জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার... by ওলে সোয়িঙ্কা
অনেক দেরিতে হলেও ২০১০ সাল তেলবিষয়ক বৈশ্বিক সচেতনতা সৃষ্টির বছর। এ বছরটা মনে করিয়ে দিল, তেল ব্যবসার সঙ্গে আমার পরিচয় বেশ পুরোনো। শুরুটা নাইজেরিয়া স্বাধীন হওয়ারও আগে। তখন এক অখ্যাত গ্রামে তেল পাওয়ার একটা ছোট খবর আমার নজরে আসে, দৈবক্রমে। গ্রামটির নাম অলোইবিরি।
আমি ব্রিটেনে পড়তে গিয়েছিলাম। সে সময় ব্রিটিশরা পৃথিবীর নানা জায়গায়, বিশেষত সাবেক উপনিবেশগুলোয় প্রাকৃতিক সম্পদের সন্ধান চালাচ্ছিল। তবে ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলোর জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানের সামান্যতম আবাসও আমি তখনো পাইনি। বিদেশিদের হাতে তেল তুলে দেওয়ার মাধ্যমে এজাতীয় সম্পদ কবজা করার প্রতিযোগিতা শুরুর কী তাৎপর্য থাকতে পারে গরিব দেশগুলোর জন্য, তা তখন আমার উপলব্ধির আওতার বাইরের বিষয়।
সেই খবর আমাকেও নাড়া দিয়েছিল। তা একদমই শিল্প ও বাণিজ্যের জায়গা থেকে নয়। মৌলিক বাণিজ্য-পণ্য পাম তেলের জায়গায় অশোধিত তেল চলে আসার পর কোন ধরনের রূপান্তর আসন্ন, তা নিয়ে আমি গভীর ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম।
তখনো আমি একবারও নাইজার বদ্বীপে যাইনি। ১৯৫৪ সালে কলেজে পড়তে বিদেশে যাওয়ার আগে তো নয়ই। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভূগোল বই থেকে জেনেছিলাম নাইজারের কথা। বইয়ে পড়েছিলাম, এ জায়গাটি ঘন ম্যানগ্রোভপূর্ণ জলাভূমি। আর লোককাহিনির মামি ওয়াটাতে পরিপূর্ণ (এরা অর্ধমানব, অর্ধমৎস্য মনোমুগ্ধকর প্রাণী, আমাদের দিককার মৎস্যকন্যা)! সেখানকার প্রাচীন জীবনছন্দের মধ্যে কল্পনায় আমি নানা অনাত্মীয়কে সন্নিবেশ করলাম। প্রথমে এল যাজক, বণিক আর ঔপনিবেশিক শক্তি; আর এখন তেল অনুসন্ধান।
সেই কল্পনার পেছনে যে ভাবনা কাজ করছিল, তা আমার নাটক দ্য সোয়াম্প ডুয়েলারস-এর বিষয় নয়। সেখানে বিষয়টি আনা হয়নি। নাটকে উঠে এল প্রকৃতির সঙ্গে আমার অমোঘ আলাপচারিতা। নাটকটির পটভূমিতে আমাদের সম্পদ নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর হুড়াহুড়ির প্রভাব আর অর্থনৈতিক তাৎপর্যের এ ধরনের টিমটিমে উপস্থিতি ছিল শুধু।
আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে এসব কায়কারবারের পরিণতি বুঝতে আরও কয়েক দশকের প্রয়োজন ছিল। পৃথিবীর এক অখ্যাত কোণে সুযোগসন্ধানীদের করপোরেট দায়িত্বহীনতার মধ্যেও একভাবে তাদের উৎসভূমি শিল্পোন্নত দেশগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপার থাকে (যেমন ছড়ায় সমুদ্রবক্ষে জাহাজ থেকে নিঃসৃত তেলের আস্তরণ)—এই ফয়সালায় পৌঁছাতে তখনো আরও কিছু সময় দরকার ছিল।
ব্রিটেন থেকে নাইজেরিয়ায় ফিরে আমি প্রচলিত রীতির নাটকের ওপর গবেষণা শুরু করি। এই গবেষণার অংশ হিসেবে আমি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াই। তখন তেলের আহরণ পর্যায় অর্থাৎ খননকাজ চলছিল। তার জ্বলন্ত সাক্ষী হিসেবে আকাশে দেখা যেত তেল জ্বলছে দপ দপ করে। এক সড়ক নির্মাণ কোম্পানির বদৌলতে আকাশপথে দক্ষিণ-পূর্বাংশের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তেলের আগুনের শিখা কোম্পানির মিশনের সংকেত বহন করত। সেই মিশন আসলে সেসব এলাকাকে শিল্পায়নের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। এই প্রক্রিয়াকেই শুধু সহজ করে তুলছিল খনিজ তেল।
তবে ধীরে ধীরে সংবাদ চুইয়ে চুইয়ে বেরোতে বেরোতে হঠাৎ বিপুল বেগে বেরিয়ে আসে, তেলের নতুন অবয়বে। জলাভূমিবাসীদের দুনিয়া দখল হয়ে যায়।
বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ, ভূমিদখল, ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, পরিবেশ ক্ষয়, জীবন-জীবিকা ধ্বংস—তেলের শিখা আর আকাশের নির্বিষ লেখাজোকা নয়, বরং অপরিণামদর্শিতা আর নিস্পৃহতার আগুন।
এক্সন ভালদেজ বিপর্যয়ের (১৯৮৯) বহু আগেই ১৯৭৫ সালে ডাচ উপকূলের অদূরে কোলোকোট্রোনিস নামের আরেক তেলবাহী জাহাজের গায়ে ফাটল ধরে। এবার যে তেল নির্গমন হলো, তাকে সতর্কবার্তা হিসেবে গণ্য করা যেত। কোলোকোট্রোনিস নামের মাঝে আমি শুনলাম অলোইবিরির এক আজব প্রতিধ্বনি।
যখন থেকে নাইজার বদ্বীপের পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টি জানা যেতে থাকল, তখনই আমি কোলোকোট্রোনিস বিষয়ে আদালতের কার্যবিবরণীর একটি কপি সংগ্রহ করি। আদালতের রায় জাহাজ কোম্পানির বিরুদ্ধে গিয়েছিল। বিস্তারিত খুঁটিনাটি ঘাঁটতে গিয়ে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। জীবনে প্রথম দেখলাম, কোনো পাখি, কোনো পতঙ্গ কিংবা এক বর্গফুট চাষযোগ্য জমিও মূল্যায়িত হয় ডলারে, সেন্টে। উপলব্ধি করলাম, তেল নির্গমনের ক্ষেত্রে কত গাছগাছালি আর পশুপাখি মারা গেল, তার তালিকা করা শুধুই নৈমিত্তিক হিসাবরক্ষণ যজ্ঞ। তাতে মনে হয় যেন আফ্রিকা কিংবা তৃতীয় বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ওপর কোনো প্রভাবই পড়েনি!
