শিয়া সমাবেশে গ্রেনেড: অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় নতুন উদ্বেগ by এম সাখাওয়াত হোসেন

দেশের দুই প্রান্তের দুই জায়গায় দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা নিয়ে কূটনৈতিক মহলের উদ্বিগ্নতা ও সরকারের বিড়ম্বনার রেশ কাটতে না-কাটতেই রাজধানী ঢাকায় পর পর দুটি ঘটনা ঘটে গেল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজাগানিয়া হলো হোসেনি দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের আশুরা পালনের উদ্যোগে তাজিয়া মিছিল প্রস্তুতকালে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ওই সময় সেখানে পুলিশের প্রহরা তো ছিলই, এমনকি সাদা পোশাকেও পুলিশের উপস্থিতি ছিল। জানা গেছে, পুলিশের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ওই সময় তাজিয়া মিছিল বের করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। হামলায় একজনের প্রাণহানি ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
শিয়া সমাবেশে হামলা বাংলাদেশে এক অভাবনীয় বিষয়। কারণ শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলে শিয়া-সুন্নির মধ্যে কোনো তফাত খুঁজতে কেউ যায়নি, আক্রমণ তো দূরের কথা। বাংলায় সুলতানি আমল থেকে শুরু করে সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত অনেক শাসক ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের। তখন যেমন এ বিভাজন নিয়ে বাংলা অঞ্চলে প্রশ্ন ওঠেনি, তেমনি পূর্ব পাকিস্তান থাকার সময় থেকে অক্টোবর ২৩, ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মাথায় এ ধরনের কোনো বিষয় এসেছে বলে মনে হয়নি। এমনিতে বাংলাদেশে শিয়া মুসলমানদের সংখ্যা উপমহাদেশের যেকোনো রাষ্ট্র থেকে কম এবং এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থী হওয়ার কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। সে কারণেই এই হামলা একধরনের বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হয়েছে, বিশেষ করে দেশে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার পেছনে ‘জঙ্গি আছে, জঙ্গি নেই’ বিতর্ক যখন তুঙ্গে। সরকারের সব ধরনের চেষ্টা সত্ত্বেও বিদেশিরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না।
আন্তমুসলমান বিবাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই শিয়া-সুন্নির বিভেদ দারুণভাবে বিভক্ত করেছে তথাকথিত সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে। পাকিস্তান থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত এই বিভাজন এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে এই বিভাজনের পেছনে বিশ্বের একক শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রান্ত পররাষ্ট্রনীতির অবদান রয়েছে। ইতিহাসের পাতায় শিয়া-সুন্নি বিবাদ থাকলেও তা বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ের মতো নয়। পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি বিবাদকে বৃহত্তর আঙ্গিকে উদয় হতে দেখা গেছে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের চলে যাওয়ার পর।
পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি বিভেদ তৈরি হওয়ার পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত। প্রথমত, ১৯৭৯ সালে রেজা শাহ পাহলভির উৎখাতের পর শিয়া ধর্মীয় রাষ্ট্রের উত্থান এবং যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বিবাদ, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জিম্মি সংকট; দ্বিতীয়ত, প্রায় একই সময়ে ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারি এবং পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সুন্নি মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর সহায়তায় জিহাদ ঘোষণা। ওই জিহাদের সম্মুখে ছিল সুন্নি-অধ্যুষিত পাকিস্তান এবং আধ্যাত্মিক ও আর্থিক প্রেরণায় ছিল সৌদি আরব। প্রায় এক ডজন মুজাহিদ সংগঠন, যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল, তাদের মধ্যে আটটি গোষ্ঠীকে পাকিস্তানের মাধ্যমে অস্ত্র, বাসস্থান ও অর্থের জোগান দেওয়া হয়েছিল। এদের প্রায় সবাই ছিল সুন্নিগোষ্ঠী, এমনকি ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদাও ছিল সুন্নিগোষ্ঠীর সংগঠন, যার মধ্য থেকে পরবর্তী পর্যায়ে জন্ম নেয় হরকাতুল জিহাদ, লস্কর-ই-তাইয়েবাসহ একাধিক সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত গোষ্ঠী। বাংলাদেশেও গঠিত হয় হরকাতুল জিহাদ বা হুজি (বি), যার অনুপ্রেরণায় জন্ম জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ। ওই একই আদর্শে আরও কিছু সংগঠন গড়ে ওঠে, যার মধ্য শীর্ষে রয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এবং আরও কিছু ছোট চরমপন্থী দল।
মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি বিবাদ উসকে দেওয়ার পেছনে রয়েছে আফগানযুদ্ধে ইরানের ভূমিকা এবং চারটি মুজাহিদীন দলকে সহযোগিতা দেওয়া। এর সবই শিয়া-অধ্যুষিত ইরানসংলগ্ন পশ্চিম আফগানিস্তানের মুজাহিদীন সংগঠন। এরা ছিল শিয়া হাজারা ও আজিক গোত্রের মুজাহিদীন। এখনো ইরানের কারণে আফগানিস্তানে শিয়া-সুন্নি বিভেদ বিদ্যমান। ইরান তৎকালীন নর্দান অ্যালায়েন্সকে সহযোগিতা করায় তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর একজন ইরানি কূটনীতিকসহ মাজার-ই-শরিফে বহু হাজারা শিয়াকে নিধন করে।
