পল্লীভ্রমণ: 'দ্বীপ মনপুরার টানে' by মৃত্যুঞ্জয় রায়

কালবোশেখির চোটটা গেছে পানামা লঞ্চের ওপর দিয়ে। যাত্রীরা ভয়ে তো কেঁদেকেটে অস্থির, দুলুনি-ঝাঁকুনি দমকা বাতাসের দাপট। বাতাসের ঝাপটায় লঞ্চ ওল্টানোর হাত থেকে অবশেষে রেহাইÑ সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর মুন্সীগঞ্জের কাছে পৌঁছতেই এ অবস্থা। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নামে পরিত্রাণ। এসব খবর, খবর হয় না, কোনো সংবাদপত্র বা চ্যানেলে আসে না। আসে দুর্ঘটনায় পড়ে লোক মরলে বা লঞ্চ ডুবলে। তবে এসব খবর আসে লঞ্চের সারেং-সুকানিদের মুখে মুখে। ঝড়ে পড়ে ফিরে আসা কিছু যাত্রী চলেছেন পরদিনের লঞ্চে। ওদের মুখ থেকেও শোনা গেল ঘটনা। আজ সেই তা-বের লেশমাত্র নেই। আজ কী আশ্চর্য জ্যোৎস্নাপ্রপাত নেমেছে নদীর ওপর! ঊনপূর্ণিমার নীলাভ আলোয় ভাসছে নদীর বুক, জলের চাতাল, নদীতীর, ইটভাটি আর ধোঁয়া ওড়া জলযানগুলো। তিরতির করে বাতাস বইছে। কালবোশেখির তা-বের কোনো লেশমাত্র নেই। কী আশ্চর্য এক দেশ। এই কাঁদে, এই হাসে। লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে কাল সন্ধ্যার ঘটনার কথা শুনে মনে একটু ভয়ও হলো। টালমাটাল মেঘনার জল পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত মনপুরায় পৌঁছতে পারব তো! আজ পানামা না, এমভি টিপু-৫-এর পালা। এই প্রথম চলেছি ভোলার মনপুরার টানে। লঞ্চ যাবে হাতিয়া পর্যন্ত। হাতিয়ার আগের স্টেশন মনপুরা আমার গন্তব্য। মনপুরা ঘাটের নাম নাকি রামনেওয়াজ ঘাট। সেই মুন্সীগঞ্জ পৌঁছতেই ঊনপূর্ণিমার চাঁদটা ঘোলা হয়ে এলো। ঈশান কোণে মেঘ জমতে শুরু করেছে। তাহলে কি আজো আবার! দুরু দুরু বুকে লঞ্চের কেবিনে না ঢুকে ডেকের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে মেঘ আর চাঁদের খেলা দেখতে লাগলাম। বাতাসের জোর বাড়ছে, ধীরে ধীরে নদীও চওড়া হচ্ছে। ফকফকে জ্যোৎস্না আর এখন নেই। আকাশে একটু একটু মেঘ জমতে শুরু করেছে। ডেকে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে এসব দেখতে দেখতে চলেছি আর মনের মধ্যে কল্পনায় মনপুরার একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছি, কেমন হতে পারে সেই স্বপ্নের দ্বীপটা? টিপু-৫ কিন্তু সব কিছুকে থোড়াই কেয়ার করে সদর্পে এগিয়ে চলেছে। একে একে পেরিয়ে যাচ্ছে মল্লিকপুর, দৌলতখান, হাকিমউদ্দিন, তজুমদ্দিন। লঞ্চের ডেকে বসে এসব স্টেশনের জেটিতে নিশাচর যাত্রীদের ব্যস্ত ওঠানামা দেখছি। উঠছে নামছে বস্তা বস্তা মালামালও। সেসঙ্গে চলছে কুলিদের হাঁকডাক, লঞ্চের ঘণ্টাধ্বনি। নদীর কোনো কূল নেই, কিনারা নেই। কেবলই অথৈ পাথার। অন্ধকারেও নদীপাড়ে ভাঙনের চিত্র লঞ্চের সার্চ লাইটে স্পষ্ট। ভোরের আলো ফুটলেও তা