অধ্যাপকের গায়ে কেরোসিন: সেদিন যা ঘটেছিল by হুমায়ুন মাসুদ
তখন
দুপুর ১২টা। ৫ম সেমিস্টারের ক্লাস শেষ করে চেয়ারম্যানের কক্ষে যান ইংরেজি
বিভাগের অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ। এসময় সেখানে ওই বিভাগের মাস্টার্সের
শিক্ষার্থী মাইনুল আলম অনিক, রাশেদুন্নবী চৌধুরী, রাসেল, মাহমুদুল হাসান,
আলী হোসেন, জান্নাতুল ফেরদৌস, সংগীতা বিশ্বাস, ফেরদৌস আলম ডলিসহ বেশ কয়েকজন
উপস্থিত হন। তাদের দেখে সেখান থেকে চলে আসতে চাইলে শিক্ষার্থীরা মাসুদ
মাহমুদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন। এরপর তারা তাকে হেনস্তা করতে থাকেন।
একপর্যায়ে ওই কক্ষ থেকে টেনে লিফটে করে তারা তাকে নিচে নিয়ে যান। সেখান
থেকে ধাক্কা দিতে দিতে মাসুদ মাহমুদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইটে নিয়ে
যাওয়া যায়। আর এখানেই তার গায়ে কেরোসিন ঢালেন মাহমুদুল হাসান।
গত ২ জুলাই মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (ইউএসটিসি) অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢালার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এসব তথ্য জানান। তারা আরও জানান, যখন অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদকে আগলে ধরে প্রক্টর নুরে আলম সিদ্দিকী মেইন গেটের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পাশ থেকে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের একজন বলতে থাকেন, “কিরে, তোরা ধর না, ব্যাটা। ধর। স্যারকে ধর। ধাক্কা দে, ধাক্কা দে, ধরে ধাক্কা দে...”। একই সময়ে প্রক্টর নুরে আলম সিদ্দিকী অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের সেখান থেকে চলে যেতে বললে কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী বলতে থাকেন, “আমরা কেন সরে যাবো। আমরা উনাকে পুলিশে দেবো, আপনাকেও। আপনিও সমান অপরাধী”।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, দুই মাস আগে ইংরেজি বিভাগের উপদেষ্টা অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে কয়েকজন ছাত্রী যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেন। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই দুইদিন আগে তাকে লাঞ্ছিত করেন কিছু শিক্ষার্থী। ইংরেজি বিভাগ থেকে সম্প্রতি বরখাস্ত হওয়া এক শিক্ষকের ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটেছে।
তবে এসব কথা অস্বীকার করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ অন্যায়ভাবে তাদের পরীক্ষা দিতে দিচ্ছেন না। এ কারণে বিভাগে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। তাই তারা এই শিক্ষকের বিরোধিতা করছেন। আর এসব ঘটনার জের ধরেই মঙ্গলবার মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন মাহমুদুল হাসান।
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগের বিচার না হওয়ায় টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন কিছু শিক্ষার্থী। এর আগেই মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢালার ঘটনা ঘটে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেই দিন দুপুর ১২টায় ৫ম সেমিস্টারের একটি ক্লাস শেষ করে চেয়ারম্যান কক্ষে গিয়ে একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম। এসময় জান্নাতুল ফেরদৌস, সংগীতা বিশ্বাস, ফেরদৌস আলম ডলি, মাইনুল আলম অনিক, রাশেদুন্নবী চৌধুরী, রাসেল, মাহমুদুল হাসান, আলী হোসেনসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী ওই কক্ষে আসে। তাদের দেখে আমি চলে আসতে চাইলে প্রথমে মাইনুল আলম অনিক তর্ক শুরু করে। আমাকে কক্ষ থেকে বের হতে বাধা দেয়। তার সঙ্গে ফেরদৌস আলম ডলি চেঁচামেচি শুরু করে। এরপর রাশেদুন্নবী চৌধুরী আমাকে হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে রাসেল নামে আরেক শিক্ষার্থী আমাকে টেনে চেয়ার থেকে তুলে চেয়ারম্যানের কক্ষ থেকে বের করে। এরপর মো. আলী হোসেন নামে এক ছাত্র আমার জামা টেনে ধরে লিফটে নিয়ে নিচে নিয়ে যায়। নিচে পার্কিংয়ে নিয়ে যাওয়ার পর মাহমুদুল হাসান আমার হাতে থাকা একটি বই ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এরপর আমাকে তারা জোর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেইটে নিয়ে যায়। সেখানে মাহমুদুল হাসান আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেয়।’
