স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ এক প্রসন্ন কল্লোল' by শাহাবুদ্দীন নাগরী
‘খটখটে মাটির ভিতর উনিশ বছর আমি ছিপ ফেলে বসে আছি আত্মার সন্ধানে’ (‘পাগল এই রাত্রিরা’) Ñ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’র (১৯৬৭) কবিতাটি পড়ার পর কবি সম্পর্কে আমার ভেতর সৃষ্টি হয় এক অন্যরকম অনুভূতি। এমন নিপাট উপমাশ্রয়ী শব্দগুচ্ছ কবিতার অন্তরের মাধুর্যকে কীভাবে মোহনীয় করে তোলে তা উদ্ধৃত গ্রন্থের কবিতাগুলো না পড়লে আমার কিশোর বয়সে হয়তো অনেক কিছুই অজানা থেকে যেত। আরো পরিণত হয়ে কবি যখন তাঁর কবিতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেনÑ ‘কবিত্বময় গদ্য আর কবিতা এক জিনিস নয়। কবিতা একটি অখ- শিল্পকাজ, কবিত্বময় গদ্য তা নয়। অনেক গদ্য লেখায় আছে কবিতা, কিন্তু তা কবিতা নয়। কবিতা শুধু লিরিক্যাল গদ্য নয়, তার সম্পূর্ণ অভিঘাত অন্য জিনিস। ভাষা এবং বিষয়ের সম্পূর্ণ অখ- একক অভিঘাত কবিতার। গদ্য কবিতাকে ব্যবহার করে অনেক সময়, কবিতাও গদ্যকে ব্যবহার করে অনেক সময়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত গদ্য গদ্যই, কবিতা কবিতাই।’ (কবিতার কথা, চেতনায় জল পড়ে শিল্পের পাতা নড়ে, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৯, প্রবন্ধটির প্রথম প্রকাশকাল ১৯৮৩)।
এক বহুমাত্রিক লেখক-কবি-গবেষক প্রয়াত আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০)-এর কবিতা আর লেখালেখি পড়তে গিয়ে এভাবেই চমকে উঠেছি তাঁর চিন্তা-বিশ্বাস-বিশ্লেষণ-অন্বেষণ দেখে আমার কিশোরোত্তীর্ণ বয়সেই। ওপরের কবিতাংশ এবং উদ্ধৃতিটি তাঁরই। নির্ভার গদ্যে রচিত ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ যেন উল্টেই দিয়েছিল সে সময়ের কবিতাকে। গ্রন্থটি পড়ে মান্নান সৈয়দের শিক্ষক প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান লিখেছিলেন : ‘গ্রাম্যতা সর্বতোভাবে বর্জনীয়। নতুন টেকনিক আমদানি কোনো অপরাধ নয়। শুধু প্রশ্ন, তাঁর সাফল্য দেশি ঐতিহ্যে কতটুকু সুসঙ্গতি লাভ করেছে। মান্নান এই ক্ষেত্রে আশ্চর্য রকমে অনেকখানি সফল।’ (সমকাল, মাঘ-চৈত্র ১৩৭৩)। আমার যখন কবিতা বোঝার বয়স হয়েছে তখন কবিতার এই প্যাটার্ন নিয়ে আমি নিজেই ভেবেছি, কীভাবে মান্নান সৈয়দ সফল হলেন? তাঁর চেয়ে কী শামসুর রাহমান বা শহীদ কাদরীর কবিতা পড়তে অনেক ভালো লাগে না? ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’ বা ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’-এর কবিতাগুলো কি অনেক হৃদয়সঞ্জাত, গভীর ও সপ্রতিভ মনে হয় না? পরে নিজে নিজেই নিজের ভেতর তৈরি করেছি কবিতার আঙ্গিক, টেকনিক, বিষয় এবং উপস্থাপনার কলাকৌশল। সেই ফর্ম্যাটে কবিতাকে ঢেলে দিয়েছি, তারপর সেখান থেকে উদ্ধার করেছি কবির কাব্যিক অনুভূতি এবং আদর্শ। ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’র কবিতার অন্তর্নিহিত বিশ্বাস এবং নির্যাস প্রথম গ্রন্থের মতো থাকলেও আবদুল মান্নান সৈয়দ চলতি কবিতার ধারায় সাজিয়েছিলেন কবিতাগুলো, প্রথম গ্রন্থের সঙ্গে বিশাল ফারাক। টানা গদ্যে লেখা কবিতা থেকে তিনি ফিরে এলেন কেন? তিনি তাঁর ‘কবিতা’ প্রবন্ধে বলেছেন : ‘কবিতা মানে রূপান্তর, কবিতা মানে বদল, কবিতা মানে পরিবর্তন। কবিতা মানে অবৈকল্য নয়, কবিতা মানে তির্যকতা। কবিতা নয় বস্তুফলক, এমনকি কবিতা কল্পনাফলকও নয়। কবিতা বস্তুকে তো রূপান্তরিত করেই, এমনকি কল্পনাকেও পরিবর্তিত করে।’ (করতলে মহাদেশ, নলেজ হোম, ঢাকা ১৯৭৯। রচনা পুনর্বার মুদ্রিত হয় ১৯৮৭ সালে মুক্তধারা কর্তৃক প্রকাশিত নির্বাচিত প্রবন্ধ গ্রন্থে)।
