রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: কেনাকাটায় অভিনব দুর্নীতি, তদন্ত চলছে by মো. আরিফুজ্জামান
প্রতিটি
বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর প্রতিটি বালিশ আবাসিক
ভবনের খাটে তোলার মজুরি দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। কভারসহ কমফোর্টারের (লেপ বা
কম্বলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত) দাম ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা। যদিও এর
বাজারমূল্য সাড়ে ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। একইভাবে
বিদেশি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৩৬ টাকায়। এর বাজারমূল্য অবশ্য
তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।
এটি একটি সরকারি কেনাকাটার চিত্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদেশিদের আবাসিক ভবনের জন্য এসব কেনাকাটায় অস্বাভাবিক মূল্য ধরা হয়েছে। পাঁচটি ২০ তলা ভবনের জন্য এসব কেনাকাটা হয়েছে। প্রতিটি তলায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য কমফোর্টার শুধু বেশি দামে কেনাই হয়নি, কেনার পর দোকান থেকে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছাতে আলাদা ট্রাক ব্যবহার করা হয়েছে। মাত্র ৩০টি কমফোর্টারের জন্য ৩০ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া দেখানো হয়েছে। আর একেকটি কমফোর্টার খাট পর্যন্ত তুলতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ হাজার ১৪৭ টাকা। কমফোর্টার ঠিকঠাকমতো খাট পর্যন্ত তোলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য তত্ত্বাবধানকারীর পারিশ্রমিক দেখানো হয়েছে প্রতিটির ক্ষেত্রে ১৪৩ টাকা। ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ লাভ ধরে সম্পূরক শুল্কসহ সব মিলিয়ে প্রতিটি কমফোর্টারের জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২২ হাজার ৫৮৭ টাকা। শুধু কমফোর্টার নয়, চাদরের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। ৩০টি চাদর আনতে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ট্রাক ভাড়া করা হয়েছে। আর ভবনের নিচ থেকে খাট পর্যন্ত তুলতে প্রতিটি চাদরের জন্য মজুরি দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা।
এভাবে ফ্রিজ, ইলেকট্রিক কেটলি, ওয়াশিং মেশিন, ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন আসবাব ও পণ্য ক্রয়ে অস্বাভাবিক মূল্য দেখানো হয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রতিটি কেনাকাটায়। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। গত কয়েক দিনে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে পাবনায় অবস্থিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবনে ১৪৬ কোটি টাকার পণ্য কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেনাকাটার প্রতিটিতে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, প্রকল্পটিতে একবারে দরপত্র না ডেকে ছয় ধাপে বা প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১০০ কোটি টাকার ওপর কেনাকাটা হলে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশ প্রয়োজন হয়। এর নিচে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত মন্ত্রী অনুমোদন দেন। আর তার নিচে হলে গণপূর্তের সংস্থাপ্রধান বা প্রধান প্রকৌশলী অনুমোদন দিতে পারেন। রূপপুরের ১৪৬ কোটি টাকার কেনাকাটা একবারে না করে ছয়টি প্যাকেজে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যাতে বিষয়টি মন্ত্রিসভা ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন না লাগে।
এসব অভিযোগ তদন্তে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি কমিটি গঠন করেছে। এরই মধ্যে গত অক্টোবরে ২৯ কোটি ১৫ লাখ টাকার একটি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি পাঁচটি বিল পরিশোধ না করার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩০ কোটি টাকার নিচে থাকলে গণপূর্তের সংস্থাপ্রধান বা প্রধান প্রকৌশলীই অনুমোদন দিতে পারেন। সেটি মন্ত্রণালয়ে আসে না। সে কারণে আমাদের পক্ষে এটি জানা সম্ভব হয় না। একটিমাত্র বিল দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ ওঠার পর বাকি চারটি বিল আটকে রাখা হয়েছে।’
