ ঘুমিয়ে আছে। এ সময় কিছু বুঝে উঠার আগেই মুহূর্তেই পেছন থেকে তাসলিমার মাথায় পুতা দিয়ে আঘাত করে মাহফুজ। লুটিয়ে পড়ে তাসলিমা। রক্ত ঝরতে থাকে। দ্রুত একটা নেকরা এনে গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে তাসলিমার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর মাহফুজ রক্তমাখা হাতে পুতা নিয়ে লামিয়ার রুমে যায়। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে লামিয়া এপাশ ওপাশ করছে। হঠাৎ লামিয়া চোখ মেলে দেখে মাহফুজ রক্তমাখা শরীরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে চিৎকার দিতে দিতেই মাহফুজ পুতা ছুড়ে মারে লামিয়ার মাথায়। মাথা ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। লামিয়া খাটের উপর দাঁড়িয়ে যায়। তখন ঘরের মধ্যে দড়ি খুঁজতে থাকে মাহফুজ। একপর্যায়ে পুতা নিয়ে মাহফুজের উপর ছুড়ে মারে লামিয়া। মাহফুজ সরে গেলে সেই পুতা গিয়ে পড়ে ঘুমিয়ে থাকা তাসলিমার মেয়ে সুমাইয়ার মাথায়। আঘাত পেয়ে সে কাঁদতে থাকে। এদিকে মাহফুজ পুতা নিয়ে পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়ে লামিয়ার উপর। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে লামিয়া বাঁচার জন্য খামছে ধরে মাহফুজকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। পুতা দিয়ে লামিয়ার মাথায় একাধিক আঘাত করে মাহফুজ। অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়লে খাটের উপর শুইয়ে নেকরা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে লামিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করে। ওদিকে রক্তক্ষরণে অচেতন হয়ে পড়ে সুমাইয়া। পরে তার গলায় পেন্ট পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মাহফুজ। ওদিকে স্কুল থেকে বাসায় আসে শান্ত। সে বাইরে থেকে মা মা বলে ডাকতে থাকে। তখন মাহফুজের সম্বিত ফিরে আসে। হায় হায় আমি এতগুলো খুন করে ফেলেছি? তখন সে দ্রুত তাসলিমার লাশ টেনে মোশারফের রুমে নিয়ে যায়। এবং সাদা চাদর দিয়ে ভাই-বোনের লাশ ডেকে রাখে। দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে মেঝের রক্ত কিছুটা মুছে ফেলে। পরে দরজা খুলে দিলে শান্ত ঘরে ঢুকে। মাহফুজ তাকে বলে কী হয়েছে? মাকে ডাকছো কেন? এ সময় মেঝেতে রক্ত দেখতে পেয়ে শান্ত বলে ‘ভাইয়া’ এত রক্ত কেন? তখন মাহফুজ শান্তকে দেয়ালের সঙ্গে জোরে ধাক্কা মারে। এতে আঘাত পেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে শান্ত। পরে গলা টিপে ও পুতা দিয়ে মাথায় আঘাত করে শান্তকে খুন করে। সবাইকে হত্যার পর বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধোয়। পরে পুতা ধুয়ে রান্না ঘরে রেখে দেয়। এবং রক্তমাখা কাপড় পাল্টিয়ে মোশারফের কাপড় পরে ঘরের তালা চাবি নেয়। বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে চাবি বাড়ির রিজার্ভ পানির ট্যাঙ্কির ভেতর ফেলে দিয়ে বাসার পাশে মোশারফের কারখানায় গিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। এভাবেই মাহফুজ তার হত্যা মিশন শেষ করে। শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে যখন প্রচার পেয়ে যায় তালাবদ্ধ ঘরের ভেতর ৫ জন খুন হয়েছে। তখন স্বজনদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে মাহফুজ। এবং রাতেই মাহফুজকে সন্দেহজনকভাবে আটক করে পুলিশ। পরদিন রোববার সকালে নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে যে মামলা করেন সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, তার ভাগ্নে মাহফুজের সঙ্গে তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী লামিয়ার একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে ঘটনার ১৫ দিন আগে। ওই ঘটনায় বড় মামী তাসলিমা ভাগ্নে মাহফুজকে বকাঝকা করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল। এই কারণে সে ক্ষুব্ধ হতে পারে। এদিকে পুলিশ বুধবার রাতে রিজার্ভ ট্যাংকিতে ফেলে দেয়া চাবিটি ও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পুতা উদ্ধার করেছে।
কেন হত্যাকাণ্ড?