এ জন্যই কি মান্নান সৈয়দ তাঁর কবিতার জগতে প্রতিনিয়তই সন্ধান করেছিলেন নতুন পথের? কবিতা নিয়ে খেলেছিলেন, মেতেছিলেন নতুন উৎসবে? শব্দের আড়ালে যে শব্দ লুকিয়ে থাকে তাকেই কী তিনি তুলে এনেছিলেন তাঁর নিত্যনতুন কবিতার শরীরজুড়ে? আর তাঁর কবিতার বিষয়? বিষয়ে কী তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক? ‘মাছ সিরিজ’ (১৯৮৪) গ্রন্থের কবিতাগুলো কী তেমন কিছু? তিনি কবিতার বিষয়কে কীভাবে মুড়েছিলেন কবিতার মোড়কে? যখন তিনি ‘পরাবাস্তব’ কাকে বলে জানতেন না, তাঁর নিজের ভাষ্যমতে, বিশুদ্ধ পরাবাস্তব কবিতা তিনি ঐ সময়েই লিখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, মনের গভীরে ওলট-পালট হতে হতে, স্বপ্ন ও জাগরণের ভেতর দিয়ে ঘোর লাগা শব্দ যখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যায়, ‘অর্ধচেতনার স্রোত’ নামিয়ে আনে অন্ধকারজয়ী পঙ্ক্তি সেটাই প্রকৃত কবিতা, পরিমার্জনা করলে তার প্রকৃত চেহারা থাকে না। এই তো ছিলেন আমাদের মান্নান সৈয়দ।
‘করতলে মহাদেশ’ যদিও তাঁর ৩৬ বছর বয়সকালে প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ, তবুও সত্যিকার অর্থে এ গ্রন্থের লেখালেখি তাঁর আরো কম বয়সের লেখা। ‘প্রবেশক’ শীর্ষক ভূমিকাংশে তিনি বলেছেন যে, কবি ও কবিতা বিষয়ে তাঁর এ লেখাগুলোর সময়কাল ১৯৭২-৭৯ সালের মধ্যে। ফলে, কবিতা বিষয়ে তাঁর এ গ্রন্থে যে বিশদ ব্যাখ্যা, বিশাল পৃথিবী এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উল্লেখযোগ্য কবি এবং তাঁদের কবিতার তুলনাত্মক কথা উল্লেখিত হয়েছে, মনস্ক পাঠকমাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন অতিতরুণ একজন লেখকের সাহিত্যের পৃথিবীকে জানার এবং তা বিশ্লেষণ করার কী অসাধারণ ক্ষমতা তিনি ঐ বয়সেই অর্জন করেছিলেন। একে ‘অর্জন’ই বলা সঙ্গত। সবাই এটা পারেন না। তুলনা-প্রতিতুলনা করা বা সাযুজ্য (ষরশবহবংং) খোঁজা তো রীতিমতো ধারাল মস্তিষ্কের কাজ। মান্নান সৈয়দ তাঁর লেখালেখি জীবনের শুরু থেকেই এই অসাধ্য কাজটি নিপুণ শিল্পসুষমার লালন এবং চর্চা করেছেন। ব্যর্থতার দায় তিনি কখনো স্বীকার করেননি (এটি তাঁর চরিত্রেরও বাইরে ছিল), তবে প্রকাশে এসব রচনার সৃষ্টিকালীন সময়ের কথা অকপটে উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন : ‘প্রবন্ধগুলি তাৎক্ষণিক, অনেক সময় ক্ষণকালীন আবেগে কিংবা ফরমাশে লেখা, আবার অনেক সময় একটি ভাবনা পিছু ফিরেছে আমার দীর্ঘদিন ধরে।… হয়তো এরই মধ্যে আমার কাব্য বিবেচনায় একটি বহমান বাঁকা জলস্রোতের সন্ধান পাবেন কেউ কেউ;Ñ আমি শুধু এটুকু নিবেদন করতে পারি যে, তা কোনো কৃত্রিম বা স্থির হ্রদ নয়Ñ একটি প্রবহমান ও প্রাকৃতিক ধারা।’(প্রবেশক, প্রাগুক্ত)
