শোকের মাতম: বনানী ট্র্যাজেডিতে নিহত ২৫ by জিয়া চৌধুরী
‘একটু
ভালো করে বাঁচবো বলে আর একটু বেশি রোজগার, ছাড়লাম ঘর আমি ছাড়লাম ভালোবাসা,
আমার নীলচে পাহাড়।’ অঞ্জন দত্তের গানের মতো নিজের ঘর, ভালোবাসা ফেলে
জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসা ২৫ জন মানুষ আর কোনোদিন তাদের পরিবারে ফিরবেন না।
বনানীর এফআর টাওয়ারের ভয়াবহ আগুন টেনে দিয়েছে তাদের জীবনের ইতিরেখা। নিজের
ঘর, ভালোবাসার মায়া ফেলে তারা এখন বহু দূরের পথে।
বৃহস্পতিবার বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় অন্তত ২৫ জনের প্রাণহানির খবর নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। নিহতদের একেক জনের জীবন ঘিরে ছিল হাজারো স্বপ্ন। অনেক ইচ্ছে-আহ্লাদ পূরণ হবার বাকি ছিল তাদের। কিন্তু মুহূর্তের আগুনে থমকে গেছে ২৫টি পরিবারও। হাসি-আনন্দের খোরাক হয়ে বেঁচে থাকার কথা যাদের, তারাই এখন অশ্রুর কারণ।
ছুটির দিনগুলোতে যাদের বাবা-মা কিংবা স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে আনন্দে সময় পার করার কথা তারা এখন আজীবনের ছুটিতে। অফিস, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কিংবা প্রতিদিনকার জীবনযাপন কোনো কিছুই এখন আর তাদের ছুঁতে পারবে না।
প্রিয়জনদের হারিয়ে শোক আর বেদনায় কাতর-স্তব্ধ পরিবারগুলো। শেষবারের জন্য পরিবারের সদস্যকে নিয়ে গেছেন নিজ নিজ এলাকায়, শেষ বিদায় দিতে। এদিকে, এফ আর টাওয়ারের আগুনের ঘটনায় নিহত মোট ২৫ জনের তালিকা দিয়েছে পুলিশ কন্ট্রোল রুম। নিহতরা হলেন- মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রামপাশা গ্রামের সৈয়দা আমিনা ইয়াসমিন (৪৮), বরিশালের উত্তর করাপুর সরদারবাড়ীর মোহাম্মদ মনির হোসেন সরদার (৫২), ঢাকার গেন্ডারিয়ার মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান (৩২), নীলফামারী জলঢাকার রুমকি আক্তার (৩০), দিনাজপুরের বালুয়াডাঙ্গার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন (৪০), রংপুরের পীরগঞ্জের চাতরা গ্রামের মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান (৩৬), খুলনার তেরখাদার কোদলা গ্রামের মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ঢাকার মিরপুরের রূপনগরের ফ্লোরিডা খানম পলি (৪৫), ঢাকার আতাউর রহমান (৬২), চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণের মোহাম্মদ রেজাউল করিম রাজু (৪০), নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের আহম্মদ জাফর (৫৯), নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের জেবুন্নেসা (৩০), ঢাকার মগবাজারের মোহাম্মদ সালাউদ্দিন মিঠু (২৫), টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের নাহিদুল ইসলাম তুষার (৩৫), বগুড়ার সান্তাহারের তানজিলা মৌলি (২৫), গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর মোহাম্মদ পারভেজ সাজ্জাদ (৪৬), শ্রীলঙ্কার নাগরিক নিরস ভিগমা রাজা (৩৫), কুষ্টিয়ার কুমারখালীর