মন্ত্রণালয় ও ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভাকে এড়াতেই কি ইচ্ছা করে ছয়টি প্যাকেজে দরপত্র ডাকা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘আপনি যেটা বুঝছেন, আমরাও সেটি বুঝছি। এভাবে ছয়টি প্যাকেজে না করে একটি প্যাকেজেই দরপত্র ডাকা যেত।’
অস্বাভাবিক মূল্যে পণ্য কেনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গণপূর্ত বিভাগের সাত কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে পাবনার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
কাজ পেয়েছে কারা
ছয়টি প্যাকেজের মধ্যে তিনটি কাজই পেয়েছে ঠিকাদার শাহাদাত হোসেনের মালিকানাধীন সাজিন এন্টারপ্রাইজ। এই শাহাদতের সঙ্গে পাবনা সদর আসনের সাংসদ গোলাম ফারুক খন্দকারের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ছয় প্যাকেজে মোট ১৪৬ কোটি টাকার মধ্যে সাজিন এন্টারপ্রাইজ তিনটি কাজ পেয়েছে। একটি কাজ পেয়েছে মজিদ সন্স লিমিটেড। সাজিন এন্টারপ্রাইজের তিনটি কাজের মধ্যে একটি ২৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার বিল গত বছরের অক্টোবরে পরিশোধ করা হয়েছে। তহবিলসংকটের কারণে অন্যরা বিল নিতে পারেনি। তবে এখন মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে বিল দিতে নিষেধ করেছে।
সাজিন এন্টারপ্রাইজ কী করে তিনটি কাজ পেল, জানতে চাইলে শাহাদত হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরপত্র ডাকা হয়েছে। আমরা অংশ নিয়েছি, সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজগুলো পেয়েছি।’ সাংসদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণেই একাধিক কাজ পেয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শাহাদাত বলেন, ব্যবসা করতে হলে তো স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেই হয়। শুধু এমপি সাহেব নন, অনেকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে।’
কেনাকাটা অনুমোদনকারী রাজশাহী গণপূর্ত জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এত বড় কেনাকাটা এর আগে গণপূর্ত করেনি। সে কারণে ঠিকাদার পাওয়া যেত না। আগামী অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই রাশিয়ানদের কাছে সব কটি ভবন বুঝিয়ে দেওয়ার তাড়া ছিল। এ জন্য ছয়টি প্যাকেজে করা হয়েছে, দুর্নীতির উদ্দেশ্য থেকে করা হয়নি।
কেনাকাটায় নয়ছয়
রূপপুর প্রকল্পে কেনাকাটার তালিকায় দেওয়া নয়টি পণ্যের মূল্যে সরেজমিন বাজারমূল্য যাচাই করে ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে। হাতিল (হাতিল কোড-১০৭) বা সমমানের ছয়টি চেয়ারসহ একটি ডাইনিং টেবিলের মূল্য দেওয়া হয়েছে ৮৩ হাজার ৭৯০ টাকা। কনফারেন্স টেবিলের মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫০ টাকা। রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের হাতিলের শোরুমের বিক্রয়কর্মী নুরুল আলম জানিয়েছেন, এ মডেলের চেয়ারসহ ডাইনিং টেবিলের কোনো ছাড় ছাড়াই মূল্য ৪৩ হাজার ৭০০ টাকা। আর কনফারেন্স টেবিলের মূল্য ১ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ টাকা।
একটি মিয়াকো ইলেকট্রিক কেটলির দাম দেখানো হয়েছে ৪ হাজার ৩৫৫ টাকা। অথচ বেস্ট ইলেকট্রনিকসের ব্যবস্থাপক নোমান চৌধুরী জানিয়েছেন, এ ব্র্যান্ডের ওয়ারেন্টিযুক্ত ইলেকট্রিক কেটলির দাম ১ হাজার ৩০০ টাকা। আর ওয়ারেন্টি ছাড়া ৮৫০ টাকা। এ রকম অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক দাম ধরা হয়েছে।
রূপপুর প্রকল্পের কেনাকাটায় বেস্ট ইলেকট্রনিকস থেকে পণ্যের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক নোমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রূপপুরের ঠিকাদাররা আমাদের একটি পণ্যমূল্যের তালিকা দিতে বলেছিলেন। তাঁরাই বলেছিলেন বেশি করে দাম ধরে দিতে। আমরা যে মূল্য ঠিক করে দিয়েছিলাম, তা প্রকৃত মূল্য থেকে অনেক বেশি। তবে ওই ঠিকাদাররা আমাদের কাছ থেকে পণ্য কেনেননি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এটি সাগরচুরি। বাংলাদেশে এর আগে এমনটি শোনা যায়নি। পৃথিবীর কোথাও ঘটেছে কি না, জানা নেই। এই সরকারের এটি অগ্রাধিকার প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে বলেছেন, সে কারণে এর হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।
এটি একটি সরকারি কেনাকাটার চিত্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদেশিদের আবাসিক ভবনের জন্য এসব কেনাকাটায় অস্বাভাবিক মূল্য ধরা হয়েছে। পাঁচটি ২০ তলা ভবনের জন্য এসব কেনাকাটা হয়েছে। প্রতিটি তলায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য কমফোর্টার শুধু বেশি দামে কেনাই হয়নি, কেনার পর দোকান থেকে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছাতে আলাদা ট্রাক ব্যবহার করা হয়েছে। মাত্র ৩০টি কমফোর্টারের জন্য ৩০ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া দেখানো হয়েছে। আর একেকটি কমফোর্টার খাট পর্যন্ত তুলতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ হাজার ১৪৭ টাকা। কমফোর্টার ঠিকঠাকমতো খাট পর্যন্ত তোলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য তত্ত্বাবধানকারীর পারিশ্রমিক দেখানো হয়েছে প্রতিটির ক্ষেত্রে ১৪৩ টাকা। ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ লাভ ধরে সম্পূরক শুল্কসহ সব মিলিয়ে প্রতিটি কমফোর্টারের জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২২ হাজার ৫৮৭ টাকা। শুধু কমফোর্টার নয়, চাদরের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। ৩০টি চাদর আনতে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ট্রাক ভাড়া করা হয়েছে। আর ভবনের নিচ থেকে খাট পর্যন্ত তুলতে প্রতিটি চাদরের জন্য মজুরি দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা।
এভাবে ফ্রিজ, ইলেকট্রিক কেটলি, ওয়াশিং মেশিন, ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন আসবাব ও পণ্য ক্রয়ে অস্বাভাবিক মূল্য দেখানো হয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রতিটি কেনাকাটায়। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। গত কয়েক দিনে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে পাবনায় অবস্থিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবনে ১৪৬ কোটি টাকার পণ্য কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেনাকাটার প্রতিটিতে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, প্রকল্পটিতে একবারে দরপত্র না ডেকে ছয় ধাপে বা প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ১০০ কোটি টাকার ওপর কেনাকাটা হলে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশ প্রয়োজন হয়। এর নিচে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত মন্ত্রী অনুমোদন দেন। আর তার নিচে হলে গণপূর্তের সংস্থাপ্রধান বা প্রধান প্রকৌশলী অনুমোদন দিতে পারেন। রূপপুরের ১৪৬ কোটি টাকার কেনাকাটা একবারে না করে ছয়টি প্যাকেজে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যাতে বিষয়টি মন্ত্রিসভা ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন না লাগে।
এসব অভিযোগ তদন্তে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি কমিটি গঠন করেছে। এরই মধ্যে গত অক্টোবরে ২৯ কোটি ১৫ লাখ টাকার একটি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি পাঁচটি বিল পরিশোধ না করার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩০ কোটি টাকার নিচে থাকলে গণপূর্তের সংস্থাপ্রধান বা প্রধান প্রকৌশলীই অনুমোদন দিতে পারেন। সেটি মন্ত্রণালয়ে আসে না। সে কারণে আমাদের পক্ষে এটি জানা সম্ভব হয় না। একটিমাত্র বিল দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ ওঠার পর বাকি চারটি বিল আটকে রাখা হয়েছে।’
মন্ত্রণালয় ও ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভাকে এড়াতেই কি ইচ্ছা করে ছয়টি প্যাকেজে দরপত্র ডাকা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘আপনি যেটা বুঝছেন, আমরাও সেটি বুঝছি। এভাবে ছয়টি প্যাকেজে না করে একটি প্যাকেজেই দরপত্র ডাকা যেত।’