তাঁর এ বক্তব্যের প্রমাণ মেলে তাঁর ‘করতলে মহাদেশ’ গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধ ‘মৃত্যুর নিপুণ শিল্প’ (রচনাকাল ১৯৭৯) পড়লে। উদ্ধৃতিটি একটু দীর্ঘ হলেও আর উল্লেখের প্রয়োজন আছে ভেবে নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারলাম না : ‘বছরখানেক আগে একজন বিখ্যাত, কিছুটা নেপথ্যবাসী, সংস্কৃতিসেবী ও রবীন্দ্রপ্রেমিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন এ দেশে ঠিক রবীন্দ্রচর্চা হলো না। তাকে আমার মতামত জানাতে গিয়ে বলেছিলাম : এর প্রধান কারণ, রবীন্দ্র গ্রন্থাবলী ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত তথ্যাবলীর অভাব। এটাই আমি প্রথম কারণ বলে ব্যাখ্যা করেছিলাম। দ্বিতীয়ত আমি বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথকে আমরা আমাদের সাহিত্যের কেন্দ্রভূমি দান করিনি, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যিক কারণে যত তাঁর চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণেই আমরা শ্রদ্ধা বা অশ্রদ্ধা করেছি। এর ফল ফলেছে এইÑরবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে, কবি ও লেখক রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অন্তর্দর্শী আলোচনার পরিবর্তে আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের বাইরের বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং দুঃখের বিষয়, রবীন্দ্রপ্রেমিক এবং রবীন্দ্রঅপ্রেমিক দুই মিলেই মূল রবীন্দ্রনাথকে প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছেন আমাদের।… অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ উত্তরাধিকারীদের জন্য অনেক কিছু দিয়ে গেলেও তাঁর অনেক গুণ তাঁরই নিজস্ব। বাঙালি তাঁর সঙ্গে নিজেকে অন্বিত করতে পারেনি।’ এমন মন্তব্য ও মতামত আজ হয়তো কোনোভাবেই টিকবে না, কেননা বাংলাদেশে যে বিপুল রবীন্দ্রচর্চা হয়েছে এবং হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমরা অন্বিত নই তা প্রমাণ করে না [এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্য কোথাও করা যেতে পারে]।
কিন্তু মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে মান্নান সৈয়দ নিজেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিস্তর খুঁটিনাটি তুলে ধরে রচনা করেছেন দীর্ঘ প্রবন্ধ। সমসাময়িক ও উত্তররৈবিক তিরিশি কবিদের সঙ্গে খুঁজে ফিরেছেন রবীন্দ্রনাথের মিল-অমিলের খতিয়ান। রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশে যেভাবে চর্চা করা হয়, নাটক-সংগীত-কবিতা ইত্যাদি নানা মাধ্যমে, তা আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক কোনো অবহেলারই ইঙ্গিত দেয় না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ পাঠ্যভুক্ত, তাকে নিয়ে নানা গবেষণা হচ্ছে, লিখিত হচ্ছে অভিসন্দর্ভ, সারাবছরই পত্র-পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ আছেন। মান্নান সৈয়দ তিরিশ বছর আগে যা বলেছিলেন, সাত বছর পর তা থেকে সরে এসেছেন কিছুটা, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি মেতে উঠলে নতুন কিছু আমরা অবশ্যই পেতাম। অথচ বিচিত্র খেয়ালী মানুষ মান্নান সৈয়দের ক্ষেত্রে সেটা আর হয়নি [রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মাত্র কটি লেখাই তিনি লিখেছিলেন]। ‘শুদ্ধতম কবি’ (১৯৭২) লিখে তিনি যেভাবে নিমগ্ন হয়েছিলেন জীবনানন্দে, সেখান থেকে ফিরে আসা তাঁর জন্য আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তিরিশের কবি এবং কবিতা নিয়ে বিস্তর গবেষণা কাজ করেছেন। ফরমায়েশি কাজ করেছেন