তিনি আরও জানান,পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং বিভাগের চেয়ারম্যানসহ আমার কয়েকজন সহকর্মী এসে আমাকে ভিসির কক্ষে নিয়ে যান। জোবায়ের ইসলাম ও সানি কাদের নামে দুই ছাত্র পরিকল্পিতভাবে এটি ঘটিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
এ ব্যাপারে সানি কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এর আগে মে মাসে যখন ছাত্রীরা স্যারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছিল, তখন আমরা স্যারের পক্ষে মানববন্ধন করেছিলাম। মঙ্গলবারের ঘটনার সময় আমি নিচে ছিলাম। চেঁচামেচি শুনে ওপরে গিয়ে দেখি, স্যারের সঙ্গে মাস্টার্সের আপুরা তর্ক-বিতর্ক করছে। এসময় তারা স্যারের সঙ্গে লিফটে নিচে নেমে আসেন। নিচে নেমে আসার পর মাহমুদুল হাসান ভাইয়ের সঙ্গে স্যারের কথা কাটাকাটি হয়। তারপর দেখলাম, স্যার নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেইটের দিকে চলে যাচ্ছেন। এসময় আমরা স্যারকে সিএনজি অটোরিকশায় তুলে দিতে চাইলে মাহমুদুল হাসান ভাই এসে বাধা দেন। উনাকে সিএনজি অটোরিকশা থেকে নামিয়ে উনি তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন।’
সানি আরও বলেন, ‘মাহমুদুল হাসান ভাই কেন কাজটা করেছে, আমরা কেউ জানতাম না। তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত। এর আগেও ক্লাসে কয়েকজনের সঙ্গে তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করেছেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নুরে আলম সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, শিক্ষার্থীরা স্যারকে (অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ) টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তখন আমরা তাদের বাধা দেই। শিক্ষার্থীরা স্যার গায়ে যেন হাত না দেয়, সেজন্য হুঁশিয়ার করি। একপর্যায়ে মেইন গেইটে তর্ক-বিতর্ক হয়। এসময় দেখি, স্যারের গায়ে কেরোসিনের গন্ধ; উনার পুরো শার্ট ভেজা। কে শার্টে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে তা আমি দেখিনি। তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে আমরা স্যারকে ভিসির কক্ষে নিয়ে যাই।’
ঘটনার নেপথ্যে
নাম প্রকাশ না করে বিভাগের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,গত বছর উপদেষ্টা হিসেবে ইংরেজি বিভাগে যোগদানের পর মাসুদ মাহমুদের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য বছরে দু’টি করে সেমিনার করা ও একটি করে প্রকাশনা দেওয়া বাধ্যবাধকতামূলক করে। এ কারণে ওই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাশরুর আনোয়ার বরখাস্ত হন। একই কারণে ওই বিভাগের শিক্ষক আক্তার নুর বেগম, নওশিন জাহান আরজু ‘রিজাইন’ দেন। তাদের অনুগত শিক্ষার্থীরাই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
এ ব্যাপারে মাসুদ মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “মাশরুর আনোয়ার বিভাগে আট বছর আগে নিয়োগ পায়। তার রেজাল্ট সিজিপিএ তিনের নিচে। গত ৮ বছরে তার কোনও পেপার নেই এবং সে ক্লাসে সবচেয়ে অনিয়মিত। শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তার গাফিলতি আছে। এসব কারণে কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করে। বিষয়টির জন্য সে আমাকে দোষারোপ করে। বরখাস্ত হয়ে চলে যাওয়ার সময় সে আমাকে বলে গেছে, ‘স্যার, আমি আপনাকেও এখান থেকে সরিয়ে দেবো’। ওই ঘটনার জের ধরেই মাশরুরসহ চাকরি ছেড়ে দেওয়া শিক্ষকরা কয়েকজন ছাত্রীকে দিয়ে প্রথমে আমার নামে যৌন হয়রানির একটা অভিযোগ তুলে। এখন আমাকে প্রাণে মেরে ফেলতে শিক্ষার্থীদের দিয়ে আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিলো।”
