‘গল্পটা আসতে হবে ভেতর থেকে’ by জিয়া উস সালাম
উজমা আসলাম খান |
উজমা আসলাম খানের দি মিরাকুলাস ট্রু হিস্টরি অব নমি আলি পড়তে হলে
ভালোবাসার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই পাকিস্তানি লেখক নিজে বলেছেন: ভালোবাসা
হলো ঘৃণার বিপরীত। তুমি যাকে ভালোবাসবে, সে তোমাকে ভালোবাসবে। তিনি শব্দ
নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন কিংবা বলা যায় শব্দের জীবন ভালোবাসেন। সেগুলোই তার
কাজে ফুটে ওঠে। তার থিনার দ্যান স্কিন ম্যান ছিল এশিয়ান লিটারেরি প্রাইজের
সংক্ষিপ্ত তালিকায়, কমনওয়েলথ প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছিল ট্রেসপাসিং।
থিনার দ্যান স্কিন ২০১৪ সালের করাচি লিটারেচারি ফেস্টিভ্যালে সেরা ফিকশনের
জন্য ফ্রেঞ্জ প্রাইজ পেয়েছিল। তিনি জিওমেট্রি অব গডসের জন্য স্বাধীন
পাবলিশার বুক অ্যাওয়ার্ডসে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছিলেন।
দি মিরাকুলাস ট্রু হিস্টরি অব নমি আলিকে কোনো গণ্ডিতেই ফেলা যায় না এবং
এ কারণেই লেখক একে ‘ঐতিহাসিক ফিকশন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আন্দামান ও
নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রেক্ষাপটে লেখা গ্রন্থটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময়কার ঘটনা বলেছে, ওই সময় সেখানে বন্দীদের লড়াই, উপনিবেশ প্রভুদের আচরণের
কথা তুলে ধরা হয়েছে।
একদিকে আমরা এমনসব ব্রিটিশের দেখা পাই, যারা মেয়াদ কাটিয়ে দেয়া বা
নির্দোষ ঘোষিত বন্দীদের ব্যাপারে তেমন যত্নবান ছিল না। কেবল তাদেরকে এক
টুকরা জমি মঞ্জুর করেই দায়িত্ব শেষ করত। অন্য দিকে ছিল জাপানিরা। তারা
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে (আইএনএ) সমর্থন করত। এমন অবস্থাতেই নমি ও তার
ভাই জি এবং তাদের বন্ধু আইয়ের কথা সামনে এসেছে। বিশ্ব শক্তিগুলোর দাবার
ঘুঁটি ছিল তারা। এসব লোকের মধ্য দিয়েই উজমা ইংল্যান্ড, জাপান, ফিলিপাইন ও
ওশেনিয়ার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
ফিকশনটির প্লট এতই জটিল যে কাহিনী শেষ করতে তার লেগেছে ২৬ বছর। তিনি এর
মধ্যে চারটি উপন্যাস লিখে ফেলেছেন, তবে এর মধ্যে নমি আলির কাহিনী শেষ করার
কথা ভোলেননি।
অনেক বছর আগে উজমা আসলাম খান পছন্দের পছন্দের বই পাওয়ার জন্য লাইব্রেরির
তাকগুলোতে হাতরাচ্ছিলেন। এই সময়েই সেলফ থেকে একটি বই পড়ে যায়। তিনি বইটি
কুড়িয়ে নাম দেখে তথ্যটি জ্যাকেটে টুকে রাখেন। বইটি নিয়ে তার আগ্রহের সৃষ্টি
হলো। এটি ছিল আন্দামান নিয়ে। আর তখনই তার মাথায় নমি আলির কাহিনী ভর করে।
এখানে ফ্রন্টলাইনে দেয়া তার সাক্ষাতকার প্রকাশিত হলো।
প্রশ্ন: ভারতে ইতিহাস নিয়ে নতুন আঙ্গিকে লেখা হচ্ছে। অনেকে
এমনকি একে কৌতুকের মতো করে বলে, ঐতিহাসিক ফিকশন। দি মিরাকুলাস ট্রু হিস্টরি
অব নমি আলির লেখক হিসেবে ঐতিহাসিক ফিকশন বলতে আপনি কী বোঝেন? এতে কি
ফিকশনের আড়ালে চলে যায় ইতিহাস?
উজমা: যারা ক্ষমতায় থাকে, তারাই পুনঃলেখনের কাজটি করছে। তারা ক্ষমতাহীন
লোকদের কথা মুছে ফেলার জন্য এমনটি করে। ক্ষমতার মাধ্যমে ইতিহাস নির্মাণ করা
অবস্থায় বেড়ে ওঠা পাকিস্তানের একজন নারীর জন্য ঐতিহাসিক ফিকশন আলাদা
উদ্দেশ্য বহন করে। এটা নীরব থাকা বা ঘৃণার জন্য নয়, বরং সমৃদ্ধ করার জন্য,
সহানুভূতি প্রকাশ করার জন্য। আমাদের সামনে যে ইতিহাস রয়েছে, সেটাই একমাত্র
ইতিহাস, তা আমরা সবসময় প্রত্যাখ্যান করে আসছি। ঐতিহাসিক ফিকশনের উদ্দেশ্য
হলো অস্তিত্বহীন কাহিনীগুলোতে মূর্ত করা।
প্রশ্ন: আপনি কোথা থেকে শুরু করলেন?