ঘোলাটে, বিস্তীর্ণ নদীর ঘোলাটে জলের মতোই যেন আকাশ। তবে ঘাটে ঘাটে লঞ্চ ভেড়ার সময় নাকে এসে লাগছিল দেশি বালাম ধানের ঘ্রাণ, নদীকূলে বিস্তীর্ণ জমি হয়তো ভরে আছে গর্ভবতী ধানের গাছে। এসব ডিঙিয়ে লঞ্চটা পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় রামনেওয়াজ ঘাটে ভিড়ল। রামনেওয়াজ ঘাট মানেই মনপুরা। সারারাতের উৎকণ্ঠা শেষে আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নিদ্রাহীন টানটান উৎকণ্ঠার যেন আপাতত সমাপ্তি ঘটল।
কিন্তু বাঁচতে আর পারলাম কই? জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় উঠেছি। না উঠেইবা উপায় কী? আর কোনো আবাসিক হোটেল নেই। সারা রাতের প্রায় নির্ঘুম ক্লান্তিটা বিছানায় শুয়ে আড়মোড়া দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু হরিণের পালের মতো মাঝে মাঝে কিছু ছেলেপুলে জানালায় এসে উঁকি দিচ্ছে। যেন আমি চিড়িয়াখানায় বন্দি কোনো জন্তু, ওরা দেখতে আসছে। ইতি-উতি উঁকি-ঝুঁকি, কিচিরমিচির কথা। বড্ড বিব্রতবোধ করছি। কেয়ারটেকার ওমর হোসেনকে হাঁক দিলাম, ঘটনা কী? এত লোকজন কীসের? ওরা কারা? ওমর হোসেন বয়স্ক মানুষ, দাড়ির ফাঁকে তার হাসি খেলে গেল। উত্তর দিলেন, ‘ওরা এই বাঁধেরহাট গ্রামেরই মানুষ। এত সুন্দর টাইলস ফিটিং বিল্ডিং মনপুরায় তো কোনোদিন হয়নি, তাই কিছু লোক প্রায় প্রতিদিনই দল বেঁধে দেখতে আসে, ফিরে গিয়ে গল্প বলে, আরো লোক আসে। কী করব কন? মানা তো করবাম পারি না। হাউস বলে কথা।’
সত্যিই, যতটা বিব্রত ও বিরক্ত হয়েছিলাম ওদের ওপর, ওমর হোসেনের কথা শুনে বাচ্চাগুলোর প্রতি খুব মায়া হলো, মায়া হলো দ্বীপ মনপুরাবাসীর ওপর। অবাকও কম হলাম না। মনে করার চেষ্টা করলাম, রামনেওয়াজ ঘাট থেকে মনপুরা পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার একটা সরু পাকা পথ। ফাঁকাও বেশ।
রাস্তার কোলঘেঁষে কিছু ঘরবাড়ি, পাড়া, মুদি দোকান। পথের দুপাশে আসার সময় মনপুরার বাড়িঘরগুলোর চেহারা একটু মনে করার চেষ্টা করলাম। কোনো বিল্ডিং দেখিনি। একটা পাকা বাড়িও চোখে পড়েনি। মনপুরায় পৌঁছে দেখলাম, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও সরকারি অফিস ভবনগুলো ছাড়া আর কোনো পাকা ভবন নেই। সবই টিন-কাঠের ঘরবাড়ি। গাছপালাও খুব ঘন না।
প্রায় প্রতিটি বাড়ির চালে একটা করে সৌর প্যানেল বসানো, বাড়ির সঙ্গে পুকুর। তার মানে বিদ্যুৎ ও পানির কষ্ট যেন মনপুরা দ্বীপবাসীর ভাগ্যের লিখন। পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, আসলেই তাই। ভোলার একটা উপজেলা হয়েও মনপুরা একটা আলাদা দ্বীপ। দ্বীপ হওয়ার কারণেই বিদ্যুতের সংযোগ সেখানে আজও পৌঁছেনি।
