আলোচনা- শিক্ষা আসলে কোনটা by ড. মোহীত উল আলম

কেবল সনদপত্র অর্জন শিক্ষা নয়, প্রবণতার উৎকর্ষতা সাধনই শিক্ষা--এ কথাটা সর্বজন স্বীকৃত, যদিও বাস্তবে ঠিক এর উল্টোটা ঘটতে দেখি। জনপ্রিয় ইংরেজ গায়ক স্টিং-এর একটা গান আছে, "দ্যাটস নট দ্য শেইপ অব মাই হার্ট।" ঠিক সেরকম আমি বলতে চাই, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে যে জিনিষটা আমরা বুঝি সেটা ঠিক সেভাবে আমি বুঝতে চাই না।
আমি কীভাবে বুঝতে চাই, তা কতগুলো উদাহরণ দিয়ে প্রথমে বোঝাতে চাই। তারপর একটা উপসংহারে আসা যাবে। প্রথমে নিজের শ্রেণীকক্ষ দিয়ে শুরু করি। পড়াই ইংরেজি সাহিত্য। প্রতি সেমিস্টারে একটা করে কোর্স থাকে শেক্সপিয়ারের নাটকের ওপর। তো পড়াচ্ছিলাম তাঁর কমেডি আ মিডসামার নাইটস ড্রিম। নাটকের শুরুতে একটি বিবাদ আছে--বাবা এগিয়াসের সঙ্গে মেয়ে হারমিয়ার। হারমিয়ার প্রেমিক লাইস্যান্ডার, কিন্তু তার বাবা তাঁকে বিয়ে করতে বলছেন ডিমিট্রিয়াসকে। ডিমিট্রিয়াসও হারমিয়ার প্রেমে মজে আছে। স্বভাবতই প্রশ্নটা করলাম ছাত্র-ছাত্রীদেরকে, তারা হলে কী করত। বাপের পছন্দমতো পাত্রকে (বা পাত্রী) বিয়ে করত, নাকি নিজেদের পছন্দমতো বিয়ে করত। ছাত্ররা তো একবাক্যেই উত্তর দিল তারা নিজেদের পছন্দমতো বিয়ে করত, ছাত্রীরাও সবাই তাই বলল, শুধু একজন ছাত্রী ছাড়া। সে বলল সে তার বাবা-মা'র পছন্দমতো বিয়ে করবে। কারণ হিসেবে বলল, বাবা-মা'র জীবন অভিজ্ঞতা যেহেতু বেশি কাজেই তাঁদের পছন্দ নিশ্চয় তার পছন্দের চেয়ে উত্তম হবে। মেয়েটির যুক্তি ক্লাসে মেনে নিলেও, মনে মনে বললাম, দ্যাটস নট দ্য শেইপ অব মাই হার্ট।
চিন্তাটা মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। কারণ মেয়েটির ব্যাখ্যা কোন নতুন ব্যাখ্যা নয়। ভর্তি করানোর সময় যখন সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করি, ইংরেজি পড়তে চাইছো কেন, তখন অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী দু'টো নিশ্চিত উত্তর দিয়ে থাকে। একটি হলো, ইংরেজি আনর্্তজাতিক ভাষা, আর আরেকটি হলো, বাবার ইচ্ছা (কখনো কখনো মায়ের ইচ্ছা)। পড়াশুনার বিষয় বাছার ব্যাপারে বাবা-মা'র ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়ার রীতি সে যে শুরু হয় তারপর তা চলতে থাকে সমগ্র শিক্ষাজীবন এবং তারপর সেটা বৈবাহিক জীবনে জীবনসাথী বাছাই থেকে চাকরিপর্ব পর্যন্ত টানা চলতে থাকে। এটা কি ভালো না মন্দ, সেটা পাঠক আমার বাকি আলোচনাটা পড়লে বুঝতে পারবেন।
শফিক রেহমান সম্পাদিত মৌচাকে ঢিল নামক মাসিকীটির আমি একজন নিয়মিত পাঠক। পত্রিকাটিতে শুধু পাঠক-পাঠিকার কাঁচা হাতে (অধিকাংশ লেখা, সব নয়) লেখা তাঁদের জীবনের নানা অভিজ্ঞতার ওপর রচনা ছাপা হয়। লেখাগুলিতে সাধারণত দু'টি বেদনার কথা ফুটে ওঠে: একটি, তারা যে বিষয়ে পড়তে চেয়েছিল, বাবা-মা'র চাপে সে বিষয়ে পড়তে পারেনি, আর দ্বিতীয়ত (এ বেদনাটা মেয়েদের লেখায় বেশি) যারা তাদের জীবনসঙ্গী হয়েছে তাদেরকে তারা চায়নি, বাবা-মা বা অভিভাবকদের চাপে তারা বিয়েতে বসতে বাধ্য হয়েছিল। আমার ছাত্রীর ব্যাখ্যায় ফিরে আসি: বাবা-মা'র অভিজ্ঞতা বেশি, কাজেই তাদের পছন্দ শ্রেয়তর হবে। এটা শুধু আমার ছাত্রীর একার কথা নয়, এটা আমাদের সামাজিক কথা। আমাদের মুরব্বীদের কথা, আমাদের শিক্ষকদেরও কথা। আমরাও ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে এভাবে যে কথা বলি না তা নয়: 'যে আমি বেশি জানি, আমার কাছ থেকে শিখে নাও'।
ভেবে দেখলাম, জীবনটাকে যদি পুকুরসম চিন্তা করা হয়, তা হলেই একমাত্র অভিভাবক এবং শিক্ষকের কথা মেনে জীবন-যাপন করা সম্ভব। কিন্তু প্রতিটা জীবন শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে একটা কূল-কিনারাহীন মহাসমুদ্রের মতো। শরীরের রহস্যের যেমন কোন শেষ নেই, মনের রহস্যেরও কোন শেষ নেই। সেখানে কে কা'কে কী শিক্ষা দেবে? কোন শিক্ষার ফলে জীবনের মোক্ষ লাভ হবে?
