কিশোর উপন্যাস- জোলা পালোয়ান by আতা সরকার

জোলার নাম বশির। কাজের কাজ কিছুই করে না। শুয়ে বসে গড়িয়ে দিন কাটায়। আর যত বাহাদুরি দেখায় জোলানী বৌ ছমিরনের ওপর। ওদের কোন ছেলেমেয়ে নেই। তাই বশিরের আয়-রোজগারের ধান্দাও কম।

তার পরও তো দু’জনের পেটের খোরাক জোগাড় করতে হয়। তাই জোলা কালে-ভদ্রে কখনো কখনো কাজ কর্মে যায়। কাজের মধ্যে কাজ হলো মাছ ধরার জাল হাটে হাটে বিক্রি করা। জালটা অবশ্য জোলা বোনে না। জাল বোনার কাজ ছমিরনকেই করতে হয়। ডাল ভাত রান্না, ঘর-গেরস্থালির কাজ কোন কিছুই বাদ নেই।
বশিরের মেজাজ খুবই কড়া। এর এদিকে-ওদিকে হলে ছমিরনের কপালে জোটে পিটুনি। ছমিরন জাল বোনে। রাতে সে জাল কেটে দিয়ে যায় ইঁদুর। এ দোষটাও যেন ছমিরনের। বশিরের হাতে তাকে নাজেহাল হতে হয়!
ইঁদুরের ওৎপাত দিন দিন বেড়েই চলেছে। বশির এজন্য ছমিরনকে পেটালেও সে মনে মনে চটে থাকে ইঁদুরের ওপরই। এক রাতে সে বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে থাকে জালের পাশে। চুপচাপ। অন্ধকারে তার চোখ জ্বলজ্বল করে। কান দুটো খাড়া, ইঁদুরের শব্দ শোনার আশায়।
রাত দুপুরে আওয়াজ শোনা যায় কিচকিচ। একটু পরেই কুচুর কুচুর। মানে ইঁদুর তার ছোট ছোট তীক্ষè দাঁত দিয়ে জাল কাটা শুরু করেছে। শব্দ লক্ষ্য করে বর্শা উঁচিয়ে পা পা এগিয়ে আসে বশির। বর্শা দিয়ে অনুমানে ঠেসে ধরে ঈঁদুরকে। প্রবল কিচকিচ আওয়াজ ওঠে। এরপর সব নীরব। বশির ম্যাচবাতি ঠুকে কুপি জ্বালাল। কাঁপা কাঁপা আলোয় দেখতে পেল, বর্শায় ফলায় রক্তাক্ত দেহে মরে আছে একটা ইঁদুর। মরা ইঁদুর দেখেই বশিরের বুক গর্বে ফুলে উঠল। ঘরের ভেতরেই সে উঁচিয়ে ধরল বর্শা। প্রচণ্ড শব্দে হুঙ্কার দিয়ে উঠল।

ছমিরন ঘুমিয়ে ছিল। বশিরের হুঙ্কারে সে ধড়ফড় করে বিছানার ওপর উঠে বসল। অবাক হয়ে সে তাকাল বশিরের দিকে। ঠিক কী ঘটেছে, সে বুঝতে পারছে না।
বশির বুকে চাপড় দিয়ে বলল : এখানে এসে দেখ, আমি কী কাণ্ড করেছি। অন্ধকারের মধ্যে এক কোপে ইঁদুর মেরেছি। হাঃ হোঃ হাঃ। আমি আজ বীর পালোয়ান হয়ে গিয়েছি। তোকে বলে রাখলাম, আজ থেকে আমি আর তোর বোনা জাল হাট-বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যাব না। আমি পালোয়ান, পালোয়ানগিরিই করব।

এরপর সে এক গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমুতে গেল। পরের দিন ভোর সকালেই সে উঠে পড়ল। ছমিরনকে তাগাদা দিয়ে বলল, এখনি তাড়াতাড়ি ভাত রেঁধে দাও। ভাত খেয়েই হাটে যাব। ছমিরন বলল, আজ হাটে কেন? আজ তো জাল বুনি নাই। একটা জাল ছিল। তাও তো কাল রাতে ঈঁদুর খানিকটা কেটেছে। বশির গর্বের সাথে বলল : ঐ ইঁদুরটাকে তো আমিই মেরেছি। ছমিরন ঠোঁট বাঁকা করে বলল : হ্যাঁ ইঁদুর মেরেছ। তাই বলে ইঁদুর খাওয়া জাল তো জোড়া লাগেনি।

বশির বলল : তোর জালের কারবার কে করছে? ঐ জোলাগিরিতে আমি নাই। আমি পালোয়ানগিরি করে রোজগার করব। ছমিরন গজ গজ করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। বশির খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে কাঁধে তুলে নিল বর্শা। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাটে চলে এল। হাটে যার সাথেই দেখা হয়, সেই তার বর্শার দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে কিগো বশির, ব্যাপারটা কী? বর্শা দিয়ে কী হবে?

এ ধরনের প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিল বশির। বুক ফুলিয়ে গর্বের সাথে জবাব দেয়, সে কথা আপনারা বুঝি শোনেননি? এখনো তাহলে খবরটা পান নাই?
লোকজনের কৌতূহল বাড়ে, কী খবর?

