কবিতা- 'বীতকৃত্য ও অন্যান্য কবিতা' by মাসুদ খান

বীতকৃত্য

যেইদিন বৃক্ষ ত্যাগ করবে তার বৃক্ষধর্ম
মিষ্ট নয়, ফল হবে কটু বা কষায়
আর সোজা না ফেলে সে ফল ফেলবে তির্যক ভঙ্গিতে…
যেইদিন আম্রবৃক্ষে জাম হবে, তাম্রবৃক্ষে সিসা…
দস্যুকে তো শীলাচারী হলে চলে না
তবুও যেদিন সে দস্যুতা ত্যাগ ক’রে
হয়ে উঠবে সুশীল, পাদ্রি ও পরার্থপর
বকেরা যেদিন মশগুল হবে মৎস্যমঙ্গলচিন্তায়…

যেদিন আয়না পরিত্যাগ করবে তার আর্শিধর্ম
দেবে না তো আর কোনো প্রতিবিম্ব
পাহাড় দেবে না প্রতিধ্বনি…
আর যত শীল ও দুঃশীল গতি অগতি কুশল অকুশল
আর যত অভিজ্ঞা ও সমাপত্তি, বারো রকমের বন্ধনযাতনা
সংসার সন্ন্যাস মোক্ষ মোহ কাম কৃত্য ঘাম মূত্র বীর্য ধর্মাধর্ম পুরীষ পৌরুষ
সব একাকার হবে যেইদিন
সেদিন কোথায় কোন দূরে নিয়ে যাবে গো আমায়
ধর্মহারা বীতকৃত্য সূত্রহীন পুরীষবিহীন…

মার্চ, ২০০৭

যোগাযোগ

ওই বাতবিতাড়িত মেঘমালা, বিজলি-জাগা মেঘের স্তবক,
তারই সাথে জাগে খর বজ্রের গমক
বজ্রের হাঁকের মধ্যে শুনছ তুমি গায়েবি অনুশাসন, বোবা ও সুদূর।
ঝিঁঝির ডাকের মধ্যে শ্রবণ করছ হে মহামণ্ডলের সুর।
সবগুলি ইন্দ্রিয় নিভিয়ে দিয়ে তুমি
গুরু গন্ধতেলের প্রদীপ জ্বেলে জেগে থাকছ, ভাসছ, একা-একা
তুলার মতন নিরপেক্ষ, ধ্রুব, অবন্ধন…
জ্বালিয়ে রেখেছ শুধু একাকী শ্রবণ!
শ্রব্যাশ্রব্য বহু কিছু ধরা পড়ছে শ্রুতিতে তোমার!

তোমার শ্রাবণ জ্ঞান থেকে আজ কিছুটা প্রসাদ
কিছুটা দ্রবণ যত্নে ঢেলে দাও শ্রবণে আমার
বেঁচে উঠি, এবং উৎপুচ্ছ হই, মেতে উঠি শ্রাবণ উৎসবে।
বাগিন্দ্রিয় বাগ্বিরুদ্ধ হোক এইবার
স্বাদরুদ্ধ স্বাদেন্দ্রিয়!
শ্র“তি ছুঁয়ে যাক শ্রুতি, হৃদিতে মিশুক হৃদি, শ্রবণে শ্রবণ…
যোগাযোগ হোক একদম সরাসরি, সোজা ও সহজ!

