ব্যাংকঋণের সুদ ও সঞ্চয়পত্রের মুনাফা by আলী ইমাম মজুমদার
দেশের
শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের দাবি রয়েছে ব্যাংকঋণের সুদের হার এক অঙ্কে
নামিয়ে আনা। এটা স্বাভাবিক, ব্যাংকঋণের সুদ যত কম হবে, শিল্প স্থাপন ও
পরিচালনা ব্যয়ও তত কমবে। বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এগিয়ে থাকার
সুযোগ পাবেন আমাদের উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা। শিল্প ও ব্যবসা অর্থনীতির
মূল চালিকাশক্তি। এগুলোর প্রসার যতটা ঘটবে, ততই বাড়বে কর্মসংস্থান ও
সরকারি রাজস্ব। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। অর্থনীতির অন্য
খাতগুলো আরও চাঙা হবে। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সামাজিক খাতেও। জনগণের
ক্রয়ক্ষমতা তাদের জীবনযাত্রার মানও বাড়াবে। সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির সুফলও
ভোগ করবে জনগণ। তাই দেশের শিল্প–বাণিজ্যের প্রসার সবারই কাম্য। সরকারও এ
বিষয়ে সচেতন এবং বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। রয়েছে ট্যাক্স হলিডে ও
রপ্তানি প্রণোদনা বোনাস। রপ্তানিমুখী শিল্পমালিকদের পণ্য বিক্রির পর্যায়ে
অতি সামান্য অগ্রিম আয়কর নেওয়া হয়। আর তাই বিবেচিত হয় চূড়ান্ত আয়কর বলে।
তৈরি পোশাকশিল্পসহ কতিপয় শিল্পে আমদানি পর্যায়েও কম সুদে ব্যাংক এলসি
খোলে। এগুলো যৌক্তিক। সম্ভব হলে এসব প্রণোদনার আওতা আরও সম্প্রসারণ করা
যেতে পারে।
এখন বেশ কিছুদিন ধরে বলা হচ্ছে, ব্যাংকগুলো অলস টাকার ওপর বসে আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্র পাচ্ছে না। তারা আমানতকারীদের মুনাফাও কমিয়ে দিয়েছে অনেক। তাই কস্ট অব ফান্ড কমে যাওয়ারই কথা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ স্প্রেড। ব্যাংক খাতে অস্বচ্ছতার অভিযোগ বেশ কিছুকাল যাবৎ শোনা যাচ্ছে। এমনকি বিদেশি ব্যাংকগুলোর কোনো কোনোটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশাবলি কৌশলে এড়িয়ে যায়—এমন অভিযোগও আছে। কস্ট অব ফান্ডের প্রকৃত হিসাব নিরূপণ আর নির্ধারিত সীমার মধ্যে স্প্রেড রাখা হচ্ছে কি না, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় তদারকি আবশ্যক। তা করা গেলে ঋণের সুদের হার কিছুটা কমেও আসবে। অবশ্য তা ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে। তবে এক অঙ্কে (১০ শতাংশের নিচে) নিয়ে আসা কতটা সম্ভব, সেটা আলোচনার দাবি রাখে।
জনগণকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগমুখী করতে ‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধো না’ এরূপ বলা হতো ষাটের দশক থেকে। ঋণ দিতে এমনকি ব্যাংক চালাতে টাকা দরকার। আর তা আসে আমানতকারীদের কাছ থেকেই। সে আমানতকে উৎসাহ দিতে চালু হয় বিভিন্ন ধরনের মেয়াদি আমানতের ওপর মুনাফা। এটা সময়ে সময়ে কমে–বাড়ে। অবশ্য ব্যাংকব্যবস্থার সূচনার আগেই আমাদের দেশে ডাকঘরের মাধ্যমে বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিম চালু করা হয়। কালের বিবর্তনে এটা জোরদার করতে একটি অধিদপ্তরও প্রতিষ্ঠা করা হয়। অবশ্য এটা একপর্যায়ে ছিল ব্যুরো, এরপরে পরিদপ্তর আর এখন অধিদপ্তর। ডাকঘর এবং এ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সংগৃহীত সঞ্চয় থেকে সরকার ঋণ নেয় বাজেট ঘাটতি মেটাতে। সময়ে সময়ে ব্যাংক থেকেও ঋণ নিতে হয় সরকারকে। কিন্তু ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকব্যবস্থার ওপর সরকার অতিরিক্ত নির্ভরশীল হলে বেসরকারি খাত তহবিল সংকটে ভোগে। সে বিবেচনায় সরকারের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংগৃহীত অর্থই নিরাপদ। তবে সরকার এ দায়
