রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা, চ্যালেঞ্জের মুখে জামায়াতের রাজনীতি: আরিফের চমক by রোকনুজ্জামান পিয়াস ও ওয়েছ খছরু
সিলেট
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৩২ কেন্দ্রের ফলে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপির মেয়র
প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ৯০৪৯৬ ভোট। তার
নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগের বদরউদ্দিন আহমদ কামরান নৌকা প্রতীকে
পেয়েছেন ৮৫৮৭০ ভোট। এ সিটির ১৩৪ টি কেন্দ্রের মধ্যে গোলযোগের কারণে দুটি
কেন্দ্রে ভোট স্থগিত রয়েছে। এ দুই কেন্দ্রের মোট ভোটার ৪৭৮৭। দুই কেন্দ্রে
ভোট স্থগিত থাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে আরিফুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী ঘোষণা করেনি
নির্বাচন কমিশন। রিটার্নিং কর্মকর্তা আলীমুজ্জামান জানিয়েছেন মঙ্গলবার
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। দিনভর দখল
অনিয়মের অভিযোগের পর রাতে ফল ঘোষণা নিয়ে অনেক নাটকীয়তা হয়েছে। নগরীর ইনডোর
স্টেডিয়ামে নির্বাচন কমিশনের ফলাফল ঘোষণা কেন্দ্রে থেকে ফল ঘোষণা শুরুর পর
থেকেই এ নাটকীয়তার শুরু। সর্বশেষ রাত ১১টায় রির্টারিং কর্মকর্তা ১১১টি
কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করার পর দীর্ঘক্ষণ আর ফল ঘোষণা হয়নি। এই ১১১কেন্দ্রে
বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী সাড়ে চার হাজার ভোটে এগিয়ে ছিলেন। এসময়
ফল ঘোষণা কেন্দ্রে উপস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিছবাহ
উদ্দিন সিরাজ প্রত্যাশিত ফল আসছে না জানিয়ে ফলাফল ঘোষণা স্থগিত রাখতে ইসি
কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন। তিনি বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই রিটার্নিং
কর্মকর্তা ১৩২ কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করেন। ফল ঘোষণার পর বিজয়ী আরিফুল হক
চৌধুরী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ বিজয় সিলেটের জনগণের। তিনি তার
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, সবকিছু ভুলে আমাদের আবার সিলেটবাসীকে
সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। সব কেন্দ্রের ফল ঘোষণার পর বিএনপির
নেতাকর্মীরা নগরীতে বিজয় মিছিল করেন। দিনের শুরুতে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে
এজেন্ট বের করে দেয়া এবং কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন
আরিফুল হক চৌধুরী। তবে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন শাহাদাৎ বরণ করলেও তিনি মাঠ
ছেড়ে যাবেন না। দুপুরের পর ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ আসা নির্বাচন স্থগিত করার
দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। যদিও সন্ধ্যায় ফলাফল আসা শুরুর পর ফল ঘোষণা
কেন্দ্রে হাজির হন বিদায়ী এ মেয়র। তিনি ফল ঘোষণার শেষ পর্যন্ত ইনডোর
স্টেডিয়ামেই অবস্থান করেন। এদিকে নির্বাচনে নিজের কেন্দ্রেই হেরেছেন
আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। তিনি সিলেট সরকারি
পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ভোটার। এই কেন্দ্রের ভোটের ফলে বিএনপির প্রার্থী
আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে ১৩০ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন তিনি। সিলেট সরকারি
পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকে আরিফুল হক চৌধুরী পেয়েছেন
৭৭৬ ভোট। নৌকা প্রতীকে কামরান পেয়েছেন ৬৪৬ ভোট।
এদিকে, সিলেটের এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র ব্যানারে লড়া জামায়াতের প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের পেয়েছেন ১০,৯৫৪ ভোট। এতো প্রচার-প্রচারণার পরও জামায়াত প্রার্থীর এতো কম ভোট পাওয়া দলটির রাজনীতিকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।