মার্চ, ২০০৭

প্রাকৃতিক
সাগরকিনারে দেখা প্রথম মিনার তাতে মেঘ তাতে পর্বতের মাথায় রাগ
রাগিনী ও বজ্রচেরাগ পাহাড়ের বগলতলায় বাষ্প, কুহু ও কামিনী রোদ
কুসুমকর্ণিকা সুরবল্লী রিঠাফল দলকলসের ঝোপে একাকী মৌমাছি
ঝাপসা হয়ে আসা পথহারা মেষ ও মালিক অস্তরাঙা চিল উঁচু চিমনিচূড়ায়
ইতস্তত ঢোলকলমি অশোক বাসক—প্রকৃতির প্রতিটি সঞ্চয় থেকে
তিল-তিল অর্থ আহরণ করে আনি সে তো তোমাদেরই জন্যে
যদিও জেনেছি বেশ—জ্যামুক্ত তীর তো আর কখনো আসবে না ফিরে
কখন কোথায় কবে কাকে যে ঘায়েল করে চলে গেছে দূরে
টলে ওঠে ধানুকীর একাগ্রতা যদি তীর ফিরে আসে বুমেরাঙের গতিপথে
কোনোদিন—সেই আশা-নিরাশায় বসে থাকা…
আমি নিশিপাগলার বেশে কী এক অদ্ভুত চোরাটানে অনন্তকাল ধরে চলেছি
অরণ্য পাহাড় নদী সম- ও মাল-ভূমির অন্তহীন অলিগলি চোরাপথ থেকে
কারা যেন খালি মায়া ছুঁড়ে মারে এমনকী আমি যখন বকফুল আর
ভেরেণ্ডা গাছের নিচ দিয়ে যাই তখনো কে যেন কেবলই মায়া মাখিয়ে দেয়…

মার্চ, ২০০৭

পাণ্ডবদের দেশে

পাণ্ডববর্জিত, ব্রাত্যজন-অধ্যুষিত জলাজংলা প্রদেশের এক নিরীহ মুসুল্লি
অদ্ভুত বিপাকে পড়ে গেছে আজান দিতে এসে এক অচেনা প্রদেশে
নির্ধারিত মোয়াজ্জিনের অনুপস্থিতিতে।

পায় না কেবলা খুঁজে, পেয়েও হারায় বারে বারে।
আর দ্যাখে, এই দেশে, এইসব বেগানা প্রদেশে
প্রচুর পাণ্ডব, পালোয়ান। এত যে পাণ্ডব, কিন্তু কেমন যে তারা
জামাত-যৌথতা জানে না, হুকুম-আহকাম মানে না,
নিয়তের ঠিক নাই, খালি-খালি কলহ করে, বাঁধায় তাণ্ডব
তদুপরি পাদ মারে, পিক ফেলে, নষ্ট করে ওজু ও ইমান…

আরো আছে হরেক কুতুব, কুতুবের অন্ত নাই,
তারা উল্টাপাল্টা ফতোয়া দেয়, এলোপাথাড়ি মছলা-মাছায়েলা ঝাড়ে,
আর খালি হেদায়েত করে, তাতে বাতেনি কথাই বেশি, জাহেরি কম-কম
সিরাতুল মোস্তাকিম বোঝে না, ঘোরানো পথ বোঝে…

নিরীহ মোয়াজ্জিনের এমনিতেই জলাবিলা দশা,
তার ওপরে পাণ্ডবেরা, কুতুবেরা হল্লা করে কেবলই টালাতে থাকে নিরীহকে।

মন-খারাপ-করা হাওয়া বয়।
মোয়াজ্জিনের মন! একটু একটু করে তুষারের মতো ঝরে।

ঘোরানো সিঁড়ির ঘুর-স্বভাব মাড়িয়ে তবু আস্তে-আস্তে সে উঠে যায় মিনারচূড়ায়।

ডিসেম্বর, ২০০৭

সংসার

আদিতে অব্যক্ত আর বিনাশে বিসর্গ। মাঝখানটায় কেবলই আবর্ত।
মাঝখানটুকু শুধু সপ্তস্বরে আর পঞ্চবর্গে
পাঁচ-পাঁচে পঁচিশ বর্ণে ব্যঞ্জনায় বিকশিত মাত্র—
এই তো বিশ্বসংসার! বিশ্বলীলাপাত্র!

পঞ্চ-পঞ্চ পঁচিশ-ব্যঞ্জন উপাদানে তৈরি ঘর।
সেই ঘর বর্গাকার।
সেই ঘরের মায়ায়, মাজেজায় রচিত এ অনিত্য সংসার।
যে ওই গৃহকে চেনে না রে মন, অচিনপ্রবণ
কী করে সম্ভব তার প্রজাদি সৃজন,
কহ প্রজাপতি?

