গোয়েন্দা তথ্য ছিল তবুও বোমা হামলা by তোহুর আহমদ
ভয়ংকর হামলার পরিকল্পনা ছিল * বোমা জঙ্গির, হামলা চালিয়েছে জামায়াত-শিবির * ভিডিও দৃশ্যে ২ হামলাকারী শনাক্ত
হোসনি
দালানে বোমা হামলার আগাম গোয়েন্দা তথ্য ছিল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তরফে
হামলার আশংকার কথা যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের জানানো হয়। গত
সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর
উচ্চপর্যায়ের যৌথসভায় হামলার বিষয়ে সরকারকে আগাম পূর্বাভাস দেয়া হয়। তবুও
হামলা ঠেকানো যায়নি। এতে করে হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার দায় কার- তা নিয়ে বড়
ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
তবে ব্যর্থতার দায়ভার যারই হোক না কেন শিয়া ধর্মাবলম্বীদের ‘ত্যাগ ও শোকে’র অনুষ্ঠানে বর্বরোচিত এ হামলায় ঝরে গেছে একটি তাজা প্রাণ। এখনও আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে।
এদিকে তাভেল্লা ও কুনিও হোশি খুনের পর নৃশংস এ হামলার ঘটনায় দেশের ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। এমনকি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সামর্থ্য নিয়ে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, হোসনি দালানে নাশকতা হতে পারে এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য তাদের কাছে ছিল। রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। বৈঠকে শুক্রবার ইমামবাড়ায় জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও শনিবার তাজিয়া মিছিলে ব্যাপক নিরাপত্তা নেয়ারও সুপারিশ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে মাঠ পর্যায়ে এসব সুপারিশ কার্যকর হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শুক্রবার মধ্য রাতে ইমামবাড়ায় ব্যাপক জনসমাগম ঘটলেও নিরাপত্তা ছিল একেবারেই ঢিলেঢালা। স্থানীয় থানা পুলিশের কর্মকর্তারাও বলছেন, হামলাসংক্রান্ত কোনো আগাম পূর্বাভাস তাদের কাছে পৌঁছায়নি। অবশ্য নিরাপত্তা ঘাটতির কথা স্বীকার করতে রাজি নয় পুলিশ। এ সংক্রান্ত মামলার এজাহারেও বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলের নিরাপত্তা ছিল যথেষ্ট। প্রায় ৪০ জন পুলিশের একটি দল নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, আগাম তথ্য থাকার বিষয়টি তার জানা নেই। তবে ঈদ, পূজা থেকে শুরু করে যে কোনো বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। সে অনুযায়ী ফোর্স মোতায়েন থাকে। তাই নিরাপত্তা ঘাটতির অভিযোগ মোটেও সঠিক নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তবে এ ঘটনার তদন্ত চলছে। একদিকে জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে তদন্তে নিরাপত্তা দুর্বলতা বেরিয়ে এলে সে বিষয়েও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভিডিওফুটেজ পর্যালোচনা : ইমামবাড়ার প্রধান ফটকের সিসি ক্যামেরাসহ ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত ৩২টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ফুটেজ পর্যালোচনা করে হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে আইনশৃংখলা বাহিনীর একাধিক টিম। ফুটেজ পর্যালোচনার জন্য র্যাবের গোয়েন্দা শাখায় পৃথক একটি টিমও গঠন করা হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, হামলার আগে ও পরে ধারণকৃত ভিডিও দৃশ্য পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তবে ভিডিও চিত্র থেকে ২ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের একটি অংশ আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এ অংশটুকুতেই ‘গুরত্বপূর্ণ’ তথ্য রয়েছে। যুগান্তরের হাতে আসা এসব ফুটেজের একটি অংশে দেখা যায়, ইমামবাড়ার প্রাচীরসংলগ্ন জায়গা থেকে পাগড়ি পরিহিত এক ব্যক্তি পরপর দু’বার লাফিয়ে উঠে ধাতব কিছু একটা ছুড়ে দিচ্ছেন। এর পরপরই জনসমাগমে হইচই পড়ে যায়। অনেককে দিগি¦দিক ছুটে পালাতে দেখা যায়। তবে আলো-আঁধারির মধ্যে ওই ব্যক্তির চেহারা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি।
পুলিশ বলছে, এভাবে অন্তত ৫টি বোমা জনতার ভিড়ে ছুড়ে দেয়া হয়। যার একটি বিস্ফোরিত হলেও বাকিগুলো সৌভাগ্যক্রমে বিস্ফোরিত হয়নি।
পুলিশের এক বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ উদ্ধারকৃত বোমার প্রস্তুত প্রণালি হাতে-কলমে যুগান্তর প্রতিবেদককে দেখান। তিনি বলছেন, এটি স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপাদান দিয়ে তৈরিকৃত বোমা। ইস্পাতের জিআই পাইপ ছোট ছোট খণ্ডে কেটে বোমার খোলসটি তৈরি করা হয়েছে। এরপর এতে কয়েকটি ফুটো করে বসানো হয়েছে, প্লাস্টিকের ডেটোনেটর ও সুইজ। ব্যাপক হতাহত করতে স্প্রিন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সিসার খণ্ড ও ইস্পাতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বল। বোমা তৈরির শেষ ধাপে জিআই পাইপের ছোট খণ্ডের মধ্যে এসব সরঞ্জাম বসানোর পর তা টেপ দিয়ে মুড়ে উপরে পিন বা চাবি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। পিন খুলে গড়িয়ে দিলেই সেটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।
ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণের পর একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তাদের ধারণা- গণজমায়েতের মধ্যে ঢুকে সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থা নেয় হামলাকারীরা। এরপর বোমার পিন খুলে জনতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তবে অন্তত একটি বোমা ছোড়া হয়েছে বাইরে থেকে। ইমামবাড়া সংলগ্ন কবরস্থানের একটি কর্নার থেকেও একটি বোমা ছোড়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয় দলের প্রধান অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, মোট ৫টি বোমা ছোড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাত্র ২ থেকে ৩ ব্যক্তি এগুলো গণজমায়েতের মধ্যে ছুড়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে র্যাব-১০-এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘ঘটনাস্থলের আশপাশে তল্লাশি চালিয়ে মোট ৫টি পিন উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়াও দুটি অবিস্ফোরিত বোমা ও একটি বিস্ফোরিত বোমার স্প্রিন্টারও উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত এসব আলামত পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানায়, এ ধরনের বোমা চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হামজা ব্রিগেডের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির সময়েও এ ধরনের বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বছর কয়েক আগে টাঙ্গাইল থেকেও একই ধরনের বোমা উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ যুগান্তারকে বলেন, হামলায় ব্যবহৃত বোমা জেএমবিসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের কাছ থেকে এর আগেও উদ্ধার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির সময় একই ধরনের বোমা ব্যবহার করা হয়। তাই সবদিক মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে।
এদিকে নৃশংস এ হামলা নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা বৈপরীত্য দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে আইনশৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, এ ঘটনার পেছনে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট। তবে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত অবিস্ফোরিত বোমা পরীক্ষা করে দেখা গেছে এগুলো বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন ব্যবহার করে। জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা থেকেও এ ধরনের বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এমন এক বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে- তাহলে এ হামলার দায় কার। জামায়াত-শিবির হামলায় জড়িত থাকলে জঙ্গিদের বোমা এল কোথা থেকে? আবার হামলায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা থাকলে জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততা কি তবে রাজনৈতিক? তবে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখন জামায়াত-শিবির আর জঙ্গির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের আড়াল করতে জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা জঙ্গি স্টাইলে এ ধরনের হামলা চালাচ্ছে। এসব বোমার কারিগর তারাই। তিনি বলেন, বিষয়টিকে আরও সহজভাবে বললে এটাই বলতে হবে, বোমা জঙ্গির হামলা চালিয়েছে জামায়াত-শিবির।
এদিকে এমন জট পাকিয়ে ওঠা বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস’র নামে হামলার দায় স্বীকারের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, হামলার পর আইএস’র দায় স্বীকারের বিষয়টি এখন হাস্যকর পর্যায়ে পড়েছে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান শুক্রবার মধ্যরাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে যুগান্তরকে বলেন, হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত। তাদের পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের মতো বীভৎস হতাহতের ঘটনা ঘটানো। কিন্তু র্যাবের তৎপরতার কারণে ‘ক্যাজুয়ালিটি’ (হতাহত) কমানো গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হামলাকারীদের সম্পর্কে আমরা বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি। আশা করছি তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (মিডিয়া) নজরুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, আইএস’র টার্গেটের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর কোনো মিল নেই। তাছাড়া ঘটনার দীর্ঘ সময় পর আইএস’র নামে দায় স্বীকারের টুইট বার্তা হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আইএস’র নাম ব্যবহার করে ঘটনার দায়ভার অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলছে।’