সূত্রমতে, শফিকুল ইসলামের বড় বোন আছিয়া বেগমের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মাহফুজ সবার বড়। ২ সন্তান ও স্বামী শরফুল মিয়াকে নিয়ে আছিয়া বেগম শহরের পাইকপাড়া এলাকায় বাস করেন। মাহফুজের বাবা শরফুল মিয়া ঝালমুড়ি বিক্রেতা। শফিক-তাসলিমা দম্পতি যখন ঢাকার কলাবাগানে বসবাস করতেন তখন মাহফুজও ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিয়ন হিসেবে কাজ করতেন। দুই বছর আগে শরীফ বিয়ে করেন লামিয়াকে। শরীফ ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ঢাকার কলাবাগানে থাকাকালীন একদিন ফাঁকা ঘরে লামিয়াকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় মাহফুজ। এ নিয়ে পারিবারিকভাবে সালিশ হয়। তাসলিমা মাহফুজকে জুতাপেটা করে। এবং তাদের বাসায় না আসতে নিষেধ করে। এতে ক্ষুব্ধ হয় মাহফুজ। ঘটনার দিন মাহফুজ জানতো দুই মামা (শফিকুল-শরীফ) বাসায় নেই। রাতে লামিয়া একা তার রুমে থাকবে। সুযোগ কাজে লাগাতে গোপনে ঘরে ঢুকে মাহফুজ। এবং লামিয়ার খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু লামিয়া টিভি দেখতে দেখতে যখন তাসলিমার রুমে ঘুমিয়ে পড়ে, তখনই মাহফুজের ছক উলটপালট হয়ে যায়। তারপরও নিজেকে কিছুটা সামলে নিলেও মোশারফ তাকে দেখে ফেলায় নতুন করে ভয় জন্মায় তার মধ্যে। কারণ ১৫ দিন আগে তাকে জুতাপেটা করে শাঁসিয়ে দিয়েছিল বড় মামী (তাসলিমা)। আজ আবার ধরা পড়ে গেছে। সকালে কী জানি হয়। এই থেকে সে মোশারফকে হত্যা করে। মোশারফকে হত্যার পর মাথায় ঢুকে পালিয়ে গেলেও সবাই জানবে আমিই খুনি করেছি। তাই সে পর্যায়ক্রমে বাসার ভেতরের সবাইকে হত্যা করে। যাতে কোনো সাক্ষী না থাকে।
শহরবাসী বলছে, দেশে এটাই কোনো প্রথম ঘটনা যে, ২০ বছরের একটি যুবক ঠাণ্ডা মাথায় ধীরেসুস্থে এক এক করে ৫টি মানুষকে হত্যা করেছে।
মাহফুজকে সোমবার ৭ দিনের রিমান্ডে নেয় মামলার তদন্ত সংস্থা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের ৪র্থ দিনের মাথায় তার এই জবানবন্দির মধ্য দিয়ে ৫ খুনের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে।
এদিকে আদালতে মাহফুজের জবানবন্দি চলাকালে দুপুর সোয়া ১টার দিকে জেলা পুলিশ সুপারের সম্মেলন কক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দীন ৫ খুনের তদন্তের আদ্যপান্ত বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজ একাই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে। এটা একটা বাজে ঘটনা। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মামলায় রিমান্ডে থাকা নাজমার কোনো সম্পৃক্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
যেভাবে ৫ জনকে খুন করা হয়:
মাহফুজের জবানবন্দির তথ্যমতে, ১৫ই জানুয়ারি শুক্রবার মাহফুজ নিশ্চিত হয় তার বড় মামা ও ছোট মামা বাসায় নেই। তাই সে মাগরিবের নামাজের আগ মুহূর্তে বাসায় আসে। দরজা নক করতেই তা খুলে দেয় শফিকুলের ছেলে শান্ত। এ সময় বাসার ভেতরে থাকা শফিকুলের স্ত্রী তাসলিমা ও মেয়ে সুমাইয়া এবং শরীফুলের স্ত্রী লামিয়া ভেতরের রুমে টিভি দেখছিল। তারা টিভি দেখায় মনোযোগী থাকায় বাসায় কে এসেছে টের পায়নি। এদিকে ঘরের ভেতরে ঢুকেই মাহফুজ পকেট থেকে ১০ টাকা