উজমা: আমি গবেষণার জন্য অনেক সময় ব্যয় করেছি। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে
ইতিহাসকে পেছনের দিকে যেতে দিয়েছি। ঐতিহাসিক বা সমসাময়িক, যে ঘটনাই হোক না
কেন, কাহিনীটি অনুভূত হতে হবে। আর তা হতে হবে নিজের ভেতর থেকে। আমার কাছে
কোনো রূপরেখা থাকে না, কোনো সংক্ষিপ্ত ধারণা থাকে না। কাহিনী এগিয়ে যায়
নিজের গতিতে। চরিত্রগুলো থাকে প্রধান অবস্থানে, ইতিহাস হয়ে পড়ে গৌণ।
প্রশ্ন: অনেক ইতিহাস আছে এবং ইতিহাস দেখার পদ্ধতিও অনেক। কিন্তু
তারপরও নারীদের ভূমিকা, তাদের অর্জন, তাদের দুর্ভোগ প্রান্তিক করার একটি
অভিন্ন অবস্থানও আছে। ইতিহাস প্রায়ই পুরুষদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়।
ঐতিহাসিক ফিকশন নিয়ে কাজ করার সময় এসব বৈষম্য সমাধানের চ্যালেঞ্জ কিভাবে
নিয়েছেন?
উজমা: শুরুতে যতটা হতাশাজনক ছিল, ততটা চ্যালেঞ্জিং ছিল না। আমি
স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই ধরনের নারীর সামনে পড়েছি। এক ধরনের নারী ছিলেন
নারী আদর্শ। তাদেরকে কর্তব্যপরায়ণ, সামাজিক কাজের মাধ্যমে পুরুষদের
প্রয়াসের প্রতি সমর্থক সতী বোন ও স্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অপর
ধরনের নারীরা পুরুষদের মতোই শক্তিশালী হিসেবে ছিলেন। পুরুষদের লিখিত
গ্রন্থে তাদের নাম কেবল উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রশ্ন: নিশ্চিতভাবেই তা হতাশা হওয়ার কথা?
উজমা: উপন্যাস লেখার একপর্যায়ে কী বলা হয়েছে, কী বলা হয়নি, তা নিয়ে
চিন্তা করা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি অন্য জগতে প্রবেশ করেছি, ভাষা ও চরিত্রের
ওপর নির্ভর করেছি। আমি ২৬ বছর ধরে যে উপন্যাসটি লিখেছি, তাতে প্রথম
চরিত্রটিই ছিল পরিচয় অজানা এক রাজবন্দী। শুরু থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল ওই
নারীর দৈনিক ও অন্তর্মুখী জীবন। আমি তাকে স্রেফ বন্দী হিসেবে দেখেছি। আমি
তাকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছি।
প্রশ্ন: আপনি কারাগার হিসেবে আন্দামানের কথা বলেছেন। এখানে
ইতিহাস আছে সামান্য। আমরা ভারতে জানি যে এক বন্দী ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমার
পত্র লিখেছিলেন এবং উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন স্থায়ী করার জন্য কাজ করার
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। গবেষক হিসেবে এ ধরনের চিঠিপত্রকে কি আপনি কাপুরোষিত
আত্মসমর্পণ হিসেবে বিবেচনা করেন?
উজমা: অবশ্যই, আমি জানি না কে বলছে। তবে আমার বইতে আমি ওই ধরনের লোকদের নিয়ে কাজ করিনি। তাদের নিয়ে তো লেখা হয়েই গেছে।
প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, আপনার চরিত্রগুলো ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বাস করে। এটা কি আপনার কাজকে জটিলতার দিকে নিয়ে গেছে?
উজমা: মনে হয় নিয়েছে।
প্রশ্ন: ভারতে আপনার বেশ কিছু নিবেদিতপ্রাণ পাঠক আছে।
পাকিস্তানি লেখক হিসেবে তাদের মানসিকতা এবং তাদের কাছে আপনার
গ্রহণযোগ্যতাকে কিভাবে দেখেন?
উজমা: আগের চারটি উপন্যাসে আমি ভিন্ন কিছুর সামনে পড়িনি। এটা নির্ভর করে
যিনি রিভিউ করেন, তার ওপর। এই বইটির জন্য এখন পর্যন্ত ভারত থেকেই বেশি চাপ
এসেছে। সম্ভবত শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি।
No comments