উত্তাপ থাকলেও নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হবে by ড. বদিউল আলম মজুমদার
কাল শনিবার একযোগে দেশের চারটি সিটি
করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থানীয়
সরকার পর্যায়ের নির্বাচন। এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ে
হচ্ছে এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ দিতে হয়।
এটি অবশ্যই একটি
ইতিবাচক দিক। আমার যতদূর মনে পড়ে আইন অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮০ দিন আগেই
নির্বাচন হওয়ার কথা। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। স্থানীয় সরকার নির্বাচন
কখন হবে, এটা নির্ধারণ করার দায়িত্ব সরকারের। সেদিক দিয়ে সরকার অন্তত
সদিচ্ছার পরিচয় দিয়েছে। যদিও ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করার পরও
নির্বাচন হচ্ছে না। কেন নির্বাচন হচ্ছে না, বাধা কোথায়- তা আমাদের কাছে
বোধগম্য নয়। তবে নির্বাচন কমিশন কিংবা সরকার- ঢাকা সিটি করপোরেশনের
নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা যাই করুক না কেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
চার সিটি করপোরেশনে কাল যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানে অনেক বিষয় লক্ষণীয়। প্রণিধানযোগ্য বেশ কিছু বিষয় আমার দৃষ্টিতে এসেছে। এর একটি হচ্ছে, এবার প্রার্থীসংখ্যা অনেক কমে গেছে। আমার যতটুকু মনে পড়ে গত নির্বাচনে প্রার্থীসংখ্যা ছিল ৯৯৩। এবার এটা কমে ৭৫১-তে এসেছে। অর্থাৎ শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ প্রার্থী কমেছে। এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীর সংখ্যা গত নির্বাচনে ছিল ৪৬। এবার সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ১২। গত নির্বাচনে রাজশাহী ও সিলেটে ১৫ জন করে মেয়র প্রার্থী ছিলেন। বরিশাল ও খুলনায় যথাক্রমে ১০ ও ছয়জন মেয়র প্রার্থী ছিলেন। এবার সবখানেই মেয়র পদে প্রার্থী আছেন তিনজন করে। মেয়র পদে প্রার্থী সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমার মনে হয়, দুটি কারণে এমনটি হয়েছে। এবার দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় নির্বাচন না হলেও বরাবরই দলীয় ভিত্তিতে হয়। অর্থাৎ দলের সমর্থন থাকে। কিন্তু এবারের মতো করে দলীয় মনোনয়ন বোধহয় আগে দেওয়া হয়নি। এবার দল যেভাবে সরাসরি যুক্ত হয়েছে, আগে বোধহয় সেভাবে যুক্ত হতে দেখা যায়নি। বিরোধী দল তো ধরেই নিয়েছে এই চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সরকারের জনপ্রিয়তার একটা পরীক্ষা। এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে বিরোধী দল যে সরকারকে একটা পরীক্ষার মুখোমুখি করতে চায় সেটাও স্পষ্ট। তো প্রার্থী কম হওয়ার এটাও একটি কারণ।
আরো একটি কারণ আলোচনায় আসতে পারে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরেও বিষয়টি এসেছে। সেটা হচ্ছে টাকার খেলা। টাকার খেলা তো জাতীয় নির্বাচনেও হয়। এখানেও হচ্ছে এবং ব্যাপকভাবেই হচ্ছে। এর ফলে হচ্ছে কী? অতীতে অনেক নির্বাচনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী দেখা যেত। সামাজিকভাবে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রার্থী হতেন। নির্বাচনে তাঁদের জয়লাভ করার সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু এবার যেহেতু দলীয় ভিত্তিতে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে, তাই ছোট দলের প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা দেখেন না। এ কারণে তাঁদের অনেকেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচন এখন তো অনেকটাই টাকার খেলায় পরিণত হয়েছে। কাজেই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকায় অনেকে এবার নির্বাচন থেকে দূরে আছেন। দলীয়ভাবে যাঁরা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁদের তুলনায় আর্থিকভাবে সক্ষম না হওয়ার কারণেই অনেকে এবার প্রার্থী হননি। এ কারণেও এবারের নির্বাচনে প্রার্থী কমে গেছে বলে মনে হয়। নির্বাচনে প্রার্থীসংখ্যা কম হলে কিন্তু সাধারণ জনগণের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কম প্রার্থী মানেই কম যোগ্য প্রার্থী। কম যোগ্য প্রার্থী মানেই যোগ্য প্রার্থীর নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা কম। এতে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, স্থানীয় সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ স্থানীয় সরকারের লক্ষ্যই হলো স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা করা, স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা। যাঁরা এই কাজ করবেন, তাঁদের তো যোগ্য হতে হবে। কারণ স্থানীয় পর্যায়ে এই ব্যক্তিরাই তো নির্বাহী। মেয়ররা তো বটেই, কাউন্সিলররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কাজেই স্থানীয় পর্যায়ে যাঁরাই নির্বাচিত হবেন, তাঁদের যোগ্য হওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মেয়র পদপ্রার্থীদের যোগ্য হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু প্রার্থী সংখ্যা কমে যাওয়াটা খুব একটা ভালো লক্ষণ নয় বলে আমি মনে করি।
এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। এই নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী। মেয়র পদপ্রার্থীদের প্রায় সবাই ব্যবসায়ী। এই চার সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁরা সবাই যে ব্যবসায়ী, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের সিংহভাগই ব্যবসায়ী। মোটা দাগে ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? আমাদের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত। আবার অনেকে বলেছেন ব্যবসা তাঁদের পেশা নয়। তবে আমাদের জাতীয় রাজনীতি যেমন ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত হয়ে গেছে, স্থানীয় সরকারের রাজনীতিও তেমনি ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত। এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। না, ব্যবসায়ীদের জনপ্রতিনিধি হতে কোনো সমস্যা নেই, আপত্তিও নেই। কিন্তু সবাই ব্যবসায়ী হলে সমাজের আর সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ কোথায়? সমাজে তো আরো অনেক শ্রেণী-পেশার মানুষ আছে। তাঁদেরও ভোটাধিকার আছে। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকছে না। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যেকোনো নির্বাচনের আগে নির্বাচন নিয়ে সাধারণের মনে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করে। নির্বাচনে টাকার খেলার পাশাপাশি পেশিশক্তির আধিপত্য বিস্তারের একটা চেষ্টা দেখা যায়। এই চার সিটি করপোরেশনে তার কোনো প্রভাব পড়বে কি না, এমন প্রশ্ন জনমনে দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমি নিজে এবার এই চার সিটি করপোরেশন এলাকা ঘুরে দেখেছি। সেখানকার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি প্রার্থীদের সঙ্গেও। সেখানে মেয়র প্রার্থীদের মুখোমুখি করা হয়েছিল। সেই বিতর্কে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এই চার সিটি করপোরেশন এলাকা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। এসব এলাকায় পেশিশক্তির প্রভাব তেমন পড়বে বলে আমার মনে হয় না। এর অবশ্য আরেকটা কারণ আছে। গত কয়েক বছরে আমাদের একটি ইতিবাচক ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছে। কিছু কঠোর আচরণবিধি প্রণীত হয়েছে। যার ফলে আগে যেমন নির্বাচন মানেই কিছু না কিছু অস্থিরতা ও উত্তেজনা দেখা যেত, সহিংস ঘটনা ঘটত- এসব এখন নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তাই বলে যে নির্বাচনী উত্তাপ নেই, তা নয়। নির্বাচনী উত্তাপ আছে। উত্তেজনাও আছে। কিন্তু পরিবেশ অনেক ভালো। যদিও আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে আশার কথা এই যে মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। গত নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনেও তথ্য দিতে হচ্ছে। আমরা অবশ্য এই তথ্যের অধিকার নিয়ে অ্যাডভোকেসি করেছি। তো এই তথ্য নিয়ে আমরা মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। এসব তথ্য দেখে-শুনে-বুঝে যেন মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে, সে জন্য আমরা কাজ করছি। আমার মনে হয়, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। কাজেই আচরণবিধি মেনে চললে সহিংসতার কোনো আশঙ্কা থাকবে বলে আমি মনে করি না। এর পেছনে দুটি কারণ আছে। প্রথমত, এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য অ্যাসিড টেস্ট। প্রথম চারটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। কাজেই নির্বাচন কমিশন সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে নির্বাচন সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত করতে। পাশাপাশি সরকারের জন্যও এটা একটা পরীক্ষা। সরকারও প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে তাদের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে; শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হতে পারে। যদিও এটা সঠিক তুলনা হয় না। কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন এক নয়।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি। এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাধারণ আসনে মাত্র ১২ জনের মতো নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে এই দেশ অনেকটা অগ্রগামী। কিন্তু নারীরা এখনো মনে করে না যে তারা পুরুষের সমকক্ষ। নির্বাচনের ময়দানে তারা যে পুরুষদের মুখোমুখি হতে পারে, এটা তারা বোধহয় মনে করছে না। হয়তো এ কারণেই মেয়র পদে একজনও নারী প্রার্থী নেই। আমার মনে হয়, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আমাদের আরো অনেকদূর যেতে হবে। নারী আসনের ক্ষেত্রে আমাদের যে সংরক্ষণ পদ্ধতি, সেটা যথোপযুক্ত নয় বলে আমার মনে হয়। এটা নারীকে ক্ষমতায়িত করে না। এটা অলঙ্কারিক। আমার অনেক দিনের প্রস্তাব, রোটেশনের ভিত্তিতে নারীদের জন্য সংরক্ষণ পদ্ধতি করা হোক।
এবারের চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, রাজনীতি যেন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আমাদের চার মেয়রের আয় হু হু করে বেড়ে গেছে। রাজনীতি যেন জাদুর কাঠিতে পরিণত হয়েছে। আমি শুনেছি, শেরেবাংলার বিরুদ্ধে নাকি একবার মামলা হয়েছিল তাঁকে দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নাকি ট্যাঙ্ দিতে সমস্যা হতো। এটাই ছিল আমাদের রাজনীতি। এখন রাজনীতি মানেই ব্যবসা। যাঁরাই নির্বাচিত হন, তাঁদের সম্পদ হু হু করে বাড়তে থাকে। এটা জনসেবা না সেলফ সার্ভিস, সেটা এখন বুঝতে হবে। এ বিষয়টি নিয়ে জাতীয়ভাবে আমাদের আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
এবারের চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি ইতিবাচক বিষয় দেখা গেছে। মেয়র প্রার্থীরা জনগণের মুখোমুখি বসেছেন। প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। একটা জবাবদিহিতার ক্ষেত্র যেন তৈরি হয়েছে। এতে আমি আনন্দিত। আনন্দিত ও উৎফুল্ল এ কারণে, আমরাই সুজনের উদ্যোগে ২০০২ সাল থেকে এটা শুরু করেছিলাম। গত জাতীয় নির্বাচনে ৮৭টি আসনে আমরা প্রার্থীদের মুখোমুখি করেছিলাম। আমরা শুধু মুখোমুখি করি না, আমরা তথ্য দিই। জনগণের মুখোমুখি হওয়ায় জনগণও সচেতন হচ্ছে।
তো আবারও সেই নির্বাচনের কথায় ফেরা যাক। কাল যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটা শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হবে- এটাই আশা করছি আমি। উত্তাপ থাকলেও কোনো সহিংস ঘটনা ঘটবে না বলে আমি মনে করি। এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে চার সিটি করপোরেশনের ভোটাররা সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বেছে নেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক : সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক
চার সিটি করপোরেশনে কাল যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানে অনেক বিষয় লক্ষণীয়। প্রণিধানযোগ্য বেশ কিছু বিষয় আমার দৃষ্টিতে এসেছে। এর একটি হচ্ছে, এবার প্রার্থীসংখ্যা অনেক কমে গেছে। আমার যতটুকু মনে পড়ে গত নির্বাচনে প্রার্থীসংখ্যা ছিল ৯৯৩। এবার এটা কমে ৭৫১-তে এসেছে। অর্থাৎ শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ প্রার্থী কমেছে। এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীর সংখ্যা গত নির্বাচনে ছিল ৪৬। এবার সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ১২। গত নির্বাচনে রাজশাহী ও সিলেটে ১৫ জন করে মেয়র প্রার্থী ছিলেন। বরিশাল ও খুলনায় যথাক্রমে ১০ ও ছয়জন মেয়র প্রার্থী ছিলেন। এবার সবখানেই মেয়র পদে প্রার্থী আছেন তিনজন করে। মেয়র পদে প্রার্থী সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমার মনে হয়, দুটি কারণে এমনটি হয়েছে। এবার দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় নির্বাচন না হলেও বরাবরই দলীয় ভিত্তিতে হয়। অর্থাৎ দলের সমর্থন থাকে। কিন্তু এবারের মতো করে দলীয় মনোনয়ন বোধহয় আগে দেওয়া হয়নি। এবার দল যেভাবে সরাসরি যুক্ত হয়েছে, আগে বোধহয় সেভাবে যুক্ত হতে দেখা যায়নি। বিরোধী দল তো ধরেই নিয়েছে এই চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সরকারের জনপ্রিয়তার একটা পরীক্ষা। এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে বিরোধী দল যে সরকারকে একটা পরীক্ষার মুখোমুখি করতে চায় সেটাও স্পষ্ট। তো প্রার্থী কম হওয়ার এটাও একটি কারণ।