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার কল করা হলে মাশরুর আনোয়ারের মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। অপর তিন শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর নুরে আলম সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ ইউটিসিতে যোগ দেওয়ার পর ওই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই ঘটনার সঙ্গে ওই ঘটনার কোনও যোগসূত্র আছে কিনা আমি নিশ্চিত নই। তবে এর আগে স্যারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি তদন্ত করে মাসুদ মাহমুদ স্যারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোনও সত্যতা পায়নি। তাহলে বোঝা যায়, অন্য কোনও কারণে হয়তো শিক্ষার্থীরা এই অভিযোগ তুলেছেন।’
জড়িতরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া মাহমুদুল হাসান ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ ঘটনায় জড়িত রাশেদুন্নবী, রাসেল, জোবায়ের ইসলাম, সানি কাদেরসহ অন্যরাও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইংরেজি বিভাগের এক ছাত্র বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাসুদ মাহমুদ স্যারের সঙ্গে যারা অশোভন আচরণ করেছেন, তারা সবাই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ করে। নগরীর ওমর গনি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে তাদের সখ্যতা রয়েছে।’
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সানি কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কোনও কমিটি নেই। তবে আমি নগর ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মাহমুদুল হাসানও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।’
কঠোর অবস্থানে প্রশাসন
অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার ঘটনায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি খুলশী থানায় মামলা দায়ের করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার দিলীপ কুমার বড়ুয়া। ওই মামলায় পুলিশ মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতারও করেছে। তাকে দুইদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। অবশ্য এর আগে ঘটনার দিন গ্রেফতারের পর মাহমুদুল হাসান কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।
এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নুরে আলম সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাসুদ মাহমুদ স্যারের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ভিসি স্যার একটি তদন্ত কমিটি করেছেন। আমরা বিষয়টিকে কঠোরভাবে দেখছি। ইতোমধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আমরা বিবৃতি দেবো। স্যারের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
গত ২ জুলাই মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (ইউএসটিসি) অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢালার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এসব তথ্য জানান। তারা আরও জানান, যখন অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদকে আগলে ধরে প্রক্টর নুরে আলম সিদ্দিকী মেইন গেটের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পাশ থেকে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের একজন বলতে থাকেন, “কিরে, তোরা ধর না, ব্যাটা। ধর। স্যারকে ধর। ধাক্কা দে, ধাক্কা দে, ধরে ধাক্কা দে...”। একই সময়ে প্রক্টর নুরে আলম সিদ্দিকী অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের সেখান থেকে চলে যেতে বললে কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী বলতে থাকেন, “আমরা কেন সরে যাবো। আমরা উনাকে পুলিশে দেবো, আপনাকেও। আপনিও সমান অপরাধী”।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, দুই মাস আগে ইংরেজি বিভাগের উপদেষ্টা অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে কয়েকজন ছাত্রী যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেন। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই দুইদিন আগে তাকে লাঞ্ছিত করেন কিছু শিক্ষার্থী। ইংরেজি বিভাগ থেকে সম্প্রতি বরখাস্ত হওয়া এক শিক্ষকের ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটেছে।
