ইরানের ওপর ট্রাম্পের অবরোধ: এরপর কী?
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো ও ইয়েমেনের শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থনের জবাব হিসেবে ইরানের বিরুদ্ধে আবার অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। অবরোধের বিধানগুলোর মূলে রয়েছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। যেসব গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান ওই কর্মসূচির রসদ সরবরাহ করে, তাদের অবরোধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মার্কিন নতুন অবরোধের আওতায় থাকা খুব কমসংখ্যক ব্যক্তি বা দেশই যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা করে। ফলে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব বের করা সহজসাধ্য হবে না। তবে এ অবরোধ আরোপের মার্কিন সিদ্ধান্ত তেহরানে নতুন বার্তা পাঠাচ্ছে। তা হচ্ছে, ওয়াশিংটনে হাওয়া বদল হচ্ছে। ইরান সম্পর্কে আগের সরকারের অবস্থানে নেই ট্রাম্প প্রশাসন। ওবামার প্রশাসন ইরানের সঙ্গে সম্পর্কটাকে দেখছিল আলোচনা ও সমঝোতার আলোকে। ওবামা তেহরানের পরমাণু কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছেন। আঞ্চলিক পরিসরে কট্টরপন্থী সংগঠন হামাস ও হিজবুল্লাহকে সাহায্য করে ইরান। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের পক্ষাবলম্বন করেছে দেশটি। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করছে ইরান। প্রতিবেশী ইরাকেও নিজেদের প্রভাবের বলয় বাড়াতে চায় দেশটি। এর সব কটিই মার্কিন স্বার্থবিরোধী। এত কিছুর পরও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে আটকাতে দেশটির সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করেন ওবামা। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্ররা চুক্তির ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলেন। কিন্তু ইসরায়েল, সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোতে এ নিয়ে বেশ উদ্বেগ ছিল। তাদের আশা ছিল, ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে চুক্তিটি বাতিল করে দেবেন। অনেকটা তাই হচ্ছে। তেহরানের ওপর এসেছে নতুন অবরোধ। কিন্তু চুক্তি বাতিলের বিষয়টি যত সহজ মনে করা হচ্ছে, আদতে ততটা সহজ হবে না। সম্প্রতি ইসরায়েলে এক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন, একটি খারাপ চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হওয়া অন্তত কোনো চুক্তি না থাকার চেয়ে ভালো। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব ক্রমশ বেড়ে চলা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইসরায়েলের জন্য আশঙ্কার বিষয়। আশপাশের দেশগুলোতে ইরানের প্রভাব বলয় বাড়ার মানে হলো দেশটি ইসরায়েলের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান অবস্থার পেছনে মার্কিন সামরিক বাহিনীর বড় ভূমিকা আছে। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের মাধ্যমে ইরানের প্রভাব বলয় বাড়ানোর দরজা খুলে দেয় ওয়াশিংটন। আবার ইরাকে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াইয়েও যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান একধরনের মিত্র। সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওবামা প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দায়সারা গোছের উদ্যোগ শিয়া শক্তিগুলোকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প প্রশাসন ইরান সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তনের নীতি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এই অবরোধ সেটিরই প্রথম পদক্ষেপ।
ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবে, তা একটা বড় প্রশ্ন। মার্কিন প্রশাসনের অবশ্য একটা যুক্তি আছে। সেটা হচ্ছে, পরমাণু অস্ত্রবাহী কোনো ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা না করতে ইরানের প্রতি জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাব। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য অনুসারে ইরানের পরীক্ষা করা নতুন ক্ষেপণাস্ত্রটি ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে পরমাণু অস্ত্রসহ আঘাত হানতে সক্ষম। মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর বিধিনিষেধ মেনে চলতে এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার মতো আচরণ করলে ইরানকে ‘জবাবদিহি করাবে’। কিন্তু ‘জবাবদিহি করাবে’ বলতে ট্রাম্প প্রশাসন কী বোঝাতে চাইছে, তা স্পষ্ট নয়। পারস্য উপসাগরীয় জলরাশিতে এই দুটি দেশের যুদ্ধজাহাজ প্রতিদিন খুব কাছাকাছি আসে। উত্তেজনা থেকে বড় ধরনের সংঘাত বেধে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র কি তবে ইরানের সঙ্গে সংঘাতের পথেই চলছে? দেশটির বাগাড়ম্বরে হয়তো সেটাই মনে হবে। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাস্তব কার্যকলাপ আর ইরান তার কী জবাব দেয়, তার ওপরই নির্ভর করবে সবকিছু।
No comments