জলাভূমির দেশ থেকে এক প্রাণবন্ত বন্ধু ও লেখক এসে আমার দরজায় কড়া নাড়লেন, তাঁকে দেখে আমি যারপরনাই খুশি হলাম। তাঁর নাম কেন সারো উইওয়া। সঙ্গে নিয়ে এলেন সরকার ও তেল কোম্পানির উদ্দেশ্যে কতগুলো সংস্কার প্রস্তাব। দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার ওগোনির মানুষের হয়ে লড়াই করে শহীদ হলেন কেন সারো উইওয়া। সেই হূদয়বিদারক বিদায়ের আগেই তিনি বিশ্ববিবেকে নাড়া দি্রেয় গেলেন।
নাইজার বদ্বীপ সারা দেশের জন্য যেন এক পুষ্টিকর জলখাবার। তাই সব অঞ্চল থেকেই তাতে চামচ ডোবানো হলো। বদ্বীপের স্থানীয় মানুষের জীবিকা অর্জনের পুরোনো পথ ধ্বংস হয়ে গেল। কেন সারো উইওয়ার মধ্য দিয়ে পরিবেশের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল সারা দুনিয়ার আদিবাসী আর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরই প্রশ্ন। তারা তাদের জীবন ফেরত চাইল। আর চাইল যেন তাদের কণ্ঠও শোনা হয়।
কেন সারো উইওয়াকে আমি আশ্বস্ত করে বলেছিলাম, তাঁর প্রতি সব সময় আমার সমর্থন থাকবে।
এরপর লম্বা সময় পেরিয়ে চলে আসি ২০১০ সালের ২০ এপ্রিলে। মেক্সিকো উপসাগরে বিপুল তেল নির্গমনের খবর এল। যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা ক্ষুব্ধ হলেন। তাঁদের খাটো হাতাওয়ালা জামা পরিহিত প্রেসিডেন্ট ছুটে গেলেন ঘটনাস্থলে। কংগ্রেসের শুনানিতে জড়ো হলেন তেল কোম্পানির নির্বাহীরা। নানা অজুহাত খাড়া করতে চেষ্টা হলো। সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমে বড় খবর হলো।
প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে জলাভূমিবাসীদের এলাকা ভিজেছিল যে পরিমাণ তেলে, এবার মেক্সিকো উপসাগরে তেল নির্গমন তার ভগ্নাংশ মাত্র। এ বিষয়টা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল। গণমাধ্যমও এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। বিপির প্রধান নির্বাহীর অনুশোচনামূলক অভিব্যক্তি যখন শুনলাম, আমার মন সরে গেল কেন সারা-উইওয়াতে। ছোটখাটো সেই মানুষটা, যাঁর মুখে ধরা থাকত পাইপ, অপ্রজ্বলিত।
জলাভূমিবাসীদের সেই জমিন, সেই নাজুক বাস্তুসংস্থানেই তাঁর মন পড়ে থাকত সব সময়। নাইজেরিয়ার সরকার আর তেল কোম্পানিগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। অবশেষে জনগণ জেগে উঠে রুখে দাঁড়াল—নয়জন মানুষের জান কোরবান করে। ওগোনির সেই নয় বীর। কেন সারো উইওয়ার হয়ে আমি যেমন একধরনের গৌরবের বোধ অনুভব করেছিলাম, তিনিও কি তা-ই বোধ করতেন? নাকি তাঁর পথ আলাদা হয়ে যেত?
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ওলে সোয়িঙ্কা: নাইজেরীয় ঔপন্যাসিক, কবি ও নাট্যকার। ১৯৮৬ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী।
আমি ব্রিটেনে পড়তে গিয়েছিলাম। সে সময় ব্রিটিশরা পৃথিবীর নানা জায়গায়, বিশেষত সাবেক উপনিবেশগুলোয় প্রাকৃতিক সম্পদের সন্ধান চালাচ্ছিল। তবে ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলোর জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানের সামান্যতম আবাসও আমি তখনো পাইনি। বিদেশিদের হাতে তেল তুলে দেওয়ার মাধ্যমে এজাতীয় সম্পদ কবজা করার প্রতিযোগিতা শুরুর কী তাৎপর্য থাকতে পারে গরিব দেশগুলোর জন্য, তা তখন আমার উপলব্ধির আওতার বাইরের বিষয়।
সেই খবর আমাকেও নাড়া দিয়েছিল। তা একদমই শিল্প ও বাণিজ্যের জায়গা থেকে নয়। মৌলিক বাণিজ্য-পণ্য পাম তেলের জায়গায় অশোধিত তেল চলে আসার পর কোন ধরনের রূপান্তর আসন্ন, তা নিয়ে আমি গভীর ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম।
তখনো আমি একবারও নাইজার বদ্বীপে যাইনি। ১৯৫৪ সালে কলেজে পড়তে বিদেশে যাওয়ার আগে তো নয়ই। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভূগোল বই থেকে জেনেছিলাম নাইজারের কথা। বইয়ে পড়েছিলাম, এ জায়গাটি ঘন ম্যানগ্রোভপূর্ণ জলাভূমি। আর লোককাহিনির মামি ওয়াটাতে পরিপূর্ণ (এরা অর্ধমানব, অর্ধমৎস্য মনোমুগ্ধকর প্রাণী, আমাদের দিককার মৎস্যকন্যা)! সেখানকার প্রাচীন জীবনছন্দের মধ্যে কল্পনায় আমি নানা অনাত্মীয়কে সন্নিবেশ করলাম। প্রথমে এল যাজক, বণিক আর ঔপনিবেশিক শক্তি; আর এখন তেল অনুসন্ধান।
সেই কল্পনার পেছনে যে ভাবনা কাজ করছিল, তা আমার নাটক দ্য সোয়াম্প ডুয়েলারস-এর বিষয় নয়। সেখানে বিষয়টি আনা হয়নি। নাটকে উঠে এল প্রকৃতির সঙ্গে আমার অমোঘ আলাপচারিতা। নাটকটির পটভূমিতে আমাদের সম্পদ নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর হুড়াহুড়ির প্রভাব আর অর্থনৈতিক তাৎপর্যের এ ধরনের টিমটিমে উপস্থিতি ছিল শুধু।
আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে এসব কায়কারবারের পরিণতি বুঝতে আরও কয়েক দশকের প্রয়োজন ছিল। পৃথিবীর এক অখ্যাত কোণে সুযোগসন্ধানীদের করপোরেট দায়িত্বহীনতার মধ্যেও একভাবে তাদের উৎসভূমি শিল্পোন্নত দেশগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপার থাকে (যেমন ছড়ায় সমুদ্রবক্ষে জাহাজ থেকে নিঃসৃত তেলের আস্তরণ)—এই ফয়সালায় পৌঁছাতে তখনো আরও কিছু সময় দরকার ছিল।
ব্রিটেন থেকে নাইজেরিয়ায় ফিরে আমি প্রচলিত রীতির নাটকের ওপর গবেষণা শুরু করি। এই গবেষণার অংশ হিসেবে আমি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াই। তখন তেলের আহরণ পর্যায় অর্থাৎ খননকাজ চলছিল। তার জ্বলন্ত সাক্ষী হিসেবে আকাশে দেখা যেত তেল জ্বলছে দপ দপ করে। এক সড়ক নির্মাণ কোম্পানির বদৌলতে আকাশপথে দক্ষিণ-পূর্বাংশের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তেলের আগুনের শিখা কোম্পানির মিশনের সংকেত বহন করত। সেই মিশন আসলে সেসব এলাকাকে শিল্পায়নের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। এই প্রক্রিয়াকেই শুধু সহজ করে তুলছিল খনিজ তেল।
তবে ধীরে ধীরে সংবাদ চুইয়ে চুইয়ে বেরোতে বেরোতে হঠাৎ বিপুল বেগে বেরিয়ে আসে, তেলের নতুন অবয়বে। জলাভূমিবাসীদের দুনিয়া দখল হয়ে যায়।
বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ, ভূমিদখল, ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, পরিবেশ ক্ষয়, জীবন-জীবিকা ধ্বংস—তেলের শিখা আর আকাশের নির্বিষ লেখাজোকা নয়, বরং অপরিণামদর্শিতা আর নিস্পৃহতার আগুন।
এক্সন ভালদেজ বিপর্যয়ের (১৯৮৯) বহু আগেই ১৯৭৫ সালে ডাচ উপকূলের অদূরে কোলোকোট্রোনিস নামের আরেক তেলবাহী জাহাজের গায়ে ফাটল ধরে। এবার যে তেল নির্গমন হলো, তাকে সতর্কবার্তা হিসেবে গণ্য করা যেত। কোলোকোট্রোনিস নামের মাঝে আমি শুনলাম অলোইবিরির এক আজব প্রতিধ্বনি।
যখন থেকে নাইজার বদ্বীপের পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টি জানা যেতে থাকল, তখনই আমি কোলোকোট্রোনিস বিষয়ে আদালতের কার্যবিবরণীর একটি কপি সংগ্রহ করি। আদালতের রায় জাহাজ কোম্পানির বিরুদ্ধে গিয়েছিল। বিস্তারিত খুঁটিনাটি ঘাঁটতে গিয়ে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। জীবনে প্রথম দেখলাম, কোনো পাখি, কোনো পতঙ্গ কিংবা এক বর্গফুট চাষযোগ্য জমিও মূল্যায়িত হয় ডলারে, সেন্টে। উপলব্ধি করলাম, তেল নির্গমনের ক্ষেত্রে কত গাছগাছালি আর পশুপাখি মারা গেল, তার তালিকা করা শুধুই নৈমিত্তিক হিসাবরক্ষণ যজ্ঞ। তাতে মনে হয় যেন আফ্রিকা কিংবা তৃতীয় বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ওপর কোনো প্রভাবই পড়েনি!