বের করে শান্তর হাতে দিয়ে বলে ভাইয়া যে এসেছি তুমি কাউকে বল না। মাহফুজ এরপর লামিয়ার খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে। রাত ১০টার দিকে মোশারফ বাসায় আসে। খাওয়া-ধাওয়া করে সবাই আগের মতোই টিভি দেখতে থাকে। মোশারফ বাইরে যায় সিগারেট আনতে। ওদিকে টিভি দেখতে দেখতে লামিয়া একসময় তাসলিমার রুমেই ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে তাসলিমা লামিয়ার রুমে ছোট ভাই মোশারফকে ঘুমানোর জন্য বিছানা করে দেয়। মোশারফ শুয়ে শুয়ে নিজের মোবাইলে নেটের মাধ্যমে হিন্দি ছবি দেখতে থাকে। খাটের নিচে বসে তা আঁচ করতে পারে মাহফুজ। রাত গভীর হয় কিন্তু মোশারফ ঘুমাচ্ছে না। রাত ২টার দিকে তার প্রস্রাবের বেগ হয়। কিন্তু খাটের নিচ থেকে বের হতে পারছে না। এক সময় বুঝতে পারে মোশারফ মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে। তখন সে খাটের নিচ থেকে বের হতে গেলে মাথায় আঘাতে খাটে শব্দ হয়। শব্দ পেয়ে মোশারফ লাইট জ্বালিয়ে খাটের নিচে মাহফুজকে দেখতে পেয়ে বকাঝকা করে। বোন তাসলিমাকে ডেকে আনে। তাসলিমা রাতের কথা চিন্তা করে বলে কী আর করা তোর সঙ্গে শুইয়ে রাখ। সকালে দেখা যাবে। পরে মাহফুজ বাথরুম থেকে এসে মোশারফের পাশে শুয়ে পড়ে। কিন্তু মোশারফ ঘুমাচ্ছে না। সে এপাশ ওপাশ করতে থাকে। একসময় মাহফুজের মনে হলো মোশারফ ঘুমিয়ে পড়েছে। সে উঠে রান্নাঘর থেকে মসলা বাটার পুতা (শিল) নেয়। এবং মোশারফের পাশে এসে পুতা নিয়ে শুয়ে থাকে। তার কাছে মনে হচ্ছে মোশারফ পুরোপুরি ঘুমায়নি। রাত ৩টার দিকে মাহফুজ খাটের উপর উঠে বসে। এবং পুতা দিয়ে সজোরে মোশারফের মাথায় আঘাত করে। চারদিকে রক্ত ছিটিয়ে পড়ে। তার শরীরেও রক্ত লেগে যায়। এ সময় মোশারফ চিৎকার দিলে শব্দ বাইরে যাওয়ার আগেই তার মুখ চেপে ধরে মোশারফ। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গোঙাতে থাকে মোশারফ। তখন পাশ থেকে একটা শার্ট এনে মোশারফের গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। কিন্তু পরক্ষণে মোশারফের রক্তাক্ত মুখ দেখে ভয় পেয়ে যায় মাহফুজ। তখন কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে রুমের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে। পরে লাশটা একটি কাঁথা দিয়ে ডেকে রেখে বাথরুমে যাওয়ার সময় দেখে কেউ টের পেয়েছি কী না? পরে আবার রান্না ঘরে যায়। রান্না ঘর থেকে সয়াবিন তেল নিয়ে কিছুটা নিজের মাথায় দেয় মাথা যেন ঠাণ্ডা হয়। কিছু তেল নিয়ে লাশের কাঁথার উপর দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে আবার দ্রুত নিভিয়েও ফেলে। যদি পুরো ঘরে আগুন লেগে যায় এই ভয়ে। এরপর শোকেসে দেখে মাথা ঠাণ্ডা করার তেল। তা নিয়ে আবার নিজের মাথায় দেয়। আবার পাঁয়চারি করে। আর চিন্তা করে আমি কী করলাম? কেউ দেখলে কী অবস্থা হবে। পাঁয়চারি করতে করতে ফজরের নামাজের সময় হয়ে যায়। তখন টের পায় কেউ একজন বাথরুমে গেছে। পরে বুঝতে পারে শান্ত বাথরুম থেকে আবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কখনো পাঁয়চারি কখনো বসে মাহফুজ। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঘড়িতে অ্যালার্ম বেজে উঠে। তখন তাসলিমা ঘুম থেকে জেগে যায় এবং শান্তকে বলে উঠো স্কুলে যেতে হবে। তাসলিমা রান্না ঘরে যায়। ছেলেকে খাবার খাইয়ে রেডি করে স্কুলে পাঠায়। মাহফুজ টের পায় বড় মামী (তাসলিমা) আবার শুয়ে পড়েছে। তখন সে পুতা হাতে নিয়ে দরজাটা একটু ভিড়িয়ে দিয়ে বের হয়। বড় মামীর (তাসলিমা) কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে তাকে ডেকে ঘুম থেকে তোলে। এবং বলে মোশারফ আপনাকে ডাকে। তাসলিমা উঠে মোশারফের রুমের সামনে গিয়ে বলে, এই মোশা! মোশা। ভাইয়ের শব্দ না পেয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে দেখে খাটের উপর কাঁথা দিয়ে ডাকা মোশারফ ঘুমিয়ে আছে। এ সময় কিছু বুঝে উঠার আগেই মুহূর্তেই পেছন থেকে তাসলিমার মাথায় পুতা দিয়ে আঘাত করে মাহফুজ। লুটিয়ে পড়ে তাসলিমা। রক্ত ঝরতে থাকে। দ্রুত একটা নেকরা এনে গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে তাসলিমার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর মাহফুজ রক্তমাখা হাতে পুতা নিয়ে লামিয়ার রুমে যায়। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে লামিয়া এপাশ ওপাশ করছে। হঠাৎ লামিয়া চোখ মেলে দেখে মাহফুজ রক্তমাখা শরীরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে চিৎকার দিতে দিতেই মাহফুজ পুতা ছুড়ে মারে লামিয়ার মাথায়। মাথা ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। লামিয়া খাটের উপর দাঁড়িয়ে যায়। তখন ঘরের মধ্যে দড়ি খুঁজতে থাকে মাহফুজ। একপর্যায়ে পুতা নিয়ে মাহফুজের উপর ছুড়ে মারে লামিয়া। মাহফুজ সরে গেলে সেই পুতা গিয়ে পড়ে ঘুমিয়ে থাকা তাসলিমার মেয়ে সুমাইয়ার মাথায়। আঘাত পেয়ে সে কাঁদতে থাকে। এদিকে মাহফুজ পুতা নিয়ে পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়ে লামিয়ার উপর। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে লামিয়া বাঁচার জন্য খামছে ধরে মাহফুজকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। পুতা দিয়ে লামিয়ার মাথায় একাধিক আঘাত করে মাহফুজ। অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়লে খাটের উপর শুইয়ে নেকরা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে লামিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করে। ওদিকে রক্তক্ষরণে অচেতন হয়ে পড়ে সুমাইয়া। পরে তার গলায় পেন্ট পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মাহফুজ। ওদিকে স্কুল থেকে বাসায় আসে শান্ত। সে বাইরে থেকে মা মা বলে ডাকতে থাকে। তখন মাহফুজের সম্বিত ফিরে আসে। হায় হায় আমি এতগুলো খুন করে ফেলেছি? তখন সে দ্রুত তাসলিমার লাশ টেনে মোশারফের রুমে নিয়ে যায়। এবং সাদা চাদর দিয়ে ভাই-বোনের লাশ ডেকে রাখে। দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে মেঝের রক্ত কিছুটা মুছে ফেলে। পরে দরজা খুলে দিলে শান্ত ঘরে ঢুকে। মাহফুজ তাকে বলে কী হয়েছে? মাকে ডাকছো কেন? এ সময় মেঝেতে রক্ত দেখতে পেয়ে শান্ত বলে ‘ভাইয়া’ এত রক্ত কেন? তখন মাহফুজ শান্তকে দেয়ালের সঙ্গে জোরে ধাক্কা মারে। এতে আঘাত পেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে শান্ত। পরে গলা টিপে ও পুতা দিয়ে মাথায় আঘাত করে শান্তকে খুন করে। সবাইকে