বশির বলে আর বলবেন না। কাল রাতে এই বর্শা দিয়ে একটা ইঁদুর একেবারে গেঁথে ফেলেছি। তাও আবার অন্ধকারের মধ্যে। এখন দেখতে পাচ্ছি আমার হাত খুব পাকা। নিশানাও খুব ভাল। সে জন্য ঠিক করেছি। এখন থেকে পালোয়ানগিরি করতে যাব, জাল বিক্রি-বাটার কাজ আর করব না।

বর্শা কাঁধে নিয়ে বশির পুরো হাট কয়েক বার চক্কর দেয় আর লোকদেরকে তার ইঁদুর বধের কাহিনী জানায়। হাটশুদ্ধো লোকজন তার কীর্তিকথা শুনে আর কাণ্ড কারখানা দেখে হাসাহাসি করে।

হাট ভেঙে যাওয়ার পর সবার শেষে যে লোকটি হাট থেকে বেরিয়ে আসে, সে হলো বশির। বর্শা কাঁধে সে ঘরে ফিরে আসে।
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই সে ছমিরনকে হুকুম করে : শিগগির ভাত রান্না কর। আমি খেয়ে দেয়ে বেরুব। আজ যাব বিদেশে। চাকরি-বাকরি খুঁজব। তোর অই জোলাগিরির কাজ নয়। এবার চাকরি করব পালোয়ানের। আমার নাম বশির পালোয়ান। দেশে দেশে আমার নাম ঘুরবে-ফিরবে।

ছমিরন মুখ ভেঙ্চে বলল : হ্যাঁ, খুব নাম-ইঁদুর মারা পালোয়ান। ছমিরনের টিপ্পনি সে গায়েই মাখল না। বলল, অনেক দূরে যাব। রাস্তায় ক্ষুধা লাগতে পারে। চাল ভেজে কয়েকটা লাড়– বানিয়ে দিবি। রাস্তায় ঐ লাড়– খেয়ে থাকব।

ছমিরন মুখ ঝামটা দিয়ে বলল : রাস্তায় এমন কোন ইয়ার দোস্ত জুটবে না যে ইঁদুর-মারা পালোয়ানকে খাওয়াতে পারে!
ক্ষেপে গেল বশির। রাগত কণ্ঠে বলল, আমার রাগ তুলিস না, তাহলে বিদেশ যাওয়ার বেলাতেও তোকে পিটিয়ে যাব। আমি যা বললাম, তাই কর।

ছমিরনেরও মেজাজ খারাপ। বশিরের হাতে হরদম মার খেয়ে খেয়ে সে এমনতেই তিরিক্ষি হয়ে আছে। তার ওপর বশিরের হুমকিতে তার আরো রাগ হলো। যতই রাগ হোক, তার পরও সে রান্নাঘরে ঢুকল। বশিরের জন্য ভাত-তরিকারি রাঁধল। তারপর খোলা কড়াইয়ে চাল ভাজতে বসল। চাল ভাজতে ভাজতেই তার মাথায় শয়তানি বুদ্ধিটা খেলে। সে মনে মনে ভাবে : জীবনে স্বামীর সোহাগ কাকে বলে কিছুই বুঝলাম না। ওটা মরলেই কী আর থাকলেই কী! এই তো এখন যাচ্ছে বিদেশে। কবে ফিরবে, আর ফিরবেই কী না, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। বিদেশে বিভূঁইয়ে আরেকটা বিয়ে করবে কি না তাই বা কে বলতে পারে। এখানে আমি কিভাবে থাকব তার কোন চিন্তা ওর মাথায় নেই। ওটা মরলেই আমি বাঁচতাম। এটা ভাবতে ভাবতেই তার মনে পড়ল, বশিরের অকারণে অসহ্য পেটানোর কথা। সঙ্গে সঙ্গে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। লাড়– বানাতে বানাতে তার সাথে বিষ মিশিয়ে দিল।

পরদিন খুব ভোরে বশির ঘুম থেকে জেগে ওঠে। অত সকালেই গোসল-টোসল সেরে নেয়। ধোপ দুরস্ত কাপড় পরে মাথায় বাঁধে পাগড়ি। ছমিরন তখন রান্নাঘরে ভাত-তরকারি গরম করছে। এর পরও অকারণে ধমকে উঠল বশির, তাড়াতাড়ি করতে পারিস না। আমি যাব অনেক দূর। পালোয়ানগিরি কি যে- সে ব্যাপার নাকি!
ছমিরনও মুখ ঝামটা দিয়ে বলল : ভাত-তরকারি সব রান্না হয়ে আছে। খেয়ে দেয়ে বিদায় হও।
বশির ধমকের সুরে বলল : রাস্তায় খাওয়ার জন্য আমার লাড়– কোথায়? সেটা তো এখনো বানাসনি।

ছমিরন বলল : সব বানিয়ে তোমার ঐ গামছার পোঁটলায় বেঁধে রেখেছি। রাস্তায় প্রাণ ভরে খেয়ো। খেয়ো কিন্তু আর ঘরমুখো হয়ো না। বশির বলল, এই বেরুচ্ছি। ঘরে যখন ফিরব, তখন তোর এই কথার জবাব দেব। পিঠটা শক্ত করে রাখিস। কয়টা লাঠি যে তোর পিঠে ভাঙব, তার হিসাব নেই।
ছমিরন মনে মনে বলল, আগে ফিরে আসই না।

বশির তড়িঘড়ি করে খাবার খেয়ে নিল। খাওয়া-দাওয়ার পর সে এক কাঁধে লাড়– বাঁধা গামছা ঝুলিয়ে নিল। আরেক কাঁধে তুলে নিল বর্শা। সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল রাস্তায়। যাত্রা শুরু করল অজানা পথ ধরে। যেতে যেতে অনেক পথ পাড়ি দিল। কত মাঠ পেরুল। কত ঘাট ডিঙ্গাল। কত পথ পেছনে ফেলে এল।