শুধু মননেই, শুধু দর্শন বা স্পর্শনেই, এমনকী স্রেফ
হাঁচিতেও হয়েছে সম্ভব, আগে, জীবের জনম।
অতঃপর কী মায়া লাগালে হায় কী লীলা লীলালে, প্রজাপতি,
মিথুনে মৈথুনে অবলীলাক্রমে জীবের সৃজন
ঔরষে গর্ভের কোষে কিমাশ্চর্য রসায়ন!

শিশুদের ভিড়ে, কলরোলে, ভরে যাচ্ছে এই তাজ্জব সংসার
অফুরান অনিবার
হৃষ্টপুষ্ট নাদুসনুদুস স্মিত সদানন্দ ভোলাভালা নধরকান্তিম…

জানুয়ারি, ২০০৮

ব্লিজার্ড

আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দাপিয়ে ফিরে
সমগ্র নীলিমা তছনছ করে দিয়ে
কোটি-কোটি দুষ্ট দাপুটে শিশু খেলছে হুলুস্থুল বালিশ ছোঁড়ার খেলা।

অজস্র কার্পাস ঝরছে
লক্ষকোটি বালিশফাটানো তোলপাড়-করা অফুরন্ত তুলা।
যেন তুলারাশির জবুথবু জাতক হয়ে পড়ে আছে ধীরা ধরিত্রী, বিব্রত বেসামাল।
সাথে উল্টাপাল্টা ঝাড়ি, একটানা বেপরোয়া বাবুরাম পাগলা পবনের।
আবার কোত্থেকে এক নির্দন্ত পাগলিনীর আরশিফাটানো উলটপালট অট্টহাসি
মুহুর্মুহু অট্টালিকায় প্রতিহত হয়ে ছুটছে দিশাহারা দিগি¦দিক
ঘরবাড়ি মিনার-ময়দান আড়ত-ইমারত গাছপালা বন বন্দর বিমান
সবকিছুর ওপর এলোপাথাড়ি থার্ড ডিগ্রি চালিয়ে বের করে আনছে
তুলকালাম গোপন তথ্য, তুলাজটিল শীৎকার।

ডিসেম্বর, ২০০৭
=============================
মাসুদ খান
কবি, লেখক।
masud_khan@yahoo.com
জন্ম
ক্ষেতলাল, জয়পুরহাট, ২৯ মে ১৯৫৯
পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জ

পেশায় প্রকৌশলী।

প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ
পাখিতীর্থদিনে (১৯৯৩ খ্রিঃ)
নদীকূলে করি বাস (২০০১ খ্রিঃ)
সরাইখানা ও হারানো মানুষ (২০০৬ খ্রিঃ)

প্রকাশিতব্য গ্রন্থ
কাকের বাসা

বগুড়া লেখকচক্র পুরস্কার পেয়েছেন কবিতায়, ১৯৯৪ সালে। বর্তমানে প্রবাসযাপন করছেন কানাডায়।
======================
কবিতা- 'পাঁচটি কবিতা' by সরকার আমিন  কবিতা- 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি'   পাঁচটি কবিতা' by অবনি অনার্য  কবিতা- 'ছুটপালক' by সব্যসাচী সান্যাল  গদ্য কবিতা- 'লীলা আমার বোন' by নান্নু মাহবুব  কবিতা- 'উৎসর্গ' by অসীম সাহা  তিনটি কবিতা' by বদরে মুনীর  কবিতা- 'সেরগেই এসেনিন বলছে' by আবদুল মান্নান সৈয়দ  কবিতা-মোহাম্মদ রফিক এর কপিলা থেকে ও অঙ্গীকার  প্রবন্ধ- 'রবীন্দ্রজন্মের দেড়শ বছর “একজন তৃতীয় সারি  উপন্যাস- 'রৌরব'  by লীসা গাজী »»»   (পর্ব-এক) # (পর্ব-দুই) # (পর্ব-তিন) # (পর্ব-চার শেষ)   গল্প- 'পান্নালালের বাস্তু' by সিউতি সবুর   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা  আহমদ ছফার অগ্রন্থিত রচনা কর্ণফুলীর ধারে  আলোচনা- 'খানিক ছফানামা' by কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর



bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ মাসুদ খান


এই কবিতা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.