শোধ করতে সুদ পরিশোধ করতে হয় একটু চড়া হারে। তাই গোটা ব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য রাখতে হয়। ইদানীং বিশ্ববাজারে তেলের দামসহ অনেক পণ্যের দাম কমে গেছে। তেলের দাম তো কমেছে অস্বাভাবিক পরিমাণে। তাই ভর্তুকি খাতে সরকারের ব্যয় হ্রাস পেয়েছে অনেক। ফলে কমেছে ঋণনির্ভরতা। অন্যদিকে উদ্যোক্তা শ্রেণি ঋণের সুদ কমাতে দাবি জোরদার করছে। সেটা কীভাবে আর কতটুকু সম্ভব, তা খতিয়ে দেখছে সরকারের বিভিন্ন মহল। অবশ্য অর্থমন্ত্রী বলেই ফেলেছেন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার এক মাসের মধ্যে কমিয়ে ফেলা হবে।
জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের আওতায় বেশ কয়েক ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে। এগুলোতে সুদের হার বরাবর কমবেশি ১৩ শতাংশ ছিল। গত বছরের জুনে সরকার এক ধাপে সবগুলো সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দিল শতকরা প্রায় ২ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর মেয়াদি আমানতের ওপর সুদের হার ৬ থেকে ৭ শতাংশে থাকছে। তাই অনেকে সে আমানতপত্রগুলো ভাঙিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। প্রশ্ন আসবে এরা কারা? এঁদের একটি বিশাল অংশ পেনশনভোগী, নারী এমনকি প্রতিবন্ধী প্রায় সবাই সঞ্চয়পত্রের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ ধরনের সঞ্চয়পত্র ক্রেতার সংখ্যা কত তা সঞ্চয় অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে নেই। তবে জানা যায়, সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় বছরে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। হতে পারে এখানে লাভের অঙ্ক বেশি দেখে কোনো কোনো সম্পদশালী লোকও বিনিয়োগ করেছেন। তবে তঁাদের বিনিয়োগের পরিমাণ যা-ই হোক সংখ্যায় অতি কম, এটা জোর দিয়ে বলা যায়।
এ অধিদপ্তরের শাখাগুলোতে লেনদেনের সময় একটি জরিপ চালালে মোটামুটি তথ্যটির যথার্থতা পাওয়া যাবে। একতলা থেকে দোতলায় উঠতে কষ্ট হয়, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না, ব্যাগে রাখা পানির বোতল থেকে মাঝেমধ্যে পানি খাচ্ছেন কিংবা নিচ্ছেন ইনহেলার এরূপ দৃশ্যই চোখে পড়বে অহরহ। কারও হয়তো সারা জীবনের সঞ্চয় এখানেই আছে। সংসার চলে এর মুনাফা থেকেই। প্রয়োজন হয় চিকিৎসা ব্যয়, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও বিয়ের খরচও। তাঁরা বিনিয়োগের মুনাফা আরও কমলে যাবেন কোথায়। একবার তো অনেকেই চলে গিয়েছিলেন শেয়ারবাজারে। এ অফিসগুলোর খাঁ-খাঁ করত—এ দৃশ্যও সেদিনের। সে শেয়ারবাজার আর বিনিয়োগকারীদের কী হয়েছে, এটা কি আলোচনার অপেক্ষা রাখে? সেখানে বিনিয়োগ করেও যদি নিয়মমতো ডিভিডেন্ড পাওয়া যেত, তবে অনেকেই হয়তো তাই করতেন। কিন্তু সে বাজারের ওপর আস্থা রাখার কোনো কারণ গত পাঁচ বছরে ঘটেনি। ভারতের অর্থনীতি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও সেখানে সঞ্চয়পত্রে প্রচুর বিনিয়োগ আছে। মুনাফার হার আমাদের চেয়ে কিছুটা কম হলেও সামাজিক নিরাপত্তাবলয় অনেক জোরদার। জীবনযাত্রার ব্যয় আমাদের চেয়ে বেশ কম।