এক অজানা গাঁয়ের রাস্তা ধরে হাঁটছিল বশির। এ সময়ই তার সামনে দিয়ে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে গেল একটা গোসাপ। দেখেই থমকে দাঁড়াল বশির। তার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বর্শা ধরা হাতটাও করে উঠল নিশপিশ। গোসাপটা যেদিকে ছুটে গেল, সেদিকে সে পা বাড়াল। তার শিকারের নেশা পেয়েছে। সে কাঁধ থেকে বর্শা নামিয়ে বাগিয়ে ধরেছে। শিকারির মত পা ফেলে ফেলে রাস্তা পেরুলো গোসাপের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। গোসাপটিও তখন শিকার ধরার আশায় থমকে দাঁড়িয়েছে। তার সামনে একটা ফড়িং উড়ছেÑ তার লক্ষ্য সেদিকে। এ সময়ই সে টের পায় তার পেছন থেকে একজন লোক সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে তাকেই শিকার করবে বলে। সে ফড়িং ধরার আশা ছাড়ান দেয়। সে দ্রুত বেগে ছুটতে থাকে সামনের মাঠের দিকে। তার পিছু পিছু বর্শা হাতে ছুটতে থাকে বশিরও। গোসাপ উপায় না দেখে মাঠের ভেতর একটা গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এতেও রক্ষা নেই। গর্তের পাশে এসে বশির দাঁড়াল। বর্শা দিয়ে গর্তের চারপাশে খুঁড়তে লাগল। গর্তের ফাঁকে গোসাপের পিঠ দেখা যাচ্ছে। কালবিলম্ব না করে বশির গোসাপের পিঠ লক্ষ করে বর্শা চালায়। ।

বর্শাটি যখন গর্ত থেকে টেনে বের করে। তখন দেখা যায় বর্শার আগায় গোসাপ গেঁথে রয়েছে। বর্শার ডগায় গোসাপটিকে দেখতে পেয়ে বশিরে বুক গর্বে ফুলে গেল। আরো একটি শিকার হলো তার। পালোয়ানগিরির ব্যবস্থা এবার নিশ্চয়ই পাকা পোক্ত হবে। বর্শাবিদ্ধ গোসাপ কাঁধে নিয়ে শিকার সে পথ হাঁটতে শুরু করল। এ অবস্থায় তাকে দেখতে পেয়ে লোকজন হাসাহাসি করে।

রাস্তার মধ্যে কেউ কেউ তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি গোসাপের চামড়ার ব্যবসা করেন নাকি? বশির অবাক হয়ে জবাব দিল : গোসাপের চামড়ার ব্যবসা করব কেন? আমি হলাম একজান বীর পালোয়ান। জীব-জন্তু শিকার করে বেড়াই। আপনারা সবাই বশির পালোয়ানের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। আমিই হলাম সেই বশির পালোয়ান।

লোকজন অবাক হয়ে বলে, বশির পালোয়ানে নামে কোন পালোয়ান আছে নাকি? কই, কোনদিন তো এমন নাম শুনি নাই!

বশির বুক ফুলিয়ে বলল: না শুনে থাকলে এখন শুনবেন। শিকারে আমার হাত কী রকম তা তো আপনারা নিজেদের চোখেই দেখতে পারলেন। কাল রাতেও এই বর্শার এক কোপে একটা ইঁদুর শিকার করেছিলাম, তাও আবার অন্ধকার রাতে। বশিরের কথা শুনে লোকজন মজা পায়। তাদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে। তারা বশিরকে লক্ষ্য করে টিটকারি দেয়। এরপর চলে যায়। কোন কিছুতেই ঘাবড়ায় না বশির। সে হাঁটতে থাকে একই ভঙ্গিতে। পরপর দুটো শিকার করেছে সে। গর্বে তার বুক টগবগ করতে থাকে। কাঁধের ওপর বর্শা। বুক টান করে সে পথ হাঁটতে থাকে।

তখন চৈত্র মাস। খা খা রোদ। হাঁটতে হাঁটতে ঘেমে-নেয়ে ওঠে বশির। পানির তেষ্টাও পায় ভীষণ। আর এদিকে পেট জুড়ে চনমনিয়ে ওঠে ক্ষুধা। এ সময়ই সে দেখতে পায় রাস্তার পাশে একটা বিশাল পুকুর। পুকুরের পাড়ে ইয়া বড় একটা বটগাছ। সে এসে বটগাছের ছায়ায় বসে। গাছের ছায়া ও বাতাসে তার শরীরটা জুড়িয়ে যায়। ওখানেই বসে বসে বিশ্রাম নেয় অনেকক্ষণ। ঠাণ্ডা বাতাসে এক সময় চোখ জুড়ে ঘুমই নামে।

ঘুম ভাঙলে ক্ষুধাটা আবার টের পায়। মনে মনে ভাবল, এবার বৌয়ের বানানো লাড়– খাওয়া যাবে। সে গামছার পোঁটলাটা খুলে লাড়– বের করে। গামছার ওপর রেখেই সে পুকুরে হাতমুখ ধুতে যায়। গায়ে গতরে একটু পানি লাগিয়ে শরীরটাকে আরো ঠাণ্ডা করে তারপর লাড়– খাবে, এই তার ইচ্ছা।
পুকুরের শান বাঁধানো ঘাট। দেখলেই দেহ মন জুড়িয়ে যায়। সে ঘাটের হাঁটু পানিতে নেমে এল।

এদিকে একটা হাতিও ওই বটগাছের নিচে এসে হাজির। কার হাতি, কোত্থেকে এসেছে কে জানে! বটগাছের নিচে এটা ওটা শুঁকতে শুঁকতে তার শুঁড় গিয়ে পড়ল লাড়–র ওপর। কোন এক আকর্ষণে সে সব ক’টা লাড়– পটাপট মুখে চালান করে দিল। তারপর থেকেই হাতি স্থির। নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল।