হত্যার পর বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধোয়। পরে পুতা ধুয়ে রান্না ঘরে রেখে দেয়। এবং রক্তমাখা কাপড় পাল্টিয়ে মোশারফের কাপড় পরে ঘরের তালা চাবি নেয়। বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে চাবি বাড়ির রিজার্ভ পানির ট্যাঙ্কির ভেতর ফেলে দিয়ে বাসার পাশে মোশারফের কারখানায় গিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। এভাবেই মাহফুজ তার হত্যা মিশন শেষ করে। শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে যখন প্রচার পেয়ে যায় তালাবদ্ধ ঘরের ভেতর ৫ জন খুন হয়েছে। তখন স্বজনদের সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে মাহফুজ। এবং রাতেই মাহফুজকে সন্দেহজনকভাবে আটক করে পুলিশ। পরদিন রোববার সকালে নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে যে মামলা করেন সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, তার ভাগ্নে মাহফুজের সঙ্গে তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী লামিয়ার একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে ঘটনার ১৫ দিন আগে। ওই ঘটনায় বড় মামী তাসলিমা ভাগ্নে মাহফুজকে বকাঝকা করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল। এই কারণে সে ক্ষুব্ধ হতে পারে। এদিকে পুলিশ বুধবার রাতে রিজার্ভ ট্যাংকিতে ফেলে দেয়া চাবিটি ও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পুতা উদ্ধার করেছে।
কেন হত্যাকাণ্ড?
সূত্রমতে, শফিকুল ইসলামের বড় বোন আছিয়া বেগমের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মাহফুজ সবার বড়। ২ সন্তান ও স্বামী শরফুল মিয়াকে নিয়ে আছিয়া বেগম শহরের পাইকপাড়া এলাকায় বাস করেন। মাহফুজের বাবা শরফুল মিয়া ঝালমুড়ি বিক্রেতা। শফিক-তাসলিমা দম্পতি যখন ঢাকার কলাবাগানে বসবাস করতেন তখন মাহফুজও ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিয়ন হিসেবে কাজ করতেন। দুই বছর আগে শরীফ বিয়ে করেন লামিয়াকে। শরীফ ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ঢাকার কলাবাগানে থাকাকালীন একদিন ফাঁকা ঘরে লামিয়াকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় মাহফুজ। এ নিয়ে পারিবারিকভাবে সালিশ হয়। তাসলিমা মাহফুজকে জুতাপেটা করে। এবং তাদের বাসায় না আসতে নিষেধ করে। এতে ক্ষুব্ধ হয় মাহফুজ। ঘটনার দিন মাহফুজ জানতো দুই মামা (শফিকুল-শরীফ) বাসায় নেই। রাতে লামিয়া একা তার রুমে থাকবে। সুযোগ কাজে লাগাতে গোপনে ঘরে ঢুকে মাহফুজ। এবং লামিয়ার খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু লামিয়া টিভি দেখতে দেখতে যখন তাসলিমার রুমে ঘুমিয়ে পড়ে, তখনই মাহফুজের ছক উলটপালট হয়ে যায়। তারপরও নিজেকে কিছুটা সামলে নিলেও মোশারফ তাকে দেখে ফেলায় নতুন করে ভয় জন্মায় তার মধ্যে। কারণ ১৫ দিন আগে তাকে জুতাপেটা করে শাঁসিয়ে দিয়েছিল বড় মামী (তাসলিমা)। আজ আবার ধরা পড়ে গেছে। সকালে কী জানি হয়। এই থেকে সে মোশারফকে হত্যা করে। মোশারফকে হত্যার পর মাথায় ঢুকে পালিয়ে গেলেও সবাই জানবে আমিই খুনি করেছি। তাই সে পর্যায়ক্রমে বাসার ভেতরের সবাইকে হত্যা করে। যাতে কোনো সাক্ষী না থাকে।
No comments