এমন ভোট আগে দেখেনি সিলেট
‘শান্তির’ শহরে আজব কিসিমের এক নির্বাচনের সাক্ষী হলো সিলেটের মানুষ। ভোটের মাঠে এবার এমন কিছু দেখলো, যা আগে কখনো দেখেনি তারা। কেন্দ্র দখল, ভোট ডাকাতি, বিরোধীপক্ষকে মারধর, পুলিশের সহযোগিতায় জালভোট, প্রতিপক্ষ এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, ভোটারদের ভোট প্রদানে বাধা, দুপুরেই ব্যালট পেপার শেষÑ কি ছিল না এই নির্বাচনে। নগরবাসী বলছে, এমন ভোট তারা আগে কখনো দেখেনি। হামলার শিকার হয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। দায়িত্বরত সাংবাদিকরাও এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। একের পর এক কেন্দ্র দখলের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান গণমাধ্যম কর্মীরা। কিন্তু ক্যামেরা তাক করা মাত্রই পুলিশসহ সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের ওপর। এসব ঘটনার নির্বাক দর্শক হওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না তাদের। গতকাল সিলেট সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়েছে। ভোট দিতে না পেরে হা-হুতাশ করে অনেকেই ক্ষোভ নিয়ে কেন্দ্র ছেড়েছেন।
সকাল সাড়ে ৮টা। পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের পুরুষ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ২টি ছাড়া আর কোনো বুথেই নেই ধানের শীষের এজেন্ট। জিজ্ঞেস করলে পোলিং অফিসারের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসার ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরীর কক্ষে নির্দিষ্ট সময় পরপর তিন দফা গিয়ে দেখা যায় তার কক্ষটি ছিল তালাবদ্ধ। পনের মিনিট পর চতুর্থবারের মতো তার কক্ষে গেলে দেখা মেলে। এ সময় ধানের শীষের এজেন্ট নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা তিনি বলতে পারবেন না। তাদেরকে কার্ড দেয়া হয়েছে, না আসলে তার কিছুই করার নেই। একই বিদ্যালয়ের মহিলা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কক্ষেই ধানের শীষের এজেন্ট নেই। এদিকে ওই কেন্দ্রে অবস্থানকালীন একের পর এক বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে নৌকার প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে বের করে দেয়ার খবর আসতে থাকে।
নগরীর ২০নং ওয়ার্ডের হাতেম আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। সেখানেও কোনো এজেন্ট পাওয়া যায়নি। বুথের সামনে জটলা পাকিয়ে একদল যুবক বুথের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ সময় ওই কেন্দ্রে থেকে একা বের হচ্ছিলেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি জানান, ২০নং ওয়ার্ডের কোনো কেন্দ্রেই তার এজেন্টদের আসতে দেয়া হয়নি।
সোয়া ১০টার দিকে টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজের ভোট কেন্দ্রে ঢুুকতেই পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়। পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সাংবাদিকদের কেন্দ্রে ঢোকা নিষেধ। তাদেরকে তেমন নির্দেশনাই দেয়া হয়েছে। পরে বাধা উপেক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করলেও বুথে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এ সময় দায়িত্বরত প্রিজাইডিং অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তার কক্ষেও ঢুকতে দেয়া হয়নি। আনসার সদস্যরা তার রুমের সামনে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। তাদের সাফ জবাব, স্যারের সঙ্গে দেখা করা যাবে না। ভোট কেন্দ্রের কয়েকজন অভিযোগ করেন, তার রুমেই জাল ভোট দেয়া হচ্ছে। শাহজালাল উপশহর একাডেমিতে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের মহড়া। কেন্দ্রের ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রে ভোটারের লম্বা লাইন থাকলেও ৫নং বুথের সামনে জটলা। এ সময় ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট লিয়াকত হোসেনকে বের করে দেয় নৌকার সমর্থকরা। এ নিয়ে কিছু সময়ের জন্য সেখানে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। পরে একে একে সব প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়। এই অবস্থায় ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মহিম উদ্দিন বলেন, কেন্দ্র শান্ত রয়েছে। এজেন্টদেরকে বের করে দেয়ার বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, কেউ স্বেচ্ছায় বেরিয়ে গেলে তার কিছুই করার নেই। ওই কেন্দ্রে অবস্থানের সময়ই খবর পাওয়া যায়, নগরীর পাঠানটুলা শাহজালাল জামেয়া ইসলামীয়া কামিল (এমএ) মাদরাসায় সংঘর্ষ চলছে।
১২টার দিকে ওই কেন্দ্রে পৌঁছলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সোয়া ১১টার দিকে কেন্দ্রের বাইরে আখালিয়ার দিক থেকে কামরান সমর্থকরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে কেন্দ্রের দিকে এগুতে থাকে। এ সময় উল্টো দিক থেকে ঘড়ি প্রতীকের সমর্থক ছাত্রশিবিরের লোকজনও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল ছোঁড়ে। এতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির এলাকা থেকে সরে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরপরই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর একদল সমর্থক কেন্দ্রে ঢুকে পড়ে। এ সময় পুলিশের সহযোগিতায় তারা কেন্দ্রের ভেতর থেকে সব ভোটারকে বের করে দেয়। কেন্দ্রের সব বুথ তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। ওই কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, দোতলা ও তিনতলার সব ক’টি বুথ দখলে। বুথের বাইরে একদলের জটলা, ভেতরে আরেকদল জাল ভোটের মহোৎসব চালাচ্ছে। এ সময় জটলা ঠেলে ছবি তুলতে গেলে নয়া দিগন্তের ফটো সাংবাদিক বাপ্পির ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয় বুথের সামনে অবস্থান করা পুলিশের এসআই রহমাতুল্লাহ মিয়া। পরে তোলা ছবিটি ডিলিট করে তার ক্যামেরা ফেরত দেন তিনি। ধাক্কা দিয়ে সাংবাদিক বাপ্পিকে নিচ তলায় নামিয়ে দেন। শুধু পুলিশ কর্মকর্তা রহমাতুল্লাহই নন, বেশির ভাগ পুলিশ সদস্যই ক্যামেরা তাক করা মাত্রই সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। পরে আবারো জাল ভোটের মহোৎসব দেখতে ভবনের তিনতলায় ওঠে ছবি তোলার চেষ্টা করলে এই প্রতিবেদকের মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ ও নৌকার সমর্থকরা। ছবি না ওঠানোর শর্তে সেখানে অবস্থান করলে দেখা যায়, ভেতরে একদল ব্যালটে সিল মারছে, আর দরজা বন্ধ করে পাহারায় আছে সুঠামদেহি এক যুবক। পুলিশ সেখানে ভোটারদের যেতে বাধা দিচ্ছেন। বিশেষ করে এসআই রহমাতুল্লাহ ও কয়েকজন কনস্টেবল এ ব্যাপারে অতি উৎসাহী ভূমিকা পালন করছিলেন। সাংবাদিকরা নির্বাক দর্শক হয়ে জাল ভোটের মহোৎসব চেয়ে চেয়ে দেখেন। আধাঘণ্টা পর নিচ তলার একটি বুথে এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এক যুবক জাল ভোটের ব্যালট সাংবাদিকদের দেখাতে উদ্যত হন। এ সময় নৌকার সমর্থক ও পুলিশ গিয়ে তাকে রুমে আটকে রাখে। পুলিশ ওই রুমে ঢুকে তাকে বেদম মারধর করে। পরে তাকে পুলিশি ভ্যানে তুলে দেয়া হয়। এরও আধাঘণ্টা পর জালভোট দিয়ে দলে দলে লোকজন নিচে নামে। এ সময় আরেক যুবক জাল ভোট দেয়ার কথা সাংবাদিকদের জানালে পুলিশ তাকে বেদম মারধর করে। ওই ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় এই প্রতিবেদকের মোবাইল আরেক দফা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। ঘটনার শুরুতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সিলেটের এক স্থানীয় সাংবাদিক জানান, ঘটনা শুরুর কিছুক্ষণ পর এরশাদুল হক ও আশিক নামে দুই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনার প্যানিক ছড়াচ্ছেন।’ ঘটনার পর থেকে ওই কেন্দ্রে আর কোনো সাধারণ ভোটারকে প্রবেশ করতে দেয়নি পুলিশ। অনেকে ভোট দিতে গেলে জানানো হয়, ব্যালট পেপার শেষ!