বশির প্রাণ ভরে হাত মুখ ধুয়ে পুকুরের পাড় থেকে উঠে এল। বটগাচের নিচে বসে সে লাড়– খাবে। তারপর যাবে নতুন কোন শিকারে। গুনগুনিয়ে সে গান ভাজতে লাগল।
পুকুরপাড়ে বটগাছের তলায় এসেই তার চোখে চড়কগাছ। ঠিক সে যেখানে শুয়েছিল। সেখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা হাতি। তা হাতি দাঁড়িয়ে থাক, এর ব্যবস্থা পড়ে হবে। কিন্তু গাছের গোড়ায় গামছার ওপর সে যে লাড়–গুলো রেখেছিল, তার একটিও নেই। নিশ্চয়ই সব গিয়েছে হাতির পেটে।

বশিরের খুব রাগ হলো। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল। এত রাগ যে তার কোন হুঁশ-জ্ঞান রইল না। সে হাতিকে ভীষণ জোরে একটা ঘুষি মারল। হাতি দাঁড়িয়ে রইল তেমনি। নড়েও না চড়েও না। এতে বশিরের রাগ আরো বেড়ে গেল। তখন সে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে হাতিকে সজোরে ধাক্কা মারল। এবার কাজ হলো। হাতি ধাক্কা খেয়ে একদিকে কাত হয়ে পড়ে গেল। এ সময় বশিরের খেয়াল হলো : আরে! হাতিটা মরেই গেল নাকি! কার না কার হাতি, মরেই গেল!

বশির খুব খেয়াল করে দেখল, হাতিটা সত্যি সত্যি মরে গিয়েছে। সে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, আরে। এটা কী কাণ্ড! আমার হাতের এক ঠেলাতেই একটা আস্ত হাতি মরে যেতে পারে!

পুকুরটা ছিল রাজার। পুকুরের কাছেই রাজার বাড়ি। রাজা রাজবাড়ি থেকে লক্ষ্য করছিলেন পুকুর পাড়ের কাণ্ড কারখানা। তিনি সব ঘটনা দেখে তলব করলেন কোতোয়ালকে।

কোতোয়াল এলে রাজা বললেন : পুকুর পাড়ে বটগাছের নিচে খেয়াল কর। এখনি ওখানে যাবে। দেখে আসবে, ব্যাপারটা কী ঘটেছে। আমি লক্ষ্য করলাম, ঐ লোকটা আমার হাতিটাকে একটা ধাক্কা দিল। অমনি হাতি কাত হয়ে পড়ে গেল। মরেই গিয়েছে বোধ হয়। আমার মনে হয়। লোকটা নিশ্চয়ই একজন বীর পুরুষ হবে। তুমি গিয়ে দেখ, ব্যাপারটা কী?

কোতোয়াল তার দলবল নিয়ে অমনি চলে এল পুকুরপাড়ে বটগাছের তলায়। সেখানে বসে আছে একটা লোক। তার হাতে বর্শা! আর রাজার হাতিটা এক পাশে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাস চলে না মরেই গিয়েছে।

কোতোয়াল বশিরকে বলল: তোমার এত সাহস! তুমি রাজার হাতি মেরেছ। এখন বুঝবে মজা। তুমি কত বড় বীর হয়েছ, দেখা যাবে। চল রাজার কাছে।

বশির ভয় পেল না একটুও। বলল, আমি বীর হয়েছি না তো কী হয়েছি, সে কথা তো কাউকে বলতে যাইনি। ঠিক আছে, চলুন রাজার কাছে। আমার যে সর্বনাশ করেছে, এর বিচার আমি তার কাছেই চাইব।

কোতোয়াল আর তার দলবল বশিরকে ধরে রাজার কাছে নিয়ে এল।
কোতোয়াল পুকুর পাড়ের বটগাছ তলার ঘটনা জানিয়ে বলল : মহারাজ, হাতিটা মরেই গিয়েছে। এই লোকটাই হাতিটাকে মেরেছে।

রাজা বশিরকে বললেন: এ বিষয়ে তোমার কি কিছু বলার আছে? বশির মনে মনে একটু ভয়ই পেল। তবুও সাহস ধরে রেখে বলল : মহারাজ, ওটা যদি আপনার হাতি হয়, তাহলে আপনার কাছেই নালিশ জানাই। আপনার হাতি আমার সর্বনাশ করেছে। আমার বহু টাকার মাল ছিল। বটগাছের গোড়ায় রেখে আমি যখন পুকুরে নেমে হাত-মুখ ধুচ্ছিলাম, তখন আপনার ঐ হাতিটাই আমার সব মাল খেয়ে ফেলেছে। আমি পালোয়ান মানুষ। আমার এত টাকার এতগুলো মাল খেয়ে ফেলায় আমার খুব রাগ হয়েছিল। এ জন্যই আমি হাতিটাকে আর কিছু করি নাই। কেবল মাত্র একটা ঠ্যালা মেরেছি। এটা কি কেউ কখনো ভাবতে পেরেছে। মানুষের এক ঠ্যালাতেই একটা হাতি মরে যেতে পারে। সে যে এভাবে পড়ে মরেই যাবে, তা আমিও ভাবতে পারি নাই।

রাজা বললেন : আমার হাতি তোমার জিনিসপত্র যা কিছু খেয়েছে, তা আমি পাব কোথায়? তুমিও আমার লাখ টাকা লাখ টাকা দামের হাতি মেরে ফেলেছ। আমি সেটারও বিচার করতে চাই না। আমি তোমাকে হাতি মারার অপরাধ থেকে মুক্তি দিলাম। এর বিচার আমি আর করলাম না। আমার মনে হয় তুমি একজন বীর পালোয়ান। তুমি যদি আমার এখানে চাকরি করতে রাজি হও তাহলে পঞ্চাশ টাকা মাস-মাইনেতে আমি তোমাকে রাখতে পারি। বশির মহাখুশি। সে একবাক্যে রাজি। রাজবাড়িতে তার চাকরি হয়ে গেল।