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের দীর্ঘ ধারাবাহিক ঐতিহ্য রয়েছে। এটা পরিচালিত হয় ১৯৪৪ সালের পাবলিক ডেবট অ্যাক্ট এবং ১৯৭৭-এর সঞ্চয়পত্র বিধিমালা অনুসারে। এ অধিদপ্তরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রধানত সঞ্চয়ের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ, ছড়িয়ে থাকা সঞ্চয় জাতীয় স্কিমের মাধ্যমে আহরণ, আহরিত অর্থ দ্বারা বাজেট ঘাটতি পূরণ, বিশেষ জনগোষ্ঠী যেমন মহিলা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনা, বৈদেশিক নির্ভরতা হ্রাস এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা। অধিদপ্তরটি নগণ্য জনবল ও অপ্রতুল অবকাঠামো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তবে তাদের প্রধান সম্পদ আমানতকারী জনগণ। এরা হতাশ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলে সংস্থাটির কার্যকারিতা হ্রাস পাবে।
শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিতে বিভিন্ন ব্যবস্থায় কারও আপত্তি নেই। কিন্তু একটি সামাজিক নিরাপত্তাবলয় ভেঙে বিশাল জনগোষ্ঠীকে কার্যত পথে বসিয়ে এমনটা করা অসংগত হবে। বর্তমান অবস্থায় ব্যাংকগুলোও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক ব্যাংক রয়েছে দেশে। সংখ্যা এখন ৫৬। জানা যায়, মালয়েশিয়ায় তা ষোলো থেকে ছয়ে হ্রাস করা হয়েছে। সেদিন এক সেমিনারে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা মন্তব্য করেছেন, বেশি ব্যাংক হওয়ায় তাঁদের ব্যবসার পরিসর হ্রাস পেয়েছে। বেড়েছে ব্যয়। আর বিনিয়োগের সুদের হার না কমার এটাও একটা কারণ। যুক্তিটি না মানার সুযোগ নেই। আর ঋণখেলাপি সংস্কৃতি এতে অবদান রাখে এমনটা বললেও বাহুল্য হবে না।
সুদের হার কমাতে গিয়ে প্রয়োজনে সরকার ভর্তুকির আকারে কিছু ছাড়ও দিতে পারে। যেমনটা দেওয়া হয় ফসলি ঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পঋণ ইত্যাদি খাতে। আর অন্য দেশের মতো সুদের হার খুবই কম থাকতে হবে—এমনটাও কিন্তু প্রয়োজন নয়। রপ্তানিতে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর এসব দিকে কিছু সুবিধা থাকলেও শ্রমমূল্য বেশি। অদক্ষ শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ভারতে আমাদের প্রায় দ্বিগুণ আর ভিয়েতনামে তিন গুণের কাছাকাছি। সময়ান্তরে আমাদেরও হয়তো আরও কিছু বাড়বে। কম মূল্যের শ্রমের সুফলও ভোগ করছেন আমাদের উদ্যোক্তারা। আমরা জনগণের স্বার্থেই একটি বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ চাই। পাশাপাশি সমাজের দুর্বল অংশের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবলয়টি আর ক্ষয় না হোক এটাও চাই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
এখন বেশ কিছুদিন ধরে বলা হচ্ছে, ব্যাংকগুলো অলস টাকার ওপর বসে আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্র পাচ্ছে না। তারা আমানতকারীদের মুনাফাও কমিয়ে দিয়েছে অনেক। তাই কস্ট অব ফান্ড কমে যাওয়ারই কথা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ স্প্রেড। ব্যাংক খাতে অস্বচ্ছতার অভিযোগ বেশ কিছুকাল যাবৎ শোনা যাচ্ছে। এমনকি বিদেশি ব্যাংকগুলোর কোনো কোনোটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশাবলি কৌশলে এড়িয়ে যায়—এমন অভিযোগও আছে। কস্ট অব ফান্ডের প্রকৃত হিসাব নিরূপণ আর নির্ধারিত সীমার মধ্যে স্প্রেড রাখা হচ্ছে কি না, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় তদারকি আবশ্যক। তা করা গেলে ঋণের সুদের হার কিছুটা কমেও আসবে। অবশ্য তা ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে। তবে এক অঙ্কে (১০ শতাংশের নিচে) নিয়ে আসা কতটা সম্ভব, সেটা আলোচনার দাবি রাখে।
জনগণকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগমুখী করতে ‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধো না’ এরূপ বলা হতো ষাটের দশক থেকে। ঋণ দিতে এমনকি ব্যাংক চালাতে টাকা দরকার। আর তা আসে আমানতকারীদের কাছ থেকেই। সে আমানতকে উৎসাহ দিতে চালু হয় বিভিন্ন ধরনের মেয়াদি আমানতের ওপর মুনাফা। এটা সময়ে সময়ে কমে–বাড়ে। অবশ্য ব্যাংকব্যবস্থার সূচনার আগেই আমাদের দেশে ডাকঘরের মাধ্যমে বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিম চালু করা হয়। কালের বিবর্তনে এটা জোরদার করতে একটি অধিদপ্তরও প্রতিষ্ঠা করা হয়। অবশ্য এটা একপর্যায়ে ছিল ব্যুরো, এরপরে পরিদপ্তর আর এখন অধিদপ্তর। ডাকঘর এবং এ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সংগৃহীত সঞ্চয় থেকে সরকার ঋণ নেয় বাজেট ঘাটতি মেটাতে। সময়ে সময়ে ব্যাংক থেকেও ঋণ নিতে হয় সরকারকে। কিন্তু ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকব্যবস্থার ওপর সরকার অতিরিক্ত নির্ভরশীল হলে বেসরকারি খাত তহবিল সংকটে ভোগে। সে বিবেচনায় সরকারের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংগৃহীত অর্থই নিরাপদ। তবে সরকার এ দায়
শোধ করতে সুদ পরিশোধ করতে হয় একটু চড়া হারে। তাই গোটা ব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য রাখতে হয়। ইদানীং বিশ্ববাজারে তেলের দামসহ অনেক পণ্যের দাম কমে গেছে। তেলের দাম তো কমেছে অস্বাভাবিক পরিমাণে। তাই ভর্তুকি খাতে সরকারের ব্যয় হ্রাস পেয়েছে অনেক। ফলে কমেছে ঋণনির্ভরতা। অন্যদিকে উদ্যোক্তা শ্রেণি ঋণের সুদ কমাতে দাবি জোরদার করছে। সেটা কীভাবে আর কতটুকু সম্ভব, তা খতিয়ে দেখছে সরকারের বিভিন্ন মহল। অবশ্য অর্থমন্ত্রী বলেই ফেলেছেন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার এক মাসের মধ্যে কমিয়ে ফেলা হবে।
জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের আওতায় বেশ কয়েক ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে। এগুলোতে সুদের হার বরাবর কমবেশি ১৩ শতাংশ ছিল। গত বছরের জুনে সরকার এক ধাপে সবগুলো সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দিল শতকরা প্রায় ২ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর মেয়াদি আমানতের ওপর সুদের হার ৬ থেকে ৭ শতাংশে থাকছে। তাই অনেকে সে আমানতপত্রগুলো ভাঙিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। প্রশ্ন আসবে এরা কারা? এঁদের একটি বিশাল অংশ পেনশনভোগী, নারী এমনকি প্রতিবন্ধী প্রায় সবাই সঞ্চয়পত্রের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ ধরনের সঞ্চয়পত্র ক্রেতার সংখ্যা কত তা সঞ্চয় অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে নেই। তবে জানা যায়, সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় বছরে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। হতে পারে এখানে লাভের অঙ্ক বেশি দেখে কোনো কোনো সম্পদশালী লোকও বিনিয়োগ করেছেন। তবে তঁাদের বিনিয়োগের পরিমাণ যা-ই হোক সংখ্যায় অতি কম, এটা জোর দিয়ে বলা যায়।
