আলোচনা- শ্বাপদসংকুল পথ by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

বিষয়টি নতুন কিছু না হলেও এর ক্রমবর্ধমান উন্মত্ততায় সমাজদেহ থর থর করছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যে কথাবার্তা, লেখালেখি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকসহ সরকারের বিভিন্ন স্তর থেকে কঠোর হুঁশিয়ারিও কম উচ্চারিত হয়নি। ভ্রাম্যমাণ আদালত পর্যন্ত বসেছে, প্রশাসনিক তোড়জোড়ও কম নয়_কিন্তু এর পরও বন্ধ হচ্ছে না মানবরূপী দানবদের ছোবল। প্রায় প্রতিদিনের পত্রপত্রিকায় এর মর্মন্তুদ চিত্র ফুটে উঠেছে।
দেশের কোথাও না কোথাও কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন, কেউ বা আহত হচ্ছেন, কেউ বা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। একশ্রেণীর তরুণ দুর্বৃত্ত দেশটাকে কিভাবে তাদের অভয়ারণ্য করে নিল_এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে ব্যর্থ হলে এই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলা কঠিন হবে। ইভ টিজিং নামক ব্যাধি আমাদের সমাজজীবনকে কিভাবে, কতটা আক্রান্ত করেছে_এর নিত্যপ্রমাণ জনমনে বারবার নতুন নতুন প্রশ্ন, শঙ্কা ও ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী, মনস্তত্ত্ববিদ, সমাজচিন্তকরা এর অতল উৎসের গভীরে প্রবেশ করে সমাজের মূল্যবোধ, শ্রেয়বোধের ভিতটি যাতে একেবারে ভেঙে না পড়ে সে জন্য চেষ্টা চালাবেন কি না_এ প্রশ্ন বাদ রেখেও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, এই নিষ্ঠুরতা, বর্বরতার শেষ কোথায়? যে ভয়ংকর ও বীভৎসরূপে ক্রমেই এই উৎপীড়ন পুষ্ট হচ্ছে, এর ফলে সমাজটা যাচ্ছে সর্বনাশের কিনারে। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের জন্য ক্রমবর্ধমান এসব ঘটনা বড় ধরনের অশনিসংকেত, যা আর নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন রাখে না। যারা সুস্থ সমাজজীবনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের ডাকাত, দস্যু, হারমাদ_কোনো অভিধায়ই চিহ্নিত করা যাবে না। তারা ওইসব দুর্বৃত্তদের চেয়ে অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও বর্বর। প্রশ্ন হচ্ছে, এই জনপদের পথগুলো জঙ্গলাকীর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও এত শ্বাপদসংকুল হয়ে উঠল কিভাবে?
যাঁরা ইভ টিজিংয়ের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ শিকার হচ্ছেন তাঁরা তো বটেই, যাঁরা এর প্রতিবাদ করতে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরাও হতাহতের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন। মা-বাবা, শিক্ষক-স্বজন_সমাজের যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই তাদের হাতে রক্তাক্ত হচ্ছেন। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত জায়গা করে নিয়েছে বর্বরতার এই ভয়ংকর চিত্র। কোনো সভ্য ও সুস্থ সমাজে এমন চিত্র অকল্পনীয়। আমরা ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছি ভয়ংকর অন্ধকারে। কেন এমন হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবও অন্তহীন। যে ব্যাধিটি সামাজিক নৈরাজ্যের একটি বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে, তাতে সামাজিক সুস্থতার বোধ ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। বিষয়টি চলছে অনেক দিন ধরে এবং কেন এমন চিত্র ক্রমেই পুষ্ট হচ্ছে, এটিও জরুরি প্রশ্ন। এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, যে সমাজ সুশৃঙ্খলভাবে চলে না, যার দায়দায়িত্ব দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে সমভাবে বোধগম্য নয়; সেখানে এমন ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি ঘটতেই থাকবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা কর্তৃক ঘটনাগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার ব্যর্থতার কারণেও আজ আমরা ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে এসে পড়েছি। রাষ্ট্রব্যবস্থার সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণের পরিচয় অনবরত ঘটে যাওয়া এসব কিছুর মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। আজ বাধ্য হয়ে যাঁরা এ কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন, তাঁদের ভীরু বলে আখ্যায়িত করার আগে এ প্রশ্নের জবাব সন্ধান করা জরুরি_এই সমাজ, এই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের প্রশাসনিকব্যবস্থা কি তাঁদের পাহারাদার হতে পেরেছে? শুধু আইনিব্যবস্থা এবং পুলিশের শাসন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিস্তৃতি রোধ করার জন্য যথেষ্ট নয়। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা খুব তিক্ত। দেখা গেছে, যাঁরা রাষ্ট্র-পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন তাঁদের প্রভাবশালীরা মাস্তান পোষার প্রকল্প হাতে নেন। তাঁরা নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, উচ্ছৃঙ্খলতাকে নিজেদের স্বার্থে প্রশ্রয় দেন। যারা দোষী তারা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ভালো থাকে! কেউ তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারে না। অন্যদিকে যে মেয়েটি নির্দোষ, সে এভাবে এমন একটি নৃশংস কাজের শিকার হয়; যাতে সমুদয় দায় তার ওপর চাপে_পরিবার থেকে, সমাজ থেকে এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারো কারো কাছ থেকে। এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
আমরা জানি, সমাজে একদল আছে, যারা এই ব্যাধির নিদান হিসেবে মেয়েদের কঠোর পর্দার অন্তরালে বন্দি করতে চাইবে। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় এবং খোঁজ নিলে জানাও যাবে, ইভ টিজিং, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির শিকার যাঁরা হয়েছেন বা হচ্ছেন_তাঁদের মধ্যে নেকাব-বোরকা পরিহিতরাও বাদ যাচ্ছেন না। আইন, সামাজিক এবং ধর্মীয় বিধানও এসব অনাচারের বিস্তৃতি যে ঠেকাতে পারছে না_নিত্য ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এরই সাক্ষ্য বহন করে। মেয়েদের উত্ত্যক্তকারী বখাটেদের অপকর্মকে ইভ টিজিং বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি চরম যৌন হয়রানি এবং নির্যাতন; যে নির্যাতনের পরিণাম ক্রমেই গভীর মর্মন্তুদ হয়ে ফুটে উঠছে। উত্ত্যক্তকারী অল্প কিংবা বেশি বয়সী যা-ই হোক, তাদের বিচরণ সর্বত্র। আমাদের মনে আছে, অতীতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকের বিরুদ্ধেও যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের চিত্র যদি এই হয়, তাহলে সমাজের অলি-গলিতে বসবাসকারী মানুষ নামধারী ওইসব কীটসমরা তো উৎসাহবোধ করবেই। কেউ কেউ বলেন, বিশ্বায়ন ও আধুনিকায়নের সঙ্গে যে ধ্বংসাত্মক নেতিবাচক দিকগুলো আসছে, তা বয়কট বা বর্জন করতে সামাজিক আন্দোলন ভিন্ন গত্যন্তর নেই। কিছু কথা হচ্ছে, আন্দোলন যে হচ্ছে না তা নয়; তবে তা এতটাই বিচ্ছিন্ন কিংবা দূরবর্তী_যার কোনো ইতিবাচক প্রভাব সমাজে তেমনভাবে পড়ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এ কারণে অতীতে কয়েকবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল এবং এর প্রতিবাদে আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সুফল মিলেছে কতটা? তাই বলতে হয়, আগে উৎস খোঁজা দরকার। সমাজের পচন হঠাৎ করে পুষ্ট হয় না কিংবা বিস্তৃতিও ঘটে না। এর উৎসমূল অনেক গভীরে এবং উৎসমূলে হাত পড়ে না বলেই দুরবস্থার চিত্র আজ ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যৌন হয়রানি কিংবা নির্যাতনের বর্ধিত রূপ আজ সমাজের বিভিন্ন স্তরে এতটাই আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যে পরিস্থিতি সংসার ও সমাজ তছনছ করে দিচ্ছে। এভাবে কোনো সমাজ চলতে পারে না। আমাদের সব অর্জন এভাবে ক্রমেই নষ্টদের অধিকারে চলে যাবে_তাও হতে পারে না। কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কোনো মেয়ে থানায় অভিযোগ দায়েরের পরও যদি এর কোনো প্রতিকার পুলিশ না করতে পারে, তাহলে সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশকে জবাবদিহি করতে হবে। খুব ভালো কথা। কিন্তু মন্ত্রীর এমন কঠোর (?) উচ্চারণের পরও ঘটনা ঘটেছে। থানা-পুলিশকে এ জন্য জবাবদিহি করতে হয়েছে কিনা জানি না। আসলে এ দেশে 'যত গর্জে তত বর্ষে না'_এমন অভিজ্ঞতাও আমাদের কম পুষ্ট নয়।
সময় সমাজকে এগিয়ে দেয়। আর সমাজের হাত ধরেই এগিয়ে যায় দেশ। কিন্তু ইভ টিজিং নামের সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত এই সমাজ দিনের পর দিন যাচ্ছে অধঃপতনের দিকে। একটি ব্যাধির সংক্রমণ কেমন করে সমাজের মূল্যবোধ থেকে শুরু করে সব ধরনের বন্ধন নষ্ট করে দেয়, ইভ টিজিং সাম্প্রতিক সময়ে এর বড় প্রমাণ। এখানে তথ্য-উপাত্ত কিংবা পরিসংখ্যান তুলে ধরা নিষ্প্রয়োজন মনে করি। কারণ, সচেতন মানুষ মাত্রই তা জানেন। আমাদের সামাজিক বন্ধন ও মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সমাজে ব্যক্তির অবস্থান, পারিবারিক সুন্দর স্থিতিশীলতা এবং সখ্য-বন্ধনের তন্ত্রীগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক ধস এতটাই নিচে নেমে গেছে যে সমাজজীবনে আস্থা ও বিশ্বাসে চিড় ধরেছে নানা রূপে, নানা মাত্রায়। এর কারণে মানুষের আবহমানকালের সনাতন পারিবারিক সৌজন্য, সৌহার্দ্য, পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ ক্রমাগত শিথিল হতে শিথিলতর হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ছে, প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী মিনু মাসানির উক্তি। তিনি বলেছেন, কোনো দেশের সীমানা-ভূখণ্ড দখল করার চেয়েও সেই দেশের মানুষের মন-মগজ, মননশীলতা দখল করাই বড় আগ্রাসনবাদ। আমরা কি সেই আগ্রাসনবাদেরই শিকার? আর এ জন্যই কি এই জনপদের পথ হয়ে পড়েছে শ্বাপদসংকুল? এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় যাঁদের, তাঁরা নিশ্চুপ না থাকলেই মঙ্গল।
=========================
মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
সাংবাদিক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.