কবিতা- 'পাগলের হাসি ও অন্যান্য কবিতা' by মহাদেব সাহা
পাগলের হাসি
আমার এ সমস্তই পাগলের হাসি, এই হাসি ধ্বনিময় স্থির
আর্ত চিৎকার, সত্তার সঙ্গে নিজের শব্দ বিনিময়, কখনো
নিঃশব্দ স্তব্ধ জলরাশি, কখনো এক সেতুহীন নরবড়ে সেতু
এই পাগলের হাসি বাতাসের শব্দ পাতার নির্জন ওড়াউড়ি, গান
দৃশ্যময় অন্ধকার;
এই দৃশ্যের উপর দিয়ে শীতগ্রীষ্ম, দিনরাত্রি, আলো-অন্ধকার
প্রতিফলনহীন প্রতিধ্বনি, অরণ্যে লুকিয়ে-থাকা বৃক্ষ, অদৃশ্য
অখ্যাত জলচর প্রাণীদের জীবনকাহিনী আর্তনাদ, দাঁড়িয়ে-থাকা
কালো ঘুম।
খড়ের মতো ধূসরতা পাড়ি দিতে দিতে এই উন্মোচন, অভিযাত্রা
অক্ষরের ঘ্রাণ, মাটির ধোঁয়া, পাথরের গন্ধ, উৎসব, বাদ্য
গোল চাকার মধ্যে কেবলই এই ঘুরপাক খাচ্ছি, হেঁটে বেড়াচ্ছি
এই বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ আমার জীবন, আমার বেঁচে থাকার নিষ্ফল
উদ্যোগরাশি, এই মেঘবৃষ্টি, শস্যহীন বিবর্ণ মাঠ, হাসি হাহাকার
এই বৃত্তের মধ্যেই আমি এই পাগলের হাসি হেসে চলেছি, তার
শব্দ শুনি অর্থ জানি না, পাগলের হাসি কিছুই বলে না, বলতে চায় না।
কালো মেঘের ওপারে পূর্ণিমা
সূর্যাস্তের ওপারে সূর্য, কালো মেঘের ওপারে পূর্ণিমা
অন্ধকারে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সন্ধ্যাতারা,
এই শীতেও মাঝে মাঝে কোকিল ডেকে ওঠে;
এতো যে বরফ পড়ে তারপরও লেখা হয় নতুন কবিতা
মনে হয় যে–রাত্রি হবে না ভোর, সেও শেষে বলে সুপ্রভাত,
শেষ নয় এই রাত্রি আছে আরো দিনের মহিমা
আছে আরো মানুষের সমবেত গান, অনন্ত স্বাক্ষর;
শুকনো পাতার শব্দ তবু জাগে কচি দূর্বাঘাস
এতো অনাবৃষ্টিতেও মানুষের হৃদয় অমর।
সূর্যাস্তের শেষে শুধু রাত্রি নয়, আছে ভোরও
আছে চারদিকে এই জেগে ওঠা, ওড়া
অন্ধকার পার হয়ে আছে এই আলোর নদীও
শীতকাল আসে তাতেই গোলাপ নিঃশেষ হয় না
জাগে গন্ধ, জাগে গান, জাগে এই জীবন আবার।
শীতের কবিতা
হয়তো রোমাঞ্চকর এই শীত, কেউ কেউ শীতেরই অপেক্ষা করে,
কিন্তু আমি শীতে সর্বদা কাতর, উষ্ণ জলবায়ু আমার পছন্দ,
বর্ষা মেঘ অফুরন্ত জল, কলকল জলের শব্দ, আমি
এই বৃষ্টি মেঘ বর্ষার দেশেই জন্মেছি। আমার দুচোখ
বেয়ে তাই অবিরাম এমন বর্ষণ, বুকে সহস্র নদীর ধারা
উপাদেয় শীতের খাদ্যের চেয়ে আমার অধিক প্রিয়
আম-কাঁঠালের গন্ধ, অধিক পছন্দ আষাঢ়ের ঢল, নদীনালা,
খালবিল, বনভূমি, অবিরাম দখিনা বাতাস;
আমার শীতের কবিতা তাই বর্ষারই বিরহের গান, মত্ত
মেঘের মাদল, শ্রাবণের জলধারা, আমি শীতের ভ্রমণ নয়
থই থই বর্ষার বিলে ভাসাতে পছন্দ করি পালতোলা নাও,