মোহাম্মদ ইফতিয়ার হোসেন মিঠু (৩৭), যশোরের বেজপাড়া মেইন রোডের শেখ জারিন তাসনিম বৃষ্টি (২৫), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (৩০), শরীয়তপুরের শৈলপাড়ার আতিকুর রহমান (৪২), লালমনিরহাটের পাটগ্রামের আনজির সিদ্দিক আবির (২৭), ঢাকার ডেমরার আব্দুল্লাহ আল ফারুক (৬২), নওগাঁর মোহাম্মদ মঞ্জুর হাসান (৪৯) ও পাবনার আতাইকুলা থানার আমির হোসেন রাব্বি (২৯)। এদের সবার পরিবারজুড়ে এখন শোকের মাতম। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় স্তব্ধ স্বজনরা। এর মধ্যে নিজ নিজ এলাকায় নিহতদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
আগুনে শেষ উচ্ছল জীবন
এই তো সপ্তাহ দুয়েক আগে গত ১২ই মার্চ জীবনের ২৬তম জন্মদিন পালন করলেন তানজিলা মৌলি। তখনো কি ভেবেছিলেন এটাই হবে তার জীবনের শেষ জন্মদিন উদযাপন! হয়তো ভাবেন নি। এমন প্রাণোচ্ছল, প্রাচুর্যে ভরা তরুণী প্রাণে কেই বা মৃত্যুর কথা চিন্তা করে। নিজের পরিবারকে নিয়ে আরো কতগুলো সময় আনন্দে-উচ্ছলতায় কাটানোর কথা ছিল তার। অথচ বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় মাত্র ২৫ বছর বয়সেই থেমে গেছে এই তরুণ প্রাণ। বিতর্ক, উপস্থাপনা কিংবা যেকোনো আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তানজিলা মৌলি পরিচিত ছিলেন তুখোড় হিসেবে, ছিলেন সবার প্রিয়জন।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন তানজিলা মৌলি। এরপর এসিআই লিমিটেড থেকে ইন্টার্ন শেষে যোগ দেন হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেস নামে একটি ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল অপারেটর প্রতিষ্ঠানে। যার অফিস ছিল বনানীর এফ আর টাওয়ারের ১১তলায়। প্রায় দু’বছর আগে ২০১৭ সালের ৪ঠা আগস্ট নোয়াখালীর ছেলে মো. রায়হানুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয় বগুড়ার সান্তাহারের মেয়ে তানজিলা মৌলির। দুজনেই বেশ ঘুরতে পছন্দ করতেন। সবশেষ নেপাল ও কক্সবাজার ট্যুরের ছবি এখনো ফেসবুকের টাইমলাইনে ভাসছে। স্বামী রায়হানুল ইসলামকে নিয়ে আরো বহু দেশ ঘোরার ইচ্ছে ছিল তানজিলা মৌলির। অথচ বৃহস্পতিবারের আগুন কেড়ে নিয়েছে তার জীবন। স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে প্রিয়তমা স্ত্রীকে। সেদিন প্রচণ্ড ধোঁয়া ও উচ্চতাপে অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় তানজিলা মৌলি।
এফ আর টাওয়ারে আটকা পড়ার পর বাবা মাসুদুর রহমান ও স্বামী রায়হানুল ইসলামের সঙ্গে সবশেষ কথা হয় তার। মুঠোফোনের কণ্ঠে ছিল বাঁচার আকুতি, কিন্তু ফোনের এপার থেকে যেন কিছুই করার ছিল না বাবা মাসুদুর রহমানের। বাবা আশ্বস্ত করেছিলেন, মা তোমার কিছু হবে না। দেখো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। খবর পেয়ে বগুড়ার সান্তাহার থেকে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছাতে রাত প্রায় ৯টা বেজে যায়। ততক্ষণে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিথর দেহে পড়ে আছে তানজিলা মৌলির মরদেহ। বাবা মাসুদুর রহমান যে মেয়েকে কথা দিয়েছিলেন তার কিছুই হবে না। মেয়েকে দেয়া কথা তো রইলো না। মেয়ের নিথর দেহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়া ছাড়া যেন আর কিছুই করার ছিল না বাবার।
প্রাণহীন এক নিথর দেহ নিয়ে বগুড়ার সান্তাহার ফিরেছেন বাবা, একেবারে শেষবারের মতো। তানজিলা মৌলিকে হারানোর বেদনা সান্তাহারবাসীকেও পোড়াচ্ছে। বশিপুর সরদার পাড়ার প্রতিটি বাড়িতে কন্যা হারানোর শোক। তার ছোটবেলার বন্ধু তুলিকা মানবজমিনকে বলেন, মৌলি আর কোনোদিন আসবে না তার প্রিয় সান্তাহারে। দেখা হবে না ওর বন্ধুদের সঙ্গে। কথা হবে না বাবা আর মার সঙ্গে। মিথির ঘরটি শূন্যই থাকবে, যেখানে শিশুকাল থেকে বেড়ে উঠেছে মিষ্টি এই মেয়েটি। কোনোভাবেই মানতে পারছি না এসব। তানজিলা মৌলিকে নিয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সংগঠন বিওয়াইএলসি’র রাইয়ান বিন নূর জানান, মৌলি আপুর সঙ্গে পরিচয় ঠিক দুই বছর আগে।
জুনিয়র ১০ ক্যান্ডিডেটদের ইন্টারভিউ ছিল সেদিন। খুব অল্প সময়ে আপুর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। উনি উনার সুন্দর হাসি দিয়ে সবাইকে খুব সহজেই কাছে টেনে নিতে পারতেন। প্রোগ্রামগুলোতে দেখা আর সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রায়ই কথা হতো। এই তো ক’মাস আগে হঠাৎ ভার্সিটি থেকে বের হয়ে দেখা! একদমই কাছাকাছি দুটো বিল্ডিং বলে প্রায়ই দেখা হতো, এই তো কিছুদিন আগেও হলো। সেদিন দুপুরে যখন আগুনের কথা জানতে পারি তখন মৌলি আপুকে ফোন করে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফেসবুকে নক করতে গিয়ে দেখলাম ঘণ্টা দুয়েক আগেও তিনি অনলাইনে ছিলেন। অথচ এভাবে স্মিত হাসির মানুষটিকে হারাতে হবে ভাবতে চোখে জল চলে আসছে। তানজিলা মৌলির স্বামী রায়হানুল ইসলাম গত নভেম্বরে তার ফেসবুকে কাকতালীয়ভাবে লিখেছিলেন, নো ম্যাটার হাউ গুড ইউ আর, ইউ ক্যান অলয়েজ বি রিপ্লেসড। কয়েক মাস আগে নিছক ভাবনা যে সত্যি হয়ে যাবে তা কে ভেবেছিল! প্রাণখোলা হাসির মৌলিকে হয়তো আজীবন অনুভব করবেন তার স্বামী রায়হানুল ইসলাম।
শেষবারের মতো পাটগ্রামে আবীর
লালমনির হাটের পাটগ্রামের কলেজ রোড এলাকায় বেড়ে উঠেছেন আনজির সিদ্দিক আবীর। উচ্চ শিক্ষার টানে পরিবার ছেড়ে ঢাকায় আসেন মাধ্যমিকের পরপর। ঢাকা থেকে প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরত্বের পাটগ্রাম তবুও ছিল তার বুকের ভেতর। ছুটি পেলেই বাবা-মার কাছে ফিরে যেতেন। বাবা আবু বকর সিদ্দিক, মা তাশরিফা খানম তামান্না আর বড় ভাই তানজীর সিদ্দিককে ঘিরে ছিল আবীরের জীবন। পরিবারের ছোট ছেলে হওয়ায় সেও ছিল সবার কাছে ভীষণ আদরের। গত ২৭শে মার্চ আনজির সিদ্দিক আবীর মধ্যরাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেন ‘মা ছেলে শুয়ে শুয়ে নিউজ ফিড দেখি। আহা, কি আনন্দ! অথচ এমন আনন্দ আর কখনো আবীরের জীবনে ফিরবে না।