এ অধিদপ্তরের শাখাগুলোতে লেনদেনের সময় একটি জরিপ চালালে মোটামুটি তথ্যটির যথার্থতা পাওয়া যাবে। একতলা থেকে দোতলায় উঠতে কষ্ট হয়, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না, ব্যাগে রাখা পানির বোতল থেকে মাঝেমধ্যে পানি খাচ্ছেন কিংবা নিচ্ছেন ইনহেলার এরূপ দৃশ্যই চোখে পড়বে অহরহ। কারও হয়তো সারা জীবনের সঞ্চয় এখানেই আছে। সংসার চলে এর মুনাফা থেকেই। প্রয়োজন হয় চিকিৎসা ব্যয়, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও বিয়ের খরচও। তাঁরা বিনিয়োগের মুনাফা আরও কমলে যাবেন কোথায়। একবার তো অনেকেই চলে গিয়েছিলেন শেয়ারবাজারে। এ অফিসগুলোর খাঁ-খাঁ করত—এ দৃশ্যও সেদিনের। সে শেয়ারবাজার আর বিনিয়োগকারীদের কী হয়েছে, এটা কি আলোচনার অপেক্ষা রাখে? সেখানে বিনিয়োগ করেও যদি নিয়মমতো ডিভিডেন্ড পাওয়া যেত, তবে অনেকেই হয়তো তাই করতেন। কিন্তু সে বাজারের ওপর আস্থা রাখার কোনো কারণ গত পাঁচ বছরে ঘটেনি। ভারতের অর্থনীতি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও সেখানে সঞ্চয়পত্রে প্রচুর বিনিয়োগ আছে। মুনাফার হার আমাদের চেয়ে কিছুটা কম হলেও সামাজিক নিরাপত্তাবলয় অনেক জোরদার। জীবনযাত্রার ব্যয় আমাদের চেয়ে বেশ কম।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের দীর্ঘ ধারাবাহিক ঐতিহ্য রয়েছে। এটা পরিচালিত হয় ১৯৪৪ সালের পাবলিক ডেবট অ্যাক্ট এবং ১৯৭৭-এর সঞ্চয়পত্র বিধিমালা অনুসারে। এ অধিদপ্তরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রধানত সঞ্চয়ের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ, ছড়িয়ে থাকা সঞ্চয় জাতীয় স্কিমের মাধ্যমে আহরণ, আহরিত অর্থ দ্বারা বাজেট ঘাটতি পূরণ, বিশেষ জনগোষ্ঠী যেমন মহিলা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আনা, বৈদেশিক নির্ভরতা হ্রাস এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা। অধিদপ্তরটি নগণ্য জনবল ও অপ্রতুল অবকাঠামো নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তবে তাদের প্রধান সম্পদ আমানতকারী জনগণ। এরা হতাশ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলে সংস্থাটির কার্যকারিতা হ্রাস পাবে।
শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিতে বিভিন্ন ব্যবস্থায় কারও আপত্তি নেই। কিন্তু একটি সামাজিক নিরাপত্তাবলয় ভেঙে বিশাল জনগোষ্ঠীকে কার্যত পথে বসিয়ে এমনটা করা অসংগত হবে। বর্তমান অবস্থায় ব্যাংকগুলোও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক ব্যাংক রয়েছে দেশে। সংখ্যা এখন ৫৬। জানা যায়, মালয়েশিয়ায় তা ষোলো থেকে ছয়ে হ্রাস করা হয়েছে। সেদিন এক সেমিনারে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা মন্তব্য করেছেন, বেশি ব্যাংক হওয়ায় তাঁদের ব্যবসার পরিসর হ্রাস পেয়েছে। বেড়েছে ব্যয়। আর বিনিয়োগের সুদের হার না কমার এটাও একটা কারণ। যুক্তিটি না মানার সুযোগ নেই। আর ঋণখেলাপি সংস্কৃতি এতে অবদান রাখে এমনটা বললেও বাহুল্য হবে না।
সুদের হার কমাতে গিয়ে প্রয়োজনে সরকার ভর্তুকির আকারে কিছু ছাড়ও দিতে পারে। যেমনটা দেওয়া হয় ফসলি ঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পঋণ ইত্যাদি খাতে। আর অন্য দেশের মতো সুদের হার খুবই কম থাকতে হবে—এমনটাও কিন্তু প্রয়োজন নয়। রপ্তানিতে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর এসব দিকে কিছু সুবিধা থাকলেও শ্রমমূল্য বেশি। অদক্ষ শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ভারতে আমাদের প্রায় দ্বিগুণ আর ভিয়েতনামে তিন গুণের কাছাকাছি। সময়ান্তরে আমাদেরও হয়তো আরও কিছু বাড়বে। কম মূল্যের শ্রমের সুফলও ভোগ করছেন আমাদের উদ্যোক্তারা। আমরা জনগণের স্বার্থেই একটি বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ চাই। পাশাপাশি সমাজের দুর্বল অংশের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবলয়টি আর ক্ষয় না হোক এটাও চাই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments