আসামে মানবতা বিপর্যয়ের আয়োজন by বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী

আসামকে যখন ব্রিটিশরা পৃথক রাজ্যের মর্যাদা প্রদান করছিলেন তখন কাচাড়, গোয়ালপাড়া ও সিলেট জেলাকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিয়েছিলেন। একটা রাজ্যে যে রাজস্ব আয় থাকলে রাজ্যের মর্যাদা পায় তা আসামের ছিল না। তাই ব্রিটিশরা অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এ তিন জেলার লোকেরাই বাঙালি এবং বাংলা ভাষী।
দীর্ঘদিন এক রাজ্যের অধিবাসী হওয়ার কারণে এ তিন জেলার বহু লোক রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, অনাবাদি এলাকা আবাদ করলে জমি পাওয়া যায় এ কারণেই গণবসতিপূর্ণ এ তিন জেলার লোকজন জমি পাওয়ার আশায় অনাবাদি আসামকে আবাদও করেছে আবার সর্বত্র ছড়িয়েও পড়েছে এবং জমির মালিকও হয়েছে।
শুধু এ তিন জেলা থেকে নয়, পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে লর্ড কার্জন যখন ১৯০৫ সালে প্রদেশ গঠন করেছিলেন তখনও প্রচুর পূর্ব-বাংলার মুসলমান একই কারণে আসামে গিয়ে জঙ্গল আবাদ করেছেন, জমির মালিক হয়েছেন এবং বসতি স্থাপন করেছেন। শত বছর পরে গিয়ে কে বাঙালি কে আসামীয় নির্ণয় করতে গেলে যে বিভ্রান্তির উদ্ভব হয়, এখন আসামেও অনুরূপ এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
আসামীয়রা ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির সময় থেকে সর্তক ছিল যেন বাঙালিরা আসামে সংখ্যাগরিষ্ঠ না হয়। ১৯৪৭ সালের সিলেটে গণভোটের সময় আসামের মুখ্যমন্ত্রী বারদুলই আর কংগ্রেস নেতা বিষ্ণুরাম নানাভাবে সাহায্য করেছিলো যেন গণভোটে পাকিস্তান জিতে যায় আর সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। না হয় আসামে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায় এ ছিল তাদের ভয়।
১৯৩৫ সালে আসাম ও উড়িষ্যায় যখন ভাষা গঠন, অক্ষর উদ্ভব ও সাহিত্য সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল তখন কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজ উভয় জাতির সঙ্গে মিলে মিশে চেষ্টা করলে তারাও বাংলাভাষী হয়ে যেত। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা এ পরিশ্রমটুকু করেননি। উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী জানকী বল্লভ পট্টনায়েকরা বাংলা ভাষা জানতেন এবং জানকীর বাংলা সাহিত্যে কিছু অবদানও আছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী বরদুলুই তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সাংস্কৃতিক সাহিত্যে লেখাপড়া করেছিলেন। যাক নিজের খেয়ে পরের মহিষ চরানোর অভ্যাস কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজের ছিল না। তাদের সম্মিলিত বিরোধিতার কারণে ড. শহীদুল্লাহ সংস্কৃতিক কলেজে সংস্কৃতিক বিভাগে ভর্তি হতে পারেননি। পরে তিনি স্যার আশুতোষের পরামর্শে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সংস্কৃতিক সাহিত্যে লেখাপড়া করেছিলেন। ড. শহীদুল্লাহর অপরাধ ছিল তিনি ছিলেন মুসলমান।
যাক, আসামে জাত্যভিমানের কারণে “বাঙালি খেদাও” অভিযান পরিচালিত হয়েছে বহুবার। কখনও এসবে জড়িত ছিল অহমিয়া জনগোষ্ঠী, কখনও রাজ্য সরকার, কখনও উভয়ে সম্মিলিতভাবে। ছয় দশকে রাজ্য সরকার অহমিয়া ভাষাকে দাফতরিক ভাষার মর্যাদা প্রদান করলে বারাক উপত্যাকায় বাংলা ভাষাকেও সমমর্যাদা প্রদানের জন্য বাঙালিরা ভাষা আন্দোলন করেছিল। ১৯৬১ সালের ১৯ শে মে শিলচরে পুলিশের গুলিতে ১১ জন বাঙালি শহীদ হয়েছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারির পর ১৯শে মে  বাঙালিরা দ্বিতীয়বার ভাষার দাবিতে রক্ত দিয়েছিলেন।
অসমিরা বলে বাঙালিরা অভিবাসী। এ নিয়ে বহুবার দাঙ্গা হয়েছে। এবারের সমস্যার উদ্ভব হয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের একটা বিতর্কিত নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে। আদালত নাগরিক নিবন্ধনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। নিবন্ধনের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে ৪০ লক্ষ লোক তাদের বসতি সম্পর্কীয় কোনও কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। অথচ এ ৪০ লক্ষ লোকের মাঝে এমনও লক্ষ লক্ষ লোক আছে যারা ৪/৫ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন। একশত বছর আগে যারা বসতি গড়েছিলেন এবং লাইন প্রথা আন্দোলনে যাদের আসামের লোক বলে স্বীকার করা হয়েছে তারা আজ এক নবসৃষ্ট দুর্ভোগের শিকার হলেন।
নাগরিকত্ববিহীন ৪০ লক্ষ লোক সহজ কথা নয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আসামে মানবতা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বাদপড়া ব্যক্তিরা বাংলাদেশী নয়। ভারত সরকার অ-আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) নিয়ে তারা এমন কিছু করবেন না, যাতে বাংলাদেশের কোনও সমস্যা হয়। ভারত সরকারের এক মুখপাত্র বলেছেন, যারা নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেনি তাদের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এখনও কিছু চিন্তা করেনি।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, পুনরায় আবেদন গ্রহণ করা হবে। যাচাই বাছাই করা হবে। একটা কথা ভারত সরকারকে মনে রাখতে হবে, একশত বছর আগে সমগ্র ভারত ছিল ব্রিটিশদের একটা একক রাষ্ট্র। যার যেখানে ইচ্ছে সেখানে বসতি করা সম্ভব ছিল। কোনও অনুমতি লাগতো না। সুতরাং নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনও কাগজপত্র এই ৪০ লক্ষ লোক দেখাতে পারবে না। আমরা শঙ্কিত এ কারণে যে ৪০ লক্ষ লোক নাগরিকত্বহারা, আবার তারা মুসলমান।
আসামের রাজ্য সরকার বিজেপির। যেকোনও মুহুর্তে যেকোনও অমানবিক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তারা ‘ঘরওয়াপসি” অর্থাৎ ঘরে ফের বলে ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা বলে। আবার বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রের পরিণত করার জন্য লোকগুলোকে পুশইন করার উদ্যোগও নিতে পারে। সুতরাং সর্ব অবস্থায় আমরা ভারত সরকারকে অনুরোধ করবো বিষয়টা ঝুলিয়ে না রেখে যেন ৪০ লক্ষ লোককে নাগরিকত্ব প্রদানে কেন্দ্রীয় সরকার সহানুভূতির সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার যা বলেছে তা দেখতে স্বস্তিদায়ক। কিন্তু অতীতের যা নজির রয়েছে তাতে শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারে যারা রয়েছেন তাদের কারও কারও বক্তব্য ভারসাম্যমূলক নয়। জাত্যভিমানের কথা তুলে দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধানোও বিচিত্র নয়। বাংলাদেশ সরকার বলেছে এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা কূটনীতির ভাষা। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে আসামে গোলযোগ হলেই মানুষের স্রোত নামবে বাংলাদেশের দিকে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.