তবে এসব কথা অস্বীকার করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ অন্যায়ভাবে তাদের পরীক্ষা দিতে দিচ্ছেন না। এ কারণে বিভাগে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। তাই তারা এই শিক্ষকের বিরোধিতা করছেন। আর এসব ঘটনার জের ধরেই মঙ্গলবার মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন মাহমুদুল হাসান।
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগের বিচার না হওয়ায় টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন কিছু শিক্ষার্থী। এর আগেই মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢালার ঘটনা ঘটে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেই দিন দুপুর ১২টায় ৫ম সেমিস্টারের একটি ক্লাস শেষ করে চেয়ারম্যান কক্ষে গিয়ে একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম। এসময় জান্নাতুল ফেরদৌস, সংগীতা বিশ্বাস, ফেরদৌস আলম ডলি, মাইনুল আলম অনিক, রাশেদুন্নবী চৌধুরী, রাসেল, মাহমুদুল হাসান, আলী হোসেনসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী ওই কক্ষে আসে। তাদের দেখে আমি চলে আসতে চাইলে প্রথমে মাইনুল আলম অনিক তর্ক শুরু করে। আমাকে কক্ষ থেকে বের হতে বাধা দেয়। তার সঙ্গে ফেরদৌস আলম ডলি চেঁচামেচি শুরু করে। এরপর রাশেদুন্নবী চৌধুরী আমাকে হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে রাসেল নামে আরেক শিক্ষার্থী আমাকে টেনে চেয়ার থেকে তুলে চেয়ারম্যানের কক্ষ থেকে বের করে। এরপর মো. আলী হোসেন নামে এক ছাত্র আমার জামা টেনে ধরে লিফটে নিয়ে নিচে নিয়ে যায়। নিচে পার্কিংয়ে নিয়ে যাওয়ার পর মাহমুদুল হাসান আমার হাতে থাকা একটি বই ছিঁড়ে ফেলে দেয়। এরপর আমাকে তারা জোর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেইটে নিয়ে যায়। সেখানে মাহমুদুল হাসান আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেয়।’
তিনি আরও জানান,পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এবং বিভাগের চেয়ারম্যানসহ আমার কয়েকজন সহকর্মী এসে আমাকে ভিসির কক্ষে নিয়ে যান। জোবায়ের ইসলাম ও সানি কাদের নামে দুই ছাত্র পরিকল্পিতভাবে এটি ঘটিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
এ ব্যাপারে সানি কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এর আগে মে মাসে যখন ছাত্রীরা স্যারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছিল, তখন আমরা স্যারের পক্ষে মানববন্ধন করেছিলাম। মঙ্গলবারের ঘটনার সময় আমি নিচে ছিলাম। চেঁচামেচি শুনে ওপরে গিয়ে দেখি, স্যারের সঙ্গে মাস্টার্সের আপুরা তর্ক-বিতর্ক করছে। এসময় তারা স্যারের সঙ্গে লিফটে নিচে নেমে আসেন। নিচে নেমে আসার পর মাহমুদুল হাসান ভাইয়ের সঙ্গে স্যারের কথা কাটাকাটি হয়। তারপর দেখলাম, স্যার নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেইটের দিকে চলে যাচ্ছেন। এসময় আমরা স্যারকে সিএনজি অটোরিকশায় তুলে দিতে চাইলে মাহমুদুল হাসান ভাই এসে বাধা দেন। উনাকে সিএনজি অটোরিকশা থেকে নামিয়ে উনি তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন।’
সানি আরও বলেন, ‘মাহমুদুল হাসান ভাই কেন কাজটা করেছে, আমরা কেউ জানতাম না। তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত। এর আগেও ক্লাসে কয়েকজনের সঙ্গে তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করেছেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নুরে আলম সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, শিক্ষার্থীরা স্যারকে (অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ) টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তখন আমরা তাদের বাধা দেই। শিক্ষার্থীরা স্যার গায়ে যেন হাত না দেয়, সেজন্য হুঁশিয়ার করি। একপর্যায়ে মেইন গেইটে তর্ক-বিতর্ক হয়। এসময় দেখি, স্যারের গায়ে কেরোসিনের গন্ধ; উনার পুরো শার্ট ভেজা। কে শার্টে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে তা আমি দেখিনি। তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে আমরা স্যারকে ভিসির কক্ষে নিয়ে যাই।’
ঘটনার নেপথ্যে
