কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের রায় যে কোনো দিন
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার রায়
ঘোষণা করা হবে আগামী যে কোনো দিন। মঙ্গলবার এ আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনাল-২।
মঙ্গলবার আসামিপক্ষের যুক্তির
বিপক্ষে পাল্টা ও সমাপনী যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করেন
রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার
আলী, প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট
নুরজাহান বেগম মুক্তা। আর ট্রাইব্যুনাল বিশেষ সুযোগ দিলে কামারুজ্জামানের
আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিকী রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করে বক্তব্য দেন।
এর
মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় যে কোনো দিন কামারুজ্জামানের মামলার
রায় দেওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) বলে রেখে দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি
ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
এ
আদেশের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল এখন তার সুবিধামতো সময়ে যে কোনো দিন রায় ঘোষণা
করবেন বলে সাংবাদিকদের জানান রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
একাত্তরের
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের
লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত
বছরের ২২ মার্চ গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল। গঠনের ৩ বছর পর এসে ৪র্থ
কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হলো। এর আগে ৩ জনের মামলার
রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে কামারুজ্জামানের মামলার মধ্য
দিয়ে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে শেষ হলো তৃতীয় কোনো
মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া। এর মধ্যে ২১ জানুয়ারি ফাঁসির আদেশ দিয়ে
জামায়াতের সাবেক রোকন (সদস্য) আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে
রায় দিয়েছেন ওই ট্রাইব্যুনাল। একই ট্রাইব্যুনাল গত ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ
দেন।
অন্যদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এদিকে একই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হতে যাচ্ছে বুধবার।
‘রায় যে কোনো পক্ষের বিরুদ্ধে যেতে পারে’
কামারুজ্জামানের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করতে সহায়তা করায় রাষ্ট্র ও আসামি- উভয়পক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল
চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘‘রায় যে কোনো
পক্ষের বিরুদ্ধে যেতে পারে। তবে যে পক্ষের রায় মনোপুত হবে না, তারা সুপ্রিম
কোর্টের আপিল বিভাগে যেতে পারেন।’’
ট্রাইব্যুনাল বলেন,
‘‘দু’পক্ষকেই ধন্যবাদ। বিশেষ করে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কফিল
উদ্দিন চৌধুরীকে বেশি করে ধন্যবাদ জানাতে হয়। তিনি চট্টগ্রামে পরিবার রেখে
ঢাকায় মামলা লড়তে আসেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তিনি অনেক সময় আসতে
পারেননি। তাকে আমরা অনেক সময় এজন্য বকাবকি করেছি। তবে তা করেছি বিচারিক
প্রক্রিয়ার স্বার্থেই।’’
এর আগে সকাল ১০টা ৪৬ মিনিটে
ট্রাইব্যুনাল বসলে প্রথমে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্কের জবাবে পর্যায়ক্রমে
পাল্টা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রথমে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও পরে প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। পরে
ট্রাইব্যুনাল সুযোগ দেন প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও
প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট নুরজাহান বেগম মুক্তাকে। তারা দুই মিনিট করে যুক্তি
উপস্থাপন করেন।
এরপর ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষে ব্যারিস্টার
এহসান এ সিদ্দিকীকে সুযোগ দেন রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি খণ্ডনের জন্য। তার
যুক্তির জবাবে ফের বক্তব্য দেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ।
সবশেষে আসামি কামারুজ্জামানের সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন জানিয়ে সমাপনী বক্তব্য দেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী।
পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ
গত ৩ জানুয়ারি শুনানি শেষে কামারুজ্জামানের মামলা পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত
২ জানুয়ারি মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান কামারুজ্জামানের আইনজীবী
অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। ৩ জানুয়ারি আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান এ
সিদ্দিকী। বিপক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল
ইসলাম।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের
ব্রাসেলস প্রবাসী বাংলাদেশি আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল-১ এর
পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে এ
আবেদন করেন আসামিপক্ষ।
ওই স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে
ট্রাইব্যুনাল-১ এ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর
রহমান নিজামী ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ
জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা
৪টিরও পুনরায় শুরু করার আবেদন গত ৩ ও ৭ জানুয়ারি খারিজ করে দেন দু’টি
ট্রাইব্যুনাল।
১০ জানুয়ারি এসব খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে
আসামিপক্ষ রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন। ১৫-১৬ জানুয়ারি শুনানি শেষে ২১
জানুয়ারি সেসব আবেদনও ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দেওয়ায় মামলাগুলোর বিচারিক
কার্যক্রমের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে।
অন্যদিকে একই
ঘটনার সূত্র ধরে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ
করায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাশাপাশি পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালও।
ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর প্রথম
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন এ
ট্রাইব্যুনালেরই বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম
ধর্মীয়
অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই
কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের
অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত
সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রাজ্জাক খান পিপিএম কামারুজ্জামানের
বিরুদ্ধে তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে তিনি ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর প্রসিকিউশনের
কাছে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ৫ ডিসেম্বর কামারুজ্জামানের
বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে জমা দেন
প্রসিকিউশন। তবে সেটি সঠিকভাবে বিন্যস্ত না হওয়ায় আমলে নেওয়ার পরিবর্তে
ফিরিয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ১২ জানুয়ারি
প্রসিকিউশন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে পুনরায় দাখিল করেন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ।
এরপর ৩১ জানুয়ারি ৮৪ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগটি
আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এরপর
১৬ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে
কামারুজ্জামানের মামলাটি প্রথম ট্রাইব্যুনাল থেকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে
স্থানান্তর করা হয়। ১৬ মে আসামিপক্ষ এবং ২০ মে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ করেন।
গত
বছরের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন,
দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাত ধরনের ঘটনায় অভিযোগ আনা
হয়।
২ জুলাই কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৮১ পৃষ্ঠার ওপেনিং
স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উত্থাপন করেন প্রসিকিউটর একেএম সাইফুল ইসলাম ও
নূরজাহান বেগম মুক্তা।
সূচনা বক্তব্যে প্রসিকিউটররা
কামারুজ্জামানকে ‘প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী’ বলে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালকে
বলেন, তিনিসহ মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী, আশরাফ হোসেন, মোঃ শামসুল
হক, মোঃ সাদত হোসাইন, আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মঈনউদ্দিন ও আব্দুস সালাম
ছিলেন আলবদর বাহিনীকে পরিচালনা করতেন।
গত বছরের ১৫ জুলাই
থেকে এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত
কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খানসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৮ জন সাক্ষী
সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।
তাদের মধ্যে ১৫ জন ঘটনার সাক্ষী
হচ্ছেন, ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হামিদুল হক,
শেরপুরে কামারুজ্জামানের স্থাপন করা আলবদর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্রের
দারোয়ান মনোয়ার হোসেন খান মোহন, বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী
বীরপ্রতীক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির আব্দুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ
গোলাম মোস্তফা হোসেন তালুকদারের ছোট ভাই মোশাররফ হোসেন তালুকদার, শহীদ
মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামানের বড় ভাই ডা. মো. হাসানুজ্জামান, লিয়াকত আলী, বীর
মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের পুত্র জিয়াউল ইসলাম, অ্যাডভোকেট আবুল
কাশেম, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান মো. জালাল উদ্দিন, শেরপুর জেলার
‘বিধবাপল্লী’নামে খ্যাত সোহাগপুর গ্রামের নির্যাতিত (ভিকটিম) তিন নারী
সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), মুজিবুর রহমান খান পান্নু এবং দবির হোসেন
ভূঁইয়া। আর জব্দ তালিকার প্রথম সাক্ষী হলেন বাংলা একাডেমীর সহকারী
গ্রন্থাগারিক এজাব উদ্দিন মিয়া ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের তথ্য সংরক্ষণ
কর্মকর্তা আমেনা খাতুন।
আসামিপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন।
অন্যদিকে
কামারুজ্জামানের পক্ষে গত ৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মোট ৫ জন সাফাই সাক্ষী
সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হচ্ছেন মোঃ আরশেদ আলী, আশকর আলী, কামারুজ্জামানের বড়
ছেলে হাসান ইকবাল, বড় ভাই কফিল উদ্দিন এবং আব্দুর রহিম। তাদের জেরা
সম্পন্ন করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ।