২০০৩ সালে দিলস্নী ঘুরছি সপরিবারে। সাথে নয় বছরের কনিষ্ঠতম ছেলেটি। দিলিস্নর শিশু পার্কটি খুব বড়। ঘূর্ণায়মান চেয়ারের খেলনায় চাপলাম । চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে চেয়ারগুলি অনেক ওপরে উঠে যায়। প্রতি আরোহীর জন্য একটি করে চেয়ার। আমরা তিনজন এক একটি চেয়ারে বসলাম। চেয়ারগুলো ঘুরতে শুরু করল। ওপরে উঠতে উঠতে পাশের একটি কড়-ই গাছের ওপরে পর্যন্ত উঠে গেল। খুব উঁচু। খুব বাতাস। হঠাৎ সামনের একটি চেয়ারে দেখলাম আমার ছেলের বয়সী একটি ছেলে তার এক হাত দিয়ে মাথার টুপিটা ধরে রেখেছে, যাতে সেটা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে না যায়। আমার তখন ভয় হলো সে আরেক হাত দিয়ে তার ভারসাম্য ধরে রাখতে পারবে কীনা। এক একটা চেয়ার এত দূরে দূরে ফাঁকায় উড়ছে যে চিৎকার করেও ওকে বলতে পারছিলাম না, টুপির মায়া ত্যাগ করে দু'হাতে যেন শক্ত করে চেয়ারের হাতল ধরে রাখে। যতরকম সুরা জানি সব পড়া শুরু করলাম। সে যা হোক, একসময় চেয়ারগুলো শান্ত হয়ে ওড়া বন্ধ করে মাটিতে নেমে আসল। ছেলেটিও নিরাপদে নেমে এল।
আমি তখন বুঝলাম, মানুষের ভিতরেই, তার বয়স যাই হোক বা পূর্বাভিজ্ঞতা যাই হোক না কেন, একটা আত্মরক্ষার তাগিদ তৈরি হয় এবং সেটাই তার শিক্ষা। ছেলেটি যদি এক হাতে টুপি না ধরে দু'হাতে ধরত, তা হলে বিপদ হতে পারত। কারণ চেয়ারের সামনের বেল্টের ফাঁক দিয়ে গলে সে পড়ে যেতে পারত। আবার আমরা ছেলেটির বাবা-মা না হয়েও ছেলেটির জন্য যতটা শংকিত হয়ে পড়েছিলাম, ছেলেটির বাবা-মা'র মনে দেখলাম বিপদের সামান্য চিন্তাও রেখাপাত করেনি।
পরে আমার একটা গল্পে একটি স্বাবলম্বী ও প্রতিরোধী গোছের মেয়ের চরিত্র অংকন করতে যেয়ে আমি এ ছেলেটির জায়গায় মেয়েটিকে বসিয়ে দিয়ে বলতে চেষ্টা করেছি যে কার চরিত্র কীরকম হবে সেটা বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ চরিত্রের প্রতিক্রিয়া কী তা থেকে বোঝা যায়। তবে আকস্মিক বিপদের আশংকা থেকে রক্ষা পাওয়ার শিক্ষা কী শুধু মানুষের ইন্দ্রিয়ার্জিত শিক্ষা, না কি সেটি প্রাথমিকভাবে পরিবারের পরিবেশ থেকে অর্জিত হয় তাও দেখার ব্যাপার আছে।
আসলে বাবা-মা যখন ছেলেমেয়ের জন্য পড়াশুনার বিষয় ঠিক করে দেন বা পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করে দেন তখন সেখানে যে মারাত্মক ভুলটি হয়ে যায়, সেটি হলো ছেলেমেয়েদের বয়স ও মনকে উপেক্ষা করা হয়। সর্বোপরি তাদের পছন্দ করার শক্তি এবং অধিকারকে খাটো করে দেখা হয়। বাবা-মা নির্বাচনযোগ্য বিষয়গুলোর ভালোমন্দ বা পাত্রপাত্রীর বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ভালোমন্দ ব্যাখ্যা করে দেখাতে পারেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অবশ্যই ছেলেমেয়ের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাদের বয়স যাই হোক না কেন। স্কুল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মা-বাবা ছেলেমেয়েকে কয়েকটি স্কুল ঘুরিয়ে দেখাতে পারেন, কিন্তু বাচ্চারাই ঠিক করবে কোন স্কুলে সে পড়বে। কারণ সব বয়সের বাচ্চারই নিজের ভালোমন্দ বোঝার একটা ক্ষমতা আছে। সেটাকে আরো শানিত করার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে বাবা-মা, অভিভাবক এবং শিক্ষকের।
ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, পড়া তৈরি করনি কেন?
