উপন্যাস- 'রৌরব' (পর্ব-দুই) by লীসা গাজী

(পর্ব-দুই)
কী ঘটতে পারে তা আগাম চিন্তা করে লাভলির চোখ মুখ রক্তিম হয়ে যাচ্ছে, মানে ওর ময়লা রঙের পক্ষে যতোটা রক্তিম হওয়া সম্ভব ততোটাই। এই চল্লিশ বছরেও ওর ময়লা রঙের কিচ্ছা শেষ হলো না। আম্মা কালকে রাত্রেই বললেন, ওর রঙটা ময়লা বইলা কি ওরে গাঙে ভাসায় দিতে হইবো নাকি! এইসব কথা সবই মুখলেস সাহেবের উদ্দেশ্যে বলা। তারপর গলা নিচু করে আরও এক দুই লাইন যোগ হয় — তোমার কী আসে-যায়, তুমি তো পার করতে পারলেই বাইচ্চা যাও। মেয়েদের জীবন যে কতো রঙের আমার জানা আছে; হাড়ে হাড়ে জানা আছে। যদিও মুখলেস সাহেব ভদ্রলোকের সাত চড়ে রা নাই অবস্থা। তবুও নীরবতা সম্মতির লক্ষণ না ধরে প্রতিবাদের লক্ষণ বলে ধরে নিলেন ফরিদা খানম। তাই মেয়েদের বিয়ে না দেয়ার পিছনে তার নানান যুক্তি তিনি দিনের মধ্যে বত্রিশবার আওড়ে যান। এই আনুষ্ঠানিক কৈফিয়ত জারি অবশ্য মাস খানেক হয় শুরু হয়েছে আর দিনকে দিন তা বাড়ছে। নইলে ফরিদা খানম দেবেন কাউকে কৈফিয়ত — এ কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিলো? তাহলে কি সত্যিই তার শরীরের সাথে সাথে মনও নরম হয়ে আসছে? তার অবর্তমানে মেয়েদের ভয়াবহ পরিণতি কি তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন? আচমকা একটা গানের সুর লাভলির মাথায় চক্কর খেয়ে গেলো, আর সেই মুহূর্তে লাল মাফলার ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। এ নির্ঘাৎ ভবিতব্য, আর কিছু না, নির্ঘাৎ তাই!

‘চলতে চলতে ইঁউহি কয়ি মিল গায়াথা, সারে রাহা চলতে চলতে…’

– পরামর্শ শেষ হলো আপনাদের? চলেন উঠি… সরি… মানে কী ঠিক করলেন… যাবেন আমার সাথে।

(– হ্যাঁ যাবো।)

– হ্যাঁ যাবো।

– বাসায় ফিরতে আপনার রাত হবে…।

– জানি।

লাভলি নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঝোলাটা কাঁধে নিলো আর তখুনি ও বাদামওয়ালাকে দেখে ফেললো। ওর বেঞ্চের ডান পাশের বিশাল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আর ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ পড়তেই ঝটিতে উল্টামুখ হয়ে হাঁটা দিলো। এতক্ষণ বোধহয় ওখানেই দাঁড়িয়েছিলো। বেচারার ব্যবসা আজকে তাহলে আর বিশেষ জমে নাই। বাঙালি মরলোই পরের চরকায় তেল দিতে দিতে!

লাল মাফলার হাঁটছে আগে আগে আর লাভলি পিছে পিছে — আগে চলে দাসি বান্দি পিছে সখিনা! — বড় ভালো লাগছে ওর। এখন যদি ছেলেটা হাঁটাটা একটু ঢিমা করে আর ওর হাতটা ধরে, ও কিচ্ছু মনে করবে না। গানটা পুরো শরীরময় এখন ওঠানামা করছে। ‘চলতে চলতে ইঁউহি কয়ি মিল গায়াথা, সারে রাহা চলতে চলতে…।’ মাথা দু’ ফাঁক করে বুকে নামছে, তারপর পেটে তারপর দু’ পা বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে; আবার মাথায় উঠে আসছে। এ কী যন্ত্রণা!

বছর খানেক হলো মুখলেস সাহেব পুরানো হিন্দি গান শোনা ধরেছেন। এখন লাভলিদের বাসায় সারাক্ষণই শামশাদ বেগম, সুরাইয়া, মোহাম্মদ রফিরা রাজত্ব করছে। পয়লা পয়লা ওদের দুই বোনের অসহ্য লাগতো, আজকাল খুব ভালো লাগে, অপেক্ষা করে থাকে কখন মুখলেস সাহেব নূরজাহান ছাড়বেন বা গীতা দত্ত। কিন্তু তার আছর যে ওর উপর এইভাবে পড়বে সেটা কে জানতো!

– খাবেন কিছু?

হাঁটা থামিয়ে লাল মাফলার জিজ্ঞেস করলো। খাওয়ার কথা শুনেই পেট চোঁ চোঁ করতে থাকে লাভলির। পাঁচ টাকার বাদাম শেষ করেছিলো কি না তাও মনে করতে পারছে না। খিদার জন্যই তাহলে মাথাটা ধরেছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আলতো করে ঠোঁট চেটে নিলো লাভলি।

– না।

গলায় কোনো জোর পাওয়া গেলো না। দৃশ্যটা এরকম, লাল মাফলার আর ও দীঘি ঘেঁষে হাঁটছে। দীঘির পাশ দিয়ে পায়ে চলার পথ, পথের উপর ওরা দু’জন, সামনে লাল মাফলার পিছে লাভলি। ওদের ডান পাশে দীঘি আর বাঁ পাশে বিশাল তরুরাজি। কথাটা বলবার জন্য লাল মাফলার দাঁড়িয়ে পড়লো এবং পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করলো।

– খাবেন কিছু?

ছেলেটার পাঁচ গজ পিছনেই ছিলো লাভলি। অতর্কিত প্রশ্নে ও থমকে দাঁড়ালো।

– না।

সাথে সাথে আশপাশটা ছবির মতো হয়ে গেলো। লাভলির ঠোঁট চাটা লক্ষ্য করে ছেলেটা হেসে ফেললো। অপেক্ষা করছে লাভলির এগিয়ে আসার। এগিয়ে আসবে না টের পেয়ে সেই পায়ে পায়ে ওর কাছে গেলো।

– আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে খুব ক্ষুধার্ত। কী ব্যাপার, আপনার কি খুব শীত করছে?

মোটেও শীত করছে না, ছেলেটা কাছে আসাতেই কুঁকড়ে গেছে ও। শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিলো। চারদিক চোখের কোণা দিয়ে দেখে নিলো। রমনা পার্কে এখন কেউ নাই নাকি? জনমানুষের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে কোথাও। সবাই ভোজবাজির মতন উড়ে গেছে। মনে হলো, এই দুনিয়াছাড়া পার্কটাতে শুধু ওরা দু’জন অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে। দমকা বাতাসে কেঁপে উঠলো লাভলির অন্তরাত্মা। প্রচণ্ড ভয়ে অসাড় হয়ে গেলো, মনে হলো বুঝি কাপড় নষ্ট করে দিবে। আগুপিছু চিন্তা না করে অসাড় শরীরটাকে নিয়ে ও বেদম ছুটতে শুরু করলো। পিছনে তাকাবার সাধ্যও ওর নাই। কিছুক্ষণ ছোটার পর হঠাৎ করে আসা ভয়টা হঠাৎই উবে গেলো, সাথে সাথে ও দরদর করে ঘামতে লাগলো। একটু দূরেই পার্ক থেকে বের হবার বড় গেইটটা চোখে পড়লো — ‘ফি আমানিল্লাহ’ নিঃশব্দে বলে উঠলো ও। এবার বেশ কয়েকজন পার্কবাসী মানুষজনের দেখা পেলো। পিঁপড়ার সারির মতো সাহস ফিরে আসছে। একটা বড় গাছের ছায়ার নিচে লাভলি দাঁড়ালো, দেখতে চায় লাল মাফলার এইদিকে আসে কি না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার জন্য ও মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। ঝোলার ভিতর ছুরিটা থাকা সত্ত্বেও কেন যে এত ভয় পেলো সেটা ভেবে লাভলির এখন নিজেকে বোকা বোকা লাগছে। সাধে কি আম্মা ডাকেন, ‘বেকুবের বেকুব’!

– খুব ভয় পাইছিলাম।

( — আমিও।)

– তুমি ভয় পাও নাকি?

(– আজকে তো পাইলাম।)

– এতো ভয় পাইলাম কেন?

(– আপুমনি, এইখানে দাঁড়ায় আছেন কেন?)

– লাল মাফলার এই পথে যায় কি না দেখি। লাবলিকে খোঁজা দরকার।

( — মানে?)

– আরে, পানি পিপাসা লাগছে।

(– অ… )

– ঐ ওই যে ঐ যে লাল মাফলার। বুদ্ধি দাও, যাব নাকি দাঁড়ায় থাকবো? এমনিতে তো সারাক্ষণ ফড়ফড় করে লেকচার মারতে থাকো। … কী করবো… এখন মনে হয় আমার সাথে কথা বলবে না। কী করবো, চলে যাবো?

( — জানি না আপুমনি, আজকে আমার বুদ্ধির চাইতে আপনারটার ধার বেশি।)

– আশেপাশে অনেক মানুষ, এইখান থেকে রাস্তা দেখা যায়, গাড়ির হর্ন শোনা যায়, গেটের সামনে দুইটা সিএনজি দেখছো? ভয় কীসের?

কথাগুলো মাথার ভিতরের লোকটাকে বললো না নিজেকে বোঝা গেলো না। এর মধ্যে লাল মাফলার বেশ কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে, যদিও এখনও লাভলিকে দেখে নাই। মাথা নিচু করে হাঁটছে। লাভলি আবারও ভিজে গেলো, নিজের গালে নিজের চড় দিতে ইচ্ছা করছে। এটা কী ধরনের তামাশা? ছেলেটার সাথে কথাবার্তা বললো, ছেলেটার বাড়িতে যেতে রাজি হলো, আবার খামাখাই গাধার মতো দৌড় দিলো — ঢঙ আর কী! লাল মাফলার এখন চোখ তুললেই লাভলিকে দেখতে পাবে। যদি না তাকিয়ে ঘুরে যায় তাহলে আর হবে না! লাভলি দোয়া পড়ছে, ‘আল্লাহ দেক, ছেলেটা তাকাক, আল্লাহ দেক ছেলেটা তাকাক’। — এবং তাকালো।

লাল মাফলার অবাক হয়ে লাভলির দিকে তাকিয়েই রইলো। মুহূর্তের জন্য দুই ভ্রূ বাঁকা হয়ে গেছিল, কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যই শুধু। আবার ভ্রূজোড়া সোজা হলো, ওর মুখের উপর দিয়ে ছেলেটার দৃষ্টি মেঘে ঢাকা রোদের মতো দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেলো। ছেলেটা ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। লাভলির চাউনি হতাশায় নেমে যাচ্ছে।

– আপনি এরকম দৌড় দিলেন কেন? যেতে না চাইলে যাবেন না। আমি তো আপনাকে জোর করি নাই।

দু’এক পা এগিয়ে গিয়ে লাল মাফলার আবার ওর ঠিক মুখের সামনে ফিরে এলো।

– কয়টা বাজে।

– পাঁচটা বিশ।

– বাসায় যাবো।

– চলেন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। অসুবিধা নাই তো…?

– অসুবিধা আছে, তবুও চলেন।

নিজের সাহসে লাভলি আজকে বারবার চমৎকৃত হচ্ছে। পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে!

– আপনের বাসায় আমি আজকে যাবো না। আমার বোনকে ছাড়া আমি কিছু করতে পারি না, হাজার চেষ্টা করলেও না। বিউটির জন্য খারাপ লাগে।

– ঠিক আছে, আরেক দিন না হয় বিউটিকে সাথে নিয়েই আসবেন।

লাল মাফলারের কথায় লাভলি হেসে ফেললো — এত সহজে আরেক দিন যেতে বললো যে না হেসে কোনো উপায় ছিলো না। আহারে লোকটার কোনো ধারণাই নাই লাভলিদের জীবন কেমন। সেখানে আরেক দিন আসে না। সেখানে একই দিনের পুনরাবৃত্তি ঘটে বছরের পর বছরের পর বছর! যদিও বা ধূমকেতুর মতো অন্য রকম কোনো এক দিনের দেখা মেলে তবে তা ধূমকেতুর মতোই — দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়।

– বিউটির রঙ আমার চেয়ে পরিষ্কার, আপনের পছন্দ হবে।

লাল মাফলারকে কথাটা কেন বললো লাভলি জানে না। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে গেইটের দিকে পা বাড়ালো। লাল মাফলার সুবোধ বালকের মতো ওর পিছু নিলো।

(– আপুমনি, সত্যি সত্যি বাসায় চলে যাচ্ছেন। এমন একটা হিরো মার্কা ছেলে… এত যে বিউটি বিউটি করেন, বিউটি আপা তো পরোয়া করে না। রিয়াজের সাথে আপনের গোপন লীলাখেলা খালাম্মা টের পেলেন কেমনে বলেন? নিজেকে কখনও জিজ্ঞাসা করছেন কথাটা? বিউটি আপা ভাঙ্গানি দিছে… )

আরও কী কী যেন বলে যাচ্ছিলো লোকটা কিন্তু লাভলি আর শুনতে চায় না, লোকটার কথা শেষ হওয়ার আগেই ও পড়িমরি দৌড় লাগালো, পিছনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায় লাল মাফলার। পার্কের সাধারণ জীবনে ঘূর্ণির সৃষ্টি হলো। বলা নাই কওয়া নাই একজন মহিলা হঠাৎ দৌড় দিলো, কেন দিলো, কী কারণে দিলো — এইসব বৃত্তান্ত জানার আগ্রহ পার্কবাসীর চোখেমুখে প্রকট হয়ে ওঠে। এই প্রথম লাল মাফলারের বিরক্ত লাগে। ছিটগ্রস্ত মহিলা ব্যাপারটা খারাপ না, কিন্তু এরকম লাগামছাড়া ছিটগ্রস্ত হলে তো বিপদ! কোনো রকম আগাম ওয়ার্নিং ছাড়া দৌড় দেয়, ইয়ার্কি আর কি! একজন দাড়িওয়ালা টুপিপরা লোক গম্ভীর মুখে এগিয়ে এলো।

– ভাইজান, মহিলা পকেটমার নাকি? এখনও দৌড় দিলে ধরতে পারবেন।

লোকটার দিকে কোনো রকমে এক ঝলক তাকিয়ে লাল মাফলারও ঝেড়ে দৌড় দিলো — যেন পকেটমার আসলে সে নিজেই আর লোকজন তাকে ধরার জন্য পিছে পিছে ধাওয়া করছে। শুধু তাই না এই যাত্রা ছুটে পালাতে না পারলে বাঁচার সম্ভাবনা জিরো। — ছুটতে ছুটতে রমনা গেইটের মুখে এসে দেখে লাভলি এরই মধ্যে একটা সিএনজিতে উঠে পড়েছে। ঠিক উঠে পড়বার মুহূর্তে লাভলি চকিতে পিছন ফিরে তাকালো — চোখোচোখি হলো লাল মাফলারের সাথে — ওর চোখ ছাপিয়ে পানি পড়ছে। দেখার ভুলও হতে পারে, ভাবলো লাল মাফলার। এমনিতেই দৌড়ে এতো দূর আসায় কুকুরের মতো জিহ্বা বের করে খাবি খাচ্ছে সে — যখন দেখলো লাভলি একটা সিএনজিতে উঠে পড়েছে আর সিএনজিটা প্রায় চলতে শুরু করেছে তখন ভিতরে একটা প্রচণ্ড তাড়া অনুভব করলো, — চোখের পলকে আরেকটা সিএনজিতে উঠে সামনেরটার পিছে পিছে যেতে বললো সে।

লাভলি বসে আছে আর সিএনজি ছুটছে নিজের ক্ষমতাকে অতিক্রম করে।

(– আপুমনি, লাল মাফলার সাহেব পিছনে আছেন, চিন্তা নাই।)

লাভলি দুই হাঁটুর মাঝখানে মুখ গুঁজে দিলো, শাল দিয়ে কান মাথা ঢেকে ফেললো। নদীর তোড়ের মতো কান্না আসছে। অনেক দিন পর কাঁদতে পারার এই স্বাধীনতা প্রাণভরে উপভোগ করলো ও। কাঁদছে লাভলি কাঁদছে।

(– আপুমনি এইটা কী শুরু করলেন। উঠেন, সামলান। র‌্যাব লিডার বাসায় কালো কাপড় পরে অপেক্ষা করতেছেন… )

লোকটার শেষের কথাগুলো লাভলি আর শুনতে পেলো না, ওর মনে পড়লো সেদিন ও খুব কষ্ট পেয়েছিলো। কী হয়েছিলো, ফরিদা খানম রিয়াজকে কী বলেছিলেন — তার কিছুই ও জানে না। ফরিদা এই ব্যাপারে ওর সাথে একটা কথাও বলেন নাই। শুধু একদিন ফাঁসির রায় ঘোষণার মতো শুনলো রিয়াজ আর আসবে না। বুকের পাঁজর গুঁড়িয়ে যাচ্ছিলো ওর, অথচ বিউটি বেশ ফুরফুরে মেজাজে সেদিন রূপচর্চা করলো। ওর পিঠছাপানো কালো চুলে ডিম দিলো, ডিম ডিম গন্ধ নিয়ে খামোখাই এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াতে লাগলো। ফরিদা খানমের সাথে স্বভাবসুলভ তর্ক বাদ দিয়ে সখী ভাব নিয়ে কথা বললো, হেসে ঢলে পড়লো। হ্যাঁ, সবই মনে পড়ছে লাভলির।

– ছিনাল! ছিনাল মেয়ে মানুষের ছিনালি যায় না। ছিনালি বার করতাছি আমি। কীসের এত চুলকানি বার করতাছি। কত বড় শয়তান ছেলে, কত বড় শয়তান!

দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিষ উগরে দিচ্ছিলেন ফরিদা খানম। সেই প্রথম তিনি নিজের কর্তৃত্ব এবং নজরদারির উপর সন্দিহান হলেন। তার দৃষ্টি এড়িয়ে বলতে গেলে তার প্রায় নাকের ডগার সামনে এতো বড় কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে দিনের পর দিন আর তিনি ঘূণাক্ষরেও টের পান নাই!

সেইবার আঠারো দিন ঘর-বন্দি থাকলো লাভলি। সেই প্রথম লাভলির কারণে ওরা দুই বোন এতো দীর্ঘ দিনের জন্য ঘরে আটকা পড়লো। কিন্তু সে জন্য বিউটির মধ্যে কোনো খেদ লক্ষ্য করা গেলো না। সে রূপচর্চা করলো আর ভিসিআরে হিন্দি সিনেমা দেখে খুশি থাকলো। মাঝে মাঝে বিউটির ঘর থেকে মা-মেয়ের সম্মিলিত হাসির শব্দ শোনা যেত। ফরিদা লাভলির ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো ওকে শুনিয়ে বুয়াকে বলতেন বিউটির প্রিয় কোনো খাবার রান্না করতে। রাতের খাবারের সময় বিউটির দরজা খুলে দিতেন, এমনকি বিউটির জন্য একদিন একটা তাঁতের শাড়িও কিনে আনলেন। একদিন ওর শাস্তির মেয়াদ শেষ হলো, ফরিদা দরজা খুলে দিলেন — লাভলি তখন চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলো, লক খোলার শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো ফরিদা খানম দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন, চাপা গলায় হিসহিস করে বললেন, “আমারে চিনস নাই, জানে শেষ করবো।”

এর উত্তরে লাভলি মিষ্টি করে হাসলো। ফরিদা খানম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। জীবন চলতে লাগলো গৎবাঁধা, যেমনকে তেমন। নিস্তরঙ্গ জীবন কোথাও কোনো ঢেউ নাই। রিয়াজ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা লাভলিদের বাড়িতে কেউ কখনও উচ্চারণ করে নাই। রিয়াজ কখনও এ-বাড়িমুখো হয় নাই, এমনকি রিয়াজের মা ওদের ছোটো খালাও আর কোনোদিন লাভলিদের বাড়িতে আসেন নাই। কোনোদিন কথাটা অবশ্য পুরোপুরি সত্য না। নয় বছর আগে একদিন সকাল সাড়ে নয়টায় ছোটো খালা আসলেন সাথে খালুজান। খালুজান একটা কথাও খরচ করলেন না। গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। খালার মুখ অবশ্য গম্ভীর ছিলো না। তাচ্ছিল্যের হাসি সারাক্ষণই ঠোঁটের প্রান্তে ঝুলে ছিলো। ওরা এসেছিলেন রিয়াজের বিয়ের কার্ড নিয়ে। নয় বছর আগে একদিন। রিয়াজ যে কাজে কামে কতো ভালো করছে তার ফিরিস্তি শোনালেন, পাত্রীর গুণগান করলেন শতমুখে এবং চড়া গলায়। যাওয়ার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের দুই বোনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমাদের শরম লাগতে পারে, তোমাদের আগে ছোট ভাইয়ের বিয়া হয়ে যাচ্ছে, তাও পারলে আইসো।”

অবশ্য ফরিদা খানম ছাড়া ওরা কেউ গেল না। লাভলির যেতে খুব শখ হয়েছিলো, কিন্তু মা’কে ভয়ে বলতে পারে নাই। ফরিদা খানম যাওয়ার পর ওরা দুই বোন প্রথম ভয়ঙ্কর খেলাটা খেললো। খেলার আইডিয়াটা যদিও ছিলো বিউটির কিন্তু নিখুঁতভাবে খেলে গেল লাভলি। তারপর ঠিক এক মাস দশদিন পরে মাথার ভিতরের লোকটা লাভলিকে তার অস্তিত্ব জানান দিলো।

(– আপুমনি, এত রোজা রেখে লাভ কী? মটকা মেরে পড়ে থাকেন।)

* * *

লাভলি আর বেশিক্ষণ মটকা মেরে পড়ে থাকলো না। এতক্ষণ দুই হাঁটুর ভাঁজে নিঃসাড় হয়ে পড়েছিলো। এবার ধীরে মাথা তুললো। চলন্ত বাতাসের দাপট আর রোজকার রাস্তার শব্দ তাকে চাবুকের ঘায়ে বর্তমানে ফিরিয়ে আনলো। ঘাড় ঘুরিয়ে সিএনজির পর্দা সরিয়ে দেখবার চেষ্টা করলো লাল মাফলার সত্যিই আসছে কিনা। বুঝতে পারলো না। পিছনে সারবাঁধা গাড়ি, বাস আর তারই ফাঁকে-ফোঁকরে সিএনজিরা ছুটে আসছে। ঘ্যাঁচ করে ট্রাফিক লাইটের সামনে এসে থেমে গেল, সিএনজিওয়ালার বোধহয় ইচ্ছা ছিলো টেনে বেরিয়ে যাবে কিন্তু বাধ সাঁধল ট্রাফিক পুলিশ, লাঠি উঁচিয়ে বাড়ি মারারও ইঙ্গিত করল সে।

– খানকির পোলা তোর বাপেরটা খাই নিহি?

চাপা গলায় হিসহিসিয়ে ওঠে সিএনজি-ড্রাইভার।

– শুনেন, আমি আছি পিছনে। আপনি ভয় পাচ্ছেন না কি?

লাল মাফলার কখন নিঃশব্দে এসে সিএনজির গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছে লাভলি খেয়াল করে নাই। প্রশ্ন শুনে কেঁপে উঠলো।

– না, একটু। একটা কথা, বাসার সামনে আমি নেমে যাবো, আপনে কিন্তু নাইমেন না। সোজা চালায় যেতে বইলেন। আম্মার ঘর থিকা রাস্তা দেখা যায়, আম্মা পর্দা ধরে দাঁড়ায় থাকবেন।

কথা কয়টা শেষ করলো কি করলো না পিছনের গাড়ির বহর পাগলা হয়ে উঠলো। হর্নের শব্দ আর ছিটকে আসা গালি-গালাজে বোঝা গেল লাল বাতি সবুজ হয়েছে। লাল মাফলার লাভলির কথায় কোনো রকমে মাথা ঝাঁকিয়ে ফিরে গেলো।

“বাড়িত যান, রাস্তায় খাড়ায়া পীড়িত কীসের?” বাসের গায়ে থাপ্পড় মেরে কন্ডাক্টর রসিকতা করে, দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুথু ফেলে রাস্তায়।

বাকি পথটুকু আর কোনো ঘটনা ঘটল না। বাসার কাছের কুপারস পেরিয়ে যেতেই লাভলির ভয় শুরু হলো। এক মনে ‘সুবাহানাল্লাহ’ ‘সুবাহানাল্লাহ’ পড়ছে তো পড়ছেই। এক সময় বাসার সামনের কলাপসিবল গেইটের একটু সামনে গিয়ে সিএনজি থামলো। লাভলি ভিতরে বসেই খানিকটা সময় নিয়ে ভাড়া মিটাল। ও দেখতে চায় লাল মাফলার কখন ওদের বাসা ছাড়িয়ে চলে যায়। কিন্তু পিছনে আর কোনো সিএনজি ছিল না। এক সময় হাজারো ক্লান্তি নিয়ে লাভলি ঘাড় নুইয়ে সিএনজি থেকে নামে। ধীরে গেইট পর্যন্ত হেঁটে যায়, তারপর যখন গেইটের পেটের ছোট্ট গেইট খুলে ভিতরে এক পা রাখে ঠিক তখুনি ওর পিছন দিয়ে হুঁশ করে আরেকটা সিএনজি বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে লাভলির। গলার কাছে দলা পাকানো কী একটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। তারপরও আশ্চর্য সংযমে পিছন ফিরে তাকাল না লাভলি — কারণ ও নিশ্চিতভাবেই জানে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন ফরিদা খানম। যদিও শীতের সন্ধ্যা নেমে এসেছে, সময় ছয়টা চল্লিশ; চারপাশ ঘন কালো চাদরে ঢেকে যাচ্ছে। তবুও লাভলি কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি না।

লাভলি গেইটের ভিতরে ঢুকে নিজের অজান্তেই মাথার উপর শাল চড়াল। মাগরিবের নামাযও ক্বাযা হয়ে গেছে। আন্তরিকভাবে দুঃখবোধ করলো। বাসায় ঢুকেই ওযু করে ক্বাযা নামাযগুলো আদায় করতে হবে, ভাবল লাভলি। বুকের উপরে চেপে বসে থাকা ভয়টা জোর করে হটিয়ে সাহস আনার চেষ্টা করলো। ধীরেসুস্থে দোতলা বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। অনেক কষ্টে বিশেষ একটা জানালার দিকে তাকাবার ইচ্ছা সংবরণ করলো। চুপচাপ ঢুকে গেল বাড়ির ভিতর, সেখানে সিঁড়ির মুখে আরেকটা তালা দেয়া গেইট। ও ভেবেছিল গেইট খোলা থাকবে, কিন্তু ছিল না, — কলিং বেলে চাপ দিল আর সাথে সাথে ছুরিটার কথা মনে পড়ে গেল লাভলির। চোখের পলকে ঝোলার চেইন খুলে আছাড়ি বিছাড়ি খুঁজতে থাকে। — ঝোলার একদম তলা থেকে খয়েরি কাগজে মোড়ানো ছুরিটা বের করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে কামিজের নিচে শেলওয়ারের গিঁঠে আটকে রাখে। ভালো করে ওড়না আর শাল দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলে। উত্তেজনায় বুক ধ্বক্ ধ্বক্ করছে। বড় জোর তিরিশ সেকেন্ড লেগেছে পুরো কাজটা সম্পন্ন করতে কিন্তু ওতেই ওর হয়ে গেছে! তখনও দোতালার দরজা খোলার আওয়াজ পায় নাই। কিছুক্ষণ দম নিলো লাভলি তারপর আবার কলিংবেল টিপে ধরল। ভিতর থেকে এক ধরনের অবুঝ, বাগ না মানা গোঁ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। যা হবার হবে। টিপে ধরেই থাকল। অনন্তকাল কী ধরেছিলো? — দরাম করে দরজা খোলার শব্দ পেল লাভলি, কলিং বেলের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিল।

– বড় খালা আসতাছি, খাড়ান।

ইবলিশটার গলা। সন্তানের ভালোবাসায় ছুরিটায় পরম আদরে হাত বুলালো লাভলি।

(– সাবাশ আপুমনি! আমি ভাবলাম আজকে বোধহয় দরজাই খুলবে না।)

সিঁড়ি ভেঙে ধুপধাপ নিচে নেমে আসছে পিচ্চি আর লাভলি সিঁড়ি-গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

দুই
আজ ফযরের নামাযের ওয়াক্ত পার হয়ে যাওয়ারও মিনিট কুড়ি পরে ফরিদার ঘুম ভাঙলো। আজকাল প্রায়ই এরকম হচ্ছে। আগে যেমন ঘুম ভাঙার সাথে সাথে চাবুকের মতো সপাং করে উঠে বসতে পারতেন আজকাল সময় লাগে। মনে হয় বিছানায় আরও কিছুক্ষণ পড়ে থাকলে কী আর এমন কেয়ামত উপস্থিত হবে। আজকে যদিও ম্যালা কাজ, তবুও উঠতে উঠতে দেরি হয়েই গেলো। কাজে লাগার আগে ওযু করে নামায পড়লেন তারপর রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। রাবেয়ার মাও বোধহয় এখনই উঠেছে, চোখের পাপড়িতে তখনও ঘুম লেগে আছে। খুবই বিরক্ত হলেন ফরিদা। কালকে রাতেই বলেছেন ঘুম থেকে উঠে প্রথমে মুখলেস সাহেবের জন্য কয়েকটা আটার রুটি বানিয়ে রাখতে। সবার জন্য আজকে লুচি হবে কিন্তু উনার শরীরটা ভালো না, লুচি পেটে সহ্য হবে না। সেজন্যই কথাটা বলা।

– তুমিও দেখি কম যাও না। বাসা ভরতি সব নবাবের বাচ্চা।

– রুটি বেলতে বেশিক্ষণ লাগব না খালাম্মা।

– পিচ্চি কই? শয়তানটা এখনও ঘুমায় না কি?

– না, উঠছে। দেখলাম তো ঘর ঝাড়ু দিতে গেছে।

– ওরে ডাক দাও। ডিম আনতে হবে।

রাবেয়ার মা তাড়াহুড়া করে লুচি বানাবার জিনিসপত্র এগিয়ে দিতে চেষ্টা করলো।

– সং-এর মতো খাবলাখাবলি করতাছো কেন? বললাম না পিচ্চিরে ডাকো। যখন যা বলব সাথে সাথে করবা। নিজে মাতব্বরি করবা না।

রাবেয়ার মা পিচ্চিকে ডাকতে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ফরিদা ছোট সসপ্যানে পানি গরম বসালেন। লুচির ময়ান তৈরির জন্য একটা এনামেলের বাটি, ময়দা, তেল আর লবণ হাতের কাছে মজুদ রাখলেন, তারপর পানি ফুটবার জন্য অপেক্ষা করে রইলেন।

– নানি ডাকছেন?

– ডিম নিয়া আয়, ১২টা আনবি। রাস্তায় দাঁড়ায়া তামশা দেখবি না। যাবি আর আসবি।

পিচ্চি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। ফরিদা আঁচলের গিঁঠ খুলে টাকা বের করে দিলেন। রাবেয়ার মা এসে নিঃশব্দে আটার রুটি বানাবার তোড়জোর শুরু করেছে।

– রুটি বানায়া একটা সব্জির লাবড়া বানাও। লাউ আছে না?

– আছে, অর্ধেকটা।

– লাউ, আলু, বেগুন আর ফুল কপি দিও। বাগারের সময় হইলে আমারে ডাকবা। হাত চালাও।

ফরিদা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাসার প্রতিটা জিনিস ঝকঝক তকতক না করা পর্যন্ত তার শান্তি হয় না। নিজেই দিনের মধ্যে হাজারবার জিনিসপত্র মোছেন। মেয়েদের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দু’জনের দরজাতেই রোজকার মতো কড়া নাড়লেন।

– লাভলি উইঠা পড়, ফযরের নামায ক্বাযা করিস না। বিউটি উঠ, দয়া কইরা ওযু কর, নামায পড়।

ফরিদা টের পান বড় মেয়ে লাভলি উঠে পড়েছে কিন্তু ছোট মেয়ে বিউটির ঘর নীরব, সুনসান। সুনসান থাকবে নয়টা দশটা পর্যন্ত। নবাবজাদীর ঘুম ভাঙার পর শুরু হবে কিচ্ছা কাহিনী। থাক্, যা করে শান্তি পায়, ফরিদা ভাবেন। আজকে তার মনটা নরম। আজ বড় মেয়ে লাভলির জন্মদিন। দেখতে দেখতে চল্লিশ বছর পার হয়ে গেল। মেয়েটার জন্য হঠাৎ করেই ফরিদার ভিতরটা হাহাকার করে ওঠে। এই ধরনের অনুভূতিকে তিনি কখনই প্রশ্রয় দেন না। কিন্তু আজকে অনেক কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে নাই। যেই মনের উপর দখল সবচেয়ে বেশি সেটাই কাবু হয়ে বসে আছে। নিজের উপর ভালোই বিরক্ত হলেন ফরিদা।
শোবার ঘরে ঢুকে ঠাহর করতে পারলেন না কী কাজে সেখানে গেছেন। এই উপসর্গও ইদানিংকালের। কিছুই মনে থাকে না — এক্ষণের কথা এক্ষণ ভুলে যান। বেশির ভাগ সময় পেটে আসে মনে আসে না। তবুও ফরিদা মনে পড়বে ভেবে কিছুক্ষণ খাটের উপর বসে থাকলেন, মনে পড়লো না — স্বামীর লেপ মুড়ি দেয়া মাথার দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন। কালকে না পরশু কবে জানি দেশের বাড়ি যাবে বলছিলো? জমি জমার বিলি ব্যবস্থা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব করা দরকার। পরে শরীরে আরও কুলাবে না।

– খালাম্মা, পানি ফুটছে।

দরজার ওপাশ থেকে রাবেয়ার মা’র ক্ষীণ আওয়াজে চিন্তার খেই হারিয়ে ফেললেন।

– আসতেছি যাও। বড় আপার জন্য পানি গরম বসাও, গোসল করবে। বড় পাতিলটাতে বসাও, অর্ধেক পানি খালুজানরে দিও।

হুকুমজারি করে ফরিদা আবার পায়ে পায়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। লুচির ময়ান তৈরি করে ভেজা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলেন, খাওয়ার সময় গরম গরম বানিয়ে দিবেন। বটি টেনে নিয়ে সব্জি কাটতে শুরু করলেন।

– রুটি যেন পাতলা হয়। কামলাদের মতো ধাবড়া সাইজের বানাইয়ো না। একই কথা ডেইলি বলি তবু কোনো ফারাক দেখি না।

অনবরত কথা বলছেন আর সব্জি কেটে যাচ্ছেন ফরিদা।

– ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ কইরা নাক টানতেছো ক্যান? সুয়েটার পরো। সুয়েটার কি সাজায় রাখার জন্য দিছি না কি?

ফরিদাও কথা বলে যাচ্ছেন, রাবেয়ার মাও নিঃশব্দে রুটি বেলে যাচ্ছে। এইসব বকাবাজিতে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর গায়ে মাখে না। নিজের মেয়েদের সাথেই যে মানুষ এমন তার সাথে তো তাও কমই আছে, রাবেয়ার মা ভাবলো।

– আম্মা, কী করেন?

লাভলি রান্নাঘরে উঁকি দিলো।

– কী, নামায পড়ছিস? গুসলের পানি বসাইছে গুসল কইরা নাস্তা খাবি, আয়।

লাভলি মাথা নাড়লো।

– লুচি না কি?

– লুচি, সব্জি আর ডিম ভাজি।

সব্জি কাটায় ফিরে যান তিনি। রান্নাঘরের দরজার পাল্লা ধরে লাভলি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আর মায়ের সব্জি কাটা দেখে। মেয়ের মনটা খুশি করতে ইচ্ছা করলো ফরিদার। স্বাভাবিক গম্ভীর মুখে মেয়েকে বললেন, “গাউছিয়া গেলে চল। দেখ বিউটি যাবে কিনা। মহারানী তো মটকা মাইরা পইড়া আছে।”

মায়ের প্রস্তাবে লাভলির নিষ্প্রাণ চোখ এক মুহূর্তেরও কম সময়ের জন্য জ্বলে উঠলো তারপর যে কে সেই। কারণ ও নিশ্চিতভাবেই জানে বিউটিকে রাজি করানো যাবে না। আর রাজি করানো না গেলে ওরও যাওয়া হচ্ছে না। কারণ নাস্তা খাওয়া শেষ হওয়ার পর ফরিদা জন্মদিনের গৎবাঁধা মেনু রাঁধতে বসবেন। তাহলে আর ও যাবে কার সাথে? মৃত পায়ে বিউটির দরজার কাছে আসলো ও। তখন বাজে আটটা পঁচিশ, বিউটির জন্য প্রায় মাঝরাত। তাও কোনো দ্বিধা না করে দরজায় বাড়ি মারতে থাকলো লাভলি। ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ধৈর্য হারিয়ে আরও কয়েকবার বেশ জোরেই ধাক্কা দিলো লাভলি, সেই শব্দে বরং ঘুম জড়ানো ভীতু চোখ নিয়ে মুখলেস সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হয়তো ভেবেছিলেন ফরিদা এই সক্কাল বেলাতেই মেয়েদের উপর চড়াও হয়েছেন। লাভলিকে দেখে তার চোখের ভীতুভাব সহজ হলো, তিনি আবার নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। লাভলি নিঃশব্দে বাবার যাওয়া দেখলো তারপর আরও কয়েকটা ঘা দিলো জোরে।
“দরজা ভাঙবি না কি? গুসলে যা। রাবেয়ার মা পানি দিয়া আসো।” রান্নাঘর থেকে ফরিদা ধমকে উঠলেন।

লাভলির জন্মের সময়টা তার স্পষ্ট মনে পড়লো। কমলাপুরের কাছে জসিম উদ্দিন রোডের ভিতরের দিকে তিন কামরার টিনের বাড়িতে তারা থাকতেন। মুখলেস সাহেব, তার মোটামোটি নতুন বউ ফরিদা আর মুখলেস সাহেবের চাচাতো ভাই আব্দুল বশির। আব্দুল বশির তাদের বাসার একটা কামরা সাবলেট নিয়েছিলেন। মুখলেস সাহেব তখন সবে টিএন্ডটি বোর্ডের সেকেন্ড ক্লাস অফিসার হয়েছেন। বশির সাহেব পেশায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, রোডস এন্ড হাইওয়েজে চাকরি করতেন। তার স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ফৌজদারহাটে বাবার বাড়িতে থাকতো। তাদের সাথে বশির সাহেবের সম্পর্ক কেমন ছাড়া ছাড়া মনে হতো। এই সব নিয়ে মুখলেস সাহেব বা তার স্ত্রী কেউই খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। তাদের ছোটো সংসারে বাড়তি একটা আয়ের পথ পাওয়া গেছে এটাই ছিলো বিবেচ্য।

লাভলির জন্মের সময়টা ভাবতে গিয়ে বশিরের কথা মনে পড়ায় যারপরনাই বিরক্ত হলেন ফরিদা। নিজ থেকেই কপাল জুড়ে কঠিন ভ্রূকুটি দেখা দিলো। সারাদিনে এই ভ্রূকুটি আর সোজা হলো না, বিরক্তি আর দুশ্চিন্তার মাত্রা বিশেষে কম বেশি হলো মাত্র কিন্তু একেবারে মিলিয়ে গেলো না।

– খালাম্মা রুটি হইছে, টেবিলে দিব?

– টেবিলে দিবা না তো কী করবা? কাঁচা আবু হইয়া যাইতাছো না কি দিনকে দিন? টেবিল লাগাও আগে। পিচ্চি হারামজাদা ডিম নিয়া আসছে?

– আসছে, সিঁড়ি মুছতাছে। কয়টা ডিম ভাজবো?

– এখন দুইটা ভাজো, ছোটো আপা উঠলে আরেকটা ভাইজা দিও। আগে গিয়া দেখো খালুজানের গুসল হইছে না কি? গুসল হইলে টেবিলে আসতে বলো।

উলের বল মাটিতে গড়িয়ে পড়লে যেভাবে উল বের হতে থাকে, বলের পিছনে যতো ছোটা যায় ততো বের হয়, ঠিক তেমনি আব্দুল বশিরের নাম মাথায় আসার সাথে সাথেই একের পর এক স্মৃতি ফরিদাকে বেসামাল করে ফেললো, একটার লেজ ধরে আরেকটা — না, এইসব হাবিজাবি ভেবে আজকের দিনটাকে সে কোনো মতেই নষ্ট হতে দেবে না।

রাবেয়ার মাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ফরিদা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাসার সবাইকে নাস্তার টেবিলে আসার জন্য ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি শুরু করে দিলেন।

– লাভলি, আয় জলদি, সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তোরা বসলে আমি গরম গরম লুচি ভাইজা দিবো। বিউটি কি উঠছে? এই বিউটি, এই ধামড়ি, উঠ — দয়া কইরা নাস্তা খাইয়া উদ্ধার কর।

শেষের কথা কয়টা বলতে বলতে বিউটির দরজায় দুমদাম কয়েকটা বাড়ি দিলেন। কাজের কাজ অবশ্য কিছুই হলো না। বিউটি এত সহজে উঠবার পাত্রী না। তারপর একই ব্যস্ততায় নিজের শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন ফরিদা, স্বামীর গোসল শেষ হয়েছে কিনা সেটাই বোধহয় দেখতে চান। মুখলেস সাহেব গোসল শেষ করে সবে নামাজে দাঁড়িয়েছেন। ঘরে ঢুকে কী একটা বলতে গিয়ে ফরিদা যখন দেখলেন মুখলেস সাহেব জায়নামাজে তখন কথাটা তিনি গিলে ফেললেন। কিন্তু ভিতরের অস্থিরতা চাপা দিতে পারছেন না কিছুতেই। জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরালেন। বাইরে মনিপুরি পাড়া তখনও আলসে আর ঘুমকাতুরে। নিস্তেজ গলির দিকে তাকিয়ে ফরিদা এক মনে ‘ইয়া নফসি’ পড়তে লাগলেন। হঠাৎ করে কী একটা মনে পড়ায় ঝটিতে আবার ঘর থেকে বের হলেন।

খাবার টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়েছে। রাবেয়ার মা গ্লাসে পানি ঢালছে।

– রাবেয়ার মা, ডিপের থিকা হাঁস বার করো। কুসুম পানিতে ভিজায় রাখো।

* * *

হাঁস কেনার ব্যাপারে কোনো ঝুঁকির মধ্যে আর যান না ফরিদা। মাস খানেক আগেই হাঁস কিনে ডিপ ফ্রিজে রেখে দেন। ‘শেষ মুহূর্তে পাওয়া গেলো না’ — এই সম্ভাবনা খারিজ করতে বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি তাই করছেন। ডিপ ফ্রিজে রেখে হাঁস খাওয়াটা যদিও তার একেবারেই পছন্দ না। কিন্তু কী করা! নাই মামার চাইতে কানা মামা ভালো। তাছাড়া সব কিছু যেন প্রকৃতির নিয়মের মতো নিখুঁতভাবে হয় সারাক্ষণ এটাই নিশ্চিত করতে জীবনপাত করছেন তিনি। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে শেষ অব্দি কিছুই নিখুঁতভাবে হচ্ছে না। এই খবর ফরিদাও জানেন। তাই চেষ্টা আর একাগ্রতা দিনকে দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

লাভলি গোসল সেরে বের হলো, চুল ভালো করে মোছা হয় নাই। গোড়া থেকে টপ টপ পানি পড়ছে। ও আবার ঘরে ঢুকে গেলো। ভালো করে না মুছলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। এত লম্বা চুল মুছতে অসহ্য লাগে আবার কাটতেও মায়া লাগে। বিউটি তো সেদিন, একটু হলে ওর ঘুমের মধ্যেই কাঁচি চালিয়ে দিয়েছিলো। রাবেয়ার মা চা দিতে ঘরে ঢুকে দেখলো ছোট আপা কাঁচি হাতে বড় আপার মাথার কাছে উবু হয়ে আছে, আর যায় কোথায়, দিলো এক চীৎকার তাতেই ঘুম ভেঙে গেলো লাভলির। আচমকা ঘুম ভাঙায় লাভলি যতটা না ধড়ফড়িয়ে উঠলো তার চাইতে বেশি ঘাবড়ে গেলো বিউটি নিজেই। এতটাই চমকে গেছিলো যে নিজের হাত-টাত কেটে একটা কাণ্ড করলো। ফরিদা সেদিন রাবেয়ার মাকে বিদায় করেই দিচ্ছিলেন। তাকে হাজারবার করে নিষেধ করা আছে আগ বাড়িয়ে সে যেন কোনো আপার ঘরে না যায়। যখন যেতে বলা হবে শুধু তখনই যেন যায়। কে শোনে কার কথা — সুযোগ পেলেই বড় আপা বা ছোট আপার কারো না কারো ঘরে তার যেতেই হবে। ফরিদা শরীরে আর মনে একটু নরম হয়ে যাওয়ায় রাবেয়ার মা’র চাকরিটা শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেলো। বছর চার-পাঁচ আগে হলেও তৎক্ষণাৎ বিদায় করে দিতেন। আজকাল ভালো কাজের মানুষ পাওয়া আকাশের চাঁদ পাওয়ার সামিল হয়েছে। তাছাড়া রাবেয়ার মা’কে রাখার অনেক সুবিধাও আছে। তিন কুলে কেউ নাই। একটাই মেয়ে ছিলো রাবেয়া, সেও কোন ছোট বেলা মারা গেছে সেই দিন-ক্ষণ সেও ঠিক করে বলতে পারে না। কথা কম বলে, হাজার বকা দিলেও রা কাড়ে না। শুধু মাঝে মধ্যে একটু টেলিভিশন দেখতে চায়। সে ফরিদা মানা করেন না। ওরাও তো মানুষ!

লাভলি চুল ভালো করে মুছে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে একটু শুকিয়ে নিল। বিউটির কানে শব্দ গেলে বিপদ হবার কথা। সে রূপচর্চা বিষয়ে পণ্ডিত হয়ে উঠছে দিনকে দিন। কোন ম্যাগাজিনে পড়েছে হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করা চুলের জন্য ক্ষতিকর — তাই সে এখন নিজে ব্যবহার তো করেই না লাভলি ব্যবহার করুক সেটাও তার চক্ষুশূল। অথচ এই হেয়ার ড্রায়ারটা সেই ফরিদাকে নিয়ে গিয়ে ইস্টার্ন প্লাজা থেকে কিনে এনেছিলো। মজার ব্যাপার হলো লাভলির যা কিছু আধুনিক ব্যবহার্য আছে সবগুলোরই এক সময়ের মালিক বিউটি। যখন তার জিনিসগুলো থেকে মন উঠে যায় তখনই সেটা লাভলির কপালে জোটে। যেমন লাভলির ঘরে একটা ছোট্ট সিডি প্লেয়ার আছে, সেটাও বলা বাহুল্য বিউটির। অনেক দিন চালানোর পর এক দুপুর বেলা সে লাভলির ঘরে দিয়ে গেলো। “আপা, এই সিডি প্লেয়ারটা তুমি নিয়ে নেও।”

– আমি নিয়ে কী করবো?

– কী করবা মানে, গান শুনবা। এরকম বেকুবের মতো কথা বলো কেন?

– আমি তো তোর ঘরেই শুনতে পারি।

– আমার ঘরেও শুনতে পারবা, আম্মাকে বলছি একটা নতুন কিনে দিতে।

– কেন এইটা কী হইছে?

– পুরান হইছে আর কী হবে!

সিডি প্লেয়ারটা পেয়ে অবশ্য লাভলির খুব লাভ হলো। শব্দ কমিয়ে যখন খুশি তখনই শুনতে পারে, বিউটির মুডের উপর নির্ভর করতে হয় না।

নামাজ শেষ করে মুখলেস সাহেব নাস্তার টেবিলে আসলেন। ইদানিং সকাল বেলা উঠেই একটা পাগলা ক্ষুধা লাগে। চেয়ারে বসে অসহায় বোধ করছেন তিনি, মা মেয়ে কারুরই দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে, ফরিদা আদৌ তাকে লুচি খেতে দিবে কিনা। টেবিলে লুচি দেখে যাচ্ছে না, কিন্তু করা হয়েছে নিশ্চয়ই, আজকে তো লাভলির জন্মদিন।

– হাত গুটায়া বইসা আছো কেন? খাও।

– লাভলি খাবে না?

– খাবে, খাবে না কেন? — লাভলি তোর গুসল হয় নাই?

লাভলি খাবার ঘরে ঢুকে ওর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলো।

– রাবেয়ার মা লুচি ভাইজা আনো।

ফরিদার এই প্রস্তাবে লাভলি এবং মুখলেস সাহেব একসঙ্গে ফরিদার দিকে তাকালো। কারণ এই লুচি ভাজার প্রক্রিয়াটি একান্তভাবেই ফরিদার নিজস্ব, সেখানে তিনি আর কাউকে ভাগ বসাতে দিবেন সেটা ভাবাই যায় না। অবশ্য চার মাস আগে বিউটির জন্মদিনেও পায়েস নাড়ার দায়িত্ব পড়েছিলো লাভলির উপর। প্রকৃতির নিয়মও তাহলে বদলায়।

রাবেয়ার মা’কে লুচি ভাজতে বলায় ফরিদা নিজেই বেশ কুণ্ঠিত বোধ করলেন। তিনি যে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন আর কর্তৃত্বও যে দুর্বল হয়ে পড়ছে এটা যেন দিনকে দিন প্রকট হয়ে উঠছে।

– সব্জি বাগাড় দিতে গিয়া গরম লাগতেছে। তুমরা শুরু করো। — রাবেয়ার মা লুচি যাতে ফুলে। — পাকঘরের ফ্যান বদলাইতে হবে। ঘুরে না। মিস্ত্রি ডাইকা আগে দেখাইতে হবে ঠিক হবে কিনা।

– ঠিক বোধহয় হবে না, দশ-বারো বছর তো গেছে।

– ঠিক না হইলে বদলাবো, দেখাইতে তো দোষ নাই।

– তাতো ঠিকই।

মুখলেস সাহেব চুপ করে গেলেন। ফরিদাকে চটিয়ে লুচি পাবার সম্ভাবনাকে মাটি করতে চাইলেন না। পিচ্চি নাস্তার প্লেটে দু’টা লুচি নিয়ে এলো। ফরিদা প্রথমে গভীর মনোযোগে লুচি পর্যবেক্ষণ করলেন, তারপর একটা লুচি লাভলির প্লেটে উঠিয়ে দিলেন। মনটা তার একটু দমে গেছে। নাহ, ভালোই তো ফুলেছে!