গত ২৪ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ
পর্যন্ত এবং মঙ্গলবার ৫ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন
চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ,
প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এ কে এম সাইফুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট
নুরজাহান বেগম মুক্তা। অন্যদিকে ৩ থেকে ১৫ এপ্রিল ও মঙ্গলবার ৪ কার্যদিবসে
আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিকী।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ
ট্রাইব্যুনাল
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরসহ
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা কামারুজ্জামান।
শেরপুর ডাকবাংলোয় বসে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সন্দেহভাজনসহ
নিরীহ বাঙালিদের ধরে আনার নির্দেশ দিতেন এবং হত্যা, নির্যাতন চালাতেন তিনি।
এছাড়া
শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে কামারুজ্জামানের
নেতৃত্বে তার পরিকল্পনা ও পরামর্শে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই ১২০ জন পুরুষকে
হত্যা করা হয় এবং ওই গ্রামের প্রায় ১৭০ জন মহিলাকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা
হয়। সে ঘটনার পর থেকে সোহাগপুর গ্রাম এখন ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত। এ
কারণে সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর জন্যও দায়ী কামারুজ্জামান।
সব
মিলিয়ে গণহত্যা, গণহত্যা সংঘটনে ষড়যন্ত্র, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যা,
ব্যাপক নির্যাতনযজ্ঞ, দেশত্যাগে বাধ্য করা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মগত ও
রাজনৈতিক কারণে ক্রমাগত নির্যাতনের সুপিরিয়র হিসেবে সব অপরাধের একক ও যৌথ
দায় কামারুজ্জামানের ওপর বর্তায় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগে।
প্রথম
অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৯ জুন সকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে
আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি
থেকে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে
নিয়ে যায়। সেখানে তাকে সারা রাত নির্যাতন করে পরদিন হত্যা করে লাশ পানিতে
ফেলে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, কামারুজ্জামান
ও তার সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন
করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন।
তৃতীয়
অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৫ জুলাই আলবদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি
সেনাদের নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং
নারীদের ধর্ষণ করে। এটি কামারুজ্জামানের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে করা হয়।
সেদিন ওই গ্রামে ১২০ জন পুরুষকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার দিন থেকে সোহাগপুর
গ্রাম ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত।
চতুর্থ অভিযোগে বলা
হয়েছে, একাত্তরের ২৩ আগস্ট কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা গোলাম
মোস্তফাকে ধরে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে স্থাপিত আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে
যান। সেখানে কামারুজামান ও আলবদররা তাকে গুলি করে হত্যা করেন।
পঞ্চম
অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে রমজান মাসের মাঝামাঝি কামারুজ্জামান ও
তার সহযোগীরা শেরপুরের চকবাজার থেকে লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমানকে অপহরণ
করে বাঁথিয়া ভবনের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখানে তাদের নির্যাতনের পর
থানায় চার দিন আটকে রাখা হয়। পরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে ওই দু’জনসহ ১৩
জনকে ঝিনাইগাতীর আহম্মেদনগর সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পরে লিয়াকত,
মুজিবুরসহ ৮ জনকে উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ের কাছে সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি
করে হত্যা করা হয়। কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত
ছিলেন।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের নভেম্বরে
কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর সদস্যরা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে ময়মনসিংহের
জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। টুনুকে সেখানে নির্যাতন
করে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সপ্তম ও
শেষ অভিযোগে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকালে ২৭ রমজান কামারুজ্জামান আলবদর
সদস্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের গোলাপজান রোডের টেপা মিয়া ও তার বড় ছেলে জহুরুল
ইসলাম দারাকে ধরে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরদিন
সকালে আলবদররা ওই দু’জনসহ সাতজনকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নিয়ে হাত বেঁধে
সারিতে দাঁড় করান। প্রথমে টেপা মিয়াকে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে গেলে তিনি নদীতে
লাফ দেন। আলবদররা গুলি করলে তার পায়ে লাগে। তবে তিনি পালাতে সক্ষম হন।
কিন্তু অন্য ছয়জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
No comments