কেউ কেউ শীতের সান্নিধ্য পেয়ে উদ্ভিদের ঘ্রাণে মেতে উঠতে চায়
আমি শীতকালে আরো কাতর হয়ে পড়ি, বর্ষার অপেক্ষায় থাকি।
যতোই বিলম্ব হোক
যতোই বিলম্ব হোক ফিরতে চাই তোমাদের কাছে
তোমাদের সাথে বসে আবার বানাতে চাই
মাটির সংসার;
হাঁটতে চাই সারাদিন মাটির উঠোনে নেবুগাছের তলায়
ঐ টুনিটুনি পাখি উড়ে যায় আমি সেই কলশব্দ শুনি,
কিছুটা বিলম্ব হয় হোক আমি ফিরতে চাই তোমাদেরই কাছে
তোমরা যারা আপন মানুষ রোদবৃষ্টি মাথায়
করে বেঁচে আছো
তোমরা যারা নাও বাইছো, তোমরা যারা
জল দিচ্ছো সবজির ক্ষেতে, তোমরা যারা খেয়ে না-খেয়ে আছো
তোমরা যারা খালি গায়ে হাঁটছো মাটির রাস্তায়
যতোই বিলম্ব হোক আমি ফিরে আসবো তোমাদের মাঝে।
আমি ফিরতে চাই তোমাদের কাছে ঐ ভাঙা কুঁড়েঘরে
ঐ পাতকুয়া থেকে জল খেতে,
ঐ খরাজাল, খালবিল, পুকুরের ধারে
চাঁদ-ওঠা বাঁশবাগানের পাশে,
যতোই বিলম্ব হোক আমি ফিরে আসবো তোমাদের কাছে।
কপোতাক্ষ মহাকাব্য
কপোতাক্ষ কিংবা সাগরদাঁড়ি এই পুণ্যনাম
খুঁজতে খুঁজতে এতদূরে এখানে এলাম,
পাবো কি কবির দেখা, তার প্রিয় চতুর্দশপদী
ছন্দে ছন্দে ভরে ওঠে এই জল, এই নদনদী;
কপোতাক্ষ মহানদ, আমি তাকে মনে মনে মহাকাব্য বলি
এভাবে দিয়েছি তাকে ফলেফুলে আমার অঞ্জলি
দিয়েছে ভাসিয়ে জলে কে বা এই বকুলের মালা
ওপারে উঠেছে চাঁদ, এইপারে ভেসে যায় থালা,
কারা যেন এই জলে ভরে রাখে মঙ্গলঘট
দাঁড়ায় পথিকবর, ছায়া দেয় শাল্মলীবট
এপারে সাগরদাঁড়ি, ঐপারে বিদ্যাসাগর
কতো দূরে কপোতাক্ষ কতো দূরে তিস্তা-দামোদর
তার ছন্দে হয় ভোর, অন্ধকার হয় দীপান্বিতা
কপোতাক্ষ মহাকাব্য অমিত্রাক্ষরের কবিতা।
অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ
=================
মহাদেব সাহা
জন্ম
গ্রাম ধানঘড়া, সিরাজগঞ্জ, ২০ শ্রাবণ ১৩৫১, ৫ আগস্ট ১৯৪৪
পিতা
গদাধর সাহা
মাতা
বিরাজমোহিনী
স্ত্রী
নীলা সাহা
দুই পুত্র
তীর্থ ও সৌধ
ঢাকা কলেজ, বগুড়া কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন। প্রথমে বাংলা ও পরে কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। লেখালেখির শুরু কৈশোরে। প্রথম কবিতার বই এই গৃহ এই সন্ন্যাস (১৯৭২)। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৭৬।
একুশে পদক ও বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ সব গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন।
======================
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ মহাদেব সাহা
এই কবিতা'টি পড়া হয়েছে...
