১২০০ অবৈধ মাদক নিরাময় কেন্দ্র! by মাহমুদ মানজুর
এখনও
স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি তার। মাঝখানে হারিয়ে গেছে হাফডজন বছর। শেষ
হয়েছে সংসার। আকাশ থেকে ছিটকে পড়েছে ঈর্ষণীয় তারকা জীবন। কোলের কন্যা
হারিয়েছে মায়ের স্নেহ, বাবার আদর। উড়ন্ত জীবন থেকে আটকা পড়েছেন রিহ্যাব
অথবা নিজ ঘরের চার দেয়ালে। নেশাতুর আঁধার থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে
তাকে নিয়ে নিরন্তর সংগ্রাম চলছে মা-বাবার। এ জীবন শীর্ষ এক টিভি তারকার।
স্বজন এবং সতীর্থদের তথ্য মতে, দেশের অন্যতম জনপ্রিয় এই তারকা সর্বস্ব
খুইয়েছেন নেশার কবলে পড়ে। তার মতো এমন অসংখ্য তাজা প্রাণ প্রতিনিয়ত পতিত
হচ্ছে মাদক নামক মরণনেশায়। মাদক ও ধূমপানবিরোধী সংগঠন ‘মানস’-এর
প্রেসিডেন্ট ডা. অরূপ রতন চৌধুরীর মতে, ‘মানুষের মনে বাড়ছে একাকিত্ব। ক্রমশ
ফুরিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। ঘরে ঘরে বাড়ছে সংকট। নষ্ট হচ্ছে একের ওপর অন্যের
বিশ্বাস। প্রতারণার ফাঁদ পাতা যেন সর্বত্র। সঙ্গে আছে বিরামহীন রাজনৈতিক
অস্থিরতা-সহিংসতা। তর তর করে কমে যাচ্ছে মনের কথা বলার অধিকার। সমাজের এমন
অসংগতি আর ব্যক্তিগত-সামাজিক হতাশা কাটাতেই মানুষ ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে উঠছে
মাদকের ওপর। যা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর আগামীর দিকে।’ একটি পরিবারকে
নিঃস্ব করে দিতে একজন মাদকাসক্ত সদস্যই যথেষ্ট। এ কথা স্বীকার করে মনোরোগ
বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘নিহত পুলিশ কর্মকর্তার
মাদকাসক্ত কন্যা ঐশী যখন তার বাবা-মাকে নির্মমভাবে হত্যা করে তখন সে ১৬ বা
১৮ বছরের ঐশী ছিল না, সে ছিল ঘাতক-দৈত্য ঐশী। আর মাদকদ্রব্যই ঐশীকে দৈত্যে
রূপান্তরিত করে। সমাজে এখন এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। যার বেশিরভাগই খবর আমরা
রাখি না।’ এমন বিপথগামী সদস্যদের নিয়ে যখন পরিবারগুলো অথৈ সাগরে খড়-কুটোর
সন্ধানে, তখনি ‘লাইট হাউজ’ হয়ে ধরা দেয় সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানসিক
ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো। কিন্তু এই নিরাময় কেন্দ্রগুলো
মাদকাসক্তদের জন্য কতটা নিরাপদ?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একরকম নিয়ন্ত্রণহীনভাবেই চলছে দেশের অধিকাংশ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নাকের ডগায় বসে চলছে এসব প্রতিষ্ঠানের নানামাত্রিক বাণিজ্য। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরেরও তেমন কোন ভ্রুক্ষেপ নেই এসব অভিযোগের প্রতি। ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব মাদক নিরাময় কেন্দ্রের অধিকাংশই অনুমোদনহীন। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে নিয়মনীতিহীনভাবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর অরাজকতার বিপরীতে এন্তার অভিযোগ রয়েছে মাদকাসক্ত রোগী ও পরিবারের। চিকিৎসার নামে রোগীর ওপর শারীরিক নির্যাতন, মাদকের ব্যবসা পরিচালনা ও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে অধিকাংশ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বেশিরভাগ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো এখন মাদক সেবনের নিরাপদ আখড়া! বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার জন্য সরকারি শর্তাবলীর মধ্যে রয়েছে- আবাসিক এলাকার পাকা বাড়ি বা ভবনে অবস্থিত, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ হতে হবে। একজন রোগীর জন্য কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকতে হবে। অন্যদিকে প্রতি ১০ বেডের জন্য পৃথক একটি টয়লেট, বাথরুম, বিশুদ্ধ পানি অন্যান্য সুব্যবস্থা এবং খণ্ডকালীন বা সার্বক্ষণিক একজন মনোচিকিৎসক, সার্বক্ষণিক একজন ডাক্তার, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স বা বয়, একজন সুইপার বা আয়া এবং জীবন রক্ষাকারী উপকরণ ও অত্যাবশ্যক ওষুধ থাকতে হবে। এ ছাড়া মাদকাসক্ত ব্যক্তির রক্ত, কফ, মলমূত্র ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত যে কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের সুবিধা থাকতে হবে। কেন্দ্রে একক বা দলগত পরামর্শক এবং মানসিক বিনোদনের জন্য অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন ও কাউন্সেলিংয়ের জন্য ২০ জনের উপযোগী একটি শ্রেণীকক্ষ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সরজমিন দেখা যায়, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ নিরাময় কেন্দ্রই মানছে না এ নিয়মগুলো। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বজলুর রহমান জানান, বিধিমালা অনুসারে কেন্দ্র পরিচালনার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলসহ সারা দেশে ১১১টি কেন্দ্র বেসরকারি নিবন্ধন নিয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় চারটি সরকারি মাদকাসক্ত পরামর্শ, নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। অথচ সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ঢাকাসহ সারা দেশে অনুমোদনহীন এমন কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ১২শ গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন অনেকগুলো অবৈধ কেন্দ্রের সন্ধান মিলেছে। যার বেশিরভাগই স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার আধাপাকা বাড়িতে অবস্থিত। ছোট ছোট চার পাঁচটি কক্ষ। নেই আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। তার মধ্যেই রান্না ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। চিকিৎসক নেই, নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম। নেই শোবার বিছানা। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও মাদক নিরাময়ের বিষয়ে অনভিজ্ঞ। তাইতো এ ধরনের বেশিরভাগ কেন্দ্রে চলে চিকিৎসার নামে শারীরিক নির্যাতন। চলে মাদকদ্রব্যের ব্যবসাও।
অভিযোগ রয়েছে টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে এসব কেন্দ্রের কার্যক্রম। এসব জায়গা থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছে এমন নজির কম। কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে কিছুদিন ভাল থাকলেও আবারও তাকে ফিরে আসতে হচ্ছে। বেশির ভাগ নিরাময় কেন্দ্রে তালা মেরে রাখা হয় মাদকাসক্তদের। ভয়ঙ্কর মাদকাসক্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের লোকেরা এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে নানা রকম উৎকণ্ঠায় থাকেন। সমপ্রতি রাজধানীর একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্তির অভিশাপ থেকে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে ভর্তি হয়েছেন এক যুবক। কিন্তু ওই কেন্দ্রে তাকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে থাকা অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার পর নিরাময় কেন্দ্রে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে পলাতক রয়েছে পরিচালক বাবুল। মোহাম্মদপুর ‘নিউ তরী’ নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দুটি কক্ষের মেঝেতে ১৫-২০ জন রোগীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কক্ষ তুলনামূলক বড় হওয়ায় দিনে সেখানে রোগীদের মানসিক চিকিৎসা বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। রাতে ওই কক্ষের মেঝেতে বিছানা পেতে রোগীরা ঘুমান বলে জানান প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। এখানে জরুরি বিদ্যুতের জন্য নিজস্ব জেনারেটর নেই। রোগীদের রুচিশীল বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। ‘নিউ তরী মাদকাসক্ত সেবা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এটি ১০ শয্যার। বাড়তি রোগী থাকলেও সবাই এখানে থাকেন না। অনেকেই বাইরে থেকে এসে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে যান। এখন ১০ জন রোগী আছেন। জেনারেটর না থাকলেও জরুরি বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর লাইন ভাড়া নেয়া আছে। এদিকে এমন আরেকটি নিরাময় কেন্দ্রের কর্মকর্তাকে নিবন্ধন নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নিবন্ধনের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা দিয়েছি অনেকদিন হলো। কিন্তু কর্মকর্তারা ফাইল আটকে রেখে আমাদের ঘুরাচ্ছেন। মোটা দাগের ঘুষ ছাড়া অনুমোদন হবে না বলেছেন। এদিকে প্রায় একই অভিযোগ করেছেন দেশের প্রথম এবং স্বনামধন্য অনুমোদিত বেসরকারি মানসিক ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘মুক্তি’র চিফ কনসালটেন্ট-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এ কোরেশী। তিনি খানিক ক্ষোভ প্রকাশ করেই বলেন, ’৮৮ সাল থেকে শত প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করিয়েছি। শুরু থেকে এখনও চেষ্টা করছি সরকারের সব নীতিমালা মান্য করে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে। অথচ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে কোন রকম সাহায্য কিংবা সহযোগিতাই পাইনি। তিনি আরও বলেন, মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের চেয়ে তারা আমাদের মতো বৈধ মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। যেখানে জেনারেল হাসপাতালগুলোর রেজিস্ট্রেশন ফি/বার্ষিক ফি সম্ভবত ৫ হাজার টাকা মাত্র, সেখানে আমাদের ফি ৫০ হাজার টাকা। কেন এই বৈষম্য? তাছাড়া নানা রকম হয়রানি তো রয়েছেই। ডা. এ এ কোরেশীর দাবি, মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা না করে বৈধভাবে বিকাশের জন্য উদ্যোগ নেয়া জরুরি। আমাদের হাসপাতালগুলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরের দাবি করছি। তা না হলে, অবৈধ নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা ক্রমশই বাড়বে; মানুষের হয়রানিও বাড়বে। এতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু মানুষ লাভবান হবে। আর আমরা যারা বৈধভাবে মানুষের সেবা করতে চাই তারা ক্রমশই বিলুপ্ত হবো। সংশ্লিষ্টদের এমন মন্তব্য কিংবা অভিযোগের জবাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বজলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তাই বলে ঢালাও অভিযোগ করা ঠিক নয়। আমরা প্রতিদিন চেষ্টা করছি অভিযোগের ভিত্তিতে সমস্যাগুলো সমাধানের। তিনি আরও বলেন, আমাদের লোকবলের অভাব সত্ত্বেও নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অবৈধ নিরাময় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি নিয়মিত। বৈধ কেন্দ্রগুলোতেও নিয়মিত মনিটরিং করার চেষ্টা করছি। সত্যি বলতে রোগীর চেয়ে সরকারি এবং বৈধ নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা অপ্রতুল। সে জন্যই আমরা সহজ শর্তে কম রেজিস্ট্রেশন ফির মধ্য দিয়ে শিগগিরই অনেকগুলো বৈধ নিরাময় কেন্দ্রকে অনুমোদন দেয়ার প্রক্রিয়ায় আছি। এদিকে কেন্দ্রীয় মদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিফ কনসালটেন্ট সৈয়দ ইমামুল হোসেন জানান, অবৈধ নিরাময় কেন্দ্রগুলোর সংখ্যা খুব দ্রুত কমিয়ে আনার পাশাপাশি বৈধ নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে পুরানো নীতিমালাকে সংশোধন করে নতুন খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এটির অনুমোদন হয়ে যাবে। তখন রেজিস্ট্রেশন এবং বার্ষিক ফি মাত্র ২ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে চলে আসবে। উদ্যোক্তারা তখন সহনীয় শর্তে বৈধভাবে নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করতে পারবেন। তিনি আরও জানান, এ ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের পাশাপাশি বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র সংশ্লিষ্টদেরও খানিক উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, একরকম নিয়ন্ত্রণহীনভাবেই চলছে দেশের অধিকাংশ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নাকের ডগায় বসে চলছে এসব প্রতিষ্ঠানের নানামাত্রিক বাণিজ্য। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরেরও তেমন কোন ভ্রুক্ষেপ নেই এসব অভিযোগের প্রতি। ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব মাদক নিরাময় কেন্দ্রের অধিকাংশই অনুমোদনহীন। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে নিয়মনীতিহীনভাবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর অরাজকতার বিপরীতে এন্তার অভিযোগ রয়েছে মাদকাসক্ত রোগী ও পরিবারের। চিকিৎসার নামে রোগীর ওপর শারীরিক নির্যাতন, মাদকের ব্যবসা পরিচালনা ও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে অধিকাংশ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বেশিরভাগ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো এখন মাদক সেবনের নিরাপদ আখড়া! বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার জন্য সরকারি শর্তাবলীর মধ্যে রয়েছে- আবাসিক এলাকার পাকা বাড়ি বা ভবনে অবস্থিত, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ হতে হবে। একজন রোগীর জন্য কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকতে হবে। অন্যদিকে প্রতি ১০ বেডের জন্য পৃথক একটি টয়লেট, বাথরুম, বিশুদ্ধ পানি অন্যান্য সুব্যবস্থা এবং খণ্ডকালীন বা সার্বক্ষণিক একজন মনোচিকিৎসক, সার্বক্ষণিক একজন ডাক্তার, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স বা বয়, একজন সুইপার বা আয়া এবং জীবন রক্ষাকারী উপকরণ ও অত্যাবশ্যক ওষুধ থাকতে হবে। এ ছাড়া মাদকাসক্ত ব্যক্তির রক্ত, কফ, মলমূত্র ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত যে কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের সুবিধা থাকতে হবে। কেন্দ্রে একক বা দলগত পরামর্শক এবং মানসিক বিনোদনের জন্য অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন ও কাউন্সেলিংয়ের জন্য ২০ জনের উপযোগী একটি শ্রেণীকক্ষ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সরজমিন দেখা যায়, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ নিরাময় কেন্দ্রই মানছে না এ নিয়মগুলো। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বজলুর রহমান জানান, বিধিমালা অনুসারে কেন্দ্র পরিচালনার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলসহ সারা দেশে ১১১টি কেন্দ্র বেসরকারি নিবন্ধন নিয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় চারটি সরকারি মাদকাসক্ত পরামর্শ, নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। অথচ সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ঢাকাসহ সারা দেশে অনুমোদনহীন এমন কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ১২শ গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন অনেকগুলো অবৈধ কেন্দ্রের সন্ধান মিলেছে। যার বেশিরভাগই স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার আধাপাকা বাড়িতে অবস্থিত। ছোট ছোট চার পাঁচটি কক্ষ। নেই আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। তার মধ্যেই রান্না ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। চিকিৎসক নেই, নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম। নেই শোবার বিছানা। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও মাদক নিরাময়ের বিষয়ে অনভিজ্ঞ। তাইতো এ ধরনের বেশিরভাগ কেন্দ্রে চলে চিকিৎসার নামে শারীরিক নির্যাতন। চলে মাদকদ্রব্যের ব্যবসাও।
অভিযোগ রয়েছে টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে এসব কেন্দ্রের কার্যক্রম। এসব জায়গা থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছে এমন নজির কম। কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে কিছুদিন ভাল থাকলেও আবারও তাকে ফিরে আসতে হচ্ছে। বেশির ভাগ নিরাময় কেন্দ্রে তালা মেরে রাখা হয় মাদকাসক্তদের। ভয়ঙ্কর মাদকাসক্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের লোকেরা এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে নানা রকম উৎকণ্ঠায় থাকেন। সমপ্রতি রাজধানীর একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে মাদকাসক্তির অভিশাপ থেকে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে ভর্তি হয়েছেন এক যুবক। কিন্তু ওই কেন্দ্রে তাকে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে থাকা অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনার পর নিরাময় কেন্দ্রে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে পলাতক রয়েছে পরিচালক বাবুল। মোহাম্মদপুর ‘নিউ তরী’ নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দুটি কক্ষের মেঝেতে ১৫-২০ জন রোগীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কক্ষ তুলনামূলক বড় হওয়ায় দিনে সেখানে রোগীদের মানসিক চিকিৎসা বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়। রাতে ওই কক্ষের মেঝেতে বিছানা পেতে রোগীরা ঘুমান বলে জানান প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। এখানে জরুরি বিদ্যুতের জন্য নিজস্ব জেনারেটর