কোম্পানিগুলো কি মিছা কথা বলে -শেয়ারবাজার by আবু আহমেদ
আসলে মিথ্যার দিক দিয়ে কোম্পানিগুলোই সবচেয়ে বড় মিথ্যা বলে। তারা কখনো কখনো নিজেরা শেয়ার ব্যবসায়ী হয়ে পড়ে। যে কোম্পানি নিজে শেয়ার ব্যবসা করে, সেই কোম্পানি তথ্য যেমন গোপন করে, তেমনি অতিরিক্ত এবং অসত্য তথ্য ফলাও করে বাজারে ছেড়ে দেয়। কোম্পানি তো নিজে আর শেয়ার ব্যবসা করে না। কোম্পানির শেয়ার ডিরেক্টররাই এবং উচ্চ ম্যানেজমেন্টের লোকজন বাজারে বিক্রি করেন। সে জন্য তাঁদের স্বার্থ থাকে, শেয়ারের মূল্য যেন অনবরত বাড়তে থাকে। কয়েক বছর আগে শেয়ারবাজারে আরেকটি নতুন ধারণা চালু হলো, নাম হলো শেয়ার-অপশন। মানে, এক্সিকিউটিভদের তাঁদের আর্থিক সুবিধার একটা অংশ শেয়ারে দেওয়া হবে। এই শেয়ার অন্য কোম্পানির শেয়ার নয়, নিজ কোম্পানির; যেখানে তিনি প্রধান কর্মাধ্যক্ষ, শেয়ার। যুক্তরাষ্ট্রই প্রথমে ‘স্টক-অপশন’ নামের এই আধুনিক প্রণোদনা চালু করে। পরে বিশ্বের অন্য দেশগুলোও তাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টরস ও অন্য উঁচু পদের ব্যবস্থাপকদের জন্য স্টক-অপশন নামের এই প্রণোদনার প্যাকেজ গ্রহণ করে। অর্থনীতি ও যুক্তি একটাই, টপ-এক্সিকিউটিভরা যদি স্টক-অপশন নিয়ে বেশি মূল্যে শেয়ার বেচতে পারেন, তাহলে তিনি তাড়াতাড়ি ধনী হবেন। আর স্টক-অপশনের জন্যই শুধু তিনি চাইবেন, কীভাবে বাজারে শেয়ার তথা স্টকের মূল্য বাড়ানো যায়। বাজার অর্থনীতির নিরিখে এই প্রণোদনার মধ্যে কোনো ত্রুটি নেই, বরং সব উপকার জ্ঞান বলে, এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও উপকৃত হবেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্যত্র। অনেক এক্সিকিউটিভ শেয়ারের মূল্য বাড়ানোর জন্য মিথ্যা তথ্যের আশ্রয় নিলেন। তাঁরা কোম্পানির দায়কে চেপে যেতে লাগলেন। যে তথ্য দিয়ে তাঁরা স্থিতিপত্র ও ইনকাম-স্টেটমেন্ট সাজাতে লাগলেন, তাতে মনে হবে, কোম্পানি শুধু জ্যামিতিক হারে লাভই করে যেতে থাকবে। তাঁদের দেয় তথ্য ও পরিসংখ্যান দেখে অনেক বিনিয়োগকারী হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ওই সব শেয়ার কেনার জন্য। মূল্য বেড়ে এক ডলারের শেয়ার হলো ২০০ ডলার। আর সেই ফাঁকে ওই টপ-এক্সিকিউটিভরা তাঁদের স্টক-অপশন প্রয়োগ করলেন। অর্থাত্ তাঁরা বাজারের অতি উচ্চমূল্যের সময়ে তাঁদের দেয় শেয়ারগুলো বেচে লাখ লাখ ডলার আরও অতিরিক্ত লাভ করলেন। এর পর থেকে সত্য বের হতে শুরু করল।