বশির পালোয়ানের স্থান হয় রাজদরবারে। রাজা তাকে পালোয়ানের পোশাক বানিয়ে দিলেন।

বশিরের পদমর্যাদা হলো পালোয়ানের। পঞ্চম টাকা তার মাস-মাইনে। পুরো রাজ্যে একজনই পালোয়ান। পালোয়ান বটে, তবে তার কোন কাজ কর্ম নেই। সে রাজপ্রাসাদেই খায়-দায়। দুপুরে রাতে নাক ডেকে ঘুমায়। আর সকালে কিংবা বিকেলে প্রতিদিনের যে কোন এক বেলায় পালোয়ানি পোশাক গায়ে দিয়ে বাজারটা ঘুরে আসে। তখন তার কাঁধে থাকে ইঁদুর মারা গোসাপ-মারা বর্শাটা। রাজ্যজুড়ে প্রায় প্রতিটি লোক বশিরের মুখ থেকে শুনেছে অন্ধকার রাতে তার ইঁদুর মারার কথা। খোলা মাঠের গর্তে লুকানো গোসাপ হত্যার কথা আর সর্বশেষ রাজার পুকুর পাড়ে বটগাছের তলায় রাজহাতি বধের কথা Ñ মাত্র এক ধাক্কায় হাতির মৃত্যু। হাতি বধের কাহিনী কেউ বিশ্বাস করেছে। কেউ করেনি। কেউ কেউ টিপ্পনি কেটে বলে, জোলার হাস্যকর কাণ্ডকারখানা দেখে হাতি হার্টফেল করেছে। কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক রাজবাড়িতে তার পালোয়ান হিসেবে চাকরিটা তো হয়েছে। এখন চান্স পেয়ে বেতনটা বাড়িয়ে নিতে পারলেই হয়। সুযোগ এসেই গেল। বশির সেদিন পালোয়ানের পোশাক পরে রাজদরবারে বসেছিল। রাজা বিচারকার্য করছিলেন। এ সময় একদল প্রজা রাজার সাথে দেখা করতে চাইল, তাদের নাকি সমূহ বিপদ। খুব কান্না-কাটি করছে। রাজা আবার কান্নাকাটি একদম সহ্য করতে পারেন না। তার মনটা তুলোর মত নরম।

রাজার অনুমতি পেয়ে প্রজাদের একটা দল দরবারে ঢুকল। তারা এসেই রাজার পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। রাজা যতই বলেন, ছাড় ছাড়, পা দুটো ছাড়Ñ ওরা ততই পা জড়িয়ে ধরে। রাজা আদরমাখা ধমকের স্বরে বললেন: হয়েছেটা কী? না বললে বুঝব কেমন করে? সমস্যা থাকলে মিটাবই বা কিভাবে।
প্রজারা সমস্বরে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল: রাক্ষসরা আমাদের গ্রামের মানুষ খেয়েছে।

ওদেরকে অনেক জেরা করে জানা গেল, রাজার রাজ্যে নতুন এক রাক্ষসের উৎপাত শুরু হয়েছে। সে আজ এ গ্রামে রয়েছে তো কাল ঐ গ্রামে হানা দিয়েছে। এভাবে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষ মারছে। মানুষ ধরে ধরে খাচ্ছেও। এখনও কোন শহরে বা রাজধানীতে সে হানা দেয়নি। এ জন্যই খবরটা রাজা- অমাত্যদের কারো কর্ণগোচর হয়নি। রাক্ষসের জ্বালাতনের খবর কেউ বিশ্বাস করল, অনেকেই করল না। রাজা বিশ্বাস করবেন কি করবেন না। তাও বুঝে উঠতে পারলেন না। এ সময়ই দরবারে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল রানীর খাস বাঁদী, হাঁফাতে হাঁফাতে বলল: এই মাত্র রাজপ্রাসাদে একটা রাক্ষস ঢুকেছিলÑ খোদ রানীমহলে। দু’জন পাহারাদারকে মেরে ঢুকেছে সে। সরাসরি রানীর ঘরে হানা দিয়েছে। রানীর গায়েই হাত দিতে ধরেছিল। রানীর হাতে ছুরি দেখে রানীর এক বাঁদীকে ধরে নিয়ে গিয়েছে।

খবররটা শুনেই রাজা ও দরবারের সবাই নড়েচড়ে বসলেন। রাজা দরবারের পাহারা জোরদার করতে বললেন।

খানিক বাদেই রাজধানীর আশপাশ শহর থেকেও গণ্যমান্য প্রতিনিধিদল এল হুড়মুড়িয়ে। তাদেরও এক কথা, কোথা থেকে এক রাক্ষস এসে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
সবার কাছ থেকে বিবরণ শুনে মনে হয়, রাক্ষস একটাই। তবে বাতাসের চাইতেও দ্রুত তার গতি। সে লহমায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে পারে। প্রচণ্ড তার ক্ষুধা। দিনে তিন-চারটে মানুষ, এক-দুটো গরু-ছাগল না হলে তার ক্ষিধে মেটে না।

দরবারে হুলস্থুল পড়ে গেল। রাজার কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি সমস্যার সমাধানের জন্য চারজন বিশ্বস্ত দরবারিকে নিয়ে গোপন সভা করলেন। কিন্তু এ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন পথ দেখাতে পারল না। রাক্ষসকে দমন করার জন্য কোতোয়ালকে নির্দেশ দিতে সে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। যেন তার একশ দশ ডিগ্রি ম্যালেরিয়া জ্বর হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত রাজা অনেক ভাবনা-চিন্তার পর ঘোষণা দিলেন : রাক্ষসকে যে বধ করতে পারবে তাকে রাজকন্যার সাথে বিয়ে দেব আর আমার রাজ্যের অর্ধেক লিখে দেব।
দরবারে গুঞ্জরণ শুরু হলো। কিন্তু সাহস করে কেউ এগিয়ে এল না। সবার মুখে এক কথা: রাক্ষসের হাতে জানটাই যদি যায়। রাজন্যাকে বিয়ে করে কী হবে। আর কিই বা হবে অর্ধেক রাজ্য দিয়ে। রাজদরবারের ভাব-গতিক দেখে রাজা যখন হতাশ হয়ে পড়ছেন, তখনি উঠে দাঁড়াল বশির জোলা। পালোয়ানের মত বুক ফুলিয়ে বলল: মহারাজ, আমাকে হুকুম দিল আমি চেষ্টা করে দেখতাম রাক্ষসটাকে মারা যায় কি না।

রাজা বললেন: তুমি চেষ্টা করলে ভালোই হয়। আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছি, হ্যাঁ, তা ঠিকই থাকবেÑ রাক্ষস যে মারতে পারবে তার সাথে আমার মেয়ে রাজকন্যাকে বিয়ে দেব আর রাজ্যের অর্ধেক লিখে দেব।

বশির মনে মনে ভাবল : এটা একটা মস্ত বড় সুযোগ। রাক্ষসটাকে মারতে পারলে রাজকন্যাকে বিয়ে করতে পারব আবার অর্ধেক রাজত্বও পেয়ে যাব। একবার চেষ্টা করে দেখলে মন্দ হয় না। হাতিটা যেভাবে মরেছে। আল্লাহই ভালো জানেন কিভাবে মরেছে, রাক্ষসটাও ঐভাবে মরে গেলে কাজ হবে।

বশিরের সাহস দেখে কেউ কেউ বাহবা দিল, কেউ কেউ তাকে আহমক বলল। অনেকেই বাঁকা ঠোঁটে হাসল।

রাজবাড়ির কাছেই রাস্তার এক পাশে বিশাল বকুল ফুলের গাছ। বশির এক সন্ধ্যায় বকুল গাছের আগায় উঠে একটা ডালের সাথে নিজেকে শক্ত করে বাঁধল। এক হাতে তার অতি প্রিয় বর্শাটা ধরে বসে রইল।

অনেক রাত। চারদিকে নিঝুম। বশির পালোয়ানের চোখে ঘুম আসতে থাকে। চোখ টেনে ধরেও সে ঘুম আটকাতে পারে না। ঠিক এ সময়ই সে থপ থপ আওয়াজ পায়। যেন একটা পাহাড় এগিয়ে আসছে। তার ঘুম ছুটে যায়। উত্তেজনায় ভয়ে সে অপেক্ষা করতে থাকে।

একটা বিশাল ছায়া এসে দাঁড়ায় বকুল গাছের তলায়। বশির ভালো মত তাকিয়ে বুঝতে পারে, এটাই রাক্ষস। রাক্ষসটা মানুষের গন্ধ পাচ্ছে। সে চারদিকে তাকিয়ে মানুষ খোঁজে। উপরের দিকে তাকাতেই সে বশিরকে দেখতে পয়। লোভে তার মুখ হা হয়ে যায়। লালা পড়তে থাকে। হাত বাড়ায়। মানুষটার নাগাল পায় না সে। গাছের ওঠার চেষ্টা করে। গাছেও উঠতে পারে না। কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তখন মুখ হা করে সে আস্ত গাছ ধরে ঝাঁকাতে শুরু করে যেন ঝড় উঠেছে, এমন প্রবল বেগে বুকুল গাছ নড়তে শুরু করে। বিপদ গনে বশির। এমন ঝাঁকুনিতে বাঁধন খুলে তার নিচে পড়ার ভয় পেয়ে বসে। আর নিচে পড়লে রাক্ষুসের হা-করা মুখের মধ্য দিয়ে একেবারে পেটে চালান হয়ে যাবে।

ভয়ে বশিরের হাত-পা পুরো শরীর কাঁপতে থাকে। সে এমন কাঁপন কাঁপতে থাকে যে এর চোটে হাতে ধরা বর্শাটা হাত থেকে ফসকে যায়। সেটা শাঁ শাঁ করে নিচে ছুটে আসে। আর পড়বি তো পড় সরাসরি রাক্ষসের মুখে, গলা বেয়ে চালান হয়ে যায় পেটের ভেতর। সেখানে নাড়ি ভুঁড়িতে গিয়ে বর্শাটা বিঁধে।

রাক্ষসের গাছ ছেড়ে দিয়ে নিজের পেট ধরে। মরণ চিৎকারে চারপাশ কাঁপিয়ে তোলে। মুখে উঠে আসে রক্ত। অতবড় শরীরটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়। এমন শব্দ হয় যেন ভূমিকম্পে সব ভেঙে পড়ছে। সে হাত-পা তড়পাতে থাকে। তারপর এক সময় স্থির হয়ে যায়।

রাক্ষসের আর কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে বশিরের কাঁপুনি থামে। এদিকে রাতের অন্ধকার কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফুটছে। বশির নিজের বাঁধন খুলে গাছ থেকে ধীরে ধীর নেমে আসে। রাক্ষসের গায়ে ধাক্কা দিয়ে টের পায় ওটা মরে গিয়েছে। এবার বশির সাহস ফিরে পায়। বুক টান করে সে বজ্রনিনাদ কণ্ঠে হায়দরি হাঁক হাঁকে : খবরদার! হুঁশিয়ার!
তার বজ্রনির্ঘোষ চিৎকারে রাজবাড়ি ও আশপাশের শহরের ঘরে ঘরে মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। সবাই হইচই করতে করতে ছুটে আসে বুকল তলায়।

সবাই দেখে, রাক্ষস গাছের তলায় মরে পড়ে আছে, তার চারপাশে বশির পালোয়ান লাফাচ্ছে তার হাঁক দিচ্ছে। হাঁক ছাড়া আর কোন কথা নেই।