নেই। রোগীদের রুচিশীল বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। ‘নিউ তরী মাদকাসক্ত সেবা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এটি ১০ শয্যার। বাড়তি রোগী থাকলেও সবাই এখানে থাকেন না। অনেকেই বাইরে থেকে এসে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে যান। এখন ১০ জন রোগী আছেন। জেনারেটর না থাকলেও জরুরি বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর লাইন ভাড়া নেয়া আছে। এদিকে এমন আরেকটি নিরাময় কেন্দ্রের কর্মকর্তাকে নিবন্ধন নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নিবন্ধনের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা জমা দিয়েছি অনেকদিন হলো। কিন্তু কর্মকর্তারা ফাইল আটকে রেখে আমাদের ঘুরাচ্ছেন। মোটা দাগের ঘুষ ছাড়া অনুমোদন হবে না বলেছেন। এদিকে প্রায় একই অভিযোগ করেছেন দেশের প্রথম এবং স্বনামধন্য অনুমোদিত বেসরকারি মানসিক ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘মুক্তি’র চিফ কনসালটেন্ট-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এ কোরেশী। তিনি খানিক ক্ষোভ প্রকাশ করেই বলেন, ’৮৮ সাল থেকে শত প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করিয়েছি। শুরু থেকে এখনও চেষ্টা করছি সরকারের সব নীতিমালা মান্য করে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে। অথচ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে কোন রকম সাহায্য কিংবা সহযোগিতাই পাইনি। তিনি আরও বলেন, মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের চেয়ে তারা আমাদের মতো বৈধ মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। যেখানে জেনারেল হাসপাতালগুলোর রেজিস্ট্রেশন ফি/বার্ষিক ফি সম্ভবত ৫ হাজার টাকা মাত্র, সেখানে আমাদের ফি ৫০ হাজার টাকা। কেন এই বৈষম্য? তাছাড়া নানা রকম হয়রানি তো রয়েছেই। ডা. এ এ কোরেশীর দাবি, মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা না করে বৈধভাবে বিকাশের জন্য উদ্যোগ নেয়া জরুরি। আমাদের হাসপাতালগুলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরের দাবি করছি। তা না হলে, অবৈধ নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা ক্রমশই বাড়বে; মানুষের হয়রানিও বাড়বে। এতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু মানুষ লাভবান হবে। আর আমরা যারা বৈধভাবে মানুষের সেবা করতে চাই তারা ক্রমশই বিলুপ্ত হবো। সংশ্লিষ্টদের এমন মন্তব্য কিংবা অভিযোগের জবাবে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বজলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তাই বলে ঢালাও অভিযোগ করা ঠিক নয়। আমরা প্রতিদিন চেষ্টা করছি অভিযোগের ভিত্তিতে সমস্যাগুলো সমাধানের। তিনি আরও বলেন, আমাদের লোকবলের অভাব সত্ত্বেও নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অবৈধ নিরাময় কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি নিয়মিত। বৈধ কেন্দ্রগুলোতেও নিয়মিত মনিটরিং করার চেষ্টা করছি। সত্যি বলতে রোগীর চেয়ে সরকারি এবং বৈধ নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা অপ্রতুল। সে জন্যই আমরা সহজ শর্তে কম রেজিস্ট্রেশন ফির মধ্য দিয়ে শিগগিরই অনেকগুলো বৈধ নিরাময় কেন্দ্রকে অনুমোদন দেয়ার প্রক্রিয়ায় আছি। এদিকে কেন্দ্রীয় মদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিফ কনসালটেন্ট সৈয়দ ইমামুল হোসেন জানান, অবৈধ নিরাময় কেন্দ্রগুলোর সংখ্যা খুব দ্রুত কমিয়ে আনার পাশাপাশি বৈধ নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে পুরানো নীতিমালাকে সংশোধন করে নতুন খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এটির অনুমোদন হয়ে যাবে। তখন রেজিস্ট্রেশন এবং বার্ষিক ফি মাত্র ২ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে চলে আসবে। উদ্যোক্তারা তখন সহনীয় শর্তে বৈধভাবে নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করতে পারবেন। তিনি আরও জানান, এ ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের পাশাপাশি বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র সংশ্লিষ্টদেরও খানিক উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
No comments