উপন্যাস- 'রৌরব' (পর্ব-এক) by লীসা গাজী

(পর্ব-এক)

আর হবে না মানব জনম
কুটলে মাথা পাষাণে 

 ১.
রাস্তায় আবোল তাবোল ঘুরতে লাভলীর খুব ভালো লাগে। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়াটা পুল সিরাত পার হওয়ার মতো কঠিন এবং জটিল। আজ অবশ্য ঘটনা অন্য রকম, আজ সে সম্পূর্ণ একা বের হয়েছে। কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হলো তা একমাত্র খোদা’তায়ালাই বলতে পারেন। তাই বলে একেবারেই যে বাইরে যাওয়া হয় না, তা না। তবে যখন যায় মায়ের সাথেই যায়, দু’একবার অবশ্য বিউটির সাথেও গেছে। সেও যাকে বলে মনে রাখবার মতো ঘটনা। কিন্তু আজ শেলওয়ার কামিজের কাপড় কেনার উদ্দেশ্যে ও একাই বেরিয়েছে। অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্যি। অবশ্য ফরিদা খানম, লাভলীর মা, যথারীতি বিউটিকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য অনেক পীড়াপিড়ি করেছেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, বিউটি শেষমেশ যাচ্ছে না দেখেও ওর যাওয়া বন্ধ করেন নাই। তার মতির এই হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ কী কে বলতে পারে। বরং গাউছিয়া যাওয়ার প্রস্তাব তার মুখ থেকেই এসেছিলো।

– গাউছিয়া গেলে চল। দেখ বিউটি যাবে কী না? মহারানী তো মটকা মাইরা পইড়া আছে।

লাভলী বৃথাই কিছুক্ষণ বিউটির দরজা ধাক্কা দিলো। ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এটাই হচ্ছে অসুবিধা, একবার যদি ঘুম দেন মহারানী সেই ঘুম ভাঙতে খবর আছে। সবে তো বাজে নয়টা, দশটা সাড়ে দশটার আগে বিউটির ঘুম ভাঙে না। ঘুম ভাঙার পরেও নানান কায়দা। দাঁত মাজা, মুখ ধোওয়া এগুলো তো আছেই এছাড়া আর যা আছে তাতেই তার ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। মাথার ঠিক মাঝখানে সিঁথি করে ডান পাশের চুল আর বাঁ পাশের চুল গুনে গুনে একশো’বার আঁচড়াবে, তারপর চুল ছেড়ে রাখবে বা টানটান করে একটা লম্বা বেণী করবে। বিউটির জন্য সব সময় ডাল বাটা ফ্রিজে তৈরী থাকে, সেই ডাল বাটা মুখে দিয়ে কম পক্ষে আধ ঘণ্টা বসে থাকবে। ডাল বাটা মুখে শুকিয়ে ঝুরঝুর করলে একটা ছোট তোয়ালে গরম পানিতে ডুবিয়ে ভালো করে চিপে নিয়ে সেটা দিয়ে আস্তে আস্তে মুখ পরিষ্কার করবে। সুতরাং বারোটার আগে যে তাকে তৈরি করানো যাবে না এটা মোটামুটি নিশ্চিত। তাও লাভলী ফরিদা খানমের কথামতো বিউটিকে ঘুম থেকে তোলবার চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলো না।

– আম্মা বিউটি ঘুমাইতেছে। ডাকলাম শুনে না।

– ডাইকা লাভ নাই, হাটকালের বংশ। নামায নাই কালাম নাই শুধু ঘুম। ঘুম থিকা উঠলেও লাভ নাই, আয়না নিয়া বসবেন। যা, তুই তৈরি হ… যাওয়ার আগে দ্যাখ, যায় কী না…।

লাভলীর অতো বায়নাক্কা নাই। বিউটির মতো ও চুলে সিঁথি কাটতেও বসলো না, মুখে ডালও ঘষলো না। কোনো রকমে চুলটা আলুথালু বাঁধলো। সব সময় যা করে তাই করলো — দু’টা লম্বা বেণী। চুল বাঁধতে গিয়ে টের পেলো আগা ফেটে চৌচির। চুল পিঠ ছাড়িয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু নিচের দিকে ইঁদুরের লেজের মতো অবস্থা। না, বিউটিকে ব‌লতে হবে আগাটা একটু ছেটে দিতে। মুখে সাবান ঘষলো। আজকাল মুখে সাবান দিলেই মুখ টানতে থাকে। আগে এরকম হতো না — ভাবতে ভাবতে মুখে নিভিয়া ক্রিম মাখে লাভলী। শীতের সময়ই যা একটু ক্রিম লাগায় ও। গরমের সময় ওর ওসব লাগে না। ড্রয়ার খুলে যে কামিজটা প্রথমে চোখে পড়লো তাই টেনে বের করলো। লাভলী মনে মনে খুব চাইছে আজকে যেন ফরিদা খানম ওদের সাথে না যান। এই চাওয়ারও কোনো কারণ নাই। ফরিদা খানম সাথে না গেলেও যে খুব একটা উনিশ বিশ হবে তাও না। বড় জোর দুই বোনে মিলে চটপটি বা ফুচকা খাবে। ফরিদা খানম সাথে থাকলেও খাওয়া যায়, তবুও শুধু ওরা দুই বোন যখন যায় তখন অন্য রকম ফুরফুরা লাগে।

লাভলীর তৈরি হতে লাগলো বড় জোর দশ মিনিট। কিন্তু বিউটি কিছুতেই সাথে যেতে রাজি হলো না। দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে কী করছে কে জানে। লাভলীর মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। ফরিদা খানম দু’একবার চেষ্টা করলেন ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলাতে, কিন্তু পারলেন না।

‘অলক্ষীর একশেষ।’ ফরিদা খেদ ঝাড়লেন। ‘এক বান্দা সারাক্ষণ বাইরে যাওয়ার জন্য কই মাছের মতো হাঁ কইরা থাকে, আরেকটারে মাইরাও বাইর করা যায় না।’

তা যেভাবেই হোক, মোদ্দা কথা হলো রাস্তায় এখন লাভলী একাই হাঁটছে। এই অসাধ্য কীভাবে সাধিত হলো লাভলী তাই ভাবছে। পৃথিবীর আশ্চর্যতম ঘটনা হিসাবে এটা খুব সহজেই গীনিজ বুক অফ রেকর্ডসে ওঠার যোগ্যতা রাখে। অবশ্য আজ ওর জন্মদিন; আজ ওর বয়স চল্লিশ হলো। এই কারণেও আম্মা হয়তো ওকে একাই বের হতে দিলেন। দু’টা সিএনজি ওর পাশ দিয়ে ধীরে বের হয়ে গেলো। ডাকি ডাকি করেও ডাকলো না লাভলী। কিছুক্ষণ হাঁটা যাক। কেউ দেখে ফেললে অবশ্য বাসায় রিপোর্ট হয়ে যাবে। কাজের ছেলেটা পিচ্চি কিন্তু শয়তানের একশেষ। আম্মাকে সারাক্ষণই ওদের দুই বোনের নামে ভাঙানি দিচ্ছে। ‘একদিন সুযোগ মতো এমন ধাতানী দিবো যে জন্মের মতো সোজা হয়ে যাবে, শয়তানের শয়তান।’ লাভলী এইসব যখন ভাবছে তখন একটা সিএনজি ওর পাশে এসে দাঁড়ালো।

— আপা, গাউছিয়া যাইবেন উঠেন।  সাট করে পিছনে ফিরলো লাভলী। যা ভেবেছিলো তাই। পিচ্চি শয়তানটা বেশ খানিকটা দূরে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মা ঠিকই পিছনে লাগিয়ে দিয়েছেন। সেই মুহূর্তে লাভলীর মরে যেতে ইচ্ছা করলো। পিছন ঘুরে পিচ্চিকে চড় দেখিয়ে সিএনজি-তে উঠে পড়লো লাভলী। এখন বাজে দশটা, দুপুরের খাবারের আগে ফিরতে হবে। লাভলী বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করে। এই প্রথম আম্মা তাকে কোনো নির্দিষ্ট সময় বলেন নাই। শুধু বলেছেন, দুপুরের খাবারের আগে ফিরতে। তার মানে ২টা পর্যন্ত সময় এখন শুধুই তার। মনে মনে দোয়া করছে জামে যাতে না পড়ে। সিএনজিটাও চলছে বেশ জোরে, মানে যতোটুকু তার সাধ্যে কুলায়।

কী আশ্চর্য, দশটা পঁয়তাল্লিশের মধ্যে লাভলী গাওছিয়ায় পৌঁছে গেলো।

সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। এখন কী করবে, কোন দিকে যাবে বুঝে কুলাতে পারলো না। চাঁদনী চকের ভিতর ঢুকতে পারে আবার গাওছিয়ার দিকেও হাঁটা দিতে পারে। হঠাৎ করেই কেমন নিঃসঙ্গ লাগলো লাভলীর। এই সুযোগে মাথার ভিতরের লোকটা কথা বলে উঠলো। কেমন ভাঙা ভাঙা মিনতিমাখা গলা। আপুমনি, আপনি এমন কেন বলেন তো? চলেন না, ঝটপট যেকোনো একটা কাপড় কিনে বুড়িগঙ্গায় হাওয়া খেয়ে আসি। শুধু আমি আর আপনে।

না, এই মুহূর্তে লোকটাকে পাত্তা দিতে রাজি না লাভলী। আজকে শখ মিটিয়ে শপিং করবে সে। তারপর পছন্দমতো একটা কোথাও দাঁড়িয়ে লাচ্ছি চটপটি খাবে, বা খাবে না।

ধীরে এক পা দু’পা করে চাঁদনী চকের দিকে পা বাড়ালো। মোটে পোণে এগারোটা বলে কঠিন মেয়েমানুষ থ্যাঁতলানো ভিড় এখনও শুরু হয় নাই। চিন্তার কিছু নাই, আর ঘণ্টাখানেক পরেই শুরু হয়ে যাবে। তবে এখনও যা আছে সেও কম না। আজ ও সম্পূর্ণ একা কোথাও এলো। শেষবার একা কবে গিয়েছিলো মনে পড়লো না লাভলীর। সত্যিই কি কখনও কোথাও গিয়েছিলো একা? হাল ছেড়ে দেয় লাভলী। নিজের বোকামিতে বিরক্ত হয়। জীবনের সবচাইতে কাঙ্ক্ষিত সময় এভাবে ফালতু চিন্তা করে কাটিয়ে দিবে নাকি! ধ্যাৎ।

যেকোনো একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকে পড়ে। মুশকিল হচ্ছে সব কাপড়ই ওর পছন্দ হচ্ছে। অবশ্য যে কাপড়ই বানাক না কেন ওকে মানাবে না। ওর মধ্যে কেমন একটা খালাম্মা খালাম্মা ভাব চলে এসেছে। কী মনে করে যে ও দু’টা বেণী করে চাঁদনী চকে এসে হাজির হলো কে জানে। দেখতে নিশ্চয় সঙ-এর মতো লাগছে। অনেকেই তার পাশ দিয়ে হুটহাট চলে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু একটু দূরে গিয়েই আবার মাথা ঘুরিয়ে ওকে আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছে। দু’টা অপরিপাটি লম্বা বেণী, কামিজের ঝুল হাঁটু ছাড়িয়ে আরও এক বিঘৎ নেমে গেছে, ভ্রুজোড়া যেমন কে তেমন, চোখে বিহ্বল হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টি, মুখের লাবণ্যটুকু বিদায় হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এমন জিনিস ঢাকা শহরের বাজারে সচরাচর দেখা যায় না। একটা কাপড় নিয়ে কতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দোকানদারও পাত্তা দিচ্ছে না। হঠাৎ করে চোখ ভিজে উঠলো লাভলীর।

– এই যে ভাই কাপড়টার গজ কতো? ভাই… একটু শুনেন ভাই…।

– বলেন, কোনটার গজ কমু? আপনের দুই হাতে দুইটা কাপড়।

– লালটার।

– ১২০ টেকা।

– আচ্ছা আড়াই গজ দেন আর এইটার সাথে মিলায়ে শেলওয়ার আর ওড়না দেন।

– শেলওয়ারের কাপড় দিতে পারমু কিন্তু ওড়না আপনেরে অন্য দুকান থিকা কিনতে হবে। সেট ছাড়া আমরা ওড়না বেচি না। শেলওয়ারের কাপড় কতো গজ?

– আড়াই।

দোকানদার তার কাপড় কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চাঁদনী চকে কাপড় কিনছে কিন্তু দামাদামিতে নাই এ আবার কেমন ধরনের কাস্টমার। কাপড় কাটতে কাটতেই বেশ ভালো করে মেপে নিলো সে। দেইখা তো লাগে বেকুব কিসিমের।

– ধরেন, গজ প্রতি ১১০ টাকা দিয়েন, দেমাদেমি করলেন না সেই কারণে কমায় দিলাম।

টাকা দিয়ে বেরিয়ে এলো লাভলী। লাল রঙটা ওর পছন্দের রঙ না, তাও কেন যে কিনলো। অবশ্য বিউটির ভীষণ পছন্দ লাল। সব চড়া রঙই তার পছন্দ যদিও। এপাশ-ওপাশের দুই একটা দোকানে ঢুকেই আবার বেরিয়ে এলো লাভলী। ওড়না কিনতে আর ইচ্ছা করছে না ওর। পরে একদিন আম্মাকে নিয়ে আসা যাবে। আম্মা বরং খুশিই হবেন। ফরিদা খানম সারাক্ষণই প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকেন যে ওরা দুই বোন তাকে ছাড়া অচল। কতোটা যে অচল সেটা ওড়না কিনতে না পারার মধ্যে আরও প্রমাণিত হবে। তবে ধরেই নেয়া যায় তার কাপড়টা পছন্দ হবে না। ফরিদার অনুপস্থিতিতে ওরা দুই বোন যাই করুক না কেন সেটা ঠিকঠাক মতো হয়েছে এটা কখনোই তাকে বিশ্বাস করানো যায় না।

ধা করে লাভলী প্রায় ২৬ বছর পিছনে চলে গেলো। মাথার ভিতরের লোকটা পড়িমরি করে বলে উঠলো, এতো তাড়াতাড়ি যাবেন না আপুমনি, প্লিজ, আমার ভীষণ মাথা ঘোরে।

যদিও লাভলী বিউটির চেয়ে প্রায় তিন বছরের বড় তবুও ওরা একই ক্লাসে পড়ত। তখন লাভলীর বয়স ১৪। দুই মেয়েকে ফরিদা বেগম স্বামী মুখলেস সাহেবের জিম্মায় রেখে বাইরে বেরিয়েছেন। প্রথমে যাবেন খিলগাঁ চৌধুরী পাড়া, বড়বোন রাহেলার বাসায়। রাহেলার মেঝো মেয়ে রুমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মেয়ে দু’টাকে বাসায় রেখে যাচ্ছেন বলে বোনের বাসায় বেশিক্ষণ বসার ইচ্ছা নাই ফরিদার। তবে ফেরার পথে টুকটাক কাঁচা বাজার না করলেই না। ঘরে সব্জি বলতে কিছুই নাই। দু’টা বেগুন দেখে এসেছেন শুধু। মুখলেস সাহেবের শরীরটা খারাপ হওয়ায় ২/৩ দিন যাবত বাজারে যাওয়া হয় নাই। ফেরার পথে সব্জি অন্তত কিনতেই হবে আর আটা। সকাল বেলা টেনেটুনে দশ-বারোটা রুটি হয়েছে। তবুও স্কুটারে যাওয়ার পুরো পথটা কপাল কুঁচকে রাখলেন ফরিদা। ভিতরটা খচখচ করছে। না, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফেরা দরকার।

মুখলেস সাহেব জ্বরে কাতর; দুই বোনকে কোনো রকম শব্দ করতে কঠিন নিষেধ করে গেলেন ফরিদা। কান পর্যন্ত কাঁথা মুড়ি দিয়ে মুখলেস সাহেব শুয়ে ছিলেন। মাথার যন্ত্রণায় দিশাহারা অবস্থা। বাসায় ওরা ছাড়া বুয়া আর একটা ছোট কাজের মেয়ে। মেয়েটার নাম সুলতানা। সুলতানাও ওদের দু’বোনের প্রায় সমবয়সী। ফরিদা খানম বাসায় থাকলে সুলতানার সাধ্যি নাই দুই বোনের ধারে কাছে ঘেঁষে। এই ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কড়া। চাকর বাকর থাকবে চাকর বাকরের মতো। ওদের সাথে আবার আলগা খাতির কীসের!