কোম্পানির লাভ কমতে লাগল, ঋণের চাপে কোম্পানির ধরাশায়ী হওয়ার অবস্থা হলো। তাহলে এত দিন ওই ঋণ কোথায় ছিল। ছিল কোম্পানির কাগজে ঠিকই, তবে ব্যালান্সশিটে নয়। ব্যালান্সশিটেও ছিল, তবে অতি গোপনে, ফুটেজে যে তথ্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পড়তে জানেননি। যখন প্রকৃত দেনার কথা সাধারণ্যে প্রকাশ হলো, তখন শেয়ার বেচার ধুম পড়ে গেল। আর সে অবস্থায় শেয়ার মূল্য ২০০ থেকে এক ডলারে এসে ঠেকল! কোম্পানির লোকজন অনেক ব্যাখ্যাই দিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের কাছে কোনো ব্যাখ্যাই গ্রহণযোগ্য হলো না। তাঁরা কোম্পানির সিইও এবং টপ-ম্যানেজারদের মিথ্যাবাদী বললেন এবং তাঁদের প্রতি জুতা নিক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করলেন। কিন্তু তাতে কী হলো? এ প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ বিনিয়োগকারী প্রায় সবকিছুই হারালেন। আর তাঁদের সেই হারানো অর্থ জমা পড়ল কতিপয় দুষ্ট মিথ্যাবাদী উদ্যোক্তা এবং এক্সিকিউটিভের পকেটে। একটি উদাহরণ হলো, ওয়াল স্ট্রিটের অন্যতম বৃহত্ কোম্পানি শেয়ার কেলেঙ্কারি। মিথ্যা তথ্য দিয়ে শেয়ার মূল্যকে বাড়ানোর দায়ে এবং ওই বাড়তি মূল্যে নিজেদের শেয়ারগুলো বিক্রি করে সুবিধা নেওয়ার জন্য আদালত সিইও এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তার ওপর জেল-জরিমানার দণ্ডাদেশ আরোপ করেন। কিন্তু তাঁদের এই কাজের অন্য সহযোগী কারা ছিলেন? প্রথমেই ছিল অডিটর। এ ধরনের ক্ষেত্রে অডিটর ছিল আর্থার অ্যান্ডারসেন নামের পৃথিবী বিখ্যাত অ্যাকাউন্টিং ফার্ম। কিন্তু সেই ফার্মও শেষ পর্যন্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপকের সঙ্গে আপস করে কোম্পানির ঋণগুলোকে চাপিয়ে যায়। বিচারে অডিট ফার্মেরও জরিমানা হয় এবং এই ফার্মকে চিরদিনের জন্য অডিট করা থেকে বিরত থাকার জন্য হুকুম জারি করা হয়। শুধু একাই তথ্য গোপনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়নি, ওয়াল স্ট্রিটের অন্য অনেক কোম্পানিও ওই একই দোষে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মতো এত শক্তিশালী রেগুলেটর থাকতে এসব হতে পারল কী করে? তবে সত্য হলো, শেয়ারবাজারে রমরমা অবস্থা চলতে থাকলে রেগুলেটর ক্রেডিট নিতেই ব্যস্ত থাকে। আর সব ফ্রন্টে যখন শীতলতা নেমে আসে, তখন রেগুলেটর প্রসিকিউটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাদের এসইসি তো অনেক লোককে প্রসিকিউট করল, কিন্তু তাতে কি লাখ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী তাঁদের হারানো অর্থ ফেরত পেয়েছেন?
কোম্পানির টপ-এক্সিকিউটিভরা এত মিথ্যার ডালা সাজাতে পারেন না। তাঁদের এ কাজে সহায়তা করেন অডিটর এবং অ্যানালিস্টরা। অডিটের অডিট রিপোর্টকে সব স্টেকহোন্ডারই অনেক মূল্য দেন। অডিটর নিযুক্ত হয় কোম্পানির সাধারণ সভায় শেয়ারহোল্ডারদের ভোটে। কিন্তু সত্য হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অডিটর শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ না দেখে কোম্পানির টপ-এক্সিকিউটিভদের পক্ষ নেয়। এ ধরনের ক্ষেত্রে ওই কোম্পানির ঋণকে লুকানোর ক্ষেত্রে অডিটর আর্থার অ্যান্ডারসেন বড় ভূমিকা পালন করে। অন্য যাঁরা কোম্পানিকে মিথ্যা বলতে সহায়তা