খবর শুনে রাজাও তার পাত্র-মিত্রদের নিয়ে ছুটে এলেন। রাক্ষসকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তিনি বেজায় খুশি। রাজ্যের ওপর থেকে একটা বিপদ কেটে গেল। ভাগ্যিস তিনি তাঁর দরবারে বশির পালোয়ানের মতো বীরকে স্থান দিয়েছিলেন। এদিকে লোকজন বলাবলি করছে : বশির পালোয়ানের মত বীর আমাদের রাজ্যে তো নেই-ই। এই জগতেও নেই।

তাদের কথার সাথে রাজা একমত হলেন। ঐ দিনই তিনি বশির পালোয়ানের নামে অর্ধেক রাজত্ব লিখে দিলেন। রাজকন্যার সাথে বিয়েও হলো ধুমধাম করে।
রাজার জামাই হয়ে বশির পালোয়ানের দিন কাটে আনন্দে। আবার ঐদিকে সে অর্ধেক রাজত্বেরও রাজা। এভাবে দিন যায়, মাস যায়। বছরের পর বছরও যেতে থাকে। এর মধ্যে রাজা বুড়ো হয়েছেন। তাঁর পাত্র-মিত্রদেরও বয়স বেড়েছে। সেই পুরনো সেনাপতিই রাজ্য রক্ষা করছে। কিন্তু বয়সের ভারে তারও অবস্থা সঙ্গিন। অবশ্য এতে কোন অসুবিধা ছিল না এতদিন। রাজা শান্তিপ্রিয়। প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সাথে রয়েছে তাঁর সদ্ভাব। এ জন্য সেভাবে সেনাবাহিনী গড়ে ওঠেনি। যে বাহিনী রয়েছে, তার সৈন্যরাও অনেক পুরনো। বুড়ো হয়ে পড়ছে।

এর মধ্যেই প্রতিবেশী এক দেশে নতুন রাজা হন এক ডাকাত সর্দার। তার প্রচণ্ড লোভ। আশপাশের রাজ্যগুলোতে সে হানা দিতে শুরু করল। লুটপাট করে নিজের ধন ভাণ্ডার বাড়াতে লাগল।

একদিন রাত নিঝুমে এ রাজ্যও আক্রমণ করে বসল। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। সেনাপতি এসে পড়ল রাজার পায়ে : মহারাজ, এখন কী উপায়? আমি নিজেও বুড়ো হয়ে পড়েছি, আমার সৈন্যরাও বুড়ো। কেউ যে যুদ্ধে যেতে চায় না। রাজার কপালে বহুদিন পর আবার ভাঁজ পড়ল। তিনি তাঁর পাত্র-মিত্রদের গোপন সভায় জিজ্ঞেস করলেন : এখন উপায়? বিনা যুদ্ধে রাজ্য দিয়ে দেব কি ডাকাত সর্দারের হাতে?

সেনাপতি বলল: যুদ্ধে এর মধ্যেই আমাদের বহু সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে। এখন পালানো ছাড়া আমাদের আর কোন পথ নেই।

উজির ভেবে চিন্তে বলল: একবার চেষ্টা করে দেখলে হয় না। মহারাজ, আপনার জামাই বশির জোলা মস্ত বড় পালোয়ান। এক ধাক্কায় সে আপনার হাতি মেরেছে। একাই এক রাক্ষসকে মেরে আমাদেরকে রক্ষা করেছে। ডাকাত সর্দারের হাত থেকে কি সে আমাদেরকে রক্ষা করতে পারবে না?

রাজা একটু আশার আলো দেখতে পেলেন। তুবও একটু সন্দেহ রইল, জামাই তার এত বড় ঝুঁকি নেবে কি?

রাজা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত বশিরকে গিয়েই ধরলেন : বাবা, এই শেষবারের মতো তোমাকে একবার যুদ্ধে যেতে হয় যে!

বশির ডাকাত সর্দারের বাড়াবাড়ির কথা আগেই শুনেছে। এই আশঙ্কাটাই তার হচ্ছিল। সে এখন আর পালোয়ানগিরি করতে চায় না, সাহসও অনেকখানি হারিয়ে ফেলেছে। সে তো এখন অর্ধেক রাজা। রাজত্ব করতেই তার কাছে ভাল লাগে। এখন যুদ্ধ করতে গিয়ে শুধু শুধুই জানটা হারাবে। কিন্তু উপায়ও নেই। বশির পালোয়ান হিসেবে তার নাম-ডাক হয়ে গিয়েছে। চারপাশে তার খ্যাতি। এ খ্যাতি রাখতে গিয়েই তাকে যুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখাতে হবে।

বশির মনে মনে ভাবল, যুদ্ধে গেলে আমার তো জীবন শেষ হবেই। তাহলে জীবনের শেষ খাবারটা খেয়েই যেতে হবে। আমার প্রিয় যে যে খাবার গুলো রয়েছে, সেগুলো তাহলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই খেয়ে নিতে হবে যাতে মৃত্যুকালে আমার জিহ্বার কোন আফসোস না থাকে। সে তার শ্বশুর বাবাকে বলল: মহারাজ, আপনি যখন হুকুম করেছেন, তখন আমি যুদ্ধে যাবই। তবে তার আগে আমার একটা সাধ রয়েছে। আমাকে ঘি-ভাত প্রাণ ভরে খাওয়র অনুমতি দিন।

রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন: তোমার মনের আশা পূরণ কর। রাজার হুকুমে রাজবাড়ির রান্নাঘর থেকে হাঁড়ি হাঁড়ি ঘি-ভাত এল। এর সাথে এল মুখরোচক নতুন নতুন খাবার।

বশির পেট ভরে খেল। খেতে খেতে পেট ভরে গেল হয়ে গেল। ঢোলের মতো। বশির আর নড়তে চড়তে পারে না।