তবে হঠাৎ কেউ গেলে সেটা বুঝতেই পারবেন না। ব্যবস্থা নেই স্বাস্থ্যসম্মত পানীয়জলেরও। দ্বীপের চারপাশে সুপ্রশস্ত নদী, এত জল তবু সেগুলো গৃহস্থালি কাজে ও পানের অযোগ্য, সেচের কাজেও লাগে নাÑ সব লোনা পানি। খাওয়ার পানির জন্য টিউবওয়েলই ভরসা। সরকারি ও বেসরকারি অফিসগুলো চলছে জেনারেটরে, নিয়ম করে। দোকানে ফটোস্ট্যাট মেশিনও চলে জেনারেটরে, তাই ফটোকপি করার দামও দ্বিগুণ। তাই বলে সারা দিনরাতই জেনারেটরের বিদ্যুৎ মেলে না। ওটা চলারও একটা নিয়ম আছে সেখানে। সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত থাকে জেনারেটরের আলো, এরপর আবার মনপুরা ডুবে যায় গভীর অন্ধকারে। গরমকালে দুঃসহ গরমেও পাখা ঘোরানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। ভাবলাম, মনপুরা ইজ ভেরি স্পেশাল। তাই এখানকার জন্য অফিস টাইমটা কি সন্ধ্যা থেকে করলে ভালো হয় না? ওমর হোসেনকে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই হেসে ফেললেন, বললেন, ‘তা কী করে হয়? গরমেন্টের একটা আইন আছে না? গাঁও-গেরামের লোকেরা কি রাইতে অফিসে আইবো?’ গাঁও-গেরামের মানুষদের কথা জানি না, তবে এখানে যারা চাকরি করতে আসেন, তাদের অনেকেরই অনুভূতি হলো মনপুরা পোস্টিং মানে পানিশমেন্ট ট্রান্সফার, শাস্তিমূলক বদলি। এটা দ্বীপান্তর বা নির্বাসন ছাড়া কিছুই না। একসময় চোর-বদমাশদের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে কালাপানি, ফাঁসি হতো, এখন এ দেশের চাকরিজীবীদের ফাঁসি হয় মনপুরা দ্বীপে। সমস্ত দ্বীপে ঢু ঢু করে ঘুরে বেড়ালে যত কেওড়া গাছ চোখে পড়ে,
রাস্তায় তত মানুষের দেখা মেলে না। বেশ নিরিবিলি, শান্ত শীতল এক দ্বীপ। পাশেই হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ। সেখানকার না জানি কী অবস্থা। ওমর হোসেন আশ্বস্ত করলেন, ‘দ্বীপটা যতই নিরিবিলি দ্যাখেন, তাতে ডরের কিছু নেই। এখানে কোনো চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই নেই। রাত-বিরেতে আপনি দিব্যি পুরোটা দ্বীপ হেঁটে বেড়াতে পারেন। আপনার গতরে কেউ টোকাটা পর্যন্ত দেবে না।’ তবে ওমর হোসেন যতই বলুক, মনে আমি অতটা বিশ্বাস করলাম না। কেননা, এই মনপুরা দ্বীপই একসময় ছিল পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা। সাগরে-নদীতে ডাকাতি-রাহাজানি ছিল যাদের পেশা। তাদের দুচারজন বংশধর যে এখনো মনপুরার মাটিতে নেই এ কথা হলফ করে বলা যাবে না। তবে সেসব না থাকলে তো আসলেই মনপুরা এক শান্তির দ্বীপ। তবু কেন যে চাকরিজীবীরা সবাই পোস্টিংটাকে বলেন শাস্তিমূলক! এখানে পোস্টিংয়ের পর অনেকেই ফের তদবিরে নেমে পড়েন মনপুরা থেকে মুক্তির জন্য।
===========================

সাপ্তাহিক ২০০০ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মৃত্যুঞ্জয় রায়

No comments

Powered by Blogger.