– ফরিদা, আজকে বিশেষ একটা দিন, একটা দুইটা লুচি খাইলে কিছু হবে না।

– কিছু হবে না তোমারে কে বললো? তুমি কি ডাক্তার?

– আম্মা, একটা খাইতে দেন।

– এখন তো বাপের জন্য আহ্লাদ দেখাইতেছো। অসুখে পড়লে সেবা করতে হবে আমারেই। — আচ্ছা যাও, একটা খাও।

কে বলেছে কর্তৃত্ব যেতে বসেছে, এখনও এই সংসারে তার কথাই শেষ কথা — সন্তুষ্ট বোধ করলেন ফরিদা। স্বামী এবং মেয়েকে পরম মমতায় নাস্তা খাওয়ালেন। যেমনই হোক তার নিজের স্বামী, নিজের মেয়ে!  বিয়ের পরে স্বামীর ঘর করতে যখন একটা ছোট্ট মফস্বল শহর ছেড়ে ফরিদা ঢাকায় এলেন তখন তার খুশির অন্ত ছিলো না। এমন না যে তিনি বিয়ে পাগলা মেয়ে ছিলেন, বা দশ বছর বয়স থেকেই পুতুল খেলার নামে নিজের সংসারের ছবি আঁকতেন, ব্যাপারটা মোটেও তা না। তবে সব সময়ই নিজের জিনিসের প্রতি তার অন্ধ টান, একরোখা মনোযোগ সব কিছুকে ছাড়িয়ে যেতো। আমার বাড়ি, আমার ভাইবোন, আমার ঘর, — এই ‘আমার’ বোধটা তার ভিতরে ছিলো বাড়াবাড়ি রকম সজাগ; স্বামী বা সংসারের চেয়ে নিজের আর কী হতে পারে। সুতরাং যেদিন তিনি স্বামীর সংসারে পা দিলেন সেদিনই ‘আমার স্বামী’ বা ‘আমার সংসার’ অবলীলায় ‘আমার বাপের বাড়ি’ বা ‘আমার ভাই-বোন’-এর চেয়ে আপন হয়ে উঠলো। স্বামী-সংসারের কাছে আর সব কিছুই হয়ে গেলো ফেলনা। আরেকটা ব্যাপারে ফরিদার একাগ্রতা লক্ষ্য করার মতো ছিলো — তিনি যাই করবেন, তাতে যেন কোনো খুঁত না থাকে। লাভলি-বিউটির বিয়ের জন্য অনেক প্রস্তাবই এসেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাণে ধরে কোনো পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে পারলেন না ঐ এক কারণে। প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো খুঁত বেরিয়ে এলো, একেবারে নিখুঁত পাত্র পাওয়া গেলো না। যার তার হাতে তুলে দিয়ে মেয়েগুলোকে পানিতে ফেলবেন নাকি! এই ভাবনাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ালো। যদিও মনটা তার আজকাল কিঞ্চিৎ টলে যাচ্ছে।

লাভলি এসে জানালো বিউটি ঘুমাচ্ছে। অসম্ভব বিরক্ত হলেন ফরিদা। ‘এইটা কী! দিনের কুনো হিসাব নাই, কিছু না — আল্লাহর তিরিশটা দিন বারোটার আগে ঘর থাইকা বাইর হয় না। আইজ বোনটার জন্মবার, আইজ একটু সকাল সকাল উঠ… শয়তান, শয়তানের কঠিন শাস্তি পাওনা হইছে।‘

নিজের মনেই ফরিদা ধমকে উঠলেন আর তার ভ্রূজোড়া ভীষণভাবে তেরছা হয়ে গেলো। লাভলিকে তৈরি হতে বললেন। তার তখনও আশা দরজা কয়েক বার ধাক্কা দিলে হয়তো মহারানী বের হবেন।

লাভলি বড় জোর পাঁচ মিনিটে তৈরি হলো। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বুক হু হু করে উঠলো ফরিদার। বয়সের ছাপ স্পষ্ট হচ্ছে! এই ঘটনা কবে ঘটলো। মেয়েটা এমন বুড়িয়ে গেছে কবে থেকে। চোখ ভিজে উঠছে টের পেতেই মুখের কাঠিন্য জোরদার করলেন। বিউটির ঘরের দরজায় দুম দুম কয়েকটা কিল দিলেন। দরজা তো খুললোই না, ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দও পাওয়া গেলো না। ক্লান্ত বোধ করলেন ফরিদা। সকাল থেকে রাত অব্দি সংসার টেনে নিয়ে যেতে হবে এই উপলব্ধি তাকে অসাড় করে ফেললো। এখন মেয়েটাকে নিষেধ করে দিতে পারেন, বিউটি যেহেতু দরজা খুলছে না আজকে আর বাইরে গিয়ে কাজ নাই, বা ওর জন্য অপেক্ষা করতেও বলতে পারেন তাহলে বের হতে হতে বারোটা সাড়ে বারোটা বাজবে, তখন বের হয়েই বা লাভ কী, দুপুরের খাওয়ার আগে তো ফিরতে পারবে না অথবা নিজেই দুই মিনিটে তৈরি হয়ে ওর সাথে যেতে পারেন। সেটাই করতে হবে ভেবে তৈরি হতে উঠলেন ফরিদা। কিন্তু তিনি গেলে রাঁধবে কে? হাঁসের মাংস, ইলিশ পোলাও… না, না তার যাওয়া চলবে না। এই সব ভাবতে ভাবতে শোবার ঘরে ঢুকেই আবার বেরিয়ে এলেন। কোনো উপায় নাই, কাল পরশুই না হয় যাক, হয় আমরা তিনজন গেলাম, না হয় ওরা দুই বোনে গেলো। ঘর থেকে বের হয়ে দেখলেন কালো ব্যাগ কাঁধে নিয়ে লাভলি খাবার টেবিলে চা সামনে নিয়ে বসে আছে। ওর কাঁধ ছাড়িয়ে দু’টা লম্বা বেণী অসহায়ের মতো ঝুলছে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে না, তস্তুরিতে আনমনে চা’চামচ দিয়ে টুং টাং শব্দ করছে শুধু। বসে থাকার ভঙ্গিতে রায় শোনার ভাবটা স্পষ্ট। কোনো অভিমান না, প্রতিবাদ না, যা বলা হবে তাই নিঃশব্দে মাথা পেতে নিতে রাজি।

– যা, আর দেরি করিস না। দুপুরের খাওয়ার আগে আগে চইলা আসিস। পছন্দ কইরা তোর জন্য এক সেট কি দুই সেট শেলওয়ার কামিজের কাপড় কিনিস। বিউটির জন্যও কিনিস এক সেট।… থাক, দরকার নাই। হারামজাদী ঘুমাক।

নিজের বলা কথায় নিজেই চমকে উঠলেন। লাভলিকে একা যেতে বললেন। এইসব তিনি কী শুরু করেছেন?

– আম্মা, আমি একা যাবো?

ভীষণ মাত্রায় অসহায় শোনালো ওর গলা। যেন একা একা সাত সমুদ্র পাড়ি দিতে বলা হচ্ছে।

– একা যাবি না তো পুলিশ পাহারায় যাবি না কী? খালি বেহুদা কথা।

তবুও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছে না লাভলি। আম্মা হয়তো এখনি বলবেন, ‘দাঁড়া তোর সাহস আমি বাইর করতাছি… এ্যাহ্, একা একা গাওছিয়া যাবে, — আহ্লাদ কতো বড়!’ — কিন্তু ফরিদা খানম এসবের কিছুই বললেন না। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রান্নাঘরে ঢুকে কী নিয়ে যেন রাবেয়ার মা’র উপর চড়াও হলেন। কোনো কথাই তখন লাভলির কানে ঢুকছে না, এবং সে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না। চল্লিশ বছরের অভ্যাস কী আর এক কথায় উল্টে যেতে পারে! ফরিদা খানম বললেও পারে না।

– বেকুবের মতো বইসা আছিস কেন? বললাম না ঘুইরা আয়। সিএনজি নিয়া যাবি। যা চাবে তাই দিবি। ভাড়া নিয়া ঝগড়া করবি না। কালকে রাতে তোর আব্বা কতো টাকা দিছে, বারো শ’ না দুই হাজার?