করেন তাঁরা হলেন বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বিশ্লেষকেরা। তাঁরাই সবুজ কালিতে কোনো কোনো শেয়ারের গুণ গাইয়ে বড় রিপোর্ট রচনার কাজটি করেন। তাঁরাই শেয়ারকে উঁচু মূল্যে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেন। আমাদের বাজারেও অডিটরের ভূমিকা অতি হতাশাব্যঞ্জক। অডিটর পারতপক্ষে কোম্পানি সম্পর্কে খারাপ বলতে চায় না। অতি অল্প কথায় ভালো ভালো বলে দায়িত্ব শেষ করে। তাদের সহযোগিতা নিয়েই তো অনেক কোম্পানি বাংলাদেশ শেয়ারবাজার থেকে অনেক অর্থ নিয়ে হয় উদাত্ত হয়েছে, নতুবা তাদের কোম্পানিকে ‘Z’ শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করে ট্যাক্স-সুদ ও মুনাফা দেওয়া থেকে বেঁচে যাচ্ছে। কিন্তু এই ‘Z’ শ্রেণীর উপ-ম্যানেজারেরা ঠিকই অতি মূল্যমানের গাড়িতে চড়ে কোম্পানির ওপর খরচটা চাপিয়ে দিচ্ছেন।
এ ক্ষেত্রে আমাদের রেগুলেটর অতি নরম। তারা ‘B’ থেকে ‘Z’ শ্রেণীতে শ্রেণীবিন্যাস করেই যেন দায়িত্ব শেষ করছে। ওয়াল স্ট্রিটে টপ-এক্সিকিউটিভদের কেউ কেউ যখন তাদের ধোঁকাবাজির জন্য জেলে যাচ্ছিল, তখন মার্কিন অর্থনীতির অন্যত্র আর একটা কলঙ্ক সবার অলক্ষ্যে দানা বাঁধতে শুরু করল। সেটা হলো, সাব-প্রাইম মর্টগেজ কেলেঙ্কারি। সবাইকে বাড়ির মালিক বানাতে গিয়ে ব্যাংকগুলো ঋণ বেচার দোকানগুলোকে এমন উন্মুক্ত করে দিল যে ঋণের জন্য কোনো জামানতই প্রয়োজন পড়ল না। সবাই নিজ নিজ বাড়ি বন্ধক রেখে ভাগে মেতে উঠল।
অর্থনীতিতে জুলুসের হাওয়া বইতে লাগল। কিন্তু সেই জুলুস বেশি দিন চলল না। শিগগিরই ধরা পড়ল তারা অ্যাসেটভ্যালুর অন্তর্নিহিত মূল্যের তুলনায় অনেক বেশি ঋণকে গছিয়ে দিয়েছে। শুরু হলো দরপতন। ঋণ ক্রেতার আর লোক পাওয়া গেল না। টক্সিক অ্যাসেটের ভারে পড়ে তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে দেউলিয়া হতে লাগল। প্রথমে বুশ, পরে ওবামা হাজার হাজার বিলিয়নস অব ডলারের রক্ষাকবচ নিয়ে এগিয়ে এলেন। এখন মার্কিন সরকার ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণের ফাঁদে বন্দী। অন্যদিকে আমেরিকাবাসী শঙ্কিত সরকারের ওই ঋণ জোগান দেওয়ার জন্য তাদের ওপর আরও বেশি ট্যাক্স বসানো হবে!
এখন মার্কিন অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ওবামা প্রশাসন চেয়ে আছে চীনসহ অন্যদের দিকে। তবে তাদের ফেরা আগের অবস্থানে আর কখনো হবে বলে মনে হয় না। এখন বিশ্বের জন্য মার্কিন অর্থনীতি আর এককভাবে ইঞ্জিন অব গ্রোথ বা প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন নয়। এখন চীন, ভারত, ব্রাজিলসহ আরও অনেক ছোট-বড় ইঞ্জিন বিশ্বের অর্থনীতিকে সামনে টানার কাজে লেগে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আস্ফাালন কিন্তু থেমে নেই। গুলি খাওয়া বাঘও অনেকক্ষণ লাফ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও অনেকটা তাই। পুঁজিবাদের চারণভূমি নিজেই পুঁজিবাদের দংশনে দংশিত। এই দৈত্য যে অতি স্বাধীনতা পেলে কী ভয়ানক হতে পারে, তার প্রমাণ তো ওয়াল স্ট্রিটের কেলেঙ্কারিগুলো।