শোকের এই দিনে কারা এ হামলা চালাতে পারে, এমন প্রশ্ন করা হলে ঢাকার ইমামবাড়ার বৃদ্ধ শিয়া মুসলমান আলাউদ্দীন আব্বাস বলেন, ‘আর কেউ নয়, ইয়াজিদের বংশধররাই এ হামলা করেছে। তবে তাদের শেষ রক্ষা হবে না।’
তবে ব্যর্থতার দায়ভার যারই হোক না কেন শিয়া ধর্মাবলম্বীদের ‘ত্যাগ ও শোকে’র অনুষ্ঠানে বর্বরোচিত এ হামলায় ঝরে গেছে একটি তাজা প্রাণ। এখনও আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের চিকিৎসা চলছে হাসপাতালে।
এদিকে তাভেল্লা ও কুনিও হোশি খুনের পর নৃশংস এ হামলার ঘটনায় দেশের ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। এমনকি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সামর্থ্য নিয়ে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, হোসনি দালানে নাশকতা হতে পারে এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য তাদের কাছে ছিল। রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। বৈঠকে শুক্রবার ইমামবাড়ায় জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও শনিবার তাজিয়া মিছিলে ব্যাপক নিরাপত্তা নেয়ারও সুপারিশ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে মাঠ পর্যায়ে এসব সুপারিশ কার্যকর হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, শুক্রবার মধ্য রাতে ইমামবাড়ায় ব্যাপক জনসমাগম ঘটলেও নিরাপত্তা ছিল একেবারেই ঢিলেঢালা। স্থানীয় থানা পুলিশের কর্মকর্তারাও বলছেন, হামলাসংক্রান্ত কোনো আগাম পূর্বাভাস তাদের কাছে পৌঁছায়নি। অবশ্য নিরাপত্তা ঘাটতির কথা স্বীকার করতে রাজি নয় পুলিশ। এ সংক্রান্ত মামলার এজাহারেও বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলের নিরাপত্তা ছিল যথেষ্ট। প্রায় ৪০ জন পুলিশের একটি দল নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, আগাম তথ্য থাকার বিষয়টি তার জানা নেই। তবে ঈদ, পূজা থেকে শুরু করে যে কোনো বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পুলিশের পক্ষ থেকে একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। সে অনুযায়ী ফোর্স মোতায়েন থাকে। তাই নিরাপত্তা ঘাটতির অভিযোগ মোটেও সঠিক নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তবে এ ঘটনার তদন্ত চলছে। একদিকে জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে তদন্তে নিরাপত্তা দুর্বলতা বেরিয়ে এলে সে বিষয়েও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভিডিওফুটেজ পর্যালোচনা : ইমামবাড়ার প্রধান ফটকের সিসি ক্যামেরাসহ ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত ৩২টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ফুটেজ পর্যালোচনা করে হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে আইনশৃংখলা বাহিনীর একাধিক টিম। ফুটেজ পর্যালোচনার জন্য র্যাবের গোয়েন্দা শাখায় পৃথক একটি টিমও গঠন করা হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, হামলার আগে ও পরে ধারণকৃত ভিডিও দৃশ্য পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তবে ভিডিও চিত্র থেকে ২ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডের একটি অংশ আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এ অংশটুকুতেই ‘গুরত্বপূর্ণ’ তথ্য রয়েছে। যুগান্তরের হাতে আসা এসব ফুটেজের একটি অংশে দেখা যায়, ইমামবাড়ার প্রাচীরসংলগ্ন জায়গা থেকে পাগড়ি পরিহিত এক ব্যক্তি পরপর দু’বার লাফিয়ে উঠে ধাতব কিছু একটা ছুড়ে দিচ্ছেন। এর পরপরই জনসমাগমে হইচই পড়ে যায়। অনেককে দিগি¦দিক ছুটে পালাতে দেখা যায়। তবে আলো-আঁধারির মধ্যে ওই ব্যক্তির চেহারা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েনি।
পুলিশ বলছে, এভাবে অন্তত ৫টি বোমা জনতার ভিড়ে ছুড়ে দেয়া হয়। যার একটি বিস্ফোরিত হলেও বাকিগুলো সৌভাগ্যক্রমে বিস্ফোরিত হয়নি।
পুলিশের এক বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ উদ্ধারকৃত বোমার প্রস্তুত প্রণালি হাতে-কলমে যুগান্তর প্রতিবেদককে দেখান। তিনি বলছেন, এটি স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপাদান দিয়ে তৈরিকৃত বোমা। ইস্পাতের জিআই পাইপ ছোট ছোট খণ্ডে কেটে বোমার খোলসটি তৈরি করা হয়েছে। এরপর এতে কয়েকটি ফুটো করে বসানো হয়েছে, প্লাস্টিকের ডেটোনেটর ও সুইজ। ব্যাপক হতাহত করতে স্প্রিন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সিসার খণ্ড ও ইস্পাতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বল। বোমা তৈরির শেষ ধাপে জিআই পাইপের ছোট খণ্ডের মধ্যে এসব সরঞ্জাম বসানোর পর তা টেপ দিয়ে মুড়ে উপরে পিন বা চাবি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। পিন খুলে গড়িয়ে দিলেই সেটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।
ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণের পর একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তাদের ধারণা- গণজমায়েতের মধ্যে ঢুকে সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থা নেয় হামলাকারীরা। এরপর বোমার পিন খুলে জনতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তবে অন্তত একটি বোমা ছোড়া হয়েছে বাইরে থেকে। ইমামবাড়া সংলগ্ন কবরস্থানের একটি কর্নার থেকেও একটি বোমা ছোড়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয় দলের প্রধান অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, মোট ৫টি বোমা ছোড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাত্র ২ থেকে ৩ ব্যক্তি এগুলো গণজমায়েতের মধ্যে ছুড়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে র্যাব-১০-এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘ঘটনাস্থলের আশপাশে তল্লাশি চালিয়ে মোট ৫টি পিন উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়াও দুটি অবিস্ফোরিত বোমা ও একটি বিস্ফোরিত বোমার স্প্রিন্টারও উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত এসব আলামত পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানায়, এ ধরনের বোমা চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হামজা ব্রিগেডের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির সময়েও এ ধরনের বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বছর কয়েক আগে টাঙ্গাইল থেকেও একই ধরনের বোমা উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ যুগান্তারকে বলেন, হামলায় ব্যবহৃত বোমা জেএমবিসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের কাছ থেকে এর আগেও উদ্ধার করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির সময় একই ধরনের বোমা ব্যবহার করা হয়। তাই সবদিক মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে।
এদিকে নৃশংস এ হামলা নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বক্তব্যের মধ্যে কিছুটা বৈপরীত্য দেখা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে আইনশৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, এ ঘটনার পেছনে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট। তবে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত অবিস্ফোরিত বোমা পরীক্ষা করে দেখা গেছে এগুলো বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন ব্যবহার করে। জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা থেকেও এ ধরনের বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এমন এক বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে- তাহলে এ হামলার দায় কার। জামায়াত-শিবির হামলায় জড়িত থাকলে জঙ্গিদের বোমা এল কোথা থেকে? আবার হামলায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা থাকলে জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততা কি তবে রাজনৈতিক? তবে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখন জামায়াত-শিবির আর জঙ্গির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের আড়াল করতে জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা জঙ্গি স্টাইলে এ ধরনের হামলা চালাচ্ছে। এসব বোমার কারিগর তারাই। তিনি বলেন, বিষয়টিকে আরও সহজভাবে বললে এটাই বলতে হবে, বোমা জঙ্গির হামলা চালিয়েছে জামায়াত-শিবির।
এদিকে এমন জট পাকিয়ে ওঠা বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস’র নামে হামলার দায় স্বীকারের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, হামলার পর আইএস’র দায় স্বীকারের বিষয়টি এখন হাস্যকর পর্যায়ে পড়েছে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান শুক্রবার মধ্যরাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে যুগান্তরকে বলেন, হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত। তাদের পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের মতো বীভৎস হতাহতের ঘটনা ঘটানো। কিন্তু র্যাবের তৎপরতার কারণে ‘ক্যাজুয়ালিটি’ (হতাহত) কমানো গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হামলাকারীদের সম্পর্কে আমরা বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছি। আশা করছি তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (মিডিয়া) নজরুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, আইএস’র টার্গেটের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর কোনো মিল নেই। তাছাড়া ঘটনার দীর্ঘ সময় পর আইএস’র নামে দায় স্বীকারের টুইট বার্তা হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আইএস’র নাম ব্যবহার করে ঘটনার দায়ভার অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলছে।’
শোকের এই দিনে কারা এ হামলা চালাতে পারে, এমন প্রশ্ন করা হলে ঢাকার ইমামবাড়ার বৃদ্ধ শিয়া মুসলমান আলাউদ্দীন আব্বাস বলেন, ‘আর কেউ নয়, ইয়াজিদের বংশধররাই এ হামলা করেছে। তবে তাদের শেষ রক্ষা হবে না।’
No comments