দ্য ড্যান্সিং গার্ল! by শাঈখ আল মাহমুদ বনি
নৃত্যরতা
মেয়েটি, বা দ্য ড্যান্সিং গার্ল – আমাদের ভারতবর্ষের পুরাকীর্তিগুলোর
মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নিদর্শন। বইয়ে অনেক পড়েছি এই ভাস্কর্যের
কথা, সামনাসামনি এই পাঁচ হাজার বছরের পুরনো নিদর্শন দেখে নির্বাক হয়ে
গিয়েছিলাম।
সিন্ধু সভ্যতার শিল্পসৌকর্যের অনুপম এই নিদর্শনটির বয়স প্রায় পাঁচ হাজার
বছর! (২০০০-২৭০০ খ্রিঃপূঃ)। জন ম্যাকে নামে একজন প্রথিতযশা পুরাতাত্ত্বিক
১৯২৬ সালে এই নিদর্শনটি আবিষ্কার করেন মোহেনজোদারো এলাকাতে,
প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের পরে পাওয়া এক বাড়ির উনুনের কাছে।
এই ভাস্কর্যটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? একটু সময় নিয়ে তাকাই এই ভাস্কর্যের
দিকে, দেখতে পাবো এর চমৎকার বৈশিষ্ট্যগুলো। দুই হাত ভরা বালা পরে সম্পূর্ণ
নিরাবরণ একজন নারী খুবই আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন কোমরে হাত দিয়ে।
এই ভাস্কর্য থেকে সিন্ধু সভ্যতার নারীদের পরিধেয় অলঙ্কার প্রসঙ্গে কিছুটা
ধারণা করা যায়। এই যে একহাত ভর্তি চুড়ি, এইরকম কিন্তু এখনো দেখা যায়
রাজস্থানে, বাঞ্জারা নামের যাযাবর গোষ্ঠীর নারীদের মাঝে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিমার
মাঝে যে আত্মবিশ্বাস আছে, এ থেকে সেই সময়ের সামাজিক পরিমণ্ডলে নারীদের
উঁচু অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যায় কি? এর ইন্টারপ্রিটিশান নিয়ে
একেক বিশেষজ্ঞ একেক মন্তব্য করেছেন। ধারণা করে নেয়া হলো, এই ভাস্কর্যের
নারীটি পেশায় একজন নৃত্যশিল্পী, তার চারুময় ভঙ্গিমা দেখে এবং এ থেকেই এর
নাম হয়ে গেল ড্যান্সিং গার্ল।
প্রত্নতাত্ত্বিক শিরিন রত্নাগর বলছেন,
- *“তার ঘন দীর্ঘ চুল নান্দনিক ভঙ্গিমায় গুটিয়ে ঘাড়ের কাছে খোঁপার মতো নিবদ্ধ। মূর্তিটি নগ্ন, কিন্তু কামোদ্দীপক নয় বরং অত্যন্ত সারল্যমাখা।“
এই ভাস্কর্যটি সিন্ধু সভ্যতার মানুষজনের কারিগরি দক্ষতা নিয়েও একটি
ধারণা দেয়। এটি ব্রোঞ্জে তৈরি। এই ভাস্কর্য থেকেই আমরা প্রথম জানতে পারি যে
সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা মেটাল কাস্টিং সম্পর্কে খুব ভালোমতোই ওয়াবকিবহাল
ছিল। এ ভাস্কর্যটি বানানোর জন্যে প্রথমে একটি কাদামাটির নমুনা তৈরি করা
হয়েছিল। এরপর সেই নমুনার গায়ে মোমের একটি পাতলা আস্তরণ দিয়ে দেয়া হলো। এরপর
তার উপর কাদামাটির আরেকটি স্তর চাপিয়ে দেয়া হলো। এখন কাদামাটির দুইস্তরের
মাঝামাঝি মোমের যে পাতলা স্তর আছে, সেখানে গলিত উত্তপ্ত ব্রোঞ্জকে ঢালা
হলো। মোম সহজেই বাষ্পীভূত হয়ে গেল এবং ব্রোঞ্জের একটি চমৎকার পাতলা
আস্তরণের অসাধারণ ভাস্কর্য আমরা পেয়ে গেলাম।
প্রত্নতত্ত্ববিদ শিরিন রত্নাগর অবশ্য বলছেন,
*“এই ভাস্কর্যটি আদতে আরো বড় কোন ভাস্কর্যের অংশবিশেষ, যেটা তার হাতের দিকে তাকালে বোঝা যায়, যেনবা সেখানে কোন খুঁটির মতো কিছু ধরে রাখার জায়গা ছিল।”
এই ভাস্কর্যটি আরো সাক্ষ্য বহন করে যে, সিন্ধু সভ্যতায় নৃত্যকলার কদর ছিল, বিনোদন ছিল তাদের জীবনধারার অংশ।
এর সমসাময়িক আরেকটি নিদর্শন পাওয়া গেছে মোহেনজোদারোতেই। আরেকটি মেয়ের
ভাস্কর্য কিন্তু সে যেন এই ড্যান্সিং গার্লের সৌন্দর্যপ্রভার কাছে অনেকটাই
ম্লান হয়ে আছে। সেটি এখন আছে পাকিস্তানের করাচির জাদুঘরে। মোহেনজোদারো এখন
পড়েছে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে। পাকিস্তান ও ভারতের মাঝে এই ড্যান্সিং
গার্লকে নিয়ে বেশ বিবাদ আছে, পাকিস্তান দাবি করে যে এই ড্যান্সিং গার্ল এর
উত্তরাধিকারী তারা। তাকে যেন এই অমূল্য নিদর্শন ফিরিয়ে দেয়া হোক। ২০১৬ সালে
এই নিয়ে বেশ কোর্টকাচারিও হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ইতালির কাছে মোনালিসা
যেমন, পাকিস্তানের কাছেও এই ড্যান্সিং গার্ল তেমনই।
পাঁচ হাজার বছরে আমাদের কি বিপুল পরিবর্তন! সিন্ধু সভ্যতার খুবই
উন্নতমানের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল, পানির বিতরণ নিয়ে তারা রীতিমতো
অবসেসড ছিল। জলপ্রকৌশলের আদিমতম কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে সেখানে। অথচ আমরা
এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলে মিরপুরকে পানির নীচ থেকে তুলতে পারি না। এই নৃত্যরতা
রমণী যে নির্ভয়ে যে আত্মবিশ্বাসে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সময়ে আমাদের আধুনিক
শহরে কি কোন নারী এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়াতে পারে?
দ্যা ডান্সিং গার্ল |
No comments