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোম্পানির লাভ কমতে লাগল, ঋণের চাপে কোম্পানির ধরাশায়ী হওয়ার অবস্থা হলো। তাহলে এত দিন ওই ঋণ কোথায় ছিল। ছিল কোম্পানির কাগজে ঠিকই, তবে ব্যালান্সশিটে নয়। ব্যালান্সশিটেও ছিল, তবে অতি গোপনে, ফুটেজে যে তথ্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পড়তে জানেননি। যখন প্রকৃত দেনার কথা সাধারণ্যে প্রকাশ হলো, তখন শেয়ার বেচার ধুম পড়ে গেল। আর সে অবস্থায় শেয়ার মূল্য ২০০ থেকে এক ডলারে এসে ঠেকল! কোম্পানির লোকজন অনেক ব্যাখ্যাই দিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের কাছে কোনো ব্যাখ্যাই গ্রহণযোগ্য হলো না। তাঁরা কোম্পানির সিইও এবং টপ-ম্যানেজারদের মিথ্যাবাদী বললেন এবং তাঁদের প্রতি জুতা নিক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করলেন। কিন্তু তাতে কী হলো? এ প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ বিনিয়োগকারী প্রায় সবকিছুই হারালেন। আর তাঁদের সেই হারানো অর্থ জমা পড়ল কতিপয় দুষ্ট মিথ্যাবাদী উদ্যোক্তা এবং এক্সিকিউটিভের পকেটে। একটি উদাহরণ হলো, ওয়াল স্ট্রিটের অন্যতম বৃহত্ কোম্পানি শেয়ার কেলেঙ্কারি। মিথ্যা তথ্য দিয়ে শেয়ার মূল্যকে বাড়ানোর দায়ে এবং ওই বাড়তি মূল্যে নিজেদের শেয়ারগুলো বিক্রি করে সুবিধা নেওয়ার জন্য আদালত সিইও এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তার ওপর জেল-জরিমানার দণ্ডাদেশ আরোপ করেন। কিন্তু তাঁদের এই কাজের অন্য সহযোগী কারা ছিলেন? প্রথমেই ছিল অডিটর। এ ধরনের ক্ষেত্রে অডিটর ছিল আর্থার অ্যান্ডারসেন নামের পৃথিবী বিখ্যাত অ্যাকাউন্টিং ফার্ম। কিন্তু সেই ফার্মও শেষ পর্যন্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপকের সঙ্গে আপস করে কোম্পানির ঋণগুলোকে চাপিয়ে যায়। বিচারে অডিট ফার্মেরও জরিমানা হয় এবং এই ফার্মকে চিরদিনের জন্য অডিট করা থেকে বিরত থাকার জন্য হুকুম জারি করা হয়। শুধু একাই তথ্য গোপনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়নি, ওয়াল স্ট্রিটের অন্য অনেক কোম্পানিও ওই একই দোষে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মতো এত শক্তিশালী রেগুলেটর থাকতে এসব হতে পারল কী করে? তবে সত্য হলো, শেয়ারবাজারে রমরমা অবস্থা চলতে থাকলে রেগুলেটর ক্রেডিট নিতেই ব্যস্ত থাকে। আর সব ফ্রন্টে যখন শীতলতা নেমে আসে, তখন রেগুলেটর প্রসিকিউটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাদের এসইসি তো অনেক লোককে প্রসিকিউট করল, কিন্তু তাতে কি লাখ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী তাঁদের হারানো অর্থ ফেরত পেয়েছেন?