জলাভূমির দেশ থেকে এক প্রাণবন্ত বন্ধু ও লেখক এসে আমার দরজায় কড়া নাড়লেন, তাঁকে দেখে আমি যারপরনাই খুশি হলাম। তাঁর নাম কেন সারো উইওয়া। সঙ্গে নিয়ে এলেন সরকার ও তেল কোম্পানির উদ্দেশ্যে কতগুলো সংস্কার প্রস্তাব। দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ার ওগোনির মানুষের হয়ে লড়াই করে শহীদ হলেন কেন সারো উইওয়া। সেই হূদয়বিদারক বিদায়ের আগেই তিনি বিশ্ববিবেকে নাড়া দি্রেয় গেলেন।
নাইজার বদ্বীপ সারা দেশের জন্য যেন এক পুষ্টিকর জলখাবার। তাই সব অঞ্চল থেকেই তাতে চামচ ডোবানো হলো। বদ্বীপের স্থানীয় মানুষের জীবিকা অর্জনের পুরোনো পথ ধ্বংস হয়ে গেল। কেন সারো উইওয়ার মধ্য দিয়ে পরিবেশের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল সারা দুনিয়ার আদিবাসী আর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরই প্রশ্ন। তারা তাদের জীবন ফেরত চাইল। আর চাইল যেন তাদের কণ্ঠও শোনা হয়।
কেন সারো উইওয়াকে আমি আশ্বস্ত করে বলেছিলাম, তাঁর প্রতি সব সময় আমার সমর্থন থাকবে।
এরপর লম্বা সময় পেরিয়ে চলে আসি ২০১০ সালের ২০ এপ্রিলে। মেক্সিকো উপসাগরে বিপুল তেল নির্গমনের খবর এল। যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা ক্ষুব্ধ হলেন। তাঁদের খাটো হাতাওয়ালা জামা পরিহিত প্রেসিডেন্ট ছুটে গেলেন ঘটনাস্থলে। কংগ্রেসের শুনানিতে জড়ো হলেন তেল কোম্পানির নির্বাহীরা। নানা অজুহাত খাড়া করতে চেষ্টা হলো। সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমে বড় খবর হলো।
প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে জলাভূমিবাসীদের এলাকা ভিজেছিল যে পরিমাণ তেলে, এবার মেক্সিকো উপসাগরে তেল নির্গমন তার ভগ্নাংশ মাত্র। এ বিষয়টা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল। গণমাধ্যমও এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। বিপির প্রধান নির্বাহীর অনুশোচনামূলক অভিব্যক্তি যখন শুনলাম, আমার মন সরে গেল কেন সারা-উইওয়াতে। ছোটখাটো সেই মানুষটা, যাঁর মুখে ধরা থাকত পাইপ, অপ্রজ্বলিত।
জলাভূমিবাসীদের সেই জমিন, সেই নাজুক বাস্তুসংস্থানেই তাঁর মন পড়ে থাকত সব সময়। নাইজেরিয়ার সরকার আর তেল কোম্পানিগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। অবশেষে জনগণ জেগে উঠে রুখে দাঁড়াল—নয়জন মানুষের জান কোরবান করে। ওগোনির সেই নয় বীর। কেন সারো উইওয়ার হয়ে আমি যেমন একধরনের গৌরবের বোধ অনুভব করেছিলাম, তিনিও কি তা-ই বোধ করতেন? নাকি তাঁর পথ আলাদা হয়ে যেত?
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ওলে সোয়িঙ্কা: নাইজেরীয় ঔপন্যাসিক, কবি ও নাট্যকার। ১৯৮৬ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী।
No comments