বনানীর আগুনের ঘটনা আবীরকে তার প্রিয় পরিবার থেকে বহু দূরে নিয়ে গেছে। যেখানে আর সে চাইলেও তার মায়ের সঙ্গে ফেসবুক টাইমলাইন স্ক্রল করতে পারবে না। জীবনের ওপারে এ আরেক জীবন। লালমনিরহাটের পাটগ্রামের স্থানীয় টিএন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ২০১১ সালে আবীর ভর্তি হন সেন্ট যোসেফ কলেজে। পরে ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় স্নাতকোত্তর শেষ করেন। আবীরের বড় ভাই তানজীর সিদ্দিক ছিল তার জীবনের ছায়ার মতো। পড়াশোনা শেষে ২০১৭ সালের ৪ঠা মার্চ যোগ দেন পুঁজিবাজারে লেনদেন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান মিকা সিকিউরিটিজে। বড় ভাই তানজীর সিদ্দিকও কাজ করেন একই প্রতিষ্ঠানে।
মানবসম্পদ বিভাগে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যে কমপ্লায়েন্স অ্যাণ্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের নির্বাহীর দায়িত্ব পান। বনানীর এফ আর টাওয়ারের ১৪তলায় থাকা মিকা সিকিউরিটিজে গত বৃহস্পতিবারও যথারীতি অফিস করছিলেন আনজির সিদ্দিক আবীর। সেখানে কাজ করা শওকত নামে একজন কর্মী জানান আগুনের ঘটনার দিন তারা সবাই শেয়ারবাজারের লেনদেন মনিটরে ব্যস্ত ছিলেন। দুপুরের দিকে আগুন লাগে বলে তারা টের পান। মিকা সিকিউরিটিজের ৪৫ জন কর্মীর ৪৪ জনই প্রাণে বেঁচে গেলেও মারা যান আবীর। অবশ্য ভবনের সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন আবীর। সিঁড়িতে থাকা অবস্থায় কথা হয়েছিল শওকতের সঙ্গে। তবে বাকি কর্মীরা উপরে ছাদে ওঠে পাশের আহমেদ টাওয়ার দিয়ে নিরাপদে নেমে যেতে পারলেও বাথরুমে থাকায় বের হতে কিছুটা দেরি হয় আবীরের। পরে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সিঁড়িতে গেলে সেখান থেকে আর বেরুতে পারেন নি বলে ধারণা তার সহকর্মীদের।
বৃহস্পতিবার বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় অন্তত ২৫ জনের প্রাণহানির খবর নিশ্চিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। নিহতদের একেক জনের জীবন ঘিরে ছিল হাজারো স্বপ্ন। অনেক ইচ্ছে-আহ্লাদ পূরণ হবার বাকি ছিল তাদের। কিন্তু মুহূর্তের আগুনে থমকে গেছে ২৫টি পরিবারও। হাসি-আনন্দের খোরাক হয়ে বেঁচে থাকার কথা যাদের, তারাই এখন অশ্রুর কারণ।
ছুটির দিনগুলোতে যাদের বাবা-মা কিংবা স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে আনন্দে সময় পার করার কথা তারা এখন আজীবনের ছুটিতে। অফিস, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কিংবা প্রতিদিনকার জীবনযাপন কোনো কিছুই এখন আর তাদের ছুঁতে পারবে না।
প্রিয়জনদের হারিয়ে শোক আর বেদনায় কাতর-স্তব্ধ পরিবারগুলো। শেষবারের জন্য পরিবারের সদস্যকে নিয়ে গেছেন নিজ নিজ এলাকায়, শেষ বিদায় দিতে। এদিকে, এফ আর টাওয়ারের আগুনের ঘটনায় নিহত মোট ২৫ জনের তালিকা দিয়েছে পুলিশ কন্ট্রোল রুম। নিহতরা হলেন- মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রামপাশা গ্রামের সৈয়দা আমিনা ইয়াসমিন (৪৮), বরিশালের উত্তর করাপুর সরদারবাড়ীর মোহাম্মদ মনির হোসেন সরদার (৫২), ঢাকার গেন্ডারিয়ার মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান (৩২), নীলফামারী জলঢাকার রুমকি আক্তার (৩০), দিনাজপুরের বালুয়াডাঙ্গার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন (৪০), রংপুরের পীরগঞ্জের চাতরা গ্রামের মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান (৩৬), খুলনার তেরখাদার কোদলা গ্রামের মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ঢাকার মিরপুরের রূপনগরের ফ্লোরিডা খানম পলি (৪৫), ঢাকার আতাউর রহমান (৬২), চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণের মোহাম্মদ রেজাউল করিম রাজু (৪০), নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের আহম্মদ জাফর (৫৯), নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের জেবুন্নেসা (৩০), ঢাকার মগবাজারের মোহাম্মদ সালাউদ্দিন মিঠু (২৫), টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের নাহিদুল ইসলাম তুষার (৩৫), বগুড়ার সান্তাহারের তানজিলা মৌলি (২৫), গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর মোহাম্মদ পারভেজ সাজ্জাদ (৪৬), শ্রীলঙ্কার নাগরিক নিরস ভিগমা রাজা (৩৫), কুষ্টিয়ার কুমারখালীর মোহাম্মদ ইফতিয়ার হোসেন মিঠু (৩৭), যশোরের বেজপাড়া মেইন রোডের শেখ জারিন তাসনিম বৃষ্টি (২৫), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (৩০), শরীয়তপুরের শৈলপাড়ার আতিকুর রহমান (৪২), লালমনিরহাটের পাটগ্রামের আনজির সিদ্দিক আবির (২৭), ঢাকার ডেমরার আব্দুল্লাহ আল ফারুক (৬২), নওগাঁর মোহাম্মদ মঞ্জুর হাসান (৪৯) ও পাবনার আতাইকুলা থানার আমির হোসেন রাব্বি (২৯)। এদের সবার পরিবারজুড়ে এখন শোকের মাতম। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় স্তব্ধ স্বজনরা। এর মধ্যে নিজ নিজ এলাকায় নিহতদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
আগুনে শেষ উচ্ছল জীবন
এই তো সপ্তাহ দুয়েক আগে গত ১২ই মার্চ জীবনের ২৬তম জন্মদিন পালন করলেন তানজিলা মৌলি। তখনো কি ভেবেছিলেন এটাই হবে তার জীবনের শেষ জন্মদিন উদযাপন! হয়তো ভাবেন নি। এমন প্রাণোচ্ছল, প্রাচুর্যে ভরা তরুণী প্রাণে কেই বা মৃত্যুর কথা চিন্তা করে। নিজের পরিবারকে নিয়ে আরো কতগুলো সময় আনন্দে-উচ্ছলতায় কাটানোর কথা ছিল তার। অথচ বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় মাত্র ২৫ বছর বয়সেই থেমে গেছে এই তরুণ প্রাণ। বিতর্ক, উপস্থাপনা কিংবা যেকোনো আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তানজিলা মৌলি পরিচিত ছিলেন তুখোড় হিসেবে, ছিলেন সবার প্রিয়জন।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন তানজিলা মৌলি। এরপর এসিআই লিমিটেড থেকে ইন্টার্ন শেষে যোগ দেন হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেস নামে একটি ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল অপারেটর প্রতিষ্ঠানে। যার অফিস ছিল বনানীর এফ আর টাওয়ারের ১১তলায়। প্রায় দু’বছর আগে ২০১৭ সালের ৪ঠা আগস্ট নোয়াখালীর ছেলে মো. রায়হানুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয় বগুড়ার সান্তাহারের মেয়ে তানজিলা মৌলির। দুজনেই বেশ ঘুরতে পছন্দ করতেন। সবশেষ নেপাল ও কক্সবাজার ট্যুরের ছবি এখনো ফেসবুকের টাইমলাইনে ভাসছে। স্বামী রায়হানুল ইসলামকে নিয়ে আরো বহু দেশ ঘোরার ইচ্ছে ছিল তানজিলা মৌলির। অথচ বৃহস্পতিবারের আগুন কেড়ে নিয়েছে তার জীবন। স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে প্রিয়তমা স্ত্রীকে। সেদিন প্রচণ্ড ধোঁয়া ও উচ্চতাপে অক্সিজেনের অভাবে মারা যায় তানজিলা মৌলি।
এফ আর টাওয়ারে আটকা পড়ার পর বাবা মাসুদুর রহমান ও স্বামী রায়হানুল ইসলামের সঙ্গে সবশেষ কথা হয় তার। মুঠোফোনের কণ্ঠে ছিল বাঁচার আকুতি, কিন্তু ফোনের এপার থেকে যেন কিছুই করার ছিল না বাবা মাসুদুর রহমানের। বাবা আশ্বস্ত করেছিলেন, মা তোমার কিছু হবে না। দেখো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। খবর পেয়ে বগুড়ার সান্তাহার থেকে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছাতে রাত প্রায় ৯টা বেজে যায়। ততক্ষণে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিথর দেহে পড়ে আছে তানজিলা মৌলির মরদেহ। বাবা মাসুদুর রহমান যে মেয়েকে কথা দিয়েছিলেন তার কিছুই হবে না। মেয়েকে দেয়া কথা তো রইলো না। মেয়ের নিথর দেহের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়া ছাড়া যেন আর কিছুই করার ছিল না বাবার।
প্রাণহীন এক নিথর দেহ নিয়ে বগুড়ার সান্তাহার ফিরেছেন বাবা, একেবারে শেষবারের মতো। তানজিলা মৌলিকে হারানোর বেদনা সান্তাহারবাসীকেও পোড়াচ্ছে। বশিপুর সরদার পাড়ার প্রতিটি বাড়িতে কন্যা হারানোর শোক। তার ছোটবেলার বন্ধু তুলিকা মানবজমিনকে বলেন, মৌলি আর কোনোদিন আসবে না তার প্রিয় সান্তাহারে। দেখা হবে না ওর বন্ধুদের সঙ্গে। কথা হবে না বাবা আর মার সঙ্গে। মিথির ঘরটি শূন্যই থাকবে, যেখানে শিশুকাল থেকে বেড়ে উঠেছে মিষ্টি এই মেয়েটি। কোনোভাবেই মানতে পারছি না এসব। তানজিলা মৌলিকে নিয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সংগঠন বিওয়াইএলসি’র রাইয়ান বিন নূর জানান, মৌলি আপুর সঙ্গে পরিচয় ঠিক দুই বছর আগে।
জুনিয়র ১০ ক্যান্ডিডেটদের ইন্টারভিউ ছিল সেদিন। খুব অল্প সময়ে আপুর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। উনি উনার সুন্দর হাসি দিয়ে সবাইকে খুব সহজেই কাছে টেনে নিতে পারতেন। প্রোগ্রামগুলোতে দেখা আর সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রায়ই কথা হতো। এই তো ক’মাস আগে হঠাৎ ভার্সিটি থেকে বের হয়ে দেখা! একদমই কাছাকাছি দুটো বিল্ডিং বলে প্রায়ই দেখা হতো, এই তো কিছুদিন আগেও হলো। সেদিন দুপুরে যখন আগুনের কথা জানতে পারি তখন মৌলি আপুকে ফোন করে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফেসবুকে নক করতে গিয়ে দেখলাম ঘণ্টা দুয়েক আগেও তিনি অনলাইনে ছিলেন। অথচ এভাবে স্মিত হাসির মানুষটিকে হারাতে হবে ভাবতে চোখে জল চলে আসছে। তানজিলা মৌলির স্বামী রায়হানুল ইসলাম গত নভেম্বরে তার ফেসবুকে কাকতালীয়ভাবে লিখেছিলেন, নো ম্যাটার হাউ গুড ইউ আর, ইউ ক্যান অলয়েজ বি রিপ্লেসড। কয়েক মাস আগে নিছক ভাবনা যে সত্যি হয়ে যাবে তা কে ভেবেছিল! প্রাণখোলা হাসির মৌলিকে হয়তো আজীবন অনুভব করবেন তার স্বামী রায়হানুল ইসলাম।