ছাত্রী বলল, স্যার, আমি জানতাম না, আমি সেদিন ক্লাসে আসিনি।
বললাম, ক্লাসে আসনি কী হয়েছে। বন্ধুবান্ধবকে মোবাইল করে জানতে পারতে, এস এম এস করতে পারতে, এমন কি ফেইসবুকে যেয়েও জিজ্ঞেস করতে পারতে।
শিক্ষার সঙ্গে অভিভাবকদের লোভাতুর মনের একটি সম্পর্ক আছে। বহুবার বলেছি এ কথা যে বাবা-মা যখন ছেলেকে চিকিৎসক বা প্রকৌশলী বানানোর জন্য ভর্তি করান তখন তাঁদের অধিকাংশের মনে থাকে চিকিৎসক হয়ে ছেলে মানবসেবায় ব্রতী হবে তা নয়, বরঞ্চ ছেলের পকেটভর্তি টাকা হবে, ছেলে বারিধারায় বা খুলশিতে বাড়ি করবে সে চিন্তা। অনুরূপভাবে প্রকৌশলীর বাবা-মা ছেলে সেতু করবে সে উদ্দেশ্যে প্রকৌশল পাঠ করাতে পাঠান না, পাঠান ছেলে কী করে বাড়ি-গাড়ির মালিক হবে সে উদ্দেশ্যে। অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রেও একই অভিভাকত্বীয় দর্শনের দেখা মিলে। অভিভাবককে দোষ দেবার উপায় নেই, কারণ সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোটা রয়ে গেছে এখনো সে দর্শনের মধ্যে আবদ্ধ--'লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।' গাড়ি-ঘোড়া হলো পার্থিব জগতের প্রতীক, সাম্প্রতিক বেনিয়া এবং দুর্নীতির অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় লুটের প্রতীক। কিন্তু শিক্ষাগ্রহণ করা থেকে লোভ বিযুক্ত করার কোন অর্থ হয় না। শিক্ষা অর্জনের সঙ্গে দেশপ্রেমের এবং দারিদ্র্যপ্রেমের শিক্ষা সহজাতভাবে অর্জিত হয় তা নয়। অধিকাংশ মানুষই শিক্ষা লাভ করতে চায় কোন একটা ব্যক্তিগত লক্ষ্য সামনে রেখে। যেমন একজন এম বি এ গ্যাজুয়েট ভাববেন যে তিনি কোন প্রতিষ্ঠানের সি ই ও হবেন, তাঁর ব্যক্তিগত খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার জন্য; তিনি নিশ্চয় ভাবেন না যে তাঁর অফিসে তাঁর অধীনস্থ সকলের পিয়ন থেকে শুরু করে ম্যানেজার পর্যন্ত সবার দেখভাল করার দায়িত্ব হবে তাঁর। আগ্রাসী পুঁজিবাদী-রাজনৈতিক সমাজে সর্বস্তরে শিক্ষা প্রদানের চিন্তার ধারণা প্রবিষ্ট করানো কিংবা সর্বব্যাপী দারিদ্র্য নিরসনের চিন্তাটা মাথায় ঢোকানো বেশ কঠিন কাজ।
আমি শিক্ষার্থীদের বলি, তুমিই পারবে, তুমিই করবে। তুমিই অন্যদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবে শুধু নয়, তারা বিপদ থেকে কীভাবে উদ্ধার পাবে সেটাও শেখাবে। বলি, নিজের চারপাশের দেয়ালটা, বাড়ির চারপাশের দেয়ালটা আগে তুলে দাও। বলি, কবি রবার্ট ফ্রস্টের ভাষায়, 'সামথিং দেয়ার ইজ দ্যাট ডাজন্ট লাভ আ ওয়াল'। ঐ 'সামথিং'টা হচ্ছে তোমার কাজ করার ক্ষেত্র, তোমার শিক্ষিত হয়ে ওঠার ক্ষেত্র।
=======================
জীবন ব্যাকরণঃ হিরালি  ন্যাটো ও রাশিয়ার সমঝোতা ইরানের ওপর কি প্রভাব ফেলবে  জার্নি বাই ট্রেন  পারিষদদলে বলেঃ  চরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা  সচেতন হলে শিশু প্রতিবন্ধী হয় না  স্মৃতির জানালায় বিজয়ের মাস  বিচারপতিদের সামনে যখন ‘ঘুষ’  কয়লানীতিঃ প্রথম থেকে দশম খসড়ার পূর্বাপর  শ্বাপদসংকুল পথ  মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম  ১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. মোহীত উল আলম
অধ্যাপক, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা ও সাবেক অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.