বেলুচিস্তানে জন-অসন্তোষ বাড়ছে by আই এ রেহমান


কিম্ভূতকিমাকার বস্তুর প্রতি পাকিস্তানের হোমরা-চোমরাদের ভালোবাসার রোগ সারবে বলে মনে হয় না। বেলুচিস্তানে জনগণের টাটকা ক্ষতগুলোর ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনায় না বসে বরং এরা ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করছে। এই প্রদেশের অভাগা জনগণের দুঃখ-শোক তিক্ত থেকে তিক্ততর হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে মুঠোফোনে আসা এই খুদে বার্তাটির কথাই ধরুন: ‘জুলুমের সীমায় পৌঁছে গেছে। সাবেক বিএসও আজাদ নেতা হামিদ শাহিন গতকাল শহীদ হয়েছেন। তাঁকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা দুই দিন আগে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর কিডনি, হূৎপিণ্ড ও বুকে ছিদ্রের চিহ্ন ছিল। কোন ইসলাম এমন বর্বরতা অনুমোদন করে? এমন জুলুম হয়তো কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনেও ঘটতে শোনা যায় না। শাবাশ ইসলামি রাষ্ট্র!’
জনগণ, বিশেষত বেলুচিস্তানের অধিবাসীদের ওপর এই বার্তার প্রভাব কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। বার্তা প্রেরক হয়তো প্রচণ্ড শোক ও ক্রোধ তাড়িত ছিলেন, তবে যুক্তিযুক্ত হবে তাঁর মনে লাগা ব্যথার তীব্রতা উপলব্ধি। তিনি যে ঘটনার বয়ান দিয়েছেন তা তো তর্কাতীত সত্য। হামিদ শাহিন পাকিস্তানি নাগরিক—তাঁর কম্পিউটারাইজড জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। তিনি অতীতে বালুচ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের (আজাদ) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। গত ২০ মার্চ গাড়িতে চড়ে তিনি করাচির উদ্দেশে রওনা দেন চিকিৎসা করানোর জন্য। পথে গাড়ি থামিয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অপহরণকারীরা সরকারি সংস্থার সদস্য বলে অভিযোগ উঠেছে। দুই দিন পর তাঁর গুলিবিদ্ধ মরদেহের খোঁজ মেলে।
হামিদ শাহিনের এমন মৃত্যুর ঘটনা বেলুচিস্তানে তেমন নতুন নয়। নির্যাতনের চিহ্নসংবলিত মৃতদেহ কিছুদিন পরপরই খুঁজে পাওয়া যায় বেলুচিস্তানে। সাম্প্রতিককালে এমন ঘটনা অনেক বেড়েছে। হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া মানুষদের নিয়ে অনেক বাদ-প্রতিবাদ ওঠার পর কেউ যদি এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, অবৈধভাবে আটকের ব্যাপারে জবাবদিহি করা এড়াতে উপায় হিসেবে বিচারবহির্ভূত হত্যার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।
সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো, এভাবে হত্যার ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে নিরুদ্দেশ ব্যক্তিদের ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় কমিশন সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের কাছে তাদের প্রতিবেদন পেশ করার ১০ সপ্তাহ পর। এর মাধ্যমে কমিশন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় প্রধান প্রধান দিকগুলো নিয়ে আন্দাজনির্ভর কথা বলার পথ বন্ধ করল এবং নিরুদ্দেশের ঘটনা ঘটলে কী করতে হবে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করল। ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়। কমিশনের প্রতিবেদনের মুখ্য বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ: ১. কমিশনের কাজ চলার সময় ২০১০ সালের আট মাসে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা অব্যাহত ছিল। প্রতি মাসে গড়ে ২৫টি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। কমিশনকে যে কয়টি মামলা তদন্তের জন্য বলা হয়েছিল, সে সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে নতুন সব ঘটনা। ২. বেশ কিছু ব্যক্তির নিরুদ্দেশ হওয়া এবং অবৈধভাবে আটকের ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা খুব সমালোচিত হয়েছে। কমিশনের কাজের বিষয় নিয়ে এদের উৎসাহহীনতা এবং এ কাজের গুরুত্ব না বুঝতে পারার জন্যও এদের ভর্ৎসনা করা হয়। ৩. শতাধিক ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরকারকে বলা হয়।
কমিশনের প্রতিবেদনের কিছু কথা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।
‘হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়া অবসান করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উচিত অযৌক্তিক গ্রেপ্তার এবং যথাযথ আইন না মেনে কাউকে আটক করা থেকে বিরত থাকা। সাধারণভাবে বলা যায়, সরকার যদি এমন কোনো কৌশল উদ্ভাবন করে যেখানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পুলিশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করবে এবং পুলিশের ওপরই গ্রেপ্তারের ভার ছেড়ে দেওয়া হবে এবং প্রাসঙ্গিক আইন মেনে চলা হবে তাহলে সেটিই যথাযথ...
‘রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা রুখতে বিশেষ পরিস্থিতিতে সীমিত সময়ের জন্য সেনাবাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে গ্রেপ্তার ও আটকের বিশেষ ক্ষমতা দেওয়ার জন্য যথাযথ আইন প্রণয়ন করতে হবে। এমন আইনই হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা বন্ধ করতে পারে।
‘নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধার/খুঁজে বের করার গতি অব্যাহত রাখতে এবং এই কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হাইকোর্টের বর্তমান অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি পদমর্যাদার কাউকে নিখোঁজ ব্যক্তিবিষয়ক কমিশনার নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।’
কমিশনের এই প্রতিবেদনের আলোকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো, সেই প্রশ্ন উত্থাপনের হক রয়েছে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত বেলুচিস্তানের জনগণের। গত ১৭ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছে, যার কাজ হবে বেলুচিস্তানের জনগণের রোষ উপশম করার জন্য আইনের খসড়া তৈরি। এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি ঘটেছে কি? এখন থেকে তো অপহরণ, অযৌক্তিকভাবে আটক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর অভিযোগ শুধু গোয়েন্দা বাহিনীর বিরুদ্ধেই উঠবে না, পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাই কাঠগড়ায় দাঁড়াবে আর তার পরিণতি ভোগ করবে সমগ্র জাতি।
এখনই সময় রাষ্ট্রের সব অঙ্গগুলোর উপলব্ধির যে, সরকারি সংস্থাগুলো নানা অপকীর্তি বারংবার অস্বীকৃতি জানিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে কিছুই অর্জিত হবে না। এসব অপহরণ/ নিরুদ্দেশ হওয়া/হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয় সংস্থার বাইরে কেউ ঘটিয়ে থাকতে পারে, সেই সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। তবে, সব ঘটনার ক্ষেত্রে এ কথা বলা যায় না। এমনকি যেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের দায়ী করা যায় না, সেখানেও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো দুষ্কৃতকারীকে তালাশ করে চিহ্নিত করা এবং বিচারের সম্মুখীন করা। সরকার এই দায়িত্বের প্রতি অসম্মান দেখাতে পারে না।
বেলুচিস্তানের জনগণকে কুরে কুরে খাচ্ছে যে অসুখ, তার নানা লক্ষণের অন্যতম হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া। তবু এই সমস্যা দূর করার জন্য আন্তরিক ও অর্থপূর্ণ প্রচেষ্টা অন্যান্য বিষয়ে (যেমন জনগণের সম্পদ ও ভাগ্যের নিয়ন্তা নিজেরাই হওয়ার অধিকার অস্বীকৃতি) আলোচনার উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
আই এ রেহমান: পাকিস্তানি মানবাধিকারকর্মী ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.