আরো একটি কারণ আলোচনায় আসতে পারে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরেও বিষয়টি এসেছে। সেটা হচ্ছে টাকার খেলা। টাকার খেলা তো জাতীয় নির্বাচনেও হয়। এখানেও হচ্ছে এবং ব্যাপকভাবেই হচ্ছে। এর ফলে হচ্ছে কী? অতীতে অনেক নির্বাচনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী দেখা যেত। সামাজিকভাবে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রার্থী হতেন। নির্বাচনে তাঁদের জয়লাভ করার সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু এবার যেহেতু দলীয় ভিত্তিতে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে, তাই ছোট দলের প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা দেখেন না। এ কারণে তাঁদের অনেকেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচন এখন তো অনেকটাই টাকার খেলায় পরিণত হয়েছে। কাজেই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকায় অনেকে এবার নির্বাচন থেকে দূরে আছেন। দলীয়ভাবে যাঁরা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁদের তুলনায় আর্থিকভাবে সক্ষম না হওয়ার কারণেই অনেকে এবার প্রার্থী হননি। এ কারণেও এবারের নির্বাচনে প্রার্থী কমে গেছে বলে মনে হয়। নির্বাচনে প্রার্থীসংখ্যা কম হলে কিন্তু সাধারণ জনগণের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কম প্রার্থী মানেই কম যোগ্য প্রার্থী। কম যোগ্য প্রার্থী মানেই যোগ্য প্রার্থীর নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা কম। এতে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, স্থানীয় সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ স্থানীয় সরকারের লক্ষ্যই হলো স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা করা, স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা। যাঁরা এই কাজ করবেন, তাঁদের তো যোগ্য হতে হবে। কারণ স্থানীয় পর্যায়ে এই ব্যক্তিরাই তো নির্বাহী। মেয়ররা তো বটেই, কাউন্সিলররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কাজেই স্থানীয় পর্যায়ে যাঁরাই নির্বাচিত হবেন, তাঁদের যোগ্য হওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মেয়র পদপ্রার্থীদের যোগ্য হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু প্রার্থী সংখ্যা কমে যাওয়াটা খুব একটা ভালো লক্ষণ নয় বলে আমি মনে করি।
এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। এই নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী। মেয়র পদপ্রার্থীদের প্রায় সবাই ব্যবসায়ী। এই চার সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁরা সবাই যে ব্যবসায়ী, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের সিংহভাগই ব্যবসায়ী। মোটা দাগে ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? আমাদের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত। আবার অনেকে বলেছেন ব্যবসা তাঁদের পেশা নয়। তবে আমাদের জাতীয় রাজনীতি যেমন ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত হয়ে গেছে, স্থানীয় সরকারের রাজনীতিও তেমনি ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত। এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। না, ব্যবসায়ীদের জনপ্রতিনিধি হতে কোনো সমস্যা নেই, আপত্তিও নেই। কিন্তু সবাই ব্যবসায়ী হলে সমাজের আর সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ কোথায়? সমাজে তো আরো অনেক শ্রেণী-পেশার মানুষ আছে। তাঁদেরও ভোটাধিকার আছে। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকছে না। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যেকোনো নির্বাচনের আগে নির্বাচন নিয়ে সাধারণের মনে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করে। নির্বাচনে টাকার খেলার পাশাপাশি পেশিশক্তির আধিপত্য বিস্তারের একটা চেষ্টা দেখা যায়। এই চার সিটি করপোরেশনে তার কোনো প্রভাব পড়বে কি না, এমন প্রশ্ন জনমনে দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। আমি নিজে এবার এই চার সিটি করপোরেশন এলাকা ঘুরে দেখেছি। সেখানকার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলেছি প্রার্থীদের সঙ্গেও। সেখানে মেয়র প্রার্থীদের মুখোমুখি করা হয়েছিল। সেই বিতর্কে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এই চার সিটি করপোরেশন এলাকা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। এসব এলাকায় পেশিশক্তির প্রভাব তেমন পড়বে বলে আমার মনে হয় না। এর অবশ্য আরেকটা কারণ আছে। গত কয়েক বছরে আমাদের একটি ইতিবাচক ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছে। কিছু কঠোর আচরণবিধি প্রণীত হয়েছে। যার ফলে আগে যেমন নির্বাচন মানেই কিছু না কিছু অস্থিরতা ও উত্তেজনা দেখা যেত, সহিংস ঘটনা ঘটত- এসব এখন নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তাই বলে যে নির্বাচনী উত্তাপ নেই, তা নয়। নির্বাচনী উত্তাপ আছে। উত্তেজনাও আছে। কিন্তু পরিবেশ অনেক ভালো। যদিও আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্যদিকে আশার কথা এই যে মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। গত নির্বাচনের মতো এই নির্বাচনেও তথ্য দিতে হচ্ছে। আমরা অবশ্য এই তথ্যের অধিকার নিয়ে অ্যাডভোকেসি করেছি। তো এই তথ্য নিয়ে আমরা মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। এসব তথ্য দেখে-শুনে-বুঝে যেন মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে, সে জন্য আমরা কাজ করছি। আমার মনে হয়, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। কাজেই আচরণবিধি মেনে চললে সহিংসতার কোনো আশঙ্কা থাকবে বলে আমি মনে করি না। এর পেছনে দুটি কারণ আছে। প্রথমত, এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য অ্যাসিড টেস্ট। প্রথম চারটা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। কাজেই নির্বাচন কমিশন সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে নির্বাচন সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত করতে। পাশাপাশি সরকারের জন্যও এটা একটা পরীক্ষা। সরকারও প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে তাদের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে; শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হতে পারে। যদিও এটা সঠিক তুলনা হয় না। কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন এক নয়।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি। এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাধারণ আসনে মাত্র ১২ জনের মতো নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে এই দেশ অনেকটা অগ্রগামী। কিন্তু নারীরা এখনো মনে করে না যে তারা পুরুষের সমকক্ষ। নির্বাচনের ময়দানে তারা যে পুরুষদের মুখোমুখি হতে পারে, এটা তারা বোধহয় মনে করছে না। হয়তো এ কারণেই মেয়র পদে একজনও নারী প্রার্থী নেই। আমার মনে হয়, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আমাদের আরো অনেকদূর যেতে হবে। নারী আসনের ক্ষেত্রে আমাদের যে সংরক্ষণ পদ্ধতি, সেটা যথোপযুক্ত নয় বলে আমার মনে হয়। এটা নারীকে ক্ষমতায়িত করে না। এটা অলঙ্কারিক। আমার অনেক দিনের প্রস্তাব, রোটেশনের ভিত্তিতে নারীদের জন্য সংরক্ষণ পদ্ধতি করা হোক।
এবারের চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, রাজনীতি যেন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আমাদের চার মেয়রের আয় হু হু করে বেড়ে গেছে। রাজনীতি যেন জাদুর কাঠিতে পরিণত হয়েছে। আমি শুনেছি, শেরেবাংলার বিরুদ্ধে নাকি একবার মামলা হয়েছিল তাঁকে দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নাকি ট্যাঙ্ দিতে সমস্যা হতো। এটাই ছিল আমাদের রাজনীতি। এখন রাজনীতি মানেই ব্যবসা। যাঁরাই নির্বাচিত হন, তাঁদের সম্পদ হু হু করে বাড়তে থাকে। এটা জনসেবা না সেলফ সার্ভিস, সেটা এখন বুঝতে হবে। এ বিষয়টি নিয়ে জাতীয়ভাবে আমাদের আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
এবারের চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি ইতিবাচক বিষয় দেখা গেছে। মেয়র প্রার্থীরা জনগণের মুখোমুখি বসেছেন। প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। একটা জবাবদিহিতার ক্ষেত্র যেন তৈরি হয়েছে। এতে আমি আনন্দিত। আনন্দিত ও উৎফুল্ল এ কারণে, আমরাই সুজনের উদ্যোগে ২০০২ সাল থেকে এটা শুরু করেছিলাম। গত জাতীয় নির্বাচনে ৮৭টি আসনে আমরা প্রার্থীদের মুখোমুখি করেছিলাম। আমরা শুধু মুখোমুখি করি না, আমরা তথ্য দিই। জনগণের মুখোমুখি হওয়ায় জনগণও সচেতন হচ্ছে।
তো আবারও সেই নির্বাচনের কথায় ফেরা যাক। কাল যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটা শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হবে- এটাই আশা করছি আমি। উত্তাপ থাকলেও কোনো সহিংস ঘটনা ঘটবে না বলে আমি মনে করি। এই নির্বাচনের ভেতর দিয়ে চার সিটি করপোরেশনের ভোটাররা সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বেছে নেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
লেখক : সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক
No comments