বেলা দুইটার আগে-পরে বিভিন্ন কেন্দ্র দখলের খবর আসতে থাকে। সুবিদবাজার এলাকার ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কোনো ভোটারকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ওই কেন্দ্রের ভেতরে তখনো জাল ভোট চলছিল। এ সময় ছবি তুলতে গেলে আবারো সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। ঘণ্টাখানেক পরে সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেয় পুলিশ। তবে আইডি কার্ড দেখিয়ে। অনেকে ভোটার নাম্বার বললেও কার্ড দেখাতে না পারায় কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. নাবিল আহমেদ অভিযোগ করেন, তাকে একঘণ্টা ধরে কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। এ সময় ওই প্রতিষ্ঠানের মহিলা ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দু’জন করে ভোটার ভেতরে ঢুকবে। তারা ভোট দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলে পরবর্তী দু’জন ঢুকবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুপুর একটা থেকে দুইটা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকার ভোট কেন্দ্রে পুলিশ সাধারণ ভোটারদের প্রবেশে বাধা দেয়। ওই সময়ই কেন্দ্র দখল করে জালভোটের মহোৎসব চলে। এদিকে এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরিবেশ দেখে নগরবাসী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, অতীতে সিলেটে এমন ভোট কেউ দেখেনি। এতে ভোটারদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই ভোট সিলেটের ঐতিহ্য ‘সম্প্রীতি’কে নষ্ট করে দিয়েছে।
এদিকে, সিলেটের এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র ব্যানারে লড়া জামায়াতের প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের পেয়েছেন ১০,৯৫৪ ভোট। এতো প্রচার-প্রচারণার পরও জামায়াত প্রার্থীর এতো কম ভোট পাওয়া দলটির রাজনীতিকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।
এমন ভোট আগে দেখেনি সিলেট
‘শান্তির’ শহরে আজব কিসিমের এক নির্বাচনের সাক্ষী হলো সিলেটের মানুষ। ভোটের মাঠে এবার এমন কিছু দেখলো, যা আগে কখনো দেখেনি তারা। কেন্দ্র দখল, ভোট ডাকাতি, বিরোধীপক্ষকে মারধর, পুলিশের সহযোগিতায় জালভোট, প্রতিপক্ষ এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, ভোটারদের ভোট প্রদানে বাধা, দুপুরেই ব্যালট পেপার শেষÑ কি ছিল না এই নির্বাচনে। নগরবাসী বলছে, এমন ভোট তারা আগে কখনো দেখেনি। হামলার শিকার হয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। দায়িত্বরত সাংবাদিকরাও এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। একের পর এক কেন্দ্র দখলের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান গণমাধ্যম কর্মীরা। কিন্তু ক্যামেরা তাক করা মাত্রই পুলিশসহ সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের ওপর। এসব ঘটনার নির্বাক দর্শক হওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না তাদের। গতকাল সিলেট সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়েছে। ভোট দিতে না পেরে হা-হুতাশ করে অনেকেই ক্ষোভ নিয়ে কেন্দ্র ছেড়েছেন।
সকাল সাড়ে ৮টা। পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের পুরুষ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ২টি ছাড়া আর কোনো বুথেই নেই ধানের শীষের এজেন্ট। জিজ্ঞেস করলে পোলিং অফিসারের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসার ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরীর কক্ষে নির্দিষ্ট সময় পরপর তিন দফা গিয়ে দেখা যায় তার কক্ষটি ছিল তালাবদ্ধ। পনের মিনিট পর চতুর্থবারের মতো তার কক্ষে গেলে দেখা মেলে। এ সময় ধানের শীষের এজেন্ট নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা তিনি বলতে পারবেন না। তাদেরকে কার্ড দেয়া হয়েছে, না আসলে তার কিছুই করার নেই। একই বিদ্যালয়ের মহিলা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কক্ষেই ধানের শীষের এজেন্ট নেই। এদিকে ওই কেন্দ্রে অবস্থানকালীন একের পর এক বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে নৌকার প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে বের করে দেয়ার খবর আসতে থাকে।