বাবাকে কচি মুরগির স্যুপ দিয়ে এসে লাভলী বিউটির সাথে সাপ লুডু খেলতে বসলো। এই খেলায় ও বিউটির কাছে অবধারিতভাবে হারে। এমনি লুডুতে যাও বা জেতার ইতিহাস আছে কিন্তু সাপলুডু খেলতে বসলেই সাপের কামড়ে লাভলীর দফারফা। বিউটি অবশ্য সব সময় খেলার জন্য মুখিয়ে থাকে। সাপলুডুর বোর্ড দেখেই খুশিতে বিউটির চোখ দু’টা গোল গোল হয়ে গেলো।

– আফা ছাদে যাইবেন?

– চুপ কর। সাপলুডু খেলবি? — আয় বস।

– না, খেলুম না, কিন্তুক ছাদে যামু।

– ছাদে যাবি মানে, কীভাবে যাবি? ছাদ তো তালা দেওয়া।

– না, ছাদ খোলা আছে। রাষ্ট্রীয় গোপন খবর ফাঁস করবার ভঙ্গিতে সুলতানা বললো।

– বুয়া আম্মাকে বলে দিবে।

– বুয়ায় ঘুম পাড়ে। এতো সকালে উঠবো না।

– বিউটি খবরদার যাবি না। আম্মার মানা আছে না।

– আম্মা তো আর দেখতেছে না। আমি যাব, তুমি না যেতে চাইলে যাইও না।

– গেলে ওখনই আসেন। একটুক্ষণ ঘুইরাই চইলা আসুম। কাক-পক্ষীও টের পাইবো না।

সুলতানার গম্ভীর মুখ দেখে লাভলী সাহস পেলো।

– দাঁড়া, আব্বাকে একটু দেখে আসি।

– আব্বাকে দেখার কী আছে, আব্বা হইলো দুধভাত।

বিউটিক পাত্তা না দিয়ে লাভলী পা টিপে টিপে মুখলেস সাহেবের ঘরে উঁকি দিলো। তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, হালকা নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারপর ওরা তিনজন রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো বুয়া পাটি পেতে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। লাভলীর বুকের ভিতরটা হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে। তিনজন হাত ধরাধরি করে পায়ে পায়ে সামনের দরজার সামনে গেলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দরজা খুললো বিউটি। তেলহীন মর্চে পড়া দরজা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে গেলো। দুপুরের নিস্তব্ধতায় এইটুকু শব্দই ঠাটা পড়া গাছের মতো তিনজনকে স্থবির করে দিলো। প্রথম স্বাভাবিক হয়ে উঠলো বিউটি।

– দরজার সামনে দাঁড়ায় থাকবো নাকি? আসো…।

ঢাকনা দেয়া ফুটন্ত পানির মতো সারা শরীরে হাসির দমক নিয়ে ওরা ছাদে উঠে গেলো, শব্দহীন। ভিড়ানো দরজা খুলে ছাদে পা দিয়েই তুমুল হাসিতে ফেটে পড়লো তিনজন। কার্নিশে বসে থাকা কাক উড়ে গেলো। ছাদে পা দেয়ার মুহূর্তটা কখনও ভুলবে না লাভলী — কী উত্তেজনা, কী উত্তেজনা, কী উত্তেজনা।

ওরা কতোক্ষণ ছাদে ছিলো এখন আর তা মনে পড়ে না লাভলীর। শুধু দুঃস্বপ্নের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা আম্মার মুখটা মনে পড়ে ওর। দুই বোনকে কিছুই বললেন না ফরিদা খানম। শুধু পত্রপাঠ বিদায় হয়ে গেলো সুলতানা আর বুয়া। স্বামীর সাথেও তিনি কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। যেন তিনি জানতেন তার অনুপস্থিতিতে এরকমই হবার কথা। শেষ পর্যন্ত বোনের বাসায় না যাওয়ার সীদ্ধান্তটা কতো বেশি জরুরী ছিলো তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন তিনি।

শুরু হলো দুই বোনের কবরের আজাব। বাসা আবার বদল হলো। এবার অবশ্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ফরিদা খানম পল্লবীতে তার বাবার দেয়া পৈতৃক জমি বিক্রি করে মনিপুরি পাড়ার ভিতর দিকে ছোট একটা দোতলা বাড়ি বানালেন। এই বাড়ি বানাবার সমস্ত দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। বাড়ি পুরোপুরি তৈরি হওয়ার আগেই সেই বাড়িতে উঠে গেলেন। এরপর থেকে ফরিদা খানম আর কখনই কোনো অল্প বয়সী কাজের মেয়ে রাখেন নাই। তার পরিবর্তে ৮ থেকে দশ বছর বয়সী কাজের ছেলে রাখা শুরু হলো। আট বছর বয়সে চাকরি শুরু আর তেরো-য় পা দিলেই বিদায়।

খয়েরি কাগজের মোড়ক থেকে লাল কাপড়টা একটু বের করে দেখে নিলো লাভলী। না, কাপড়টা বেশ সুন্দর, এটা পছন্দ না হওয়ার কোনো কারণ নাই। অবশ্য একটু বেশি লাল। শেলওয়ারের কাপড়টাও লাল কেনা উচিৎ হয় নাই। লালে লাল দুনিয়া হয়ে গেছে।

(– আম্মাগো লাল তেরি লাল কেয়া খুনিয়া!) মাথার ভিতরের লোকটা হঠাৎ বলে উঠলো। বলেই চুপ। কিন্তু ভীষণ চমকে গেলো লাভলী।

এই জীবনে বাসা ওরা কম বদল করে নাই। মনিপুরি পাড়ায় বাড়ি হওয়ার আগে অন্তত ছয়বার। ওরা যখন বেশ ছোট তখন থেকেই দুই বোন জানে যে স্কুল চলাকালীন সময়টা ফরিদা খানম স্কুল-গেইটের বাইরে অপেক্ষা করেন। খুব ছোট থাকতে অসুবিধা হতো না, কিন্তু ওরা যখন ক্লাস থ্রিতে উঠলো তখন স্কুলের বড় আপা আর সেটা বরদাস্ত করলেন না। একদিন ফরিদা খানমকে ডেকে পাঠালেন।

– আসসালামালাইকুম।

– ওয়ালাইকুমআসসালাম।

– আপনি তো লাভলী আর বিউটির মা।

– হ্যাঁ।

– দারোয়ানের কাছে শুনলাম আপনি নাকি রোজ স্কুল শুরু হয়ে যাবার পরেও গেইটের বাইরে দাঁড়ায় থাকেন।

– হ্যাঁ থাকি।

– কেন থাকেন?

– আমার মেয়েরা স্কুলের ভিতরে আর আমি বাসায় চলে যাব?

– পুরা সময়টা কি আর কোন মা বাইরে দাঁড়ায় থাকে?

– আপনাদের তো আমি কোনো অসুবিধা করতেছি না। গেইটের বাইরে দাঁড়ায় থাকি। আমার মেয়েরা ভিতরে, কখন কী লাগে না লাগে।

– আপনি দয়া করে নামিয়ে দিয়ে যাবেন আবার ছুটির সময় এসে তুলে নিয়ে যাবেন, বাকি সময়টা বাইরে অপেক্ষা করার দরকার নাই। যদি কিছু লাগে তার ব্যবস্থা আমরা করব।

– আমার মেয়েরা খুব মুখচোরা, কিছু লাগলেও তারা আপনারে বলবে না।

– না বললেও ক্ষতি নাই। ৩/৪ ঘণ্টা পরে তো আপনাকে বলতেই পারবে। ঠিক আছে, আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।

এরপর প্রায় এক বছর ওদের আর কোনো স্কুলে যাওয়া হয় নাই। ফরিদা স্বামীকে বুঝিয়ে বাসা বদল করলেন। সাজাহানপুর বালিকা বিদ্যালয়ের ঠিক উল্টা দিকে ওরা বাসা নিলো। ফ্ল্যাট বাড়ির তিনতালায় ওরা উঠে গেলো। শুরু হলো ফরিদার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। স্কুল চলাকালীন সময়ের পুরোটা তিনি সামনের বারান্দায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতেন। তারপর ছুটির ঘণ্টার চাপা আওয়াজ কানে আসলে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে নেমে যেতেন। তার চাইতেও ধীরে রাস্তা পার হতেন। মেয়েদু’টা স্কুল থেকে বের হয়ে ভীরু ভীরু চোখে মায়ের দিকে তাকালে উনি হেসে ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেন। মেয়েরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতো। ডেইলি একই ঘটনা। প্রতিদিন একই রুটিন। প্রকৃতির নিয়মের মতো অমোঘ!

পায়ে একটা ছোট নুড়ি পাথর ঠেকে প্রায় পড়বার উপক্রম হয়েছিলো লাভলীর। চাঁদনী চক থেকে বের হয়ে নিজের অজান্তেই সিনেমা হলের ঠিক সামনে এসে পড়েছে। বিশাল বড় হোর্ডিং-এ ততোধিক বিশাল নায়িকার উদ্ধত শরীর প্রায় বেরিয়ে আসতে চাইছে।

আশেপাশের মেয়েগুলোকে এবার একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলো লাভলী। আজকাল পথে বের হলেই মনে হয় এতোগুলি সুন্দর মেয়ে এক শহরে বাস করে! সবাই খুব রূপটান টুপটান মাখে বোধহয়। বিউটি পারলারে যাবারও খুব চল হয়েছে। আজকে একবার যাবে নাকি কিংবা সিনেমা হলেও চট করে ঢুকে পড়া যায়! অবশ্য আম্মা জানতে পারলে জানে মেরে ফেলবেন। কেমন করে জানি মহিলা আবার সবকিছু টের পেয়ে যান। ওর মতোই আরেকটা মেয়ে একটু দূরে একা দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য নিজেকে আর মেয়ে বলার সাহস নাই। হাজার হোক বয়স আজকে চল্লিশ হলো। কী অদ্ভুত! চল্লিশটা বছর চলে গেছে অথচ কিছুই হলো না, বিয়েটা পর্যন্ত না। হঠাৎ করেই মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি হলো ওর। মেয়েটা মিষ্টি করে হাসলো। সাথে সাথে পিছন ফিরে তাকালো লাভলী তারপর বুঝলো আসলে মেয়েটা ওকে দেখেই হেসেছে। ও-ও হাসিমুখ নিয়ে মেয়েটার দিকে ফিরলো, ততোক্ষণে মেয়েটা চোখ সরিয়ে নিয়েছে। লাভলী ঠিক করলো মেয়েটাকে অনুসরণ করবে। মেয়েটা যদি একা সিনেমা হলে ঢুকে যায় তাহলে ও-ও টুপ করে ঢুকে যাবে, মেয়েটার পাশে বসবে আর দু’জনে মজা করে সিনেমা দেখবে। টুকটাক গল্পও করবে। বাসায় ফিরে রসিয়ে রসিয়ে নতুন বন্ধুর গল্প বলবে বিউটিকে।

কখন যে মেয়েটার পাশে এক সরু গোঁফওয়ালা কলেজ ছোকরা এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি লাভলী। কায়দা আছে ছেলের। বাহারি একখান ফতুয়া পড়েছে, কমলা রঙের। তাতে হলুদে কী জানি সব লেখা। আজকালকার ছেলেরা গায়ে বেশ রঙ চড়াতে পারে। লাভলী ওর আব্বাকে কখনও নীলের নানান শেড আর সাদা ছাড়া অন্য কোনো রঙে দেখে নাই। লাভলীর চাচাতো ভাই রিয়াজ অবশ্য মেরুন শার্ট খুব পড়তো। সেও কতো বছর আগের কথা। এখন জার্মানিতে থাকে, দুটা ফুটফুটা বাচ্চা, বিদেশি বউ।

নিজের অজান্তেই একটু অস্বস্তি লাগলো লাভলীর। ছেলে মেয়ে দু’টা মাথা নিচু করে কথা বলছে, মনে হয় ওকে নিয়েই। ছেলেটা চকিতে একবার লাভলীকে দেখে নিলো। মেয়েটার ঠোঁট খুব নড়ছে। কে জানে কী বলছে ছেলেটাকে। ছেলেটা অদ্ভুতভাবে একটা ভ্রু নাচালো আর বিশ্রীভাবে জিভ বের করলো। হাসলো বোধহয়। পায়ে পায়ে লাভলী সিনেমা হলের সামনে থেকে সরে পড়তে চাইলো। বাপ বেটির যুদ্ধ না দেখলেও চলবে। এই এক জীবনে ‘মা মেয়ের যুদ্ধ’ তো আর কম দেখছে না। অবশ্য লাভলী কখনও মায়ের অবাধ্য হয়েছে তা কেউ ভুলেও বলতে পারবে না। তবে মনের কথা যদি ধরা হয় ঘটনা হবে ভিন্ন। হঠাৎই দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো ও। টালমাটাল পায়ে অনেকটা হেঁটে এসে ওভারব্রিজ পার হয়ে তবে থামলো। ভিতরটা কেমন শুকিয়ে এসেছে। ইশ ডাবের পানি পাওয়া গেলে ভালো হতো। রাস্তার পাশে কায়দা করে দাঁড়িয়ে স্ট্র-তে চুমুক দিতে পারতো। ডাবের খোঁজে এদিক ওদিক তাকায় লাভলী।

ফুটপাতে পাওয়া যাচ্ছে না এমন কোনো জিনিস নাই। আর মানুষের মাথা মানুষ খায় এমন অবস্থা। এরই মধ্যে মাথার ভিতরের লোকটা ঘুম থেকে জেগে ওঠা গলায় বললো, “আপুমনি, বারোটা কিন্তু প্রায় বাজে, চলেন না কোথাও যাই, একটু হাওয়া খাই। আচ্ছা না হয় চলেন নিউ মার্কেটের ভিতরে ঢুকি। একটা বুদ্ধি আসছে মাথায়।”

লোকটার খিকখিক হাসি লাভলী ওর সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে শুনলো। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে হাঁটা দিলো নিউ মার্কেটের যেকোনো একটা গেটের দিকে। কেন যেন মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো কাজে সে নিউ মার্কেটে যাচ্ছে। লোকটার চাপা উত্তেজনা ওর ভিতরেও সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। অজান্তেই চলার গতি দ্রুত হতে থাকে। সামনের বলপ্রিন্ট শাড়ি পরা মহিলার স্যান্ডেল মাড়িয়ে দেয়, হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে মহিলা নিজেকে সামলায়। এক ঝটকায় পিছনে ফিরে তাকিয়ে দাঁত-মুখ খিচিয়ে কী একটা বলে, তার কিছুই ও শুনতে পায় না। লোকটা এখন মাথার ভিতরে আঙুলের টোকা দিচ্ছে: ঠক ঠক ঠক ঠক। টোকার লয় যত দ্রুত হচ্ছে ওর হাঁটার গতিও ততো বাড়ছে।

নিউমার্কেটের গেইট দিয়ে ঢুকে ব্লাউজের দোকান পার হলো লাভলী, স্ন্যাকস আর আবোল-তাবোল খাবারের দোকান পার হলো, তারপর শাড়ির, তারপর গয়নার, তারপর আরও ভিতরে ঢুকলো। নিউমার্কেটের শেষ মাথায় ক্রকারিজের দোকানগুলোর কাছে এসে দম ফেললো। আর মগজের ভিতরের ঠক ঠক শব্দও বন্ধ হয়ে গেলো। যেন কেউ লাভলীকে তাড়া করছিলো একটা দুঃসাহসিক অভিযান শেষ করবার জন্য আর লাভলী তা জীবন বাজি রেখে শেষ করেছে।

খুব অবসন্ন লাগলো লাভলীর আবার একই সাথে আরাম বোধ হলো। আরাম নাকি স্বস্তি বুঝতে পারলো না। আলো ঝলমল দোকানগুলোর সামনে দিয়ে কবুতরের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলো।

– ভাবি, আসেন ভিতরে আসেন। কী লাগবে?

– না, কিছু না। দেখি…।

লোকটা ওকে ভাবি বলেছে, লাভলীর ভিতরটা খুশিতে ভরে গেলো। খুব ইচ্ছা করতে লাগলো দোকানটা থেকে কিছু একটা কেনে।

(– কিছু লাগবে না মানেটা কী? এই চান্স আপনে পাবেন আর? প্লিজ আপুমনি, ভিতরে ঢুকেন।)

– ছুরি আছে, ছুরি। পাউরুটি কাটার, না না সব্জি কাটার?

– হ্যাঁ, আছে। বিভিন্ন সাইজের আছে, কোনটা চান? দাঁড়ান ভাবি, আপনেরে বিদেশি একটা ছুরির ছেট দেখাই।

– না, না সেট লাগবে না। মোটামুটি একটা ধারওয়ালা ছুরি দেন। মাঝে সাঝে রান্নাঘরে তো ঢুকতেই হয়, আর উনি এইসব দুই চোখে দেখতে পারেন না, আমার স্বামীর কথা বলতেছি, — মানে মেঝের উপর বসে কাজের মানুষের মতো সব্জি টব্জি কাটি যে সেইটা। আচ্ছা, এমন একটা ছুরি দেন তো যেটাতে মাংসও কাটে ভালো।

বলতে বলতে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো লাভলী। সে স্পষ্ট দেখতে পেলো ওর স্বামী ওর উপর খুবই বিরক্ত।

– এইসব কী, মাটির উপর চেগায়া বইসা বাড়ির চাকরানির মতো কাটাকাটি করতেছ?

– কই কাটবো?

– কেন টেলিভিশনে দেখো না, ছুরি দিয়া কী সুন্দর শাকসব্জি কাটে। মাছও কাটা যায়।

– মাছও কাটা যায়? হ্যাঁ বলছে তোমারে!

– ছুরি দিয়া প্রথমে পিঁয়াজ টিয়াজ কাটো তারপর দেখবা অভ্যাস হয়ে গেছে।

(– উঠেন আপুমনি, উঠেন, জাগেন — দোকানদার আপনেরে তখন থেকে দেখাবার জন্য মরে যাচ্ছে।)

বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসলো লোকটা। গাল টাল লাল হয়ে উঠলো লাভলীর, এইসব কী!

– ভাবি, এই ছুরিটা দেখেন, খুব ফাইন, ফরেন মাল। ধার দেখেন, মাংস কাইটা আরাম পাবেন।

– হ্যাঁ, এইটাই, এইটাই দেন।

গলাটা একটু কেঁপে উঠলো লাভলীর। চকিতে আশপাশটা দেখে নিলো। না, দোকানে এই মুহূর্তে আর কোনো কাস্টমার নাই। দোকানদার বেটা দাম নিলো একটু বেশিই। কিন্তু লাভলীর কোনো আফসোস হলো না, ছুরিটা আসলেই ভালো, ফরেন মাল।

প্লাস্টিকের কভারে আবার ঢুকে গেলো স্টেনলেস স্টিল ছুরি। দোকানদারের হাত থেকে ছুরিটা নেয়ার সময় হাতে হাত ঠেকে গেলো। ভালো লাগলো লাভলীর, খুব ভালো লাগলো। আবারও কান মাথা গরম হয়ে গেলো, এইসব কী হচ্ছে!

(– লাগ ভেলকি লাগ, চোখে-মুখে লাগ!)

– চুপ একদম চুপ।

জীবনে প্রথম মাথার ভিতরের লোকটাকে ধমক দিলো। ধমক তুচ্ছ করে খিক খিক করে হেসে উঠলো লোকটা। লাভলী ছুরিটা খুব সাবধানে ঝোলার ভিতরে রাখলো।  দোকানদার লোকটা এবার একটু কৌতূহলের সাথে ওকে লক্ষ্য করছে। কতো আজব পাবলিক যে আসে। এই বেটিরে মনে হইতেছে কার লগে যেন ফিসফিস কইরা কথা কয় আবার আতখা চমকাইয়া উঠে। মাথার ইস্ক্রুপ সব ঢিলা নাকি?

– আপা, আর কিছু লাগবে?

– আপা না ভাবি, ভাবি ডাকতেছিলেন। না আর কিছু লাগবে না।

লাভলী হালকা পায়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। বেশ ফুরফুরে লাগছে। একটা কাজের মতো কাজ হয়েছে। বিউটি বিশ্বাসই করতে পারবে না। বাসায় গিয়ে খুব কায়দা করে ছুরিটা দেখাতে হবে ওকে। অবশ্য মহারানীর দরজা যদি খোলা থাকে তবেইসেন। খাবার সময় তো খুলবেই, তখনই দেখানো যাবে। এমনভাবে দেখাবে যেন ব্যাগের ভিতরে একটা ধারালো ছোরা থাকা কোনো ব্যাপারই না। গল্প করতে করতে আলগোছে বের করা।

চকিতে পিছন ফিরে তাকালো লাভলী, দোকানদার বেটা দোকান থেকে বের হয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ঝট করে আবার মাথা ঘুরিয়ে নিলো লাভলী। এখান থেকে সরে পড়তে হবে, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু কেন? ও তো অন্যায় কিছু করেনি। একটা নিষ্পাপ ছুরি কিনেছে মাত্র। আবার হাঁটার গতি স্বাভাবিক হয়ে এলো লাভলীর।  ধীরে সুস্থে জায়গাটা পার হলো। নিউ মার্কেটের গেট দিয়ে বের হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, কী করবে এখন? মাথার লোকটা জীবনের প্রথম এক ধমক খেয়ে সত্যি সত্যি চুপ মেরে গেছে। এই মুহূর্তে একটা বুদ্ধির দরকার। কোথায় যাবে সে। বাসায় এতো তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
ছুরিটাকে ঝোলা থেকে বের করে আরেকবার দেখতে খুব লোভ হলো। চেইন খুললো, ঝোলা থেকে বের হয়ে এলো ছুরিটা। প্লাস্টিকের মোড়কের ভিতর ছুরি, তারপর আবার একশ’ বত্রিশটা টেপ লাগানো। খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ পায় না। প্লাস্টিক না এখন ব্যবহার করা নিষেধ। ছুরিটাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার জন্য হা পিত্যেশ করে উঠলো মন। টেনেটুনে প্লাস্টিকের মোড়কটার বারোটা বাজালো লাভলী। ছিঁড়ে ফেলে দিলো গাড়িপার্কের ড্রেনের ভিতর। ছুরিটা চলে এলো হাতে আর সাথে সাথে শীতের রোদের আদুরে তেজ মসৃণ স্টেনলেস স্টিলের গায়ে পিছল খেলো। আলোর বিচ্ছুরণ আতশবাজির মতো ছিটকে পড়লো লাভলীর চোখে মুখে। সে যে কী সুখ!

( — দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করবেন নাকি রমনা পার্কে যাবেন?)

যাবো যাবো, রমনা পার্কে যাবো। লোকটার কথায় চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করলো। এতো খুশি কি তার কখনও লেগেছে? হ্যাঁ লেগেছে। যেদিন রিয়াজ…

– এই যে ভাই যাবেন? রমনা পার্ক?

লাভলীর গলায় ফূর্তি নেচে ওঠে।

– যামু, মিটার থিকা দশ টেকা বাড়ায় দিয়েন।

– দিবো, দিবো, মিটার থিকা দশ টাকা বাড়ায় দিবো।

নিজেকেই নিজে চিনতে পারছে না লাভলী, চল্লিশ বছরের মনে আঠারো বছরের ছোপ।

সিএনজি ঘুরে ওর পায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। আরাম করে উঠে বসলো লাভলী, ঝোলাটা কোলের উপর রাখলো। তাহলে আসলেই রমনা পার্কে যাচ্ছে, এই জীবনে এও সম্ভব হবে কখনও কি তা ভেবেছিলো! কিন্তু কাপড়ের প্যাকেটটা? কাপড়ের প্যাকেটটা কই? চট করে আবার নেমে পড়ে ও। এদিক সেদিক খোঁজে, রাস্তায়, ঝোলার ভিতর, এমনকি এক নজরে ড্রেনটাও দেখে নেয়। না কোত্থাও নেই। ইশ, কোনো মানে হয়! এইজন্য এইজন্যই আম্মা কখনও একা ছাড়েন না। ছাড়ার উপযুক্ত হলেই না ছাড়বে! কিন্তু গেলো কোথায়? নিশ্চয়ই ছুরির দোকানে ফেলে এসেছে। ফিরে যাবে নাকি? দ্বিধায় পড়ে যায় লাভলী।

‘টোকান কী?’ সিএনজিওয়ালা জানতে চায়।

– একটা ছোট্ট প্যাকেট, কাপড়ের।

– মনে হয় দোকানেই ফালায় আসছেন। দোকানে গিয়া খোঁজ করেন, দামি কাপড় নাকি?

এরমধ্যে একজন ড্রাইভার এগিয়ে আসে, তার পিছনে আরেকজন। “কী হারাইছে? বিষয় কী?”

ছোকরা মতন একজন তৎক্ষণাৎ ফোড়ন কাটলো। “আমি দেখলাম এই আপায় একটা ছুরি ব্যাগ থিকা বার করলো, হেরপরে আকাশের পাইল তাকায় থাকলো।”

– ছুরিটা আছে নাকি গেছে?

– ছুরি যাইবো কই? ছুরি তো দেখলাম আবার ব্যাগে রাখলো।

ব্যাগ হারানো সংক্রান্ত এই জটিল জটলায় লাভলী অসহায় বোধ করে। ওর এখান থেকে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। কী আশ্চর্য, লোকটা ছুরির সাথে ওর একান্ত মুহূর্তটাও দেখে ফেলেছে। এখন ও কী করবে? ফিরে যাবে সেই দোকানে, গিয়ে দেখবে ওখানে ও সত্যিই প্যাকেটটা ফেলে এসেছে কিনা। অথবা রাস্তা পার হয়ে আবার চাঁদনী চকে ফিরে যেতে পারে এবং আবার কাপড়টা কিনতে পারে। একেবারে খালি হাতে বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। আম্মার সেই চেনা ‘বলেছিলাম না’ টাইপ হাসিটা দেখতে ইচ্ছা করছে না একটুও। তাহলে কী আসলেই ওরা দুই বোন ফরিদা খানমকে ছাড়া কিছুই ঠিক মতো করতে পারে না। নাকি লাভলীই শুধু অচল। বিউটি হয়তো ওর মতো এতটা অপদার্থ না। বিউটি হয়তো ঠিকই কাপড় কিনে ঠিকঠাক মতো বাড়ি ফিরে যেতে পারতো।

লাভলী আবারও আতাপাতা করে আশপাশটা দেখলো। জটলার প্রতি জোড়া চোখ পরম ধার্মিকের মতো ওকে অনুসরণ করলো।

“আপা আর কতোক্ষণ খাড়ায়া থাকুম, গেলে চলেন!”

লাভলী হাল ছেড়ে দিলো। নিজেকে টেনেটুনে উঠে পড়লো সিএনজিতে। এতো শিঘ্রী রসভঙ্গ হওয়ায় কেউ কেউ খেদ ঝাড়লো সিএনজিওয়ালার উপর।

– আরে মিয়া আপারে খুজার টাইম দিবা না। আপা সিএনজি আরও পাইবেন, চিন্তা নিয়েন না।

লাভলী প্রায় দৌড়ে গিয়ে সিএনজিতে উঠে পড়ে। “এইখান থেকে চলেন, তাড়াতাড়ি।”

সিএনজিওয়ালা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। এই হঠাৎ তাড়া খাওয়ার কারণটা ধরতে পারলো না। স্টার্ট দিলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। চলতে শুরু করলো এবং সিএনজি চালক নিয়ম করে একটুক্ষণ পর পর সামনের আয়না দিয়ে পিছনের প্যাসেনজারকে দেখে নিচ্ছে। একবার চোখে চোখ পড়ে গেলো। দিবে নাকি একটা ভেংচি কেটে।

মাথার ভিতরের লোকটা খিকখিক শব্দে হাসতে শুরু করেছে। এই হাসির মানে কী? অসহ্য! হাসির শব্দ বাড়তে বাড়তে পুরো সিএনজির ভিতর ফেটে পড়লো। লাভলীর ভয় করলো, এই শব্দ সিএনজিয়ালা না শুনেই পারে না। বাইরের হর্ন, নিত্য চেঁচামেচি সব ছাপিয়ে বিশ্রী হাসিটা কান মাথা জ্বালিয়ে ফেললো।

“চুপ করো, আল্লার ওয়াস্তে একটু চুপ করো।” ও ফিসফিস করে বললো।

( — ঝোলার ভিতরটা দেখেন আপুমনি, মুহূর্তে দিলখুশ হয়ে যাবে।)

কথা শেষ হওয়ার আগেই কোলের উপর রাখা ঝোলার চেইন ঝটিতে খুলে ফেললো লাভলী। ভিতরে পানির বোতল, প্লাস্টিকে মোড়ানো ছুরি, কালো পার্স, হলুদ রঙের ডায়রি, একটা ছোট ছাতা গোলাপি রঙের। বড় মামা ব্যাংকক থেকে এনে দিয়েছিলেন সেই কত্তো বছর আগে। এই শীতকালে আম্মা যে কী মনে করে ছাতাটা ঝোলার ভিতর ভরে দিয়েছেন কে বলতে পারে।

( — উপরের জঞ্জাল সব সরান না, কী মুশকিল!)

হালকা ধমক খেয়ে ঝোলার ভিতর হাত ঢুকিয়ে দেয় লাভলী। ওমা দিব্যি সবকিছুর নিচে খয়েরি রঙের কাপড়ের প্যাকেটটা চুপ করে বসে আছে।

– ঝোলার ভিতর প্যাকেটটা আছে তুমি জানতা, তখন বলো নাই ক্যান?

( — বললে মজা দেখতো কে?)

এই উত্তরে রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেললো লাভলী। পাওয়া যে গেছে এতেই তার বত্রিশ পাটির দাঁত বের হয়ে যাচ্ছে। উফ কী বাঁচাটাই না বাঁচলো। নইলে বাসায় গিয়ে আম্মার চোদ্দশো পঞ্চাশটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। আর এই প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতো কম করে হলেও এক মাস।

* * *

না, এই মুহূর্তে বাসা বা আম্মা বা বিউটি, কোনো কিছু নিয়েই ও ভাবতে রাজি না। লাভলী কালো কার্ডিগেনের উপরের বোতাম দু’টা লাগালো আর শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিলো। একটু শীত শীত লাগছে। সিএনজির দু’পাশ থেকে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। সিটের ঠিক মাঝখানে ঘাড় গুঁজে বসে রইলো লাভলী, বক যেমন করে দুই ঘাড়ের মাঝখানে মাথা ডুবিয়ে দেয় সেইরকম। এই জগত-সংসার কোনো কিছুরই আর সাতে পাঁচে থাকতে চায় না ও। চল্লিশ বছর বয়সে আমাদের নবীজী নবুয়ত প্রাপ্ত হন। তার মানে খোদাতায়ালার দৃষ্টিতেও চল্লিশ বছরের একটা অন্য রকম মরতবা আছে। চল্লিশে বিশেষ কিছু ঘটবে, বিশেষ কিছু ঘটে।

এইসব তত্ত্ব কথা ভাবার সাথে সাথে লাভলী এও খেয়াল করলো যে আল্লাহতায়ালার নাম নিলেই ওর মনে অটোমেটিক আরবী আর উর্দু শব্দ এসে ভিড় করে। কেন কে জানে! মনে হয় আল্লাহ বাংলা শব্দ ততো পছন্দ করেন না আর এই খবরটা আমরা জানি। আজকে আবার ফযরের নামাযখানও পড়া হয় নাই। ঘুম থেকে উঠে চল্লিশ বছরের শরীরটাকে এতো ভারি লাগলো যে টেনে হিঁচড়ে বিছানা থেকে ওঠাতে পারলো না। ‘চার শূন্য চল্লিশ’ এই বোধ ওকে অনেকক্ষণ অসাড় করে রাখলো। কিন্তু তারপরও নামায ক্বাযা করা উচিৎ হয় নাই। এই জীবনে তো হলোই না, পরের জীবনটাও যদি ফসকে যায় সেটা কোনো কাজের কথা হবে না। রিয়াজ ছাড়া ওর জীবনে আর কোনো আলো বাতাস ঢোকে নাই।

আচ্ছা, আজ এতোদিন পরে হঠাৎ করে রিয়াজের কথা কেন মনে পড়ছে বারবার। রিয়াজ ওদের খালাতো ভাই। ছোটো খালার তিন ছেলে, সবচেয়ে বড় রিয়াজ। লাভলীদের বাসার কাছেই বিজ্ঞান কলেজে পড়তো সে। সবে তখন কলেজে পা দিয়েছে, নাকের নিচে হালকা সরু গোঁফের রেখা দেখা যায় কি যায় না। মাথা ভর্তি চুল, হালকা কোঁকড়া, ঘন ভ্রু, বাঁ চোখের কোণায় একটা কাটা দাগ। শুকনা, পলকা — কী যে আলাভোলা ছিলো দেখতে! কাটা দাগটা প্রায়ই ছুঁয়ে দেখতো লাভলী। খুব মায়া লাগতো। খালারা থাকতেন সেই পল্লবীতে। দুপুরে বাসায় গিয়ে খাওয়াটা তাই প্রশ্নের বাইরেই ছিলো।

খালাতো ভাই বা চাচাতো ভাই-বোনদের সাথে কখনোই খুব মাখামাখি ছিলো না ওদের। আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ওরা খুব একটা যেতোও না, আর গেলেও মা-বাবার কাছ ঘেঁষে বসে থাকতো দুই বোন। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ পেরুবার পর মা গেলেও ওরা বাবার সাথে বাড়িতেই থাকতো। যদিও লাভলীর খুব ইচ্ছা হতো মা’র সঙ্গে যেতে। কতোবার যেতে চেয়েছে, যেহেতু বিউটি কোথাও যেতে চাইতো না, তাই বাধ্য হয়ে লাভলীকেও বাসায় থাকতে হতো। ততোদিনে ফরিদা খানম বেশ সহজভাবেই ওদের দুই বোনকে বাড়িতে রেখে যেতে পারতেন। আর তিনি বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই মুখলেস সাহেব গম্ভীর মুখে সামনের দরজা লক করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতেন। ফরিদা খানম বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন, চাবি লাগাবার শব্দ কানে যাওয়ার পর ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতেন। এর অন্যথা কখনও হয় নাই। তার অনুপস্থিতিতে কেউ বাড়িতে এলে মুখলেস সাহেব চাবি খুলে তাদের ভিতরে আসতে দিতেন। চাবি সব সময় সাদা শার্টের পকেটে ভারি হয়ে ঝুলে থাকতো। শুধু তো আর একটা চাবি ছিলো না। গোটা দশেক চাবির তোড়া। সামনের দরজার চাবি, দোতালায় উঠবার সিঁড়ির গোড়ায় লোহার গ্রিলের চাবি, ছাদের চাবি, ওদের দুই বোনের শোবার ঘরের চাবি, দু’টা আলমারির চাবি, স্টোর রুমের চাবি, আরও কীসব হাবিজাবি চাবি। দুই সেট চাবি, এক সেট ফরিদা খানমের এক সেট মুখলেস সাহেবের।

সেই চোদ্দ বছর বয়সে চুরি করে ছাদে যাবার পর থেকে জীবন কতো পাল্টে গেলো। মনিপুরি পাড়ার বাড়ি তৈরি হলো, এই বাড়ি তৈরি না হওয়া অব্দি ওদের দুই বোনের ছিলো কঠিন বন্দিদশা। প্রথম দিকে স্বামী-স্ত্রী একসাথে বাইরে গেলে মেয়েদের বুয়াসুদ্ধো তালা মেরে যেতেন, কিন্তু তবুও দু’জনের কেউই শান্তি পেতেন না। কখনও অর্ধেক গিয়ে ফিরে আসতেন, আবার কখনও বা গেলেও ফিরে না আসা পর্যন্ত অস্থির বোধ করতেন। জীবনপণ করে এই বাড়ি শেষ করলেন কি করলেন না –উঠে এলেন এখানে। এখানে এসেও সেই আগের রুটিনে কঠিনভাবে বেঁধে দিলেন মেয়েদের। কিন্তু স্বস্তি নেই কোথাও। শেষমেশ এর একটা সমাধান খুঁজে পেলেন — মেয়েরা যেখানে যাবে না সেখানে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের একসাথে যাওয়া চলবে না। এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি খুশি হলেন মুখলেস সাহেব। তার এমনিতেই কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। অফিস থেকে বাড়িতে আসার পর শোবার ঘরে বেতের চেয়ারে বসে টিভি দেখেন আর ঝিম মেরে থাকেন। রাতের খাবারের সময় ডাক পড়ে, সবার সাথে বসে ভাত খান, তাও প্রায় নিঃশব্দে। খাবার নিয়ে কখনওই কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। পোলাও কোরমা যে নির্লিপ্ততায় খান বাসি ডাল ভাতও একই নির্লিপ্ততা নিয়ে খান। ফরিদা খানম একাই রাজ্যর কথা বলতে থাকেন। মেয়েরাও তখন কম যায় না। টিভির নাটকের চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে বুয়ার কতোটা বাড় বেড়েছে সবই আলোচনার বিষয়বস্তু হয়। টিভি প্রসঙ্গে মুখলেস সাহেব অবশ্য কখনও সখনও তার মতামত ব্যক্ত করেন, তাও খুব একটা জোরের সঙ্গে না। কথাবার্তা সবচেয়ে বেশি তুঙ্গে ওঠে যখন আত্মীয় স্বজনদের গুষ্টি উদ্ধার করা হয়। সবার মন ভালো হয়ে যায় মুহূর্তে।

রিয়াজ আর বিউটি প্রায় ছয় মাসের ছোট বড়; আর লাভলীর চেয়ে রিয়াজ তিন বছরের ছোট। তাই একদিন দুপুরবেলা, কলেজ শুরু হওয়ার পর পরই ছোট খালার সাথে যখন রিয়াজ বাসায় এলো ফরিদা খানম তখন বেশ দরাজ গলাতেই তাকে মাঝেমধ্যে দুপুরে এসে খেয়ে যেতে বললেন। রিয়াজ দেখতে খুব ছোটখাটো ছিলো, বয়স তখন বোধহয় তার সতেরো কিন্তু দেখতে তেরো-চোদ্দ’র বেশি লাগতো না। আর লাভলীরা দুই বোনই বেশ লম্বা চওড়া। বিউটিকে তো মোটাই বলা যায়। সে কারণেই নাকি কে জানে ফরিদা খানমের মাথায় অন্য কোন চিন্তা আসে নাই। চিন্তা যে এলো না সেও এক অবাক করা ব্যাপার বটে। যে মানুষ তিলের মধ্যে তাল দেখেন সেই মানুষ ঘি আর আগুন নির্বিঘ্নে পাশাপাশি থাকার ব্যবস্থা করলেন। ফরিদা খানম বোধহয় তার সমগ্র জীবনে দুই মেয়েকে ঘিরে সেটাই সবচেয়ে কাঁচা কাজ করেছিলেন।

( — আর করলেন আজকে।)

বলেই একদম চুপ মেরে গেলো মাথার ভিতরের লোকটা। লাভলী মুখ ফসকে বলে ফেললো, মানে?

কিন্তু এর আর কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না।

এখন লাভলীর ভাবতেও কী অদ্ভুত লাগে। এতো সাহস ওর কোথা থেকে এসেছিলো। আম্মা সুর করে বলতেন, ‘পীপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে!’ তাই তো, এছাড়া আর কী!

তখন থেকেই শুরু। কলেজের পর প্রায়ই হুটহাট করে রিয়াজ লাভলীদের বাসায় চলে আসতো, ভাত খেতো, দুই বোনকে বড় আপু আর ছোট আপু বলে ডাকতো, ওদের সাথে চুটিয়ে লুডু খেলতো। বিজ্ঞান কলেজে পড়তো সে আর দু’বোনের কাছে পাশের হলিক্রস কলেজের মেয়েদের গল্প করতো। লাভলী আর বিউটি রূপকথার গল্প শোনার মতো করে সেইসব গল্প শুধু শুনতো না গিলতো। বাইরের পৃথিবীর এইটুকু বাতাসের আশায় ওরা চাতক পাখির মতো রিয়াজের জন্য অপেক্ষা করতো। আম্মা কিছু মনে করতেন না, রিয়াজ আসলে বরং খুশিই হতেন। চট করে হয়তো বেগুন ভাজা করে দিতেন বা ডাল ভর্তা। লুডু খেলার সময় কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ পাতা আর টমেটো দিয়ে ঝাল মুড়ি বানিয়ে দিতেন। মাঝে মধ্যে আগ্রহ নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতেন।

কবে থেকে যে এই খেলার রঙ একটু একটু করে বদলাতে শুরু করলো এখন আর তা স্পষ্ট করে মনে পড়ে না লাভলীর। একদিন এক ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সে আবিষ্কার করলো আজ রিয়াজ না আসলে ও মরেই যাবে। এই আবিষ্কারের আনন্দ আর ধাক্কা দুই-ই এতো প্রচণ্ড ছিলো যে, বোঝা মাত্র মাথার উপর কাঁথাটা টেনে দিয়ে মরার মতো পড়ে থাকলো আর বুকের ধ্বকধ্বক শব্দে কানে তালা লেগে গেলো। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে এই অজুহাতে সারাটা দিন সেদিন বিছানাতেই কাটলো ওর। রিয়াজ যেন সেদিন না আসে সেজন্য দোয়া পড়তে পড়তে মুখে ফেনা তুলে ফেললো লাভলী আর মনে মনে মাথা কুটে মরলো যেন আসে!

ঘ্যাঁচ করে থেমে গেলো সিএনজি আর তার সাথে সাথে চিন্তার জট। থেমে যাওয়ার বদলে বরং হোঁচট খেলো বলা যায়। আর একটু হলে চিন্তার সাথে লাভলীর ঘাড়ে গোঁজা মাথাও সামনের লোহার গ্রিলে বাড়ি খেতো। যে গ্রিল ওকে আর সিএনজি চালককে একটা নিরাপদ বেষ্টনীতে ঘিরে রেখেছে, সেখানে আবার একটা ছোট তালা ঝুলছে।

( — ধ্যাঁৎ তেরি মাইরে বাপ! সরি আপুমনি। একটা গালি দিলাম। আপনের দিল দরিয়ায় রিয়াজ সাহেব তো ভালো রকম খাবি খাচ্ছেন। শালা, গরম জিনিসপত্র আসার আগেই পানি ঢাইলা দিলো। নামেন, নামেন পার্কের হাওয়া খান আর রিয়াজ সাহেবের কথা ভাবেন, আমিও শুনি ব্যাপার কতদূর গড়াইছিলো!)

–এই যে আপা, ঘুমান নাকি? আইসা পড়ছি… চোট লাগছে মনে হয়। গাড়ি চলার সুময় শক্ত কইরা বইসা থাকনের দরকার।

– না, না, ব্যথা লাগে নাই। ভাড়া কতো?

আসলে বেশ জোরেই বাড়ি লেগেছে লাভলীর। এখনও বাঁ হাতের তালু দিয়ে কপাল ঘষছে। এখনই হয়তো ফুলে আলু-টালু হয়ে যাবে। বিপদের উপর বিপদ। ফুলে গেলে তো বাসায় আরেক দফা জেরা শুরু হবে।

( — রিমান্ডেও নিতে পারে। ক্রস ফায়ারে মারাও যাইতে পারেন।)

–৮২ টেকা।

ইশ কপালটা টনটন করছে। মাথা ধরে যাবে এক্ষুনি। লাভলীর আছে ভয়াবহ মাথাব্যথা রোগ। একবার শুরু হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে হয়। এখন যদি ব্যথা শুরু হয়ে যায় কী করবে ও? রমনার খোলা ঘাসে চিৎপাৎ হয়ে শুয়ে পড়তে হবে, আর কী!

ধীরে সুস্থে ঝোলার চেইন খুললো লাভলী। পার্স বের করে ১০০ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলো।

– আপা নেন।

– কতো দিলেন?

– ১৫ টেকা।

– ১৫ টাকা কেন? মিটারে উঠছে ৭১ টাকা ৫০ পয়সা, আপনাকে ১০ টাকা বাড়ায় দেওয়ার কথা… বড় জোর নিবেন ৮২ টাকা, আপনে তো চাইলেনও সেইটাই। এখন আবার বেশি নিচ্ছেন কেন?

– তিন টেকা ভাংতি নাই।

– আমি বসে আছি আপনি যান ভাংতি নিয়া আসেন।

– ভাংতি কই পামু?

– ভাংতি কই পাবেন সেইটা তো আমার বিষয় না। আপনে যান।

( –খা খা খা বক্ষিলারে কাঁচা ধইরা খা!)

– চুপ!

– চুপ কারে কন?

– আমার মাথার ভিতরের লোকরে কই। যান, বইসা আছেন কেন, নিয়া আসেন।

সিএনজিওয়ালা মুহূর্তক্ষণ লাভলীর দিকে তাকিয়ে থাকে, মনস্থির করতে পারছে না ঝামেলা করবে নাকি করবে না। একটার মতো বাজে। দু’টার মধ্যে আরও অন্তত দু’টা খ্যাপ নিয়ে তারপর গাড়ি জমা দিয়ে খেতে যাবে। এর মধ্যে ঝামেলা করলে সময়টাই নষ্ট হবে আর কিছু না। এই মহিলাকে আজকে ঘাটানো ঠিক হবে না, একদম তেড়িয়া হয়ে আছে। কথা বলা মাত্র নখ বসাবে।

– আপা ধরেন, আরও পাছ টেকা ধরেন, নামেন। আমার দুই টেকার কাম নাই।

লাভলী খুশি মনে কুড়ি টাকা নিয়ে সিএনজি থেকে নামলো। নামা মাত্র শীতের রোদ ওর গা চুঁইয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এতো আরাম, ওর ঘুম পেয়ে গেলো, মনে হলো চোখ বন্ধ করে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকে। আস্তে চোখ খুলে দেখলো সামনেই রমনা পার্কের বিশাল গেট। লোকটার পাল্লায় পড়ে শেষমেশ চলেই আসলো, এটা কি ঠিক হলো? এরকম জায়গায় একা তো দূরের কথা কারো সাথেই কখনও আসে নাই আগে। বিসমিল্লাহ বলে গেটের দিকে পা বাড়ালো লাভলী। ওড়না আর শালটা গায়ে ভালো করে জড়াতে গিয়ে উত্তুরে বাতাসে হাবুডুবু খেলো। তাহলে সুখ কী এই!

বিউটি আজকে ওকে দেখলে অবাক হয়ে যেতো। চিরদিনের ভীতু ভীতু মেয়েটার ইটচাপা ফ্যাকাশে সাহস আজ শীতের রোদে ডালপালা মেলেছে। শুধু ডানা দু’টা নাই এই যা আফসোস।

পার্কের গেট দিয়ে মাথা উঁচু করে সামনে এগোলো লাভলী, দু’পাশের বিশাল বিশাল আকাশ-কাতুরে গাছগুলি ছায়া দিচ্ছে। ছায়ার ফাঁক দিয়ে অনেক সাধ্য সাধনায় রোদ গলে ওর গায়ে পড়ছে। এমনিতেই আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিলো লাভলী। টুপ করে একটা পাতা খসে পড়লো ওর মুখের উপর। অন্ধকার রাতে হঠাৎ যেমন তারা খসে পড়ে! খুব যত্নে ঝোলার চেইন খুলে পাতাটা ভিতরে রাখলো। কী গাছের পাতা কে জানে, গাছ টাছ সে একেবারেই চেনে না। এই গাছটা চিনতে পারলে ভালো হতো।

সোজা নাক বরাবর হাঁটছে লাভলী। অনেকটা পথ এসে একটু দূরের পুকুরটা চোখে পড়লো ওর, পুকুরের পাশে বেন্চ পাতা। বেশ বড় পুকুর, একেই কী দীঘি বলে! ঠিক করলো একটা বেঞ্চে গিয়ে চুপ করে বসে থাকবে। সারা দুপুর, সারা বিকাল, সারা সন্ধ্যা কাটিয়ে বাড়ি ফিরলে কেমন হবে?

( — কেমন হবে?… তৃতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হবে।)

লোকটার কথায় মজা পেলো। এলোমেলো পায়ে বেঞ্চের কাছে এগিয়ে গেলো, দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলো চারপাশে, আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসতেই ‘আহ্’ ধ্বনি বেরিয়ে এলো বুকের গহীন কুয়া থেকে। এরই মধ্যে জোড়া জোড়া মানুষের অসংলগ্ন মুহূর্ত চোখে পড়ছে। গাছের আড়াল থেকে একটা মেয়ের কচি হাসি ছিটকে ওর পায়ের কাছে এসে খানখান হয়ে ভেঙে পড়লো। নিঝুম বেঞ্চিতে বসে এই হাসির শব্দে ওর গায়ে কাঁটা ধরে যায়। এক অশরীরী অনুভূতি জাপটে ধরে। নির্জন দুপুর, দূরে কোথাও থেকে যানবাহন আর নাগরিক জীবনের অস্পষ্ট কোলাহল, এক-আধটা হাসির টুকরো-টাকরা, ভালোবাসার ফিসফাস উচ্চারণ, বাদাম-ওয়ালা আর আমড়া-ওয়ালার জবরদস্তি … এইসব কিছুকে ছাপিয়ে শীতের রোদের আরামটাই মুখ্য হয়ে ওঠে লাভলীর কাছে। এই বেঞ্চির উপর সটান হয়ে শুয়ে পড়লে কি খুব অদ্ভুত দেখাবে দৃশ্যটা। দূর থেকে কেউ দেখলে দেখবে, একটা পুরনো কাঠের বেঞ্চির উপর সাধারণ সাদাসিধা একজন মহিলা জলপাই রঙের লম্বা ঝুলওয়ালা জামা পড়ে শুয়ে আছে। ওর ডান পাশের বেণীটা বেঞ্চি থেকে ছলকে পড়ে প্রায় মাটি ছুঁই ছুঁই অবস্থা হয়েছে। কিন্তু শুয়ে থেকে থেকে ঘুমিয়ে যায় যদি, গভীর ঘুম। আর যদি না জাগে, বা জাগলেও এই পার্কটাকে যদি ভালোবেসে ফেলে ততোক্ষণে, তারপর আর যদি বাসায় ফিরে যেতে মন না চায়।

ঝটিতে ঝিমুনি ঝেড়ে ফেলে টানটান হয়ে বসলো লাভলী। কীসব আবোল তাবোল ভাবছে।

– আপা পানি খাইবেন।

বছর দশেকের একটা মেয়ের হাতে এনামেলের ছোট জগ আর একটা গ্লাস। এতোক্ষণ পিপাসা পাচ্ছিলো না কিন্তু পানি দেখার সাথে সাথে গলা পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ।

– হ্যাঁ, খাবো।

– এক গেলাশ পাঁছ টেকা।

– ঠিক আছে।   মেয়েটা কাঁপা হাতে গ্লাসে পানি ঢালে। এক চুমুকে পানিটা শেষ করে ফেলে লাভলী তারপর মেয়েটার দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে আর এক গ্লাস পানি দিতে ইঙ্গিত করে।

– দুই গেলাশ খাইলে কিন্তুক দশ টেকা।

– জানি। তুমি আর এক গ্লাস দাও।

মেয়েটা খুশি হয়ে যায়, খুব আগ্রহভরে আরেক গ্লাস পানি ঢেলে লাভলীর দিকে বাড়িয়ে ধরে। গ্লাসটা হাতে নিতেই মেয়েটা একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে বেঞ্চিতে উঠে বসে।

– দুফরে কিছু খাইবেন না আফা? আমার মায় খুব ভালা ডিম-পুলাও রান্ধে। রিকশাওয়ালা আর সিএনজিওয়ালারা মায়ের বান্ধা কাস্টমার। একজন ঠেলাওয়ালাও আসে, গফুর চাচা। রোজ দুইবেলা পিছনের গেইটে আমার মায় হাঁড়ি নিয়া বসে।

– তোমার নাম কী?

– লাবলী।

মেয়েটার উত্তরে লাভলীর হাত কেঁপে যায়, পানি ছলকে গড়িয়ে পড়ে। অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

– কী নাম বললা?

– লাবলী।

– বয়স কতো?

– জানি না।

– তুমি রোজ পানি বিক্রি করো?

“হ। আফা আমি যাই, আমার মেলা কাম।” বলেই ছুট লাগায় মেয়েটা। তখনও পানির গ্লাস লাভলীর হাতে ধরা। কিছু দূর গিয়ে আবার জিহ্বায় কামড় দিয়ে ফিরে আসে। গ্লাস ফেরত নেয়, লাভলী ঝোলা থেকে পার্স বের করে ১৫ টাকা দেয়।

– আফা দশ টেকা তো।

– কিচ্ছু হবে না, তুমি এক ঘণ্টা পরে আবার আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসবা। মনে থাকবে?

– হ থাকবো।

মেয়েটা চলে যেতেই লাভলী চঞ্চল বোধ করলো। কেমন মেয়েটার জীবন কে জানে। ওর নামে নাম। আচ্ছা, মেয়েটার কি কোনো বোন আছে, বোনটার নাম কি বিউটি? ইশ, জিজ্ঞেস করা হলো না। কী স্বাধীন মেয়েটা, সারাদিন বোধহয় পার্কে ঘুরে বেড়ায় আর খিদে পেলে মায়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে ডিমপোলাও খায়। ওর জীবনটা তো এরকমও হতে পারতো। যাবে নাকি পিছনের গেটের দিকে, তারপর এক প্লেট ডিমপোলাও কিনে রিকশাওয়ালা আর সিএনজিওয়ালাদের পাশে বসে আরাম করে খাবে। ভাবছে আর হাসছে লাভলী, ফরিদা খানমের চেহারা মনে করে হাসির বেগটা বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এই মহিলা চাকর শ্রেণীর মানুষজনের সাথে মাখামাখি একদম বরদাস্ত করেন না। নিজের অবস্থান নিয়ে তার ধারণা খুবই স্পষ্ট। আর তার মেয়ে কিনা রিকশাওয়ালার পাশে বসে গপ গপ করে ডিমপোলাও খাবে!

হাসি বাড়তে বাড়তে বড় রকমের খাবি খায় লাভলি।

( — আপুমনি, কয়টা বাজে খবর আছে?)

– খবর নাই আর খবরের দরকারও নাই।

( — সত্যি লাভলি আপু, এতোদিন পরে, আমার মনের মতোন একখান কথা বললেন আপনে। তবে জানতে না চাইলেও বলি, এখন বাজে একটা দশ। আপনের কারফিউ শুরু হবে দুইটা থেকে। দুইটার পরে দেখা মাত্র গুলি।)

– ফালতু কথা বলবা না, আমার বয়স আজকে চল্লিশ হইছে, চল্লিশ মানে জানো? আজকে আমার ইচ্ছামতো আমি বাসায় ফিরবো।

( — হ্যাঁ, তা তো বটেই!)

আবার হেঁচকি তুলে হাসতে শুরু করেছে লোকটা। এই হাসির শব্দ মাথায় যাওয়া মাত্র লাভলীর মনটা টিনখোলা মুড়ির মতো মিইয়ে গেলো। কথা সত্যি, ওর বয়স একশো হলেও ও কি আর নিজের খুশিমতো বাড়ি ফিরতে পারবে। বরঞ্চ একা বাইরে যাবার সুযোগ ওকে আর কখনই দেয়া হবে না এই গ্যারান্টি চোখ বুজে দেয়া যায়।

( — আপুমনি একটা কথা বলি মন দিয়ে শুনেন। আপনে কি এখন বাসায় যেতে চান?)

– না।

( — এখনই যদি উঠেন তাইলেই যে বিপদ কাটানো যাবে তা বলা যায় না। দুইটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছাইতে পারবেন ঠিকই কিন্তু এতোক্ষণ কী করছেন এই প্রশ্নের কোনো জুতসই উত্তর দিতে পারবেন বলে তো মনে হয় না। বাজার-সদাই কিছুই করেন নাই। আর যদি দেরি করেন তাইলে মোটামুটি ধরা যায় যে কর্ম সাবাড়, মানে আপনের বারোটা আজ বাজবে। আমি বলি কী, এক ঘণ্টা দেরি হইলেও যা হবে তিন ঘণ্টা দেরি করলেও তাই হবে… তাইলে আর এত ভাইবা লাভ কী! জীবনের মতো বার হইছেন, একটু হাওয়া বাতাস খান, গল্পগুজব করেন, তারপর ধীরে সুস্থে বাড়ি যান। না গেলেও কোনো ক্ষতি নাই।)

– গল্পগুজব করেন মানে? কার সাথে গল্পগুজব করবো?

( — আমার সাথে করতে পারেন, মজা পাবেন। আর সেইটা যদি না চান ডান দিকে তাকান, লাল কালো চেক লুঙ্গি আর ঘিয়া রঙের গেঞ্জি পরা এক লোক আরাম করে কান পরিষ্কার করাচ্ছে, আরামে চোখ বুজে আসতেছে, তাও তাকানে মাফ নাই। আমার তো মনে হয়, সে আপনের সাথে গল্পগুজব করতে খুবই আগ্রহী হবে।)

– আপা, বাদাম খাইবেন?

পিছন থেকে বাদামওয়ালা প্রায় ফিসফিস করে বললো। মুহূর্তের জন্য লাভলির মনে হলো মাথার ভিতরের লোকটাই বুঝি জিজ্ঞেস করছে। ঘটনা তা না বুঝতে পেরে ধীরে পিছন ফিরে দেখলো একটা ছোকরা মতো লোক বাদামের ঝুড়ি গলায় ঝুলিয়ে ঠিক ওর মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। কতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কে বলতে পারে। মাথার ভিতরের লোকটার সাথে এতোক্ষণ যে কথাবার্তা চলছিলো তাও নিশ্চয়ই সব শুনেছে… শুনুক। বাসায় যখন লোকটার সাথে কথা চালাচালি হয় তখন ব্রেনের মধ্যেই ঘটনা ঘটতে থাকে। বাইরে থেকে কেউ বুঝতেও পারে না যে লাভলী কারও সাথে আলাপে ব্যস্ত। সময় সময় একটু আনমনা দেখা যায়, এই যা। কিন্তু আজকে লাভলী হাওয়ায় ভাসছে। কাউকে তোয়াক্কা করছে না, দুই পয়সার পাত্তা দিচ্ছে না। ওর যদি ইচ্ছা হয় ও মাথার ভিতরের লোকটার সাথে চীৎকার করে কথা বলবে, দেখি ঠেকায় কে!

লাভলী বাদামওয়ালার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো, তারপর বললো, “হ্যাঁ খাবো।”

– পাঁচ টাকা ঠোঙ্গা।

এই পার্কে সব কিছুর দামই কি পাঁচ টাকা নাকি? ঠোঙ্গার সাইজ দেখে মনে হচ্ছে বাদামও ওকে দশ টাকার কিনতে হবে। খিদা লেগেছে। সেই সকালে লুচি আর অর্ধেকটা ডিম খেয়েছে। কবে হজম হয়ে গেছে! এখন বাসায় গেলে অবশ্য ইলিশ পোলাও, দই বেগুন আর হাঁসের ঝাল মাংস খাওয়া যাবে। সাথে থাকবে টমেটোর সালাদ। কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ আর ধনে পাতা দিয়ে চটকে মাখানো। হাঁসের মাংস খাওয়ার জন্য লাল চালের ভাত। এই মেনুর কোনো মাফ নাই। ওদের দুই বোনের জন্মদিনে ফরিদা খানম প্রতি বছর ধর্মানুষ্ঠান পালনের একাগ্রতা নিয়ে এই মেনু রেঁধে চলেছেন। শুধু তাই না, খাওয়ার পর সুন্নত হিসাবে পায়েস আর হাতে বানানো দই। অবশ্য একবার বিউটির জন্মদিনে এই নিয়মের কিছুটা ব্যতিক্রম হয়েছিলো। হাঁসের মাংস রান্না হয় নাই। হাঁস বাজারে পাওয়া যায় নাই। ওদের বাড়ির কাছের কলমিলতা বাজারে তো পাওয়া যায়-ই নাই, মুখলেস সাহেব কাওরান বাজারে গিয়েও হাঁসের ব্যবস্থা করতে পারেন নাই। তিনি অত্যন্ত ব্যাজার মুখে বাড়ি ফিরে এই দুঃসংবাদ ফরিদা খানমকে জানান। ফরিদা খানম স্বজন হারানোর সমান শোক নিয়ে মেয়ের জন্মদিনের রান্নায় মন দেয়ার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত হাঁসের মাংসের বদলে গরুর গোশ ভূনা রান্না হয়, সাথে ছিলো চালের আটার রুটি। বিউটি আর লাভলিও ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে’ টাইপ মুখ নিয়ে খেতে বসে আর নিজেদের অজান্তেই অত্যন্ত তৃপ্তি নিয়ে গরুর গোশ আর চালের আটার রুটি খায়। বেচারা মুখলেস সাহেব একবার মনের ভুলে বলে ফেলেছিলেন, “ফরিদা, গরুর গোশও খারাপ লাগতেছে না। চালের রুটির সাথে ভালোই লাগতেছে।”

– কথার ছিরি দেখো! চালের রুটি আর গরুর গোশ হইলো ঈদের নাস্তা। হাঁস পাইলা না, কী রানমু আন্দাজ না পাইয়া রানলাম। এই মেয়েরা, আমারে খুশি করার জন্য শুধু গোশ আর রুটি খাওনের দরকার নাই, ইলিশ পোলাও দিয়া খাওয়া শেষ করো।

লাভলী দুই হাতের তেলোয় বাদাম ভাঙছে আর মুখে দিচ্ছে, একটু পর পর আঙুলের ডগা দিয়ে ঝাল লবণ জিহ্বায় ছোঁয়াচ্ছে। খুব ভালো লাগছে খেতে। বাসায় গিয়ে ইলিশ পোলাও খেতে হবে চিন্তা করে গা গুলিয়ে উঠলো লাভলির। অবশ্য এটা না বললে খুব অন্যায় হবে যে ফরিদা খানম রাঁধেন খুব ভালো। কিন্তু তবুও আর কাঁহাতক ইলিশ পোলাও খাওয়া যায়।

লাভলী গভীর মনোযোগে বাদাম খেয়ে যাচ্ছে। খেতে খেতে সে চারদিকটা মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিলো। সেই কান চুলকানো লোকটা এখন পলক না ফেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কান মালিশওয়ালা দুই কান শেষ করে এখন লোকটার মাথা বানিয়ে দিচ্ছে। মাথা বানাতে গিয়ে যেভাবে ঘাড়-মাথা দাবড়াচ্ছে তাতে মনে হয় যেকোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে, ঘাড় মটকে যেতে পারে। লোকটা আবার দেখি হাসেও, লাভলি চোখটা সরিয়ে নিলো।

– আফা, এই নেন আপনের পানি। ফুচকা খাইবেন?

লাবলী এক গ্লাস পানি হাতে ফিরে এসেছে। জগটা ওর হাতে আর নাই। তার বদলে বাঁ হাতের কব্জিতে তিনটা শিউলি ফুলের মালা দুলছে। শীতের বাতাস ভর করে শিউলি ফুলের গন্ধ লাভলির নাকে লাগে। সে আগ্রহ নিয়ে পানিটা শেষ করে।

– না ফুচকা খাবো না।

– আফনে বাড়িত যাইতেন না? বাড়ি কই?

– বাড়ি নাই।

– আফা, ঐ যে একটুক দূরে বড় গাছটার ছেমায় একটা বেটা খাড়ায় আছে, হে আপনের লগে কথা কইতে চায়।

মেয়েটা কথা কয়টা বলতেই লাভলির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বড় গাছটার ছেমায় নাকি একটা বেটা খাড়ায় আছে আর সেই বেটা নাকি ওর সঙ্গে কথা কইতে চায়, এর মানে কী? ওর সঙ্গে কেন কথা বলতে চাইবে! চকিতে লাভলী গাছটার দিকে তাকিয়ে আবার মাথা ঘুরিয়ে ফেললো। সে প্রায় কিছুই দেখতে পেলো না। গাছের পিছনে লোকটা গা ঢাকা দিয়ে আছে। শুধু লোকটার লাল রঙের মাফলার চোখে পড়লো। বাতাসে মাফলারটা উড়ছে, গাছের আড়াল-টাড়াল মানছে না। লাভলী টের পেলো রাজ্যের কৌতূহল নিয়ে মেয়েটা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ও এখন কী বলবে; ও যে ভয় পেয়েছে এটা কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। হয়তো ওর ঝোলাটার দিকেই সবার নজর। সেটা হলে কোনো ভয় নাই; ঝোলাটা ও চোখ বন্ধ করে দিয়ে দিতে পারে। অবশ্য ছুরিটা কায়দা করে রেখে দিতে হবে। ছুরি কেনার সুযোগ আর ও কোনো দিনই হয়তো পাবে না, হয়তো বলছে কেন, অবশ্যই আর কোনোদিনই পাবে না। সুতরাং ছুরিটা বাঁচাতে হবে। এখনই ঝোলা খুলে ছুরিটা বের করা যায় তারপর বেঞ্চের নিচে রেখে দেয়া যায় বা ছুরিটা রেখে তার উপর বসে থাকা যায় চুপচাপ। তারপর যখন লোকটা আসবে তখন নিশ্চিন্ত মনে ঝোলাটা তার হাতে তুলে দেবে। ‘মেঘ না চাইতেই জল’- টাইপ ব্যাপার হবে। লাভলী লক্ষ্য করলো মেয়েটা পিছন দিকে তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে আসছি বলেই দৌড় দিলো লাল মাফলারের দিকে।

( — একটা লোক ভালো মনে আপনের সঙ্গে কথা বলতে চায়, কথা বলেন। এত ভয় পাচ্ছেন কেন?)

– চিনি না জানি না, আন্দাজে কী কথা বলবো? ভয় পাবো না, যদি ছিনতাইকারী হয়?

( — জন্মে শুনছেন ছিনতাইকারী আলাপ পরিচয় করে ছিনতাই করতে আসছে? আর আপনে ঢাকার রাস্তায় কখনও বার হইছেন যে মানুষ চিনবেন? লোকটা হয়তো দুইটা রসের কথাও বলতে চাইতে পারে।) – লাল মাফলারের সাথে আমি রসের কথা বলতে যাবো কোন দুঃখে?

( — দুঃখ আপনের কম নাই আপুমনি, দুঃখ আছে। অবশ্য সে তর্কে গিয়া কোনো ফায়দা নাই। ঘটনা এখন যা ঘটবে চিন্তা করতেই মজা লাগতেছে।) মেয়েটা আবার দৌড়ে ফিরে এলো। দৌড়াদৌড়ির চোটে বেচারা হাঁপাচ্ছে। কথা বলতে গিয়ে দম হারিয়ে ফেলছে। শিউলি ফুলের মালা তিনটার বদলে এখন মাত্র একটা কব্জিতে ঝুলে আছে। বাকি দুইটার কী গতি হয়েছে কে জানে। মেয়েটা গেছে তো বেশিক্ষণ হয় নাই। মেয়েটা থুক করে এক দলা থুতু পায়ের কাছে ফেললো।

– আফা, হেই বেটা আপনের লগে কথা কইবো। ডাহুম? ওই দেখেন গাছের ছেমায়, এহন দেহা যায় পষ্ট।

( — আরে দেখেন না আপুমনি, পছন্দ হয় কি না?)

দেখলে কী দোষ, শুধু মাথাটা পিছনে ঘুরালেই লাল মাফলারকে দেখা যাবে। সন্ধ্যা না, রাত না, দুপুরের সময়, কী আর হবে। ওকে তো আর সবার সামনে গলায় ছুরি বসাতে পারবে না। যদি হঠাৎ ভয় লাগেই তাহলে ওই মাথা-মালিশ লোকটাকে ডাকা যাবে, যার মাথা মালিশ করা হচ্ছে তাকেও ডাকা যেতে পারে। ওরা দুইজন তো এখন মালিশ-টালিশ বাদ দিয়ে ঠায় তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ব্যাপার ঘটছে বুঝতে পেরেছে বোধহয়। সুতরাং ইশারায় ডাকলেও কাজ হবে, পড়িমরি করে ছুটে আসবে। তাছাড়া আশেপাশেই জোড়ায় জোড়ায় অনেকেই বসে আছে, প্রেম করছে। বাদামওয়ালাও আছে নিশ্চয়ই, কাছে ধারে কোথাও। সাহস করে লাভলী এবার মাথাটা পিছনে ঘুরাতেই লাল মাফলারকে দেখে ফেললো। লাল মাফলার এখন আবার একটু এগিয়ে এসেছে, বেশ বোকা বোকা ভদ্র চেহারা। বয়সও মনে হচ্ছে ওর চাইতে অনেক কম। ওর চাইতে বয়স কম হওয়া অবশ্য কোনো বড় ব্যাপার না, অনেকেরই কম। আচ্ছা, এই লাল মাফলার ছেলেটা কেন ওর সাথে কথা বলতে চায়? লাল মাফলারকে এবার বেশ ভালো করে তাকিয়ে দেখলো লাভলী। ছেলেটার মধ্যে কেমন একটা গোবেচারা ভঙ্গি। লাভলী টের পেলো, ওর মন থেকে ভয় ভয় ভাবটা দূর হয়ে যাচ্ছে। লোকটা অপ্রস্তুত একটা হাসি দিয়ে আছে। গায়ে গলা বন্ধ খয়েরি রঙা সুয়েটার আর লাল মাফলার, কালো রঙের প্যান্ট, চুল ভালোই লম্বা — বাতাসের ঝাপটায় চোখে মুখে এসে পড়ছে। এই কারণে বয়স আরও কম লাগছে। কতো হবে বয়স — তিরিশ, বত্রিশ? নাকের নিচে সরু হালকা গোঁফ। লাল মাফলার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

( — পছন্দ হইছে, পছন্দ হইছে।)

– তোমার মাথা।

ছোট মেয়েটা ইতিমধ্যে কখন উধাও হয়ে গেছে লাভলী টের পায় নাই, বিস্মিত হয়ে ও তাকিয়ে দেখলো লাল মাফলার সাহেব এক পা দুই পা করে ওর বেঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছে। ওর এখন কী করা উচিৎ, সটান উঠে দাঁড়িয়ে উল্টা দিকে হাঁটা দেয়া উচিৎ, চীৎকার দেয়া উচিৎ, নাকি মুখ ঘুরিয়ে ফেলা উচিৎ। লাভলী অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, এই তিনটা উচিতের কোনোটাই ও করলো না বরং কিছু না ভেবেই ডান হাত দিয়ে কপালের চুলগুলি একটু ঠিকঠাক করে নিলো, দুই বেণীর একটাকে সামনে নিয়ে আসলো। বৃথাই চেষ্টা! এইসব করতে করতে ছেলেটা প্রায় বেঞ্চির কাছে চলে এলো। বেঞ্চির কাছাকাছি এসে ঘাড় ডানে বাঁয়ে ঘুরিয়ে আবারও আশপাশটা দেখে নিচ্ছে। এই ছেলের মতলবটা কী!

লাভলী হঠাৎ করে ভিতরে একটা তাড়া খেলো, এক দৌড়ে সেখান থেকে সরে পড়তে ইচ্ছা করছে ওর। দৌড়াতে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি পৌঁছে তবে দম ফেলবে! বিউটি অবশ্য এতে খুবই বিরক্ত হবে। কিন্তু আম্মা যখন এরকম হাঁসফাঁসের কারণ জিজ্ঞেস করবেন তখন ও কী উত্তর দিবে। ফরিদা খানম তখন ঠিকই নারিকেল কুরানির মতো কুরে কুরে ওর ভিতর থেকে সব খবর বের করে ফেলবেন; তারপর শেষ রাতের দিকে শিল পাটার শিল দিয়ে মাথায় একটা ছোট্ট বাড়ি দিবেন। কার্য হাসিল!

অচেনা ছেলের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, কী কথা বলতে হয় ওর আসলেই জানা নাই। লাভলী সোজা হয়ে গুছিয়ে বসে ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করছে।

অনেকক্ষণ ধরেই তো সোজা হয়ে বসে আছে, লাল মাফলারের আসতে এতো দেরি হচ্ছে কেন? সে তো এসেই পড়েছিলো। যখন লাভলী নিশ্চিত যে ছেলেটা আসছে না ঠিক তখুনি পিছন থেকে, একেবারে বলা যায় ওর ঘাড়ের ওপর থেকে আলতো খুক খুক আওয়াজ শুনতে পেলো। ও তাও চলৎশক্তিহীন হয়ে বসে রইলো। এবার আরও একটু জোরে গলা খাকারি দেয় লাল মাফলার। লাল মাফলারই তো, পিছন ফিরে এখন যদি ও অন্য কাউকে দেখে!

– আমাকে কিছু বলবেন?

( — বাহ! আনাড়ি হিসাবে শুরুটা খারাপ হয় নাই, আপুমনি।)

প্রশ্নটা শুনে লাল মাফলারের কাশির দমক বেড়ে গেলো। প্রচণ্ড বেগে কাশতে শুরু করেছে। নিজেকে সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে সে। শীতের নরম রোদে তার ফাটা ঠোঁট চোখে পড়লো লাভলীর। কোনো রকমে থুতু ফেলে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকালো ছেলেটা — কেমন আড়ষ্ট হয়ে এতোটুকুন হয়ে গেছে। সেই মুহূর্ত থেকে লাভলীর পুরো ব্যাপারটা ভালো লাগতে শুরু করলো। একটু আগের অস্বস্তি, ভয় আর অসহায়তা কোথায় উবে গেছে। চট করে উপর আর নিচের ঠোঁট জোড়া চেটে নিলো।

( — কথা বলেন না কেন, আপনের দিকে তাকায়ে খাবি খাইতেছে দেখেন না?)

– আপনে আমাকে কিছু বলবেন?

– না, মানে আপনি একা দেখে কথা বলতে আসলাম।

একটা বাক্য বলতে গিয়ে লাল মাফলারের ঘাম বের হয়ে গেছে। সে যত্ন করে প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল আর ঘাড় মুছলো। রুমালটা ধবধবে সাদা। এমন সাদা যে রোদের নরম আলোতেও জ্বলে উঠেছে।

ইশ, এতো পরিষ্কার রুমালটা বরবাদ হয়ে গেলো, মনে মনে ভাবছে লাভলী। লোকটার সাথে কথা বলার জন্য আর কতোক্ষণ ঘাড় ঘুরিয়ে রাখবে বুঝতে পারছে না। এরই মধ্যে ঘাড়ে চিন চিন ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। লাভলী দেখলো পাশের বেঞ্চির মাথা-কান মালিশ করানো লোকটা কৌতূহলের চোটে বেঞ্চ থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছে। ধ্যাৎ, আর কাঁহাতক ঘুরে থাকা যায়, লাল মাফলারের কথা বলতে ইচ্ছা হলে সামনে এসে দাঁড়াবে। লাভলী আস্তে ধীরে আবার সোজা হয়ে বসলো। ছেলেটা আবারও বার দুয়েক খুক খুক করে থেমে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ আর কোনো শব্দ শোনা যায় না, ছেলেটা আছে না চলে গেছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎই একটা ভারি নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ টের পেলো পিছনে, আর সাথে সাথে লাভলীর ভিতর থেকেও একটা গভীর শ্বাস বেরিয়ে এলো কোনো রকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া।

লাল মাফলার শব্দহীন ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে বসেছিলো লাভলী, ছেলেটার জুতাজোড়া নজরে এলো, ঝট করে মাথা তুললো আর চোখাচোখি হয়ে গেলো ছেলেটার সঙ্গে।

( — এতক্ষণে চার চোখের মিলন হলো! আমার ধৈর্য টৈর্য সব যাইতে বসছিলো।)

– চুপ করবা?

– আমাকে বলছেন?

একটু থমকে যায় লাভলী, তারপর খুব সহজভাবে বললো, “না, আপনাকে না।”

এই অপ্রত্যাশিত আর অদ্ভুত আলাপচারিতার পর দু’জনেই চুপ হয়ে যায়। লাল মাফলার আবারও আশপাশটা দেখে নেয়। তাকে চুপ করতে বলে নাই তাহলে কাকে বললো। দ্বিধায় পড়ে যায় ছেলেটা। লাভলীর অস্বস্তি বোধ হওয়া আবার ফিরে আসে। এটা সে কী করলো, মাথার ভিতরের লোকটার সাথে কথা বললো, একেবারে অপরিচিত এই ছেলেটার সামনে? এখন যদি ছেলেটা ভাবে ওর মাথায় গণ্ডগোল আছে। দেখতে খারাপ! আবার মাথাও খারাপ!! এই দুই জিনিস এক সাথে থাকলে সেই মানুষের সাথে কে কথা বলে! এখন যদি ছেলেটা বাপ বাপ বলে পালায় তাকে কি আর দোষ দেয়া যাবে?

– আমার মাথার ভিতরে একটা লোক আছে খুব যন্ত্রণা করে, তার সাথে মাঝে মধ্যে কথা বলি। আপনে কিছু মনে কইরেন না।

লাভলীর কথায় ছেলেটা লাজুক হাসলো, যেন মাথার ভিতরের লোকের ব্যাপারটা সে বুঝে ফেলেছে। কী একটু ভাবলো, তারপর সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে বেঞ্চের যে কোনায় লাভলী বসেছে তার অন্য কোনায় জড়োসরো হয়ে বসলো। লাভলী আর ছেলেটার মাঝখানে নির্জন বেঞ্চ আর বাদামের ঠোঙ্গা পড়ে থাকে।

আচ্ছা, ওর হচ্ছেটা কী আজকে? মাথার ভিতরের লোকটার কথা ও বিউটিকেও বলে নাই। একবারেই যে বলে নাই তা অবশ্য সত্যি না। বলেছিলো মনে হয়, কিন্তু বিউটি কোনো আগ্রহ দেখায় নাই। লোকটা কে, কেন, কীভাবে মাথার ভিতরে ঢুকলো এইসব কিছুই সে জানতে চায় নাই। জানতে চাইলেও লাভ হতো না, কারণ ও-ই জানে না — অন্যদের জানাবে কীভাবে।

যদিও লাভলীর সময়টা স্পষ্ট মনে আছে, রাত সাড়ে চারটা, অ্যালার্ম ঘড়িটা ক্রিং ক্রিং করে বিরামহীন ডেকে যাচ্ছে শান্ত দুপুরের ভিক্ষুকের মতো। এখনি ফরিদা খানমও দরজায় কিল দিতে শুরু করবেন, যখন ঘুমজড়ানো চেতনার সঙ্গে ও বলছে, সেহরি খাওয়ার জন্য উঠতে হবে, ঠিক তখন মাথার ভিতর থেকে লোকটা প্রথম কথা বললো, “আপুমনি, এতো রোজা রেখে লাভ কী, মটকা মেরে পড়ে থাকেন।”
কী ভীষণ ধড়ফড় করে উঠেছিলো ও; গায়ের প্রতিটা রোমকূপের খবর হয়ে গেছিলো। সেদিন তো বুঝতেই পারে নাই কথাটা কে বললো। ধরেই নিয়েছিলো স্বপ্ন দেখেছে। হ্যাঁ, স্বপ্নই হবে! লোকটার অস্তিত্ব মাথার ভিতরে নিশ্চিত করে টের পেলো রিয়াজের বিয়ের ঠিক একমাস দশ দিন পরে, আজ থেকে নয় বছর আগে।

– লোকটা কি সব সময়ই কথা বলে?

ছেলেটার প্রশ্নে অপ্রস্তুত বোধ করলো লাভলী। হঠাৎ কেমন গুটিয়ে গেলো। পুরো ব্যাপারটাই খুব খাপছাড়া ঠেকছে, যেন ওর জীবনে এইসব ঘটছে না আদৌ। এই যে দুপুর বেলা পার্কে বসে থাকা, বাদাম খাওয়া, পাতা ঝরার টুপটাপ শব্দ, শুকনো পথের চিহ্ন, টুকরো টাকরা কথা আর হাসির অস্পষ্ট ঝিলিক, এই যে এক হাত দূরে একটা সম্পূর্ণ অচেনা ছেলের বসে থাকা। নিজের অজান্তেই লাভলী নিজেকে চিমটি কেটে আনমনে উফ্ করে ওঠে।

( — আপুমনি, আপনের ব্যাপারটা আমি বুঝতেছি না, একজন ভদ্রলোক ভালো মনে আপনের পাশে এসে বসছেন, দুইটা সুখ-দুঃখের কথা বলবেন, আর আপনে ডুব মারছেন ফালতু চিন্তায়।)

– লোকটা কি এখন আপনের সাথে কথা বলছে?

লাল মাফলার তো সাংঘাতিক!

– না, না কেউ আমার সাথে কথা বলতেছে না, আমি এমনি বলছিলাম। আপনে নাকি পানিওয়ালা মেয়েটারে বলছেন, আমাকে কী বলবেন…। কী বলবেন?

– কিছু বলবো না, দূর থেকে দেখলাম আপনে হেঁটে এই বেঞ্চে এসে বসলেন। অন্য কোনোদিকে তাকালেন না। যেন এই বেঞ্চে এসেই আপনি সব সময় বসেন। আমি ভাবলাম আমি যে কারণে আসছি আপনি সেই।

– আপনে কী কারণে আসছেন? — আর আমি কে?

একটু থেমে লাভলী প্রশ্নটা শেষ করে আর তাতেই ছেলেটা কুঁকড়ে যায়। লাল মাফলারের চেহারা সাদা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এবার সে সত্যি সত্যি পালাতে পারলে বাঁচে। মাথা নিচু করে চোরের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এখন যদি সাট করে সরে পড়ে আশ্চর্য হবে না ও।

মাথার ভিতরের লোকটা সশব্দ হাসিতে ফেটে পড়ে। অপ্রত্যাশিত এই হাসির শব্দে কাপ থেকে চা ছলকে পড়ার মতো লাভলী বেঞ্চি থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো। ও নিশ্চিত হাসির শব্দটা ছেলেটা শুনেছে। কারণ হাসি শুরু হতেই সে চমকে লাভলীর দিকে তাকালো, তারপর আবার মাথা নিচু করে ফেললো। এই জীবনে আর মাথা তুলবে বলে মনে হচ্ছে না। আর তক্ষুনি লাল মাফলারের জন্য খুব মায়া লাগলো ওর। এই মায়ার সাথে ওর ভালোই পরিচয় আছে। আর সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই ওর ভয় করলো, কারণ এই মায়া সর্বনাশ করে ছাড়ে। লাল মাফলারকে এখন আরও অল্প বয়সী লাগছে। জড়তায় তার ঠোঁটজোড়া পর্যন্ত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

(– আপুমনি, ধরা খাইছে, দেখেন না কেমন কাহিল অবস্থা।)

– আপনে যা বলতে চান বলতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।

– না, মানে আমার বিরাট ভুল হয়েছে, আমি সরি। আমার এখন উঠে চলে যাওয়া উচিৎ… আপনি আজকের কথা মনে রাখবেন না প্লিজ।

– কী ভুল হইছে, কোন কথা মনে রাখবো না?

(– আরে বললাম না আপুমনি, ধরা খাইছে, কঠিন ধরা।)

বেশ জোরের সাথে এদিক ওদিক মাথা ঝাঁকালো লাভলী। যেন প্রবল ঝাঁকি দিয়ে মাথা থেকে লোকটাকে ফেলে দিতে চায়। “আর একটা কথাও না…!”

– আপনাকে বললে আপনি কষ্ট পাবেন, আমি যাই। ছেলেটা সটান উঠে দাঁড়ালো আর লম্বা লম্বা পা ফেলে উল্টোমুখী হাঁটা শুরু করলো। উঠে দাঁড়ানোর তাড়ায় লাল মাফলারটা ঘাড় থেকে চকিতে পড়ে গেলো। সাথে সাথে লাভলীর ভিতরে হাহাকার ছড়িয়ে পড়লো। বেঞ্চি থেকে পড়ি কী মরি নেমে লাল মাফলারটা হাতে নিলো।… কী নরোম আর আরাম!

( — এতো ভাবতেছেন কী আপুমনি, ডাক দেন, ডাক দেন…।)

মাথার ভিতরের লোকটার গলাও অদ্ভুত মরিয়া শোনালো।

– এই যে শুনেন… আপনের মাফলার।

ছেলেটা ঘুরে দাঁড়ালো, লাভলীও দাঁড়িয়ে — হাতের মুঠোয় লাল মাফলার, গায়ে জড়ানো শাল খসে পড়েছে — দুই বেণী আর কামিজের লম্বা ঝুল ওকে আরো মাটির কাছাকাছি এনে দিলো, চোখের হাহাকার দৃষ্টি কি ধরা পড়লো, নইলে ছেলেটা এতো সহজ ভঙ্গিতে ফিরে এলো কেন? নাকি, ছেলেটা জানতো পিছন থেকে সমস্ত প্রত্যাশা নিয়ে এইভাবে তাকে ডাকা হবে, সেজন্যই কি সে ইচ্ছা করে উঠে দাঁড়াবার সময় লাল মাফলার পথে ফেলে দিলো? কে জানে? এই প্রশ্নের জবাব কোনোদিন পাওয়া যাবে না।

লাভলী শক্ত মুঠিতে লাল মাফলার ধরে রইলো। কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। হাবে-ভাবে তাই মনে হয়। ছেলেটা এগিয়ে এসে লাভলীকে পিছনে ফেলে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো। লাভলী বোকার মতো লাল মাফলার হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। এক সময় ও ধীরে এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চির কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। বসবে কি বসবে না মনস্থির করতে পারছে না। হঠাৎই শীতের দমকা হাওয়া ওকে আমূল নাড়িয়ে দিলো। নিজেকে এতো পলকা আর কখনও লাগে নাই। চকিতে বেঞ্চিটা ধরে ফেললো। একটা ঝাল মুড়িওয়ালা আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। সে এসে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই লাল মাফলার চোখ বাঁকিয়ে চলে যেতে ইঙ্গিত করলো। ঝালমুড়িওয়ালা কোনো কথা খরচ না করে ওদের সামনে থেকে দ্রুত সরে পড়লো। লাভলীর কেন যেন মনে হলো ঝালমুড়িওয়ালা লাল মাফলারকে ভয় পায়।

– বসেন।

– বাসায় যাবো।

– আপনার বাসা কোথায়?

– আমার বাসা…

– থাক্, বলার দরকার নাই।

লাভলী বেঞ্চিতে বসে পড়লো আর লাল মাফলারটা বেঞ্চির মাঝখানে রাখলো। এই কাপড়ের টুকরাটাই ওদের দু’জনের মাঝখানে যতি চিহ্ন হয়ে পড়ে রইলো। নিজের অজান্তেই লাভলী মাথা নিচু করে ভাবতে থাকে ও কেন বসলো, কী কথা বলবে, এই ছেলে ওর কাছে কী চায়, রমনা পার্কের দীঘিটা ঘিরে এই ছেলের হাত ধরে হাঁটলে কেমন লাগবে…। এত অল্প সময়ের মধ্যে তাও ভেবে ফেললো।

ফিরে আসার পর লাল মাফলারকে আর চেনা যাচ্ছে না। তার আগের জড়তা, ঠোঁট কাঁপাকাঁপি, লাজুক চাউনি এইসবের কিচ্ছু অবশিষ্ট নাই। এত দ্রুত কোনো মানুষ পাল্টে যেতে পারে? নাকি আগের হাব-ভাবই ভান ছিলো, সবই কোনো জটিল নাটকের অভিনয়কৌশল। লাল মাফলারটাকে খুব সহজে হাতে তুলে নিলো ছেলেটা আর এলোমেলো ভাঁজ করে কোলের উপর রাখলো। তারপর বেমক্কা একটা প্রশ্ন করলো যার জন্য লাভলী মোটেই তৈরি ছিলো না, এমনকি মাথার ভিতরের লোকটা পর্যন্ত না।

– আপনি কি আমার সাথে যাবেন?

– হ্যাঁ?

( — খাইছে!)

– আমার সাথে যাবেন, আমার ফ্ল্যাটে? — আমি একাই থাকি।

লাল মাফলারের বলার ধরনে এরকম অদ্ভুত প্রস্তাবও লাভলীর কাছে খুবই স্বাভাবিক শোনালো। যেন হরহামেশাই অচেনা মানুষজন ওকে তাদের বাসায় যেতে বলে আর এর মধ্যে বিন্দুমাত্র অপমানিত বা অস্বস্তি বোধ করার মতো কিছু নাই।

– আমাকে দুইটার মধ্যে বাসায় পৌঁছাতে হবে।

লাভলীর জবাবে ছেলেটা হেসে ফেললো, হাসির শব্দ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো বাতাস চিরে যায়। দূরে কারা যেন এই শীতের রোদে বাচ্চাদের সাথে করে পার্কে নিয়ে এসেছে। বাচ্চাদের হৈ চৈ-এর টুকরা-টাকরা গড়িয়ে চলে এলো ওদের কাছে। পৃথিবী আমূল বদলে গেলো। এ জগত ওর ভীষণই আটপৌরে, সিদাসাদা মনে হলো। ছেলেটার হাসিতে লাভলীর সঙ্কোচ কেটে যায়।

“দুইটার বেশি দেরি হলে আম্মা রাগ হবেন।” অল্প বয়সী মেয়ের গলায় ও কথাটা বলে।

– দু’টা তো অনেক আগে বেজে গেছে। এখন প্রায় আড়াইটা বাজে। আপনার আম্মা রাগ হলে কী করেন?

– আমাদের ঘরে ঢুকায়ে চাবি লাগায় দেন। অবশ্য আমাদের এখন আর অসুবিধা হয় না। আমাদের দুইজনের ঘরেই টেলিভিশন আছে। আমার চোদ্দ ইঞ্চি।

– আপনাদের দুইজনের মানে?

– আমার আর আমার বোনের।

– কতোক্ষণ চাবি লাগিয়ে রাখেন?

– ঠিক নাই। কখনও দুই তিন ঘণ্টা আবার কুনু সময় এক, দুই দিন। আম্মা চাবি খুলে খাবার দিয়ে যান, গল্পগুজব করেন, আমরা রাত্রে কী খাবো বা দুপুরে কী খাবো জিজ্ঞাসাবাদ করেন, কখনও পাশে বসে নাটক ফাটক দেখেন, তারপর আবার চাবি ঘুরায়ে চলে যান। একসময় আমরা টের পাই ঘর আর লক করা নাই। আমরা ঘর থেকে বার হই, আবার সব ঠিক। আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। আজকে বাসায় গেলে হয়তো চার পাঁচ দিন লক কইরা রাখবেন। লক করলে আম্মা দুই বোনের ঘরই লক করেন। বিউটি কিছু করুক বা আমি কিছু করি, যার কারণেই হোক না কেন দুইজনের ঘরেই চাবি পড়ে। ভালোই হয়, বাসার কাজ থিকা রেহাই পাওয়া যায়। কাপড় ইস্তারি করতে হয় না। খাই দাই আর টিভি দেখি। কেউ বাসায় বেড়াইতে আসলে আম্মা আলগোসে আমাদের দরজা খুইলা দেন। আমরা স্বাভাবিক ঘোরাফেরা করি আবার চইলা গেলে ঘরে ঢুকে যাই। আমাদের বাসায় বেশি লোকজন আসেও না। তাছাড়া তখন আমরা দুই বোনই খুব রূপচর্চা করি। মাথায় ডিম দেই, মেনদি দেই, কাঁচা হলুদ বাটা হাত পায়ে মুখে মাখি। রঙ পরিষ্কার হয়। আম্মা বুয়াকে দিয়ে এইসব করায়ে দেন। আমি এমনিতে রূপচর্চার ধার ধারি না, ভাল লাগে না, আইলসামি লাগে। কিন্তু ঘর লক থাকলে আমিও করি।

– তাহলে তো আপনার লাভই হয় বলা যায়।

– সেইটা ঠিক। তখন অনেক মজাও হয়। আম্মা আমাদের পছন্দের খাওয়া রান্ধেন। বাইরে থেকে গল্পের বই কিনা আনেন। আমাদের দিন কাটে আনন্দে।

সম্পূর্ণ একজন অচেনা মানুষের কাছে এক নিঃশ্বাসে ওদের পারিবারিক গোপন শাস্তিবিধান নির্দ্বিধায় বলে আশ্চর্য শান্তি পেলো লাভলী। এই প্রথম লাল মাফলারকে একটু বিচলিত দেখায়। ওর এতগুলি কথার মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে। কে জানে কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছে, ফিরে আসার সীদ্ধান্তটা ঠিক ছিলো কি না এখন তার সেই চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু লাভলীর বোকা বোকা সরলতায় লাল মাফলার প্রবল আকৃষ্ট বোধ করছে। বাসায় নিয়ে যাওয়ার চিন্তা তাকে পেয়ে বসলো।

– আপনারা কখনও তালা ভাঙতে চেষ্টা করেন নাই?

– ক্যান, তালা ভাঙবো ক্যান? আম্মা তো আমাদেরকে কখনও বিনা কারণে তালা মারেন না। আমরা এখন আর মাইন্ড করি না।

তারপর লাভলীকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় ওর কিছু একটা মনে পড়ে গেছে। মনে পড়ায় লজ্জাও পায়। নিজের অজান্তেই জিহ্বায় কামড় দেয়। লাল মাফলার ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো, এই কিসিমের মহিলা সে আগে কখনও দেখে নাই।

– কী চিন্তা করেন?

– না কিছু না…।

– আপনার আব্বা আছেন?

– হ্যাঁ, আব্বার শরীর বেশি ভালো না।

– আপনার আম্মা যে আপনাদের তালা দিয়ে রাখেন, তিনি কিছু বলেন না?

– এইটা আপনে কী বললেন? আম্মা তো আমাদেরকে তালা দিয়া রাখেন না। যখন আমরা কিছু উল্টাপাল্টা করি তখন আর উপায় কী। এই যেমন আজকে, আমার দুইটার সময় বাসায় যাওয়ার কথা, যাবো কখন আল্লায় মালুম। তাইলে আপনেই বলেন আম্মা আমাদেরকে তালা দিবেন না তো কী করবেন, কোলে নিয়া বইসা থাকবেন? আব্বাকে তো আম্মা তাই বলেন, তালা দিবো না তো কী করবো, কোলে নিয়া বইসা থাকবো?

– একটু আগে কী চিন্তা করছিলেন?

– যখন আমাদের ঘর তিন চার দিন তালা মারা থাকে, তখন আমরা এক বোন আরেক বোনের কাছে বেড়াইতে যাই। আমাদের খুব মজা হয়।

– বেড়াতে যান মানে? আপনারা এক বাসায় থাকেন না?

– হ্যাঁ থাকি, কিন্তু দুইজনের রুম তো দুইটা। আমি আম্মাকে ডেকে বলি যে আমি বিউটির বাসায় বেড়াইতে যাইতে চাই। আপনাকে বলা হয় নাই, বিউটি আমার বোনের নাম। আম্মা তখন দরজার কাছে এসে আমাকে রেডি হইতে বলেন। আমি রেডি হই। তারপর আম্মাকে বলি যে আমি রেডি। তখন আম্মা দরজা খুলে দেন, আমি আর আম্মা বিউটির ঘরে যাই। কখনও আমি আম্মা দুইজনে, কখনও আমি একা।

– বিউটির বাসায় মানে ঘরে গিয়ে কী করেন?

– প্ল্যান করি, প্ল্যানটা আপনেরে বলা যাবে না। ওইটা আমার আর বিউটির একটা খেলা; তবে আম্মা যদি সাথে যায়, তাইলে এমনি এইটা সেইটা গল্প করি। অন্যদেরকে নিয়া হাসাহাসি করি। বিউটি অনেক খাতিরযত্ন করে। চা খাওয়ায়, নাস্তা। আমার বাসায় আসলে আমিও আদর করি।

– নাস্তা দেয় কীভাবে, ঘর তালা দেয়া না?

– আম্মা নিয়া আসেন, বিউটি আমাদের বেড়ে টেড়ে দেয়। খুব ভালো লাগে। এইটাও আমাদের একটা খেলা। আম্মা খেলাটায় খুব মজা পান, এইটা খেলতে কখনও মানা করেন না।

– আপনার আব্বা খেলেন না?

– না, না… এইটা হচ্ছে মেয়েদের খেলা। আব্বা খেলেন না। আব্বার শরীর ভালো না।

– চলেন আমার বাসায়। আমিও আপনার সাথে খেলাটা খেলতে চাই।

মাথার ভিতরের লোকটা আশ্চর্য রকম চুপ করে আছে। টু শব্দ পর্যন্ত করছে না। ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গেছে কি না কে বলতে পারে? এবার সে একটু নড়েচড়ে বসলো।

( — আপুমনি, লোকটার বাসায় চলেন যাই, খাতির টাতির করবে মনে হয়।)

লোকটার কথায় প্রবল আপত্তি জানায় লাভলী, নিজের অজান্তে শিউরে ওঠে।

– না, না আম্মা জানলে জানে মেরে ফেলবেন।

( — আম্মা জানবেনটা কেমনে, আরে… আজকে এসপার ওসপার এমনিই হবে। হবেই যখন ভালো মতোই হোক।)

লোকটার কথার জবাব দিতে গিয়েও চুপ মেরে যা‍য় ও, লাল মাফলার ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস নিয়ে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে। অথচ আধ ঘণ্টা আগে এই ছেলেটাকেই লাভলীর মনে হচ্ছিলো ভীরু ভীরু গোবেচারা টাইপের, যেন ভাজা মাছও উল্টে খেতে জানে না। এখন কেমন চোখে মুখে চালিয়াতি খেলে বেড়াচ্ছে। ভান, সবই ভান।

লাভলী লোকটার কথার উত্তর দিবে, না লাল মাফলারের সাথে রওয়ানা হবে বুঝে উঠতে পারছে না। ছেলেটার পিছে পিছে ওর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে এটা ঠিক। যেকোনো কোথাও। একেবারে কোথাও যদি নাই যাওয়া যায়, — তাহলে অন্তত সামনের দীঘীটার পাড় ঘেঁষে হাঁটতে পারে দু’জনে। ক্ষতি কী!

– আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনারা দু’জন আগে কথা শেষ করেন, আমার কোনো তাড়াহুড়া নাই।

– আমি কারও সাথে কথা বলতেছি না।

– আপনার মাথার ভিতরের লোকটার নাম কী?

– নাম নাই।

– নাম নাই?

– নাম নাই।

– আপনি একটা নাম দিয়ে দেন।

– আমার মাথার ভিতরে কেউ নাই।

লাভলীর চোখে পানি চলে এলো। কোথা থেকে, কেন তার হদিস ওর জানা নাই। ওর মনে হলো লাল মাফলার ওর সাথে ইয়ার্কি মারছে। পাগলের পিছনে বাচ্চারা যেভাবে পাগলি পাগলি বলে দৌড়ায় সেই একই নিষ্ঠুরতায়। বাচ্চারা যদিও টের পায় না কতোটা নিষ্ঠুর তারা হচ্ছে, কিন্তু লাল মাফলার কি পায়?

– আচ্ছা, আমি গিয়ে দু’টা সিগারেট নিয়ে আসি। আপনারা এর মধ্যে ঠিক করেন আমার সাথে যাবেন কি না? কোনো জোর জবরদস্তি নাই। খুশি মনে যাওয়া।

ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো আর সঙ্গে সঙ্গে লাভলী নিশ্চিত হয়ে যায় সে আর ফিরে আসছে না। প্রবল ইচ্ছা হয় বলতে, ‘হ্যাঁ যাবো। আমার কারও সাথে কথা বলে ঠিক করার দরকার নাই। আমি যাবো।’ কিন্তু অনিবার্যভাবেই বলা হয় না। লাভলীর ইচ্ছা কবে আর ডালপালা মেলেছে।

লাল মাফলার লম্বা লম্বা পা ফেলে রমনা অরণ্য পেরিয়ে গেলো। মাথার ভিতরের লোকটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে উশখুশ করছে কথা বলার জন্য, এবার আর না বলে পারলো না।

( — এরকম সুযোগ আর পাবেন না আপুমনি। হাত দিয়া আর কতো দিন? চলেন যাই, কী হবে? এই লোক খুন জখম করার লোক না।)

– কেমনে জানো?

( — জানি আপুমনি, যাওয়ার জন্য আপনে ছটফট করছেন। ভালোবাসা কী তা তো জানলেনই না। একটা সুযোগ যখন আসছে, মন দিয়ে, শরীর দিয়ে জানেন।)

– ভালোবাসা কী আমি জানি না, এইটা কী বললা তুমি? আমার এখনও পরান পুড়ে।

( — সরি আপুমনি, সরি। ভুল হইছে। অবশ্যই জানেন, কিন্তু শরীরের ভালোবাসা? সেও কিছুটা জানেন যদিও — কিন্তু একটা আস্তো জীবন কাটায় দিয়ে একদিন মরেও যাবেন — অথচ আসল শরীরী ভালোবাসা কী জিনিস তা জানবেন না। এইটা কিছু হইলো? মনে করেন, উপরওয়ালাই আপনাকে সুযোগ করে দিছে।)

– তওবা তওবা, না না — আমি কখনও এই কাজ করতে পারবো না। তোমার কথায় পইড়া অনেক বেশরমের কাজ করছি। আম্মা…।

( — আরে থোন ফালায়ে আম্মা। এইখানে আম্মার ধার কে ধারে! আমার কথায় পড়ে অনেক বেশরমের কাজ করছেন, — এই কথা কি ঠিক বললেন? রসময় গুপ্ত কি আমি এনে দিছি? আমি শুধু বলছি হাত কাজে লাগান। তবে আপুমনি দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মিটে? সেই জন্যই বলতেছি চলেন…।)

– আমি সব সময়ই জানতাম তোমার সাথে কথা বলা আমার ঠিক না, বিপদ হবে একদিন, মস্ত বিপদ।

( — তাহলে এইখানে সময় নষ্ট করে লাভ কী, বাসায় চলেন। আজকে এমনিতেও আম্মা আপনাকে কিছুই জিজ্ঞেস করবেন না। কোরবানীর গরুর মতো ভালো মতন খাওয়ায় দাওয়ায় রুমে পাঠায় দিবেন আর আলগোছে দরজা লক করে দিবেন। তখন না হয় আস্তে ধীরে দুইজনে যুক্তি করে ঠিক করবো নে কী বলা যায়।)

– আচ্ছা, তোমার নাম কী? উনি জিজ্ঞেস করতেছিলেন।

( — উনিটা কে?… ও আচ্ছা, ব‍‍লেন নাম নাই।)

– আমিও তাই বলছি। — চল্লিশ বছর বয়স হলো আমার আজকে। চল্লিশ বছর! চিন্তা করতে পারো।… তুমি ঠিকই বলছো আমি যাবো তার সাথে। তার হাত ধরে বলবো আমারে নিয়ে যান। শুধু একবার আমি জানতে চাই কেমন লাগে?

( — আমিও। তবে হাতও মন্দ না। মনে পড়ে আপুমনি প্রথম দিনের কথা? আপনে, বিছানা, ঘর — সব থরথর করে কাঁপলো।)

হ্যাঁ, মনে পড়লো লাভলীর, সমস্তই মনে পড়লো। সঙ্কোচে লজ্জায় না কি শরীরী আনন্দে মুখ লাল হলো! লালে লাল দুনিয়া! আম্মাগো লাল তেরি লাল কেয়া খুনিয়া!

দুপুর তিনটার দিকে রিয়াজ সেদিন লাভলীদের বাসায় এসে উপস্থিত। রিয়াজ বাসায় আসলে ফরিদা খানম আর আগের মতো ততোটা খুশি হন না। শুকনা গলায় জানতে চাইলেন, দুপুরে খেয়ে এসেছে কিনা। রিয়াজ জানালো সে খেয়ে এসেছে। ফরিদা খানম তার চাইতেও শুকনা গলায় জানতে চাইলেন তাহলে আসার কারণ কী। রিয়াজ গোবেচারা মুখ করে বললো লাভলী আর বিউটির জন্য সে নোটস নিয়ে এসেছে। লাভলী আর বিউটি তখন প্রাইভেটে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওদের গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়ার একটা কলেজে নামমাত্র ভর্তি হয়ে আছে ওরা দুইজন। পরীক্ষার সময় শুধু গ্রামে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতে হবে। ফরিদা খানম নোটস দেখতে চাইলেন, রিয়াজ ঝোলা থেকে ভূগোল সেকেন্ড পেপারের নোটস বের করে দিলো। নোটস দেখে ফরিদা খানমের মুখে এঁটে বসা কঠিন রেখাগুলো আলগা হতে শুরু করলো এবং এক সময় মিলিয়ে গেলো। একটু আগের কঠিন ব্যবহারের জন্য তাকে একটু সঙ্কুচিতও মনে হলো। ঘরে পাতা দই নিজের হাতে এনে রিয়াজের হাতে দিলেন।

– নোট ফোট দিয়া লাভ নাই। পড়াশুনা এগুলার হবে না। বেহুদাই কষ্ট।

সেদিন নোটের সাথে জীবনের প্রথম লাভলীর হাতে এলো ২টা রসময় গুপ্ত। শরীরী আঁকিবুঁকির খুঁটিনাটি গোগ্রাসে গিললো। পড়তে পড়তে নিজের শরীর একেবারেই নিজের বশে ছিলো না। এই বই যক্ষের ধনের মতো কোথায় যে লুকাবে ও তার কুল কিনারা করতে পারছিলো না। রক্তে আগুন ধরে যাওয়া এমন বৈকল্য আর না জানা আবেশ কিছুতেই একা একা ভোগ করতে লাভলীর ইচ্ছা করলো না। কিন্তু ও বড় বোন হয়ে ছোট বোনের হাতে এই বই কীভাবে তুলে দেবে? আবার এটাও মনে হলো বই দু’টা লুকিয়ে রাখার একটা ব্যবস্থা বিউটি অবশ্যই করতে পারবে। রিয়াজের কাজ গুছানো, বইগুলা ছিলো নোট বইয়ের মলাটে ঢাকা।

ফরিদা খানম যখন গোসল করতে গেলেন, লাভলী বিউটির ঘরে উঁকি দিলো, বিউটি গভীর মনোযোগে রিমুভার দিয়ে নেল পলিশ তুলছে। বই দু’টা ও বিউটির সামনে টেবিলের উপর রাখলো।

– আমি তো বলে দিছি আমি পরীক্ষা দিবো না। নোট বইসহ ঘর থিকা বিদায় হও। আপা, আম্মারে বলছি আমারে একটা ভিসিআর কিনা দিতে, আম্মা রাজি হইছেন। তবে পরীক্ষার পরে।

– তোরে কিনা দিবে মানে?

– আমারে কিনা দিবে মানে আমারে কিনা দিবে, আমার ঘরে থাকবে ভিসিআর। তোমরা যখন খুশি আমার ঘরে সিনেমা দেখতে পারবা।

– আমার ঘরে থাকবে না কেন?

– তোমার ঘরে থাকবে না কারণ ভিসিআর কিনার বুদ্ধি তোমার না আমার। তোমার ঘরে থাকার আরেকটা অসুবিধা আছে…।

– কী অসুবিধা?

– মাসের তিরিশটা দিনের মধ্যে বত্রিশটা দিনই তো তুমি মাথাব্যথায় ঘর অন্ধকার কইরা পইড়া থাকো। তখন আমাদের হবে বিপদ, লেটেস্ট হিন্দি সিনেমা দেখা আসমানে উঠবে, তার বদলে দেখতে হবে চিৎ কুমারী।

– আমি চাইও না আমার ঘরে… আচ্ছা, তুই যা চাস আম্মা তাই কেন তোরে কিনা দেন?

– আম্মা আমারে ভয় পান। আমি যখন ঘাড় গোঁজ কইরা তর্ক করতে থাকি তখন আমারে ডরান।

– তোর এত বুকের পাটা কোত্থিকা হইলো?

– বুকের পাটা আবার কী, এইটা সহজ হিসাব… আমি তার কথা শুনবো আমার আরাম আয়েস তিনি দেখবেন।… ডরে তুমি চিকা হয়ে থাকো কেন আপা? ঘরের ভিতরে আমরা খুশিমতো চলবো, বুঝলা…।

– বুঝলাম।

বললো বটে তবে লাভলী আসলেই ঘরের ভিতরে এতটুকু হয়ে থাকে। ফরিদার সাথে তর্ক করা তো দূরের কথা দ্বিমত পোষণ করার মতো সাহসও ওর নাই।

বইগুলি টেবিলের উপর পড়ে রইলো, লাভলী ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিউটি টেবিলের সামনের চেয়ারটায় এক পা তুলে বসেছে আর ঘাড় গুঁজে নেলপলিশ তুলছে। ঘাড় গুঁজেই সে বিস্তর কথা অনেকটা আপন মনে বলে গেলো। লাভলী বেরিয়ে যাবার জন্য পিছন ফিরতেই সে আবারো মাথা না তুলে বললো, “নোট বই দুইটা নিয়া যাও আপা। বললাম না আমার লাগবে না।”

– এই দুইটা নোট বই না।

ঘাড় না তুলে চট করে শুধু চোখের পাতা উপরে তুলে তাকালো বিউটি কিন্তু কোনো কথা বললো না। পরেও রসময় গুপ্ত লাভলী কোথায় পেয়েছে, কে দিয়েছে কখনও জানতে চায় নাই। অবশ্য বই দুটা সে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সেটা বলেছে। একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে জানালার উপরের কার্নিশে রেখেছে। বইয়ের সাথে ভারি একটা ইটও ঢুকিয়ে দিয়েছে যাতে তুফানের সময়ও পড়ে না যায়। ইট যোগাড় করেছে কাজের ছেলে হারুণ আর জানালার কার্নিশের উপর রাখার দায়িত্বটাও তারই ছিলো। বিউটির কাজ সব সময়ই পাকা।

মনস্থির করে অপেক্ষা করছে লাভলী আর সেই ফাঁকে নানান ভাবনা মাছির মতো ভনভন করছে মাথার ভিতরে। সময় থেমে গেছে। কোথাও টু শব্দ নাই, এমনকি এই শীতের অপরাহ্নে পাতা ঝরার টুপটাপও না। পাশের বেঞ্চির মাথা-মালিশওয়ালা লোকটা কখন চলে গেছে, যাকে মালিশ করা হচ্ছিলো সে এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। দুপুরের নিস্তব্ধতা মৃত্যুর মতো ছেঁকে ধরলো লাভলীকে। ওর মনে হলো এই সব শেষ, আর কোনোদিন কোনো ভালোবাসার চাউনি ওর শরীরকে স্পর্শ করবে না। ওর প্রতিটা রোমকূপ হাহাকার করে উঠলো। ওর ঘুমন্ত অনুভূতি ঘাই হরিণীর মতো প্রচণ্ড বিক্রমে ওর পাঁজর এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেললো। লাভলী পাঁজরভর্তি হতাশা আর ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

অরণ্য ভেদ করে লাল মাফলার হাওয়ায় দুলছে। দুলুনি আস্তে ধীরে বড় হচ্ছে… ছেলেটাকে দূর থেকে খুব শুকনা দেখালো, যেন হাওয়ায় ভাসছে, ভাসতে ভাসতে আসছে। ফিরে তাহলে আসছে, জীবনে এই প্রথম লাভলীর নিজেকে নারী মনে হলো। একটা মেয়ের অমোঘ আকষর্ণে একটা ছেলেকে ফিরতেই হবে — এই জাতীয় ভাবের উদয় হলো মনে; ওর মন তো ঠিক করাই আছে। ও যাচ্ছে ছেলেটার সঙ্গে....

================================
লীসা গাজী
লেখক, অভিনেত্রী, নির্দেশক
leesa@morphium.co.uk

বই
সোনাঝরা দিন(তাহমিমা আনাম-এর বই A Golden Age-এর অনুবাদ
=======================

bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ লীসা গাজী

অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ

No comments

Powered by Blogger.