অস্বাভাবিক মূল্যে পণ্য কেনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গণপূর্ত বিভাগের সাত কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে পাবনার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
কাজ পেয়েছে কারা
ছয়টি প্যাকেজের মধ্যে তিনটি কাজই পেয়েছে ঠিকাদার শাহাদাত হোসেনের মালিকানাধীন সাজিন এন্টারপ্রাইজ। এই শাহাদতের সঙ্গে পাবনা সদর আসনের সাংসদ গোলাম ফারুক খন্দকারের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ছয় প্যাকেজে মোট ১৪৬ কোটি টাকার মধ্যে সাজিন এন্টারপ্রাইজ তিনটি কাজ পেয়েছে। একটি কাজ পেয়েছে মজিদ সন্স লিমিটেড। সাজিন এন্টারপ্রাইজের তিনটি কাজের মধ্যে একটি ২৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার বিল গত বছরের অক্টোবরে পরিশোধ করা হয়েছে। তহবিলসংকটের কারণে অন্যরা বিল নিতে পারেনি। তবে এখন মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে বিল দিতে নিষেধ করেছে।
সাজিন এন্টারপ্রাইজ কী করে তিনটি কাজ পেল, জানতে চাইলে শাহাদত হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরপত্র ডাকা হয়েছে। আমরা অংশ নিয়েছি, সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজগুলো পেয়েছি।’ সাংসদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণেই একাধিক কাজ পেয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শাহাদাত বলেন, ব্যবসা করতে হলে তো স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেই হয়। শুধু এমপি সাহেব নন, অনেকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আছে।’
কেনাকাটা অনুমোদনকারী রাজশাহী গণপূর্ত জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী নজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এত বড় কেনাকাটা এর আগে গণপূর্ত করেনি। সে কারণে ঠিকাদার পাওয়া যেত না। আগামী অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই রাশিয়ানদের কাছে সব কটি ভবন বুঝিয়ে দেওয়ার তাড়া ছিল। এ জন্য ছয়টি প্যাকেজে করা হয়েছে, দুর্নীতির উদ্দেশ্য থেকে করা হয়নি।
কেনাকাটায় নয়ছয়
রূপপুর প্রকল্পে কেনাকাটার তালিকায় দেওয়া নয়টি পণ্যের মূল্যে সরেজমিন বাজারমূল্য যাচাই করে ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে। হাতিল (হাতিল কোড-১০৭) বা সমমানের ছয়টি চেয়ারসহ একটি ডাইনিং টেবিলের মূল্য দেওয়া হয়েছে ৮৩ হাজার ৭৯০ টাকা। কনফারেন্স টেবিলের মূল্য দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫০ টাকা। রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের হাতিলের শোরুমের বিক্রয়কর্মী নুরুল আলম জানিয়েছেন, এ মডেলের চেয়ারসহ ডাইনিং টেবিলের কোনো ছাড় ছাড়াই মূল্য ৪৩ হাজার ৭০০ টাকা। আর কনফারেন্স টেবিলের মূল্য ১ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ টাকা।
একটি মিয়াকো ইলেকট্রিক কেটলির দাম দেখানো হয়েছে ৪ হাজার ৩৫৫ টাকা। অথচ বেস্ট ইলেকট্রনিকসের ব্যবস্থাপক নোমান চৌধুরী জানিয়েছেন, এ ব্র্যান্ডের ওয়ারেন্টিযুক্ত ইলেকট্রিক কেটলির দাম ১ হাজার ৩০০ টাকা। আর ওয়ারেন্টি ছাড়া ৮৫০ টাকা। এ রকম অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক দাম ধরা হয়েছে।
রূপপুর প্রকল্পের কেনাকাটায় বেস্ট ইলেকট্রনিকস থেকে পণ্যের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক নোমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রূপপুরের ঠিকাদাররা আমাদের একটি পণ্যমূল্যের তালিকা দিতে বলেছিলেন। তাঁরাই বলেছিলেন বেশি করে দাম ধরে দিতে। আমরা যে মূল্য ঠিক করে দিয়েছিলাম, তা প্রকৃত মূল্য থেকে অনেক বেশি। তবে ওই ঠিকাদাররা আমাদের কাছ থেকে পণ্য কেনেননি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এটি সাগরচুরি। বাংলাদেশে এর আগে এমনটি শোনা যায়নি। পৃথিবীর কোথাও ঘটেছে কি না, জানা নেই। এই সরকারের এটি অগ্রাধিকার প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রী যেহেতু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে বলেছেন, সে কারণে এর হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।
No comments