তৃতীয়ত, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে এবং সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইরাক-ইরান যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম হোসেনকে দিয়ে ইরানের ক্ষমতাকে খর্ব করতে চেয়েছিল, যা ওই সময়ে ইরানের শিয়া শক্তিকে দমাতে পারত। সৌদি আরবসহ সুন্নি আরব রাষ্ট্রগুলো সাদ্দাম হোসেনকে এ কারণেই মূলত সহযোগিতা করেছিল। ইরাকযুদ্ধের কারণে আফগানিস্তানে শিয়া শক্তির উত্থান ঘটাতে পারেনি। এসব পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের ভূমিকার কারণে সেখানে সুন্নি শক্তি তালেবানদের উত্থান ঘটে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় লাদেনের ভূমিকা। পাকিস্তানের সুন্নি জিহাদি গোষ্ঠীকে শিয়াদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আশির দশক থেকেই শিয়া-অধ্যুষিত করাচি ও বেলুচিস্তান তথা পাঞ্জাবের কিছু অংশে গোষ্ঠিগত বিবাদ ও দাঙ্গা–হাঙ্গামা চলতে থাকে।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের প্রেক্ষাপটেরও রয়েছে শিয়া-সুন্নির আধিপত্যের লড়াই। একদিকে সুন্নি রাষ্ট্রশক্তি সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলো; অপর দিকে ইরান, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের শিয়াপ্রধান সরকার। স্মরণযোগ্য যে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইরাকে শিয়া শক্তির উত্থান হওয়ায় ওই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইরাকে শিয়া-সুন্নি সংঘাত, যার ভয়াবহতা সম্বন্ধে কমবেশি সবাই অবগত।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতের এক প্রান্তে ইরান, অপর প্রান্তে সৌদি আরব। এ সংঘাতের মধ্যেই জন্ম নিয়েছে এযাবৎকালের সবচেয়ে সংগঠিত সুন্নি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এদের মূল লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্যে তথা সিরিয়া ও ইরাকে শিয়া শক্তির উৎখাত। অপর দিকে ইয়েমেনে শিয়া শক্তি দমনে সৌদি আরবের শক্তি প্রদর্শন। ইয়েমেনের পরিস্থিতির জন্য সৌদি আরব অনবরত ইরাককে দায়ী করছে। এমনকি বাহরাইনে খলিফা পরিবারের শাসনের অবসান চেয়ে ১৯৯০-এর দশকে এবং ২০১১ সালে যে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়, সেটাকেও শিয়া অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ওই অভ্যুত্থান ঠেকাতে সৌদি আরব তার সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছিল। বাহরাইনে প্রায় ৬৫ শতাংশ শিয়া মুসলমান।
যা-ই হোক, বর্তমানে শুধু সৌদি আরবই নয়, আইএসের অন্যতম লক্ষ্য সুন্নি-অধ্যুষিত অঞ্চল গঠন এবং শিয়াদের উৎখাত। আইএসের ঘোষিত তথাকথিত ইসলামি খেলাফত হবে সুন্নি-অধ্যুষিত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিয়া-সুন্নি বিভাজনে পড়েছে পাকিস্তান থেকে মধ্যপ্রাচ্য। আইএস অনেকটাই ওয়াহাবি মতবাদে দীক্ষিত। তবে ওয়াহাবিদের চেয়ে এক ধাপ ওপরে।
পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে হাজারা শিয়া-অধ্যুষিত অঞ্চলে দেওবন্দি কট্টরপন্থী গোষ্ঠীর অনবরত হামলায় জর্জরিত বেলুচিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল, যার মধ্যে রাজধানী কোয়েটা অন্যতম। পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা চলছে তিন দশক ধরে। সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৮৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৭০০ শিয়া মুসলমান নিহত ও ৭ হাজার ৭০০ জন আহত হয়েছেন। এবারও (অক্টোবর ২২, ২০১৫) মহররমের দশম দিনের প্রাক্কালে বেলুচিস্তানের ভাগ নামক শহরে মসজিদে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও ২০ জন শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য আহত হয়েছেন। এখন এ হামলার পেছনে কাদের হাত রয়েছে, তা পরিষ্কার না হলে তালেবানদের একাংশ, যারা আইএসের নেতৃত্বে আনুগত্য প্রকাশ করেছে, তাদের সন্দেহ করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের শিয়া মসজিদে হামলার এক দিন পরই বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম শিয়া ইমামবাড়ায় আশুরার প্রাক্কালে এই হামলা হয়েছে। এই হামলা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপরই শুধু নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তাতে আরেকটি নতুন উদ্বেগের কারণ যুক্ত করেছে। যদিও ওই হামলার পর আশুরার অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে, তথাপি আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় যে অশনিসংকেত রয়েছে, তার মাত্রা আরও বাড়বে।
ইমামবাড়ার এ হামলার ঘটনা বিদেশিদের উৎকণ্ঠা না কমিয়ে বরং বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ধরনের হামলার আগাম কোনো তথ্য আমাদের গোয়েন্দাদের কাছে কতখানি ছিল, সে তথ্য জানা না থাকলেও পুলিশের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে ধারণা করা যায় যে কিছু তথ্য নিশ্চয়ই ছিল। এ ঘটনাকে যত সহজ ভাবা যায়, তেমনটি নয়। ধরন দেখে মনে হয় যে এতে ধর্মীয় ভিন্নপন্থীদের হাত আছে। অতীতের কয়েকটি হত্যাকাণ্ড, যা ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ার কারণে ঘটেছে বলে ধারণা করা যায়, তার সঙ্গে এর যোগসূত্র রয়েছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখার বিষয়। এ ঘটনায় আইএস দায়িত্ব স্বীকার করেছে বলে যে খবর বের হয়েছে, তার সত্যতাও নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কাজেই এ ঘটনার গভীরে তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এ সবই দেশকে অস্থির অবস্থায় নিয়ে যাবে। প্রয়োজন নির্মোহ তদন্ত। কোনো সম্প্রদায়ের ওপর হামলা স্বাধীন বাংলাদেশে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এ ধরনের হামলার নিন্দা জানাই।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.