শেষবারের মতো পাটগ্রামে আবীর
লালমনির হাটের পাটগ্রামের কলেজ রোড এলাকায় বেড়ে উঠেছেন আনজির সিদ্দিক আবীর। উচ্চ শিক্ষার টানে পরিবার ছেড়ে ঢাকায় আসেন মাধ্যমিকের পরপর। ঢাকা থেকে প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরত্বের পাটগ্রাম তবুও ছিল তার বুকের ভেতর। ছুটি পেলেই বাবা-মার কাছে ফিরে যেতেন। বাবা আবু বকর সিদ্দিক, মা তাশরিফা খানম তামান্না আর বড় ভাই তানজীর সিদ্দিককে ঘিরে ছিল আবীরের জীবন। পরিবারের ছোট ছেলে হওয়ায় সেও ছিল সবার কাছে ভীষণ আদরের। গত ২৭শে মার্চ আনজির সিদ্দিক আবীর মধ্যরাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেন ‘মা ছেলে শুয়ে শুয়ে নিউজ ফিড দেখি। আহা, কি আনন্দ! অথচ এমন আনন্দ আর কখনো আবীরের জীবনে ফিরবে না।
বনানীর আগুনের ঘটনা আবীরকে তার প্রিয় পরিবার থেকে বহু দূরে নিয়ে গেছে। যেখানে আর সে চাইলেও তার মায়ের সঙ্গে ফেসবুক টাইমলাইন স্ক্রল করতে পারবে না। জীবনের ওপারে এ আরেক জীবন। লালমনিরহাটের পাটগ্রামের স্থানীয় টিএন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ২০১১ সালে আবীর ভর্তি হন সেন্ট যোসেফ কলেজে। পরে ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় স্নাতকোত্তর শেষ করেন। আবীরের বড় ভাই তানজীর সিদ্দিক ছিল তার জীবনের ছায়ার মতো। পড়াশোনা শেষে ২০১৭ সালের ৪ঠা মার্চ যোগ দেন পুঁজিবাজারে লেনদেন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান মিকা সিকিউরিটিজে। বড় ভাই তানজীর সিদ্দিকও কাজ করেন একই প্রতিষ্ঠানে।
মানবসম্পদ বিভাগে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যে কমপ্লায়েন্স অ্যাণ্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের নির্বাহীর দায়িত্ব পান। বনানীর এফ আর টাওয়ারের ১৪তলায় থাকা মিকা সিকিউরিটিজে গত বৃহস্পতিবারও যথারীতি অফিস করছিলেন আনজির সিদ্দিক আবীর। সেখানে কাজ করা শওকত নামে একজন কর্মী জানান আগুনের ঘটনার দিন তারা সবাই শেয়ারবাজারের লেনদেন মনিটরে ব্যস্ত ছিলেন। দুপুরের দিকে আগুন লাগে বলে তারা টের পান। মিকা সিকিউরিটিজের ৪৫ জন কর্মীর ৪৪ জনই প্রাণে বেঁচে গেলেও মারা যান আবীর। অবশ্য ভবনের সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন আবীর। সিঁড়িতে থাকা অবস্থায় কথা হয়েছিল শওকতের সঙ্গে। তবে বাকি কর্মীরা উপরে ছাদে ওঠে পাশের আহমেদ টাওয়ার দিয়ে নিরাপদে নেমে যেতে পারলেও বাথরুমে থাকায় বের হতে কিছুটা দেরি হয় আবীরের। পরে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সিঁড়িতে গেলে সেখান থেকে আর বেরুতে পারেন নি বলে ধারণা তার সহকর্মীদের।
No comments