শিকলে বাঁধা মেহেরুলের জীবন

প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তার পাশে টিনের ছাউনি দিয়ে এক চিলতে জীর্ণ একটি ছাপড়া ঘর। যার এক পাশে টিনের বেড়া দেয়া থাকলেও তিনদিকে নেই কোনো আবরণ। সেই ঘরের খুঁটির সঙ্গে দুই হাত আর পায়ে শিকলে বাঁধা অবস্থায় লেপ কাঁথার স্তূপের উপর বসে আছে মানসিক ভারসাম্যহীন মেহেরুল (৩৬)। খাওয়া-দাওয়া সব সেখানেই। বছরকালের অধিক সময় ধরে এভাবেই চলছে তার জীবন। শত কষ্ট আর যন্ত্রণায় মুক্তির জন্য চিৎকার করলেও মুক্তি মিলে না তার। এ নিয়ে চারপাশের কারও মনে নেই কোনো অনুভূতি। আর এভাবেই দীর্ঘ বছর ধরে চলছে তার শিকলে বাঁধা অসহায় জীবন। মেহেরুল উপজেলার ধরঞ্জী ইউনিয়নের ধরঞ্জী (মাস্টারপাড়া) গ্রামের হতদরিদ্র আব্দুল আলিমের ৭ ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় সন্তান। সরজমিন জানা যায়, জন্মের পর দরিদ্র পিতার সংসারে ভালোই চলছিল তার জীবন। মেহেরুলের কৈশোর জীবনের শেষ সময়ে তার মা মেরিনা বেগম মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। অনেক চিকিৎসা করার পর সুস্থ না হওয়াতে সংসার ও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়ে করেন মেহেরুলের বাবা আব্দুল আলিম। মেরিনা বেগমের ঠাঁই হয় তার বাবার বাড়ি। এদিকে, প্রথম পক্ষের সন্তানদের আপন সন্তানের মতো আগলে সংসারের হাল ধরেন দ্বিতীয় স্ত্রী শাহেরা বেগম। এমন অবস্থায় মেহেরুলও তার মা মেরিনা বেগমের মতোই হঠাৎ করে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। দিনমজুর বাবা সাধ্যমতো চিকিৎসা করেও কোনো ফল হয়নি। একপর্যায়ে মেহেরুলের পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা। ফলে  শিকলে বাঁধা পড়ে তার জীবন। এরপরও দরিদ্র পিতা সহায় সম্বল বন্ধক রেখে ও ধার-দেনা করে বিভিন্ন জায়গায় তার চিকিৎসা করান। চিকিৎসার পরে একটু সুস্থ হয়ে উঠলেও কিছুদিন পর আবারো অসুস্থ হয়ে পড়ে। মেহেরুলের চিকিৎসা করাতে নিঃস্ব হয়ে পড়েন  আব্দুল আলিম। একসময় কিছুটা সুস্থ হলে মেহেরুলকে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের পর বেশ ভালোই ছিল মেহেরুল। এ সময় তার একটা পুত্র সন্তানও হয়। সন্তান বায়োজিদের বয়স যখন আট বছর তখন আবারো তার মাঝে দেখা দেয় মানসিক সমস্যা। ফলে নেমে আসে মেহেরুলের সংসারে অশান্তি। এবার আট বছর বয়সী শিশু সন্তান বায়েজিদকে রেখে সংসার ছেড়ে চলে যায় তার স্ত্রী। আবারো দরিদ্র পিতা আব্দুল আলিম ও তার সৎমার সংসারে চাপে মানসিক ভারসাম্যহীন মেহেরুল ও তার পুত্রের ভার। কিন্তু আর্থিক দৈন্যতার কারণে তার তেমন চিকিৎসা করতে পারেন না আর। এ সময় দিন দিন মেহেরুলের আচরণ হয়ে পড়ে মারমুখী। প্রতিবেশীরা হয় অতিষ্ঠ। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে গত প্রায় এক বছরের অধিক কাল ধরে তাকে শিকলে বেঁধে রেখেছে তার পরিবার। মেহেরুলের বাবা বলেন, চোখের সামনে আদরের সন্তানের এমন অবস্থা দেখে কোন পিতা সহ্য করতে পারে? ডাক্তার বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা করালে সুস্থ হতে পারে। এজন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। আমি তো তার চিকিৎসা ও অন্যান্য ছেলে-মেয়ের পেছনে খরচ করে এখন নিঃস্ব। কোথা থেকে আর চিকিৎসা করাবো। তাই শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি।

মেহেরুলের সৎমা শাহেরা বেগম বলেন, মেহেরুল সৎ ছেলে হলেও নিজের সন্তানের মতোই মানুষ করেছি। কখনো সৎ ছেলে ভাবিনি। শিকলে বাঁধা সন্তানকে দেখে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু উপায় নেই। প্রতিদিনই প্রস্রাব-পায়খানা যুক্ত কাপড় পরিষ্কার করতে কষ্ট হলেও যখন ছেলেকে গরু ছাগলের মতো খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখি তখন বুকটা ছিঁড়ে যায়। টাকার অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। উপযুক্ত চিকিৎসা করালে মেহেরুল সুস্থ হতে পারতো। এজন্য সমাজের বিত্তবানরা কেউ সাহায্য করলে আমাদের ছেলেকে সুস্থ করতে পারতাম। তার প্রতিবেশী অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্য নুর ইসলাম বলেন, তার চিকিৎসা করতে করতে পরিবারটি এখন নিঃস্ব। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে তারা ছেলেকে শিকলে বেঁধে রেখেছেন। তার সুচিকিৎসার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সহায়তা কামনা করেন তিনি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.