নাম প্রকাশ না করে বিভাগের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,গত বছর উপদেষ্টা হিসেবে ইংরেজি বিভাগে যোগদানের পর মাসুদ মাহমুদের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য বছরে দু’টি করে সেমিনার করা ও একটি করে প্রকাশনা দেওয়া বাধ্যবাধকতামূলক করে। এ কারণে ওই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাশরুর আনোয়ার বরখাস্ত হন। একই কারণে ওই বিভাগের শিক্ষক আক্তার নুর বেগম, নওশিন জাহান আরজু ‘রিজাইন’ দেন। তাদের অনুগত শিক্ষার্থীরাই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
এ ব্যাপারে মাসুদ মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “মাশরুর আনোয়ার বিভাগে আট বছর আগে নিয়োগ পায়। তার রেজাল্ট সিজিপিএ তিনের নিচে। গত ৮ বছরে তার কোনও পেপার নেই এবং সে ক্লাসে সবচেয়ে অনিয়মিত। শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তার গাফিলতি আছে। এসব কারণে কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করে। বিষয়টির জন্য সে আমাকে দোষারোপ করে। বরখাস্ত হয়ে চলে যাওয়ার সময় সে আমাকে বলে গেছে, ‘স্যার, আমি আপনাকেও এখান থেকে সরিয়ে দেবো’। ওই ঘটনার জের ধরেই মাশরুরসহ চাকরি ছেড়ে দেওয়া শিক্ষকরা কয়েকজন ছাত্রীকে দিয়ে প্রথমে আমার নামে যৌন হয়রানির একটা অভিযোগ তুলে। এখন আমাকে প্রাণে মেরে ফেলতে শিক্ষার্থীদের দিয়ে আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিলো।”
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার কল করা হলে মাশরুর আনোয়ারের মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। অপর তিন শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর নুরে আলম সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ ইউটিসিতে যোগ দেওয়ার পর ওই বিভাগের কয়েকজন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই ঘটনার সঙ্গে ওই ঘটনার কোনও যোগসূত্র আছে কিনা আমি নিশ্চিত নই। তবে এর আগে স্যারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি তদন্ত করে মাসুদ মাহমুদ স্যারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কোনও সত্যতা পায়নি। তাহলে বোঝা যায়, অন্য কোনও কারণে হয়তো শিক্ষার্থীরা এই অভিযোগ তুলেছেন।’
জড়িতরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া মাহমুদুল হাসান ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ ঘটনায় জড়িত রাশেদুন্নবী, রাসেল, জোবায়ের ইসলাম, সানি কাদেরসহ অন্যরাও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইংরেজি বিভাগের এক ছাত্র বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাসুদ মাহমুদ স্যারের সঙ্গে যারা অশোভন আচরণ করেছেন, তারা সবাই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ করে। নগরীর ওমর গনি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে তাদের সখ্যতা রয়েছে।’
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সানি কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কোনও কমিটি নেই। তবে আমি নগর ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মাহমুদুল হাসানও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।’
কঠোর অবস্থানে প্রশাসন
অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার ঘটনায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি খুলশী থানায় মামলা দায়ের করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার দিলীপ কুমার বড়ুয়া। ওই মামলায় পুলিশ মাহমুদুল হাসানকে গ্রেফতারও করেছে। তাকে দুইদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। অবশ্য এর আগে ঘটনার দিন গ্রেফতারের পর মাহমুদুল হাসান কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।
এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নুরে আলম সিদ্দিকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাসুদ মাহমুদ স্যারের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ভিসি স্যার একটি তদন্ত কমিটি করেছেন। আমরা বিষয়টিকে কঠোরভাবে দেখছি। ইতোমধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আমরা বিবৃতি দেবো। স্যারের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
মেইন গেইটের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ |
No comments