নগরীর ২০নং ওয়ার্ডের হাতেম আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। সেখানেও কোনো এজেন্ট পাওয়া যায়নি। বুথের সামনে জটলা পাকিয়ে একদল যুবক বুথের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ সময় ওই কেন্দ্রে থেকে একা বের হচ্ছিলেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি জানান, ২০নং ওয়ার্ডের কোনো কেন্দ্রেই তার এজেন্টদের আসতে দেয়া হয়নি।
সোয়া ১০টার দিকে টিলাগড় এলাকার এমসি কলেজের ভোট কেন্দ্রে ঢুুকতেই পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়। পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সাংবাদিকদের কেন্দ্রে ঢোকা নিষেধ। তাদেরকে তেমন নির্দেশনাই দেয়া হয়েছে। পরে বাধা উপেক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করলেও বুথে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এ সময় দায়িত্বরত প্রিজাইডিং অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তার কক্ষেও ঢুকতে দেয়া হয়নি। আনসার সদস্যরা তার রুমের সামনে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। তাদের সাফ জবাব, স্যারের সঙ্গে দেখা করা যাবে না। ভোট কেন্দ্রের কয়েকজন অভিযোগ করেন, তার রুমেই জাল ভোট দেয়া হচ্ছে। শাহজালাল উপশহর একাডেমিতে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের মহড়া। কেন্দ্রের ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রে ভোটারের লম্বা লাইন থাকলেও ৫নং বুথের সামনে জটলা। এ সময় ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট লিয়াকত হোসেনকে বের করে দেয় নৌকার সমর্থকরা। এ নিয়ে কিছু সময়ের জন্য সেখানে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। পরে একে একে সব প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়। এই অবস্থায় ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মহিম উদ্দিন বলেন, কেন্দ্র শান্ত রয়েছে। এজেন্টদেরকে বের করে দেয়ার বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, কেউ স্বেচ্ছায় বেরিয়ে গেলে তার কিছুই করার নেই। ওই কেন্দ্রে অবস্থানের সময়ই খবর পাওয়া যায়, নগরীর পাঠানটুলা শাহজালাল জামেয়া ইসলামীয়া কামিল (এমএ) মাদরাসায় সংঘর্ষ চলছে।
১২টার দিকে ওই কেন্দ্রে পৌঁছলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সোয়া ১১টার দিকে কেন্দ্রের বাইরে আখালিয়ার দিক থেকে কামরান সমর্থকরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে কেন্দ্রের দিকে এগুতে থাকে। এ সময় উল্টো দিক থেকে ঘড়ি প্রতীকের সমর্থক ছাত্রশিবিরের লোকজনও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল ছোঁড়ে। এতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির এলাকা থেকে সরে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরপরই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর একদল সমর্থক কেন্দ্রে ঢুকে পড়ে। এ সময় পুলিশের সহযোগিতায় তারা কেন্দ্রের ভেতর থেকে সব ভোটারকে বের করে দেয়। কেন্দ্রের সব বুথ তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। ওই কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, দোতলা ও তিনতলার সব ক’টি বুথ দখলে। বুথের বাইরে একদলের জটলা, ভেতরে আরেকদল জাল ভোটের মহোৎসব চালাচ্ছে। এ সময় জটলা