বশির ঐ অবস্থাতেই বলল: আমাকে একটা ঘোড়ায় তুলে শক্ত করে বেঁধে দিন, যাতে আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে না যাই।

বশিরের পরামর্শ মতো সবাই মিলে তাকে ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে দিয়ে বেঁধে দিল। বশির তার হাতে একটা ছোড়া নিল। তারপর ঘোড়াটাকে ছুটিয়ে নিল সামনে। শত্রু শিবিরের দিকে। ছোরার খোঁচা খেয়ে ঘোড়া তীর বেগে ছুটতে লাগ। যেন উড়ে চলছে।

এ যুদ্ধের কিছু দিন আগেই ভূূমিকম্প হয়েছিল। বশিরের ঘোড়া যে পথ ধরে ছুটছিল, তার দু’পাশে ছিল বড় বড় গাছ। ভূমিকম্পে এ গাছগুলোর গোড়া শেকড়-বাকড় নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। এখন ঘোড়ার দাপটে পথের মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আর এতে ঘোড়ার ছোটার পেছনে পেছনে গাছগুলো শেকড় উপড়ে ধপাধপ পড়ে যাচ্ছিল।
ডাকাত সর্দারের সৈন্য শিবিরে হইচই রর উঠে গেল। তারাও বশির পালোয়ানের নাম ও কীর্তি কাহিনী শুনেছিল। এখন সে নিজে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসছে। তাকে দেখার জন্য সবাই শিবির থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তারা বশির পালোয়ানকে পিঠে নিয়ে ছুটন্ত ঘোড়াকে দেখতে পেল। আর দেখতে পেল, ঘোড়ার চলার দাফটে ধাপধপ করে একেকটা বড় বড় গাছ মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। যার ঘোড়ার এত দাপট, তার দাপট না জানি কত! ডাকাত সর্দারের সৈন্যদলে আতঙ্ক তৈরি হয়। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল : আজ আমাদের নির্ঘাত মৃত্যু হবে। এই পালোয়ান এলে আজ আমরা দলে দলে মারা যাব।

ডাকাত দলের সৈন্যরা সবাই পেছনের রাস্তায় পালাতে শুরু করল। এদিকে বশিরের দম আটকে যাচ্ছিল। ঐ অবস্থাতেই সে দেখতে পেল, শত্র“পক্ষের সৈন্যরা পালাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে তার দুর্বল শরীরে শক্তি এসে গেল। সে শত্র“ শিবিরে গিয়ে যখন উপস্থিত হলো, তখন সেখানে তাকে বাধা দেয়ার জন্য কেউ উপস্থিত নেই। সে তার বাঁধন খুলে ঘোড়া থেকে নামল। কোন রকমে তাদের রাজ্যের পতাকা সেখানে পুঁতে দিন।

বিজয়ীর বেশে সে ফিরে এল। রাজা পরম সমাদরে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন: বাবা, আমি বুড়ো হয়েছি। আমার রাজত্বটাও তোমাকেই দিলাম। পুরো রাজ্যের রাজা এখন থেকে তুমিই।

যথারীতি বশির পালোয়ানের রাজা হিসেবে অভিষেক হলো। সে হলো বিশাল রাজ্যের রাজা।

একদিন সে তার রাজকন্যা স্ত্রীকে বলল: তোমার আরেকটা বোন রয়েছে। ছমিরন তার নাম। সে আমার পয়লা স্ত্রী। জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। আমার হাতে শুধু শুধু পিটুনি খেয়েছে। সব শুনে রাজকন্যা বলল: আমার বোন দূর অজগাঁয়ে থাকবে কেন? তাকেও এখানে নিয়ে আসুন। আমরা দু’বোন এক সাথে থাকব।

বশির অনেক জিনিসপত্র, লোক লস্কর নিয়ে ছমিরনকে আনতে তার গাঁয়ে চলল।

ছমিরন তখন ঘরের ভেতর একলা-একলা ভাত রাঁধছিল। এ সময়ই তার পেছনে এসে দাঁড়াল বশির একা। তার লোকজনকে সে বাইরে রেখে এসেছে। বশিরকে দেখে ছমিরন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। আমতা আমতা করে বলল: তুমি এখনো বেঁচে আছ? মরো নাই? বশির বলল: তোকে না মেরে আমি মরব নাকি। ভিন গাঁয়ে আমি ঘর বানিয়েছি। নতুন একটা বিয়েও করেছি। এখন তোকে নিতে এসেছি।

ছমিরন প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলল : না না, আমি এখান থেকে কোথাও যাব না। তোমার হাতে আর পিটুনি খাব না।

বশির গভীর দরদের সাথে বলল : আগে অভাব ছিল। খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট ছিল। তাই মেজাজ-মর্জি ভালো ছিল না। তোকে পিটিয়ে নিজের মনের অশান্তি মেটাতাম। এখন আমার অবস্থা ভালো। খাওয়া-পরা-থাকার কোনো চিন্তা নেই। তাই মনে সুখ। তোকে আর কখনোই পেটাব না।

বশিরের অনেক অনুরোধে অবশেষে ছমিরন তার সাথে যেতে রাজি হলো। সেজেগুজে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই সে অবাক! এত লোক-লস্কর, পাইক-বরকন্দাজ। সবাই বশিরকে দেখে কুর্নিশ করছে আর তাকে মহারাজ বলে সম্বোধন করছে। ছমিরনকেও বলছে ‘রানীমা’। ছমিরনকে নেয়ার জন্য একটা পালকিও এসেছে। সে গিয়ে উঠলো পালকিতে। আর ঘোড়ায় বশির।

বশির পালোয়ান তার বৌকে নিয়ে চলল তার নিজের রাজ্যে।

[বরিশাল ও রংপুরের লোককাহিনী অবলম্বনে]
==================================


কিশোরকন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আতা সরকার

No comments

Powered by Blogger.