নজরুল-ফররুখকে নিয়ে, বাংলা একাডেমীর অনুরোধে ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ (১৯৮৯) তাঁর একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ বলে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। তিনি নিজেই বলেছেন ‘দীর্ঘ, সযতœ, নিরন্তর মনোযোগে যাঁদের বিষয়ে উৎসাহিত থেকেছি, মোটামুটি ধারাক্রম অনুযায়ী তাঁরা হলেন : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নজরুল ইসলাম, ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা, জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ফররুখ আহমদ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শাহাদাৎ হোসেন প্রমুখ। এঁদের কারো-কারো বিষয়ে গ্রন্থ রচনা বা সম্পাদনা করেছি। কোনো লেখাই, আমার বিবেচনায়, এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়নি। (আমার গদ্য, আমার বিশ্বাস, রূপম প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৪)। চল্লিশ বছরের একজন তরুণ লেখকের এই যে বিচিত্র, বহুরৈখিক, বহুমাত্রিক, বহুদেশিক, বহুভাষিক কবি-লেখকের প্রতি সীমাহীন আগ্রহ এবং তাঁদের নিয়ে দিবারাত্রি পরিশ্রম, তা যে কোনো লেখকের জন্যই শ্লাঘার বিষয়।
আবদুল মান্নান সৈয়দের শুরুটা কবিতা দিয়ে হলেও তিনি আসলে একসময় নিবিষ্ট হয়ে পড়েন গদ্যে, বিশেষত গবেষণা কাজে। আমার ধারণা, সাধারণ গদ্য লিখতে তিনি স্বস্তিবোধ করতেন না, তথ্য-তত্ত্ব, সূত্রের ছড়াছড়ি, নির্ঘণ্ট আর নানান সন-তারিখের উদ্ধৃতিতে তাঁর গদ্য হয়ে উঠেছিল পরিশীলিত ও নির্মেদ মূল্যবান গবেষণা। (আজ ভাবতে অবাক লাগে, যে মানুষটি এত গবেষণা-কাজ করলেন, এত কবি-লেখককে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ আর তুলনামূলক আলোচনা করে বাংলাদেশের সাহিত্যকে উজ্জীবিত করলেন, তিনি কেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে শুরু করা তার অভিসন্দর্ভটি সমাপ্ত করলেন না? কেন তিনি পিএইচডি ডিগ্রিটি নামের আগে জুড়ে রাখার বাসনা লালন করলেন না? জানি না, এ প্রশ্নের জবাব তার কোনো অন্তরঙ্গ সুহৃদ জেনে থাকলে তা কখনো প্রকাশ করবেন কিনা। আমি জিজ্ঞেস করলে হেসে হেসে বলতেন, হবে হবে। কিন্তু কবে? বেড়ে যেত তাঁর অট্টহাসি, ছাদফাটানো হাসি। এমন প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারেন ক’জন?)
কিন্তু আমি ভাবি, যে মানুষটি তরুণ বয়সেই ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’-এর মতো কাব্যগ্রন্থ এবং ‘সত্যের মতো বদমাশ’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৮, এ পর্যন্ত ‘সত্যের মতো বদমাশ’-এর চারটি সংস্করণ বেরিয়েছে, যথাক্রমে ১৯৭৩, ১৯৮০ এবং ২০১০ সালে)-এর মতো গল্পগ্রন্থ লিখে তাঁর সমকাল এবং আসন্নকালকে আলোড়িত বিমোহিত-চমকিত করেছিলেন, তিনি কেন কঠিন গদ্য আর নিবিড় গবেষণায় মগ্ন হয়ে গেলেন? পাকিস্তান সরকার ‘সত্যের মতো বদমাশ’কে অশ্লীলতার (!) দায়ে বাজেয়াপ্ত করেছিল, একজন লেখকের শক্ত মাটির ওপর দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য এর চেয়ে কি বেশি কিছুর প্রয়োজন ছিল? কেননা তরুণটি তো তখন সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছে, সামনে যোজন যোজন পথ এবং চিন্তা-চেতনায় নতুনত্বে ভরপুরÑএ তারুণ্যের সামনে তো দরোজা বন্ধ থাকার কথা নয়। বই বাজেয়াপ্তির কথা উঠলে আরো দুটো বইয়ের নাম মনে চলে আসে, একটি ব্রিটিশ কবি ও কথাসাহিত্যিক ডি.এইচ. লরেন্স (১৮৮৫-১৯৩০)-এর ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ (১৯২৮) উপন্যাস, অন্যটি উত্তররৈবিক খ্যাতিমান কবি, কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-৭৪) উপন্যাস ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ (১৯৬৭)। এই বই দুটোও নিষিদ্ধ হয়েছিল অশ্লীলতার (!) দায়ে। বুদ্ধদেব বসুকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল এবং শেষ অবধি আদালতের রায়ে সে দায় থেকে মুক্তিও পেয়েছিলেন তিনি। আর ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ ১৯২৭ সালে ইতালির ফোরেন্সে প্রথম প্রকাশিত হলেও ইংল্যান্ডে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল ১৯৬০ সালে। এই তিন বিখ্যাতকে উদ্ধৃত করার কারণটা এই যে, ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ ডি.এইচ. লরেন্স লিখেছিলেন ৪২ বছর বয়সে এবং এর ৩ বছর পরই তিনি মারা যান। বুদ্ধদেব বসু ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ লিখেছিলেন ৫৯ বয়সে, যখন তিনি আপন ঔজ্জ্বল্যে দীপম্যান। আর আবদুল মান্নান সৈয়দ যখন ‘সত্যের মতো বদমাশ’ প্রকাশ করেছিলেন (যদিও গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলো তাঁর আরো কম বয়সের লেখা, ‘সত্যাসত্য’ গল্পটি লিখেছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে) তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৫। এই অতিতরুণ লেখকটির সামনে তখন তো হারাবার কিছু নেই, সময় সামনে এগিয়ে যাবার, আরো গল্প আরো উপন্যাস লিখে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যাওয়া কোনো পরিশ্রমই নয় তাঁর কাছে।
কিন্তু যেভাবে বেড়ে ওঠার কথা, যেভাবে কুঁড়ি থেকে পাপড়ি মেলে ফুল হওয়ার কথা, ফুল তিনি হলেন বটে, তবে বন্দি হলেন না সাহিত্যের কোনো নির্দিষ্ট আচ্ছাদিত বারান্দায়। সুষমা আর সুঘ্রাণে মৌ মৌ হলো চারদিক, যে অর্থে সব্যসাচী বলা হয়,তার সবটুকুই তাঁর বিশাল ক্যানভাসে তিনি আঁকতে শুরু করলেন সাহিত্যের নানান চিত্র।’ জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’ (১৯৬৯), ‘মাতাল মানচিত্র’ (১৯৭০), ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ (১৯৭৪), ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’ (১৯৮২), ‘পরাবাস্তব কবিতা’ (১৯৮২), ‘পার্ক স্ট্রিটে এক রাত্রি’ (১৯৮৩), ‘মাছ সিরিজ’ (১৯৮৪), ‘আমার সনেট’ (১৯৯০), ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ (১৯৯৩), ‘নীরবতা গভীরতা দুই বোন বলে কথা’সহ (১৯৯৭) আরো নানা কাব্যগ্রন্থের ভেতর দিয়ে মান্নান সৈয়দ তাঁর কাব্যধারা এবং কবিতাচিন্তার যে প্রবহমান জলধারার সৃষ্টি করেছিলেন, অচেনা পরাবাস্তববাদী হয়ে যাঁর যাত্রা শুরু সেই তিনি এসে ‘স্থিত হয়েছেন প্রাজ্ঞ, নির্মোহ, অধ্যাত্মচেতন ও স্রষ্টার সমর্পিত সত্তায়’। শুরুতে কবিতা নিয়ে যেমন মেতে উঠেছিলেন, গ্রন্থপ্রকাশকালগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি এসে থেমে আবার শুরু করেছেন আশির শুরুতে। তারপর ১৯৯০, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৭ ইত্যাদি সময়গুলোই নির্দেশ করে যে, কবিতা নিয়ে খুব বেশি সময় তিনি দেননি, গল্প উপন্যাসেও নয়। বরঞ্চ বেড়েছে গবেষণার কাজ। কেন এই স্থানান্তর তাঁর? কেন সৃজনশীলতার (পৎবধঃরারঃু) এত উপাদান তাঁর ভেতরে থাকার পরও তিনি আস্তে আস্তে ঝুঁকে পড়লেন মননশীলতার (ঃযড়ঁমযঃভঁষহবংং ধহফ রহঃবষষবপঃঁধষরঃু) দিকে? প্রজ্ঞা ও মেধার প্রকাশ কি কবিতায় হয় না? মান্নান সৈয়দ সৃষ্টিশীল কবির পুরোধা হতে পারতেন। তাঁর কবিতা নিয়ে তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক কবিগণ, তার সমবয়সী কবিগোষ্ঠী কিংবা উত্তরসূরি তরুণ কবিরা মধ্যষাটে যেমন উচ্ছ্বসিত, চমকিত এবং রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিলেন, সেই সম্ভাবনার ধারাটি কি বহমান রাখা যেত না? কেন তিনি সৃজনশীলতাকে পরম অবহেলায় ঠেলে দিয়ে মননশীলতায় মগ্ন হলেন? তিনি কি ‘কবি’ হতে চাননি? নাকি মননশীলতার পথে এগুতে এগুতে শেষ পর্যন্ত অনুভব করলেন, তার প্রতিন্যাস ছিল ভুল। আর এই ভুলকে আড়াল করবার জন্য কি তিনি তাঁর এইসব ছুটে বেড়ানো কাজকে ‘জীবনানুসন্ধানের ব্যাপার’ বলে উল্লেখ করেছিলেন তাঁর জীবনকালে মুদ্রিত সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে? (শিলালিপি, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১০)। তবে, আমার কেন জানি মনে হয়, মান্নান সৈয়দ হতে চেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত, মননশীল লেখক ঃযড়ঁমযঃভঁষ রহঃবষষবপঃঁধষ হবার একটা গভীর আগ্রহ তাঁর ভেতরে ক্রিয়াশীল ছিল সবসময়। দায়িত্বপালনের জন্য এটাও একটা কর্মক্ষেত্র। কাউকে না কাউকে তা করতেই হয়, মান্নান সৈয়দ করেছেন। কবিতাকে আশ্রয়স্থল হিসাবে নিতে হয়তো তাঁর শঙ্কা ছিল। কেননা কবিতা আশ্রয়চ্যুত করতে পারে যে কোনো সময়, করতে পারে স্থানচ্যুতও। কিন্তু ধ্রুপদী-মননশীল লেখককে কেউ সহসা ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে না। তাঁর অবস্থান আস্থার সঙ্গে অনড়ই থাকে। মান্নান সৈয়দেরও থাকবে। জীবদ্দশায় যে অভিমান তাঁকে কখনো কখনো ম্লানমুখ করেছিল, তার উত্তরসূরিরা সে অভিমান মুছে ফেলে কালের প্রায়শ্চিত্ত করবে। [যেমনটি ঘটেছে জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রে], তাঁর কল্লোলিত জীবনচিত্র ভরে উঠবে পেলব প্রসন্নতায়।
==============================
পল্লীভ্রমণ: 'দ্বীপ মনপুরার টানে' by মৃত্যুঞ্জয় রায় তিনটি কবিতা by ওমর শামস কবিতাত্রয়ী by টোকন ঠাকুর ও কামরুজ্জামান কামু কবিতা- 'নিরাকারের মুখ' by সৈয়দ তারিক ছয়টি কবিতা' by গোলাম কিবরিয়া পিনু কবিতা- 'স্বর্ণজল্লাদ' by পিয়াস মজিদ কয়েক'টি কবিতা- by শামসেত তাবরেজী ও আলতাফ হোসেন গদ্য কবিতা- 'ব্রহ্মাণ্ডের ইসকুল' by শামীম রেজা কবিতা- 'সেরগেই এসেনিন বলছে' by আবদুল মান্নান সৈয়দ কবিতা-মোহাম্মদ রফিক এর কপিলা থেকে ও অঙ্গীকার প্রবন্ধ- 'রবীন্দ্রজন্মের দেড়শ বছর “একজন তৃতীয় সারি প্রবন্ধ- 'নজরুলের কবিতা: ভাবনা-বেদনা' by আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রবন্ধ- 'কবিতা, মানবজাতির মাতৃভাষা' by মাসুদ খান আহমদ ছফার অগ্রন্থিত রচনা কর্ণফুলীর ধারে গল্প- 'পান্নালালের বাস্তু' by সিউতি সবুর গল্পিকা- 'সেল প্রেম' by আবদুশ শাকুর উপন্যাস- 'রৌরব' by লীসা গাজী »»» (পর্ব-এক) # (পর্ব-দুই) # (পর্ব-তিন) # (পর্ব-চার শেষ)
সাপ্তাহিক ২০০০ এর সৌজন্যে
লেখকঃ শাহাবুদ্দীন নাগরী
এই লেখা'টি পড়া হয়েছে...
No comments