আমার এ সমস্তই পাগলের হাসি, এই হাসি ধ্বনিময় স্থির
আর্ত চিৎকার, সত্তার সঙ্গে নিজের শব্দ বিনিময়, কখনো
নিঃশব্দ স্তব্ধ জলরাশি, কখনো এক সেতুহীন নরবড়ে সেতু
এই পাগলের হাসি বাতাসের শব্দ পাতার নির্জন ওড়াউড়ি, গান
দৃশ্যময় অন্ধকার;
এই দৃশ্যের উপর দিয়ে শীতগ্রীষ্ম, দিনরাত্রি, আলো-অন্ধকার
প্রতিফলনহীন প্রতিধ্বনি, অরণ্যে লুকিয়ে-থাকা বৃক্ষ, অদৃশ্য
অখ্যাত জলচর প্রাণীদের জীবনকাহিনী আর্তনাদ, দাঁড়িয়ে-থাকা
কালো ঘুম।
খড়ের মতো ধূসরতা পাড়ি দিতে দিতে এই উন্মোচন, অভিযাত্রা
অক্ষরের ঘ্রাণ, মাটির ধোঁয়া, পাথরের গন্ধ, উৎসব, বাদ্য
গোল চাকার মধ্যে কেবলই এই ঘুরপাক খাচ্ছি, হেঁটে বেড়াচ্ছি
এই বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ আমার জীবন, আমার বেঁচে থাকার নিষ্ফল
উদ্যোগরাশি, এই মেঘবৃষ্টি, শস্যহীন বিবর্ণ মাঠ, হাসি হাহাকার
এই বৃত্তের মধ্যেই আমি এই পাগলের হাসি হেসে চলেছি, তার
শব্দ শুনি অর্থ জানি না, পাগলের হাসি কিছুই বলে না, বলতে চায় না।
কালো মেঘের ওপারে পূর্ণিমা
সূর্যাস্তের ওপারে সূর্য, কালো মেঘের ওপারে পূর্ণিমা
অন্ধকারে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সন্ধ্যাতারা,
এই শীতেও মাঝে মাঝে কোকিল ডেকে ওঠে;
এতো যে বরফ পড়ে তারপরও লেখা হয় নতুন কবিতা
মনে হয় যে–রাত্রি হবে না ভোর, সেও শেষে বলে সুপ্রভাত,
শেষ নয় এই রাত্রি আছে আরো দিনের মহিমা
আছে আরো মানুষের সমবেত গান, অনন্ত স্বাক্ষর;
শুকনো পাতার শব্দ তবু জাগে কচি দূর্বাঘাস
এতো অনাবৃষ্টিতেও মানুষের হৃদয় অমর।
সূর্যাস্তের শেষে শুধু রাত্রি নয়, আছে ভোরও
আছে চারদিকে এই জেগে ওঠা, ওড়া
অন্ধকার পার হয়ে আছে এই আলোর নদীও
শীতকাল আসে তাতেই গোলাপ নিঃশেষ হয় না
জাগে গন্ধ, জাগে গান, জাগে এই জীবন আবার।
শীতের কবিতা
হয়তো রোমাঞ্চকর এই শীত, কেউ কেউ শীতেরই অপেক্ষা করে,
কিন্তু আমি শীতে সর্বদা কাতর, উষ্ণ জলবায়ু আমার পছন্দ,
বর্ষা মেঘ অফুরন্ত জল, কলকল জলের শব্দ, আমি
এই বৃষ্টি মেঘ বর্ষার দেশেই জন্মেছি। আমার দুচোখ
বেয়ে তাই অবিরাম এমন বর্ষণ, বুকে সহস্র নদীর ধারা
উপাদেয় শীতের খাদ্যের চেয়ে আমার অধিক প্রিয়
আম-কাঁঠালের গন্ধ, অধিক পছন্দ আষাঢ়ের ঢল, নদীনালা,
খালবিল, বনভূমি, অবিরাম দখিনা বাতাস;
আমার শীতের কবিতা তাই বর্ষারই বিরহের গান, মত্ত
মেঘের মাদল, শ্রাবণের জলধারা, আমি শীতের ভ্রমণ নয়
থই থই বর্ষার বিলে ভাসাতে পছন্দ করি পালতোলা নাও,
কেউ কেউ শীতের সান্নিধ্য পেয়ে উদ্ভিদের ঘ্রাণে মেতে উঠতে চায়
আমি শীতকালে আরো কাতর হয়ে পড়ি, বর্ষার অপেক্ষায় থাকি।
যতোই বিলম্ব হোক
যতোই বিলম্ব হোক ফিরতে চাই তোমাদের কাছে
তোমাদের সাথে বসে আবার বানাতে চাই
মাটির সংসার;
হাঁটতে চাই সারাদিন মাটির উঠোনে নেবুগাছের তলায়
ঐ টুনিটুনি পাখি উড়ে যায় আমি সেই কলশব্দ শুনি,
কিছুটা বিলম্ব হয় হোক আমি ফিরতে চাই তোমাদেরই কাছে
তোমরা যারা আপন মানুষ রোদবৃষ্টি মাথায়
করে বেঁচে আছো
তোমরা যারা নাও বাইছো, তোমরা যারা
জল দিচ্ছো সবজির ক্ষেতে, তোমরা যারা খেয়ে না-খেয়ে আছো
তোমরা যারা খালি গায়ে হাঁটছো মাটির রাস্তায়
যতোই বিলম্ব হোক আমি ফিরে আসবো তোমাদের মাঝে।
আমি ফিরতে চাই তোমাদের কাছে ঐ ভাঙা কুঁড়েঘরে
ঐ পাতকুয়া থেকে জল খেতে,
ঐ খরাজাল, খালবিল, পুকুরের ধারে
চাঁদ-ওঠা বাঁশবাগানের পাশে,
যতোই বিলম্ব হোক আমি ফিরে আসবো তোমাদের কাছে।
কপোতাক্ষ মহাকাব্য
কপোতাক্ষ কিংবা সাগরদাঁড়ি এই পুণ্যনাম
খুঁজতে খুঁজতে এতদূরে এখানে এলাম,
পাবো কি কবির দেখা, তার প্রিয় চতুর্দশপদী
ছন্দে ছন্দে ভরে ওঠে এই জল, এই নদনদী;
কপোতাক্ষ মহানদ, আমি তাকে মনে মনে মহাকাব্য বলি
এভাবে দিয়েছি তাকে ফলেফুলে আমার অঞ্জলি
দিয়েছে ভাসিয়ে জলে কে বা এই বকুলের মালা
ওপারে উঠেছে চাঁদ, এইপারে ভেসে যায় থালা,
কারা যেন এই জলে ভরে রাখে মঙ্গলঘট
দাঁড়ায় পথিকবর, ছায়া দেয় শাল্মলীবট
এপারে সাগরদাঁড়ি, ঐপারে বিদ্যাসাগর
কতো দূরে কপোতাক্ষ কতো দূরে তিস্তা-দামোদর
তার ছন্দে হয় ভোর, অন্ধকার হয় দীপান্বিতা
কপোতাক্ষ মহাকাব্য অমিত্রাক্ষরের কবিতা।
অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ
=================
মহাদেব সাহা
জন্ম
গ্রাম ধানঘড়া, সিরাজগঞ্জ, ২০ শ্রাবণ ১৩৫১, ৫ আগস্ট ১৯৪৪
পিতা
গদাধর সাহা
মাতা
বিরাজমোহিনী
স্ত্রী
নীলা সাহা
দুই পুত্র
তীর্থ ও সৌধ
ঢাকা কলেজ, বগুড়া কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন। প্রথমে বাংলা ও পরে কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। লেখালেখির শুরু কৈশোরে। প্রথম কবিতার বই এই গৃহ এই সন্ন্যাস (১৯৭২)। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৭৬।
একুশে পদক ও বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ সব গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন।
======================
কবিতা- 'যেভাবে ঘরের কিসসা রচিত হয়' by ওমর কায়সার কবিতা- 'বীতকৃত্য ও অন্যান্য কবিতা' by মাসুদ খান কবিতা- 'পাঁচটি কবিতা' by সরকার আমিন কবিতা- 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি' পাঁচটি কবিতা' by অবনি অনার্য কবিতা- 'ছুটপালক' by সব্যসাচী সান্যাল গদ্য কবিতা- 'লীলা আমার বোন' by নান্নু মাহবুব কবিতা- 'উৎসর্গ' by অসীম সাহা তিনটি কবিতা' by বদরে মুনীর কবিতা- 'সেরগেই এসেনিন বলছে' by আবদুল মান্নান সৈয়দ কবিতা-মোহাম্মদ রফিক এর কপিলা থেকে ও অঙ্গীকার কবিতা- 'সেতু' by বায়েজীদ মাহবুব উপন্যাস- 'রৌরব' by লীসা গাজী »»» (পর্ব-এক) # (পর্ব-দুই) # (পর্ব-তিন) # (পর্ব-চার শেষ) গল্প- 'পান্নালালের বাস্তু' by সিউতি সবুর গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা আহমদ ছফার অগ্রন্থিত রচনা কর্ণফুলীর ধারে
bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ মহাদেব সাহা
এই কবিতা'টি পড়া হয়েছে...
No comments