কোম্পানির টপ-এক্সিকিউটিভরা এত মিথ্যার ডালা সাজাতে পারেন না। তাঁদের এ কাজে সহায়তা করেন অডিটর এবং অ্যানালিস্টরা। অডিটের অডিট রিপোর্টকে সব স্টেকহোন্ডারই অনেক মূল্য দেন। অডিটর নিযুক্ত হয় কোম্পানির সাধারণ সভায় শেয়ারহোল্ডারদের ভোটে। কিন্তু সত্য হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অডিটর শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ না দেখে কোম্পানির টপ-এক্সিকিউটিভদের পক্ষ নেয়। এ ধরনের ক্ষেত্রে ওই কোম্পানির ঋণকে লুকানোর ক্ষেত্রে অডিটর আর্থার অ্যান্ডারসেন বড় ভূমিকা পালন করে। অন্য যাঁরা কোম্পানিকে মিথ্যা বলতে সহায়তা করেন তাঁরা হলেন বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বিশ্লেষকেরা। তাঁরাই সবুজ কালিতে কোনো কোনো শেয়ারের গুণ গাইয়ে বড় রিপোর্ট রচনার কাজটি করেন। তাঁরাই শেয়ারকে উঁচু মূল্যে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেন। আমাদের বাজারেও অডিটরের ভূমিকা অতি হতাশাব্যঞ্জক। অডিটর পারতপক্ষে কোম্পানি সম্পর্কে খারাপ বলতে চায় না। অতি অল্প কথায় ভালো ভালো বলে দায়িত্ব শেষ করে। তাদের সহযোগিতা নিয়েই তো অনেক কোম্পানি বাংলাদেশ শেয়ারবাজার থেকে অনেক অর্থ নিয়ে হয় উদাত্ত হয়েছে, নতুবা তাদের কোম্পানিকে ‘Z’ শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করে ট্যাক্স-সুদ ও মুনাফা দেওয়া থেকে বেঁচে যাচ্ছে। কিন্তু এই ‘Z’ শ্রেণীর উপ-ম্যানেজারেরা ঠিকই অতি মূল্যমানের গাড়িতে চড়ে কোম্পানির ওপর খরচটা চাপিয়ে দিচ্ছেন।
এ ক্ষেত্রে আমাদের রেগুলেটর অতি নরম। তারা ‘B’ থেকে ‘Z’ শ্রেণীতে শ্রেণীবিন্যাস করেই যেন দায়িত্ব শেষ করছে। ওয়াল স্ট্রিটে টপ-এক্সিকিউটিভদের কেউ কেউ যখন তাদের ধোঁকাবাজির জন্য জেলে যাচ্ছিল, তখন মার্কিন অর্থনীতির অন্যত্র আর একটা কলঙ্ক সবার অলক্ষ্যে দানা বাঁধতে শুরু করল। সেটা হলো, সাব-প্রাইম মর্টগেজ কেলেঙ্কারি। সবাইকে বাড়ির মালিক বানাতে গিয়ে ব্যাংকগুলো ঋণ বেচার দোকানগুলোকে এমন উন্মুক্ত করে দিল যে ঋণের জন্য কোনো জামানতই প্রয়োজন পড়ল না। সবাই নিজ নিজ বাড়ি বন্ধক রেখে ভাগে মেতে উঠল।
অর্থনীতিতে জুলুসের হাওয়া বইতে লাগল। কিন্তু সেই জুলুস বেশি দিন চলল না। শিগগিরই ধরা পড়ল তারা অ্যাসেটভ্যালুর অন্তর্নিহিত মূল্যের তুলনায় অনেক বেশি ঋণকে গছিয়ে দিয়েছে। শুরু হলো দরপতন। ঋণ ক্রেতার আর লোক পাওয়া গেল না। টক্সিক অ্যাসেটের ভারে পড়ে তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে দেউলিয়া হতে লাগল। প্রথমে বুশ, পরে ওবামা হাজার হাজার বিলিয়নস অব ডলারের রক্ষাকবচ নিয়ে এগিয়ে এলেন। এখন মার্কিন সরকার ইতিহাসের বৃহত্তম ঋণের ফাঁদে বন্দী। অন্যদিকে আমেরিকাবাসী শঙ্কিত সরকারের ওই ঋণ জোগান দেওয়ার জন্য তাদের ওপর আরও বেশি ট্যাক্স বসানো হবে!
এখন মার্কিন অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ওবামা প্রশাসন চেয়ে আছে চীনসহ অন্যদের দিকে। তবে তাদের ফেরা আগের অবস্থানে আর কখনো হবে বলে মনে হয় না। এখন বিশ্বের জন্য মার্কিন অর্থনীতি আর এককভাবে ইঞ্জিন অব গ্রোথ বা প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন নয়। এখন চীন, ভারত, ব্রাজিলসহ আরও অনেক ছোট-বড় ইঞ্জিন বিশ্বের অর্থনীতিকে সামনে টানার কাজে লেগে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আস্ফাালন কিন্তু থেমে নেই। গুলি খাওয়া বাঘও অনেকক্ষণ লাফ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও অনেকটা তাই। পুঁজিবাদের চারণভূমি নিজেই পুঁজিবাদের দংশনে দংশিত। এই দৈত্য যে অতি স্বাধীনতা পেলে কী ভয়ানক হতে পারে, তার প্রমাণ তো ওয়াল স্ট্রিটের কেলেঙ্কারিগুলো।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments