ডলুরার সেই পবিত্রভূমি by মৃত্যুঞ্জয় রায়
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি। দেশের একটা জায়গায় গিয়ে ছোটবেলার এ ছড়াটা বেশ মনে পড়ল। জায়গাটার নাম ডলুরা। সুনামগঞ্জের মেঘালয় সীমান্তঘেঁষা গারো আদিবাসী-অধ্যুষিত একটা গ্রাম। একাত্তরের দিনগুলো তো মেঘে-ঢাকা দিনের মতোই ছিল অন্ধকার, বিভীষিকাময়, বর্ষার বৃষ্টি ফোঁটার মতো লাখো-কোটি বাঙালির অশ্রুবিন্দুতে সিক্ত। একদিন মেঘ ফুঁড়ে হেসেছিল সূর্য, ছুটে গিয়েছিল অন্ধকার, বাদলের ধারা—আমাদের অশ্রুবিন্দুগুলো। স্বাধীনতার টকটকে লাল সূর্যে হেসেছিল নতুন দেশ বাংলাদেশ। বাদলে সিক্ত হয় মাটি, সিক্ত সেই বসুন্ধরার বুকে বাদল শেষে হেসে ওঠে ফসলের সম্ভার। লাখো-কোটি বাঙালির অশ্রুতে-রক্তে সিক্ত হয়েছিল যে মাটি, সেই মাটির বুকে জন্ম নিয়েছিল এক আশ্চর্য আনন্দপুত্র বাংলাদেশ। বিজয়ে আমরা উল্লাসে মেতেছিলাম। কিন্তু সেই বিজয়ের আনন্দের মধ্যেও ছিল চাপা কান্না, বলতে না-পারা স্বজন হারানোর বেদনা। সেসব বেদনা বুকে নিয়েই আমরা বেঁচে আছি, এখনো স্বপ্ন দেখি শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশের। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই সুনামগঞ্জ শহর থেকে সুরমা নদীর হল্লারঘাট পার হয়ে পাকা রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলাম ডলুরা সীমান্তে ঘুমিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের সময় চিরনিদ্রায় শায়িত আটচল্লিশজন শহীদের সেই পবিত্রভূমিতে।
সুরমা পেরিয়ে হল্লারঘাট থেকে একজন গারো কৃষক আন্দ্রেয়াজ দান্দালী আমাকে একটা ভাড়ার মোটরসাইকেলে করে রওনা হলেন নারায়ণতলার দিকে। ও গ্রামেই তাঁর বাড়ি। সুন্দর পাকা পথ। যেতে যেতে বাঁ দিকের একটা মাঠ দেখিয়ে জানালেন, ওইখানে ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের ফাঁড়ি। লোকেরা বলত লালবাড়ি। ওখান থেকেই তারা সুরমার এপারে বিভিন্ন গ্রামে অপারেশন চালাত। পাকা রাস্তার দুই পাশে কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, গাছগাছালি, ফসলের মাঠ, সমতল ভূমি। দেখতে দেখতে আমরা নারায়ণতলা মিশনে পৌঁছে গেলাম। পথে পড়ল চৌমুহনী বাজার। এরপর যেতে যেতে ঘরবাড়ি একটু পাতলা হয়ে এল। দেখতে পেলাম নতুন গড়ে কিছু ওঠা হালকা কুঁড়েঘর, নতুন নতুন বসতি, রক্তরাঙা ফুল ফোটা শিমুলগাছ আর বাঁশঝাড়। আলগা বালুর পথ। তবে ডলুরা গণকবর পর্যন্ত রাস্তাটা পাকা। শহীদদের কবরের কয়েক হাত পেছনেই নোম্যানস-ল্যান্ড, এর কয়েক হাত দূরেই ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারের কঠিন বেড়া। ওপারে মেঘালয়ের সুউচ্চ খাসিয়া পাহাড়। আন্দ্রেয়াজ জানালেন, গ্রামটাতে এখনো প্রায় আড়াই শ ঘরে গারো আদিবাসীর বাস রয়েছে। সেখানেই মেঘের পাহাড় মেঘালয়ের কোলঘেঁষে ডলুরা গণকবরে লালনুড়ির বালুর বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন আটচল্লিশজন শহীদ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ডলুরা ছিল বালাট সাব-সেক্টরের অধীন। সেই সাব-সেক্টরে তখন যুদ্ধ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. লুৎফর রহমান ওরফে জজ মিয়া। তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, এখনো একাকী থাকলে গুলি আর বোমার শব্দ শুনি। সুনামগঞ্জে মার্চের পর থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের ফলে অনেক লোক তখন ঢাকা ত্যাগ করে তাদের গ্রামের বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আসতে থাকে। কেউ কেউ সীমান্ত পেরিয়ে আরও নিরাপদ জায়গার খোঁজে চলে যায় রিফিউজি ক্যাম্পে। আবার কেউ কেউ সীমান্ত পেরিয়ে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে। ফিরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ডলুরা সীমান্তবর্তী গ্রাম হওয়ায় এবং মেঘালয়ে যাওয়ার জন্য যোগাযোগব্যবস্থা ভালো থাকায় রোজই বিপুল লোক এ পথে আসতে থাকে। কমান্ডারের নির্দেশ ছিল, এসব লোককে যেন আমরা ঠিকমতো সেবা দিই, আশ্রয় দিই। প্রায় প্রতি রাতেই আমরা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে দু-চারজন লোকের থাকার ও খাবারের ব্যবস্থা করতাম। মনে পড়ে ভালো লাগে যে তখন সিলেটের এম সি কলেজ, ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ, ভৈরব কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা এ পথে সীমান্ত পার হওয়ার জন্য আসত মুক্তিযোদ্ধা হতে, যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। তাই কৌশলগত কারণে এ জায়গাটা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য তারা সুরমা নদীর এ পারে ক্যাম্প স্থাপন করে ভারতগামী লোকদের আসা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। তবুও তারা বিভিন্ন ঘুরপথে ঝুঁকি নিয়ে আসতে থাকে। এরপর শুরু হয় ডলুরা ও তার আশপাশে আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ, কাউন্টার-অ্যাটাকে ওরাও যেমন মরতে থাকে, তেমনি আমাদেরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান। তাঁদের শবদেহগুলো গ্রামবাসী ও সহযোদ্ধারা এই ডলুরা সীমান্তে এনে সমাহিত করেন। মো. মন্তাজ মিয়া, মো. রহিম বখত, মো. ধনু মিয়া, মো. কেন্তু মিয়া, অধর দাস, কবীন্দ্র নাথ—এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে সমাহিত করা হয়। যাঁদের পরিচয় পাওয়া গেছে, নামফলকে শুধু সেই আটচল্লিশজনের নামই আছে। ফলকে নাম নেই, এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাও এখানে সমাহিত আছেন বলে তিনি জানান। তাঁদের পরিচয় হয়তো কেউ কখনো জানবে না। কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগের মহিমা তো কখনো মুছে যাবে না। তিনি বলেন, কোনো মুক্তিযোদ্ধা তো নিজের নামের জন্য যুদ্ধ করেননি, যুদ্ধ করেছিলেন একটা দেশের নামের জন্য। তাই ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা সম্মিলনীর সৌজন্যে স্বাধীনতাসংগ্রামের শহীদদের স্মরণে সেখানে গড়ে উঠেছে ডলুরার সেই পবিত্রভূমি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা, ডলুরা সমাধিস্থলের পবিত্রভূমির মতো দেশটাও পবিত্র হোক।
সুরমা পেরিয়ে হল্লারঘাট থেকে একজন গারো কৃষক আন্দ্রেয়াজ দান্দালী আমাকে একটা ভাড়ার মোটরসাইকেলে করে রওনা হলেন নারায়ণতলার দিকে। ও গ্রামেই তাঁর বাড়ি। সুন্দর পাকা পথ। যেতে যেতে বাঁ দিকের একটা মাঠ দেখিয়ে জানালেন, ওইখানে ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের ফাঁড়ি। লোকেরা বলত লালবাড়ি। ওখান থেকেই তারা সুরমার এপারে বিভিন্ন গ্রামে অপারেশন চালাত। পাকা রাস্তার দুই পাশে কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, গাছগাছালি, ফসলের মাঠ, সমতল ভূমি। দেখতে দেখতে আমরা নারায়ণতলা মিশনে পৌঁছে গেলাম। পথে পড়ল চৌমুহনী বাজার। এরপর যেতে যেতে ঘরবাড়ি একটু পাতলা হয়ে এল। দেখতে পেলাম নতুন গড়ে কিছু ওঠা হালকা কুঁড়েঘর, নতুন নতুন বসতি, রক্তরাঙা ফুল ফোটা শিমুলগাছ আর বাঁশঝাড়। আলগা বালুর পথ। তবে ডলুরা গণকবর পর্যন্ত রাস্তাটা পাকা। শহীদদের কবরের কয়েক হাত পেছনেই নোম্যানস-ল্যান্ড, এর কয়েক হাত দূরেই ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারের কঠিন বেড়া। ওপারে মেঘালয়ের সুউচ্চ খাসিয়া পাহাড়। আন্দ্রেয়াজ জানালেন, গ্রামটাতে এখনো প্রায় আড়াই শ ঘরে গারো আদিবাসীর বাস রয়েছে। সেখানেই মেঘের পাহাড় মেঘালয়ের কোলঘেঁষে ডলুরা গণকবরে লালনুড়ির বালুর বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন আটচল্লিশজন শহীদ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ডলুরা ছিল বালাট সাব-সেক্টরের অধীন। সেই সাব-সেক্টরে তখন যুদ্ধ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. লুৎফর রহমান ওরফে জজ মিয়া। তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, এখনো একাকী থাকলে গুলি আর বোমার শব্দ শুনি। সুনামগঞ্জে মার্চের পর থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের ফলে অনেক লোক তখন ঢাকা ত্যাগ করে তাদের গ্রামের বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আসতে থাকে। কেউ কেউ সীমান্ত পেরিয়ে আরও নিরাপদ জায়গার খোঁজে চলে যায় রিফিউজি ক্যাম্পে। আবার কেউ কেউ সীমান্ত পেরিয়ে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে। ফিরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ডলুরা সীমান্তবর্তী গ্রাম হওয়ায় এবং মেঘালয়ে যাওয়ার জন্য যোগাযোগব্যবস্থা ভালো থাকায় রোজই বিপুল লোক এ পথে আসতে থাকে। কমান্ডারের নির্দেশ ছিল, এসব লোককে যেন আমরা ঠিকমতো সেবা দিই, আশ্রয় দিই। প্রায় প্রতি রাতেই আমরা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে দু-চারজন লোকের থাকার ও খাবারের ব্যবস্থা করতাম। মনে পড়ে ভালো লাগে যে তখন সিলেটের এম সি কলেজ, ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ, ভৈরব কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা এ পথে সীমান্ত পার হওয়ার জন্য আসত মুক্তিযোদ্ধা হতে, যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। তাই কৌশলগত কারণে এ জায়গাটা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য তারা সুরমা নদীর এ পারে ক্যাম্প স্থাপন করে ভারতগামী লোকদের আসা প্রতিরোধের চেষ্টা করে। তবুও তারা বিভিন্ন ঘুরপথে ঝুঁকি নিয়ে আসতে থাকে। এরপর শুরু হয় ডলুরা ও তার আশপাশে আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ, কাউন্টার-অ্যাটাকে ওরাও যেমন মরতে থাকে, তেমনি আমাদেরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান। তাঁদের শবদেহগুলো গ্রামবাসী ও সহযোদ্ধারা এই ডলুরা সীমান্তে এনে সমাহিত করেন। মো. মন্তাজ মিয়া, মো. রহিম বখত, মো. ধনু মিয়া, মো. কেন্তু মিয়া, অধর দাস, কবীন্দ্র নাথ—এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে সমাহিত করা হয়। যাঁদের পরিচয় পাওয়া গেছে, নামফলকে শুধু সেই আটচল্লিশজনের নামই আছে। ফলকে নাম নেই, এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাও এখানে সমাহিত আছেন বলে তিনি জানান। তাঁদের পরিচয় হয়তো কেউ কখনো জানবে না। কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগের মহিমা তো কখনো মুছে যাবে না। তিনি বলেন, কোনো মুক্তিযোদ্ধা তো নিজের নামের জন্য যুদ্ধ করেননি, যুদ্ধ করেছিলেন একটা দেশের নামের জন্য। তাই ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা সম্মিলনীর সৌজন্যে স্বাধীনতাসংগ্রামের শহীদদের স্মরণে সেখানে গড়ে উঠেছে ডলুরার সেই পবিত্রভূমি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা, ডলুরা সমাধিস্থলের পবিত্রভূমির মতো দেশটাও পবিত্র হোক।
No comments