– দুই হাজার।

* * *

লাভলি ঘরের দরজা খুলে বাইরে পা দিতেই ভয় আর অনিশ্চয়তা ফরিদার বুকে দাঁত বসালো। জিহ্বা থেকে কণ্ঠনালী পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ। প্রাণপনে বলতে চাইলেন, ‘তুই একা কই যাস? তোর আস্পর্দা তো কম না হারামজাদী? … আমারে চিনস না, হাত পা ভাইঙ্গা লুলা বানায়া ফালায় রাখুম।’ কিন্তু তার গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হলো না। ধীরে তার চোখের উপর দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। তিনি কোনো রকমে নিজের ঘরের জানালার সামনে দাঁড়ালেন। এই জানালা দিয়ে তাদের বাড়ির সামনের রাস্তা আর গলির মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন, কয়েক সেকেন্ড পরে লাভলিকে দেখলেন বড় লোহার গেইটের গায়ের ছোটো গেইটটা খুলে বাড়ির বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো, মাথার উপর ওড়না দিলো আর কালো কার্ডিগেনের উপর শালটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলো। ফরিদা ভাবলেন, লাভলি হয়তো মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকাবে, তাহলে উনি তাড়াতাড়ি যেতে বলবেন বা কিছু, কিন্তু লাভলি পিছন ফিরে ওপরে তাকালো না একবারও। গেইট খুলে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো, যেন কী করা উচিৎ এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত না। তখনই ফরিদা প্রাণপনে চেঁচিয়ে উঠলেন।

– পিচ্চি এই পিচ্চি। মইরা থাকে সবগুলা।

– জি নানি?

– যা, শিগগির যা, বড় খালা গেইটের সামনে দাঁড়ায় আছে, গাউছিয়া যাবে, একটা সিএনজি ধরায় দিয়া আয়।

– আপায় একা যাইবো?

পিচ্চি তার আড়াই বছরের চাকরী-জীবনে কোনো আপাকেই কোথাও একা যেতে দেখে নাই, ঘাবড়ে গেলো একটু।

– খালি কথা, খালি কথা — থাপড়ায়ে মনে হয় দাঁতগুলা ফালায় দেই। এতোক্ষণে গলির মোড় পর্যন্ত চইলা গেছে। দৌড় দে। যাবি, সিএনজি ধরায় দিয়াই চইলা আসবি, বুঝছস?

মাথা নেড়ে সায় দিলো কি দিলো না ছুট লাগালো আর সঙ্গে সঙ্গে ফরিদার মনে কু ডাক দিয়ে উঠলো। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটাই যে আজকে তিনি করলেন এই বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইলো না। শীতের সকালেও ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে খাটের উপর বসলেন। একবার ভাবলেন গাউছিয়া যাবেন, কিন্তু উঠে দরজা খুলে রওনা হবার মতো কোনো শক্তি খুঁজে পেলেন না। এই প্রথম আরেকটা নতুন ভাবনা মাথায় এলো, বয়স তার বা মুখলেস সাহেব কারোরই কম হয় নাই, কয়দিন আর বাঁচবেন — মেয়ে দুইটার তখন কী হবে? এই দুনিয়ায় তাদের তখন একাই চলতে হবে। যাক ভালোই হয়েছে একা পাঠিয়েছেন। অভ্যাস হোক — এই সব ভেবেও ফরিদার শান্তি হচ্ছে না। হাত পা কেমন ঠাণ্ডা বরফের মতো হয়ে যাচ্ছে।

– খালাম্মা, হাঁসের মাংস গলছে। পিঁয়াজ কাটছি।

রাবেয়ার মার গলা প্রায় শোনাই গেলো না কিংবা হয়তো জোরেই বলেছে চিন্তার মধ্যে ছিলেন বলে ঠাহর করতে পারেন নাই।

– কী?

– মাংস গলছে।

– ঠিক কইরা বলো… নতুন বউয়ের মতো মিন মিন করতাছো কেন? পিঁয়াজ কাটছো?

– জি কাটছি।

– ফ্যান বন্ধ করো, বড় আপার বিছানা ঝাইড়া সুন্দর কইরা বিছাও।… আরে, কথা না শেষ করতেই দৌড় দেও কেন… পিচ্চি ফিরছে?

– জি।

– ওরে পাঠাও।

ঘরের কাছে এসে পিচ্চি দাঁড়ালো, হাতের স্পর্শে পর্দা নড়ে উঠলো।

– নানী ডাকছেন?

– তোরে না বলছি সিএনজি ধরায় দিয়াই চইলা আসবি, কথা কান দিয়া যায় না।

– ধরায় দিয়াই চইলা আসছি।

– ঠিক মতো সিএনজিতে উঠছে।

– জি উঠছে।

– সিএনজিওয়ালা বুড়া না জুয়ান?

– বেশি জুয়ান না, বুড়াই।

– সকালের কাজ শেষ হইছে?

– জি, নানা পেপার চায়।

– আমারে কস কেন? আমি কি পেপার নিয়া বইসা আছি। বসার ঘর থিকা নিয়া যা। নানায় কই?

– পিছনের বারান্দায় বইসা আছে।

* * *

মুখলেস সাহেবের মতো এরকম নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যদি তার হতো, কারো সাতে নাই পাঁচে নাই, আগে নাই, পিছে নাই — ধরতে গেলে কোথাওই নাই। একটা অস্তিত্বহীন নিঃসাড় জীবন কেমন আলগোছে কাটিয়ে যাচ্ছেন। বিয়ের কয়েক দিনের মাথায় প্রথম নাইওর গিয়ে ফরিদাও শুধু কয়েক দিনের জন্য এরকম নিঃসাড় হয়ে থাকলেন। ফরিদার মা খুব ডাকসাঁইটে মহিলা ছিলেন। তার কথায় অতো বড় পরিবার উঠতো আর বসতো। মা’র কথার নড়চড় তার দাদিজানও কখনও করতেন না। দেখতে ছিলেন ছোটখাটো একরত্তি মানুষ, কিন্তু চাল-চলন, ঠমক-ঠামক ছিলো সিংহিনীর মতো। যেখানে হাত দিতেন সেখানেই নাকি সোনা ফলতো। সেই পয়মন্ত মায়ের গল্প দাদিজান খুব গর্বের সাথে সবাইকে বলে বেড়াতেন। এমনকি বাড়িতে ফকির মিসকিন আসলে তাকেও শুনতে হতো।

– হায়দারের মা, ফকির বেটি কতোক্ষণ ধইরা বইসা আছে, এখনও দুই মুঠা চাইল দিতে পারলা না? — বুঝলা, মাইঝলা বউমা এই বাড়িত যেদিন পাও দিলো সেদিন ঘটনা হইলো অন্য রকম। আমগো ভাইগ্য আতখা এইখান থিকা এক লাপ দিয়া উঠলো এইখানে।

লাফটা যে কতো বড় তা দেখাবার জন্য ফরিদার দাদিজান তার ডান হাত উপুড় করে একদম মাটির কাছাকাছি রাখতেন আবার মুহূর্তে তার কাঁধ বরাবর নিয়ে আসতেন, তার চোখ থেকে হাসি চুঁইয়ে পড়তো। তখন হয়তো ফরিদার মা পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, বা উঠানে বসে কোনো ভাইবোনের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন — দাদিজানের এইসব আলাপে তার কোনো আহ্লাদ হতো না।

– আম্মা, আপনে থামেন। চিনা নাই শুনা নাই সবের সাথে এতো গপের দরকার কী!

আম্মার ধমক খেয়েও দাদিজান পরমানন্দ লাভ করতেন আর যাকে বলছেন সে পয়মন্ত বউয়ের বেয়াদবী দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতো।

সেই আম্মাজান নাইওর বাসের দ্বিতীয় দিনে ফরিদাকে একান্তে ডাকলেন। ফরিদারা পাঁচ ভাইবোনের সবাই মা’কে যমের মতো ভয় পেতেন আর বাবা ছিলেন সবার কাছে দুধ-ভাত তুল্য। আম্মা কিছু জিজ্ঞাসা করলে তার সত্যি জবাব দিতে হবে এই ছিলো নিয়ম, এই নিয়মের খেলাপ স্বয়ং দাদিজানও করতেন না।

– বিয়ার দুইদিন পরে বাপের বাড়ি আসছস, মুখ বেজার কেন? কী হইছে?

– কিছু হয় নাই আম্মা।

– হইছে ঠিকই… কথা হইতেছে তুই বলতে চাস কি চাস না।

ফরিদা দীর্ঘক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে রইলেন। এই চুপ করে থাকার সময়টুকু আম্মা কোনো তাগাদা দিলেন না। বালিশের ওয়াড়ে ফুল তুলছিলেন।

– আমি বলতে চাই না।

– বলতে না চাইলে বলবি না। কিন্তু বললে মনে হয় ভালো, আমি একটা উপায় চিন্তা করতে পারি।

– উপায় নাই।

এইবার ফরিদার মা খানিকটা সময় চুপ করে থাকলেন