ঠেলে ছবি তুলতে গেলে নয়া দিগন্তের ফটো সাংবাদিক বাপ্পির ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয় বুথের সামনে অবস্থান করা পুলিশের এসআই রহমাতুল্লাহ মিয়া। পরে তোলা ছবিটি ডিলিট করে তার ক্যামেরা ফেরত দেন তিনি। ধাক্কা দিয়ে সাংবাদিক বাপ্পিকে নিচ তলায় নামিয়ে দেন। শুধু পুলিশ কর্মকর্তা রহমাতুল্লাহই নন, বেশির ভাগ পুলিশ সদস্যই ক্যামেরা তাক করা মাত্রই সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। পরে আবারো জাল ভোটের মহোৎসব দেখতে ভবনের তিনতলায় ওঠে ছবি তোলার চেষ্টা করলে এই প্রতিবেদকের মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ ও নৌকার সমর্থকরা। ছবি না ওঠানোর শর্তে সেখানে অবস্থান করলে দেখা যায়, ভেতরে একদল ব্যালটে সিল মারছে, আর দরজা বন্ধ করে পাহারায় আছে সুঠামদেহি এক যুবক। পুলিশ সেখানে ভোটারদের যেতে বাধা দিচ্ছেন। বিশেষ করে এসআই রহমাতুল্লাহ ও কয়েকজন কনস্টেবল এ ব্যাপারে অতি উৎসাহী ভূমিকা পালন করছিলেন। সাংবাদিকরা নির্বাক দর্শক হয়ে জাল ভোটের মহোৎসব চেয়ে চেয়ে দেখেন। আধাঘণ্টা পর নিচ তলার একটি বুথে এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এক যুবক জাল ভোটের ব্যালট সাংবাদিকদের দেখাতে উদ্যত হন। এ সময় নৌকার সমর্থক ও পুলিশ গিয়ে তাকে রুমে আটকে রাখে। পুলিশ ওই রুমে ঢুকে তাকে বেদম মারধর করে। পরে তাকে পুলিশি ভ্যানে তুলে দেয়া হয়। এরও আধাঘণ্টা পর জালভোট দিয়ে দলে দলে লোকজন নিচে নামে। এ সময় আরেক যুবক জাল ভোট দেয়ার কথা সাংবাদিকদের জানালে পুলিশ তাকে বেদম মারধর করে। ওই ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় এই প্রতিবেদকের মোবাইল আরেক দফা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। ঘটনার শুরুতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সিলেটের এক স্থানীয় সাংবাদিক জানান, ঘটনা শুরুর কিছুক্ষণ পর এরশাদুল হক ও আশিক নামে দুই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনার প্যানিক ছড়াচ্ছেন।’ ঘটনার পর থেকে ওই কেন্দ্রে আর কোনো সাধারণ ভোটারকে প্রবেশ করতে দেয়নি পুলিশ। অনেকে ভোট দিতে গেলে জানানো হয়, ব্যালট পেপার শেষ!
বেলা দুইটার আগে-পরে বিভিন্ন কেন্দ্র দখলের খবর আসতে থাকে। সুবিদবাজার এলাকার ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কোনো ভোটারকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ওই কেন্দ্রের ভেতরে তখনো জাল ভোট চলছিল। এ সময় ছবি তুলতে গেলে আবারো সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। ঘণ্টাখানেক পরে সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেয় পুলিশ। তবে আইডি কার্ড দেখিয়ে। অনেকে ভোটার নাম্বার বললেও কার্ড দেখাতে না পারায় কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. নাবিল আহমেদ অভিযোগ করেন, তাকে একঘণ্টা ধরে কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। এ সময় ওই প্রতিষ্ঠানের মহিলা ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দু’জন করে ভোটার ভেতরে ঢুকবে। তারা ভোট দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলে পরবর্তী দু’জন ঢুকবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুপুর একটা থেকে দুইটা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকার ভোট কেন্দ্রে পুলিশ সাধারণ ভোটারদের প্রবেশে বাধা দেয়। ওই সময়ই কেন্দ্র দখল করে জালভোটের মহোৎসব চলে। এদিকে এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরিবেশ দেখে নগরবাসী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, অতীতে সিলেটে এমন ভোট কেউ দেখেনি। এতে ভোটারদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই ভোট সিলেটের ঐতিহ্য ‘সম্প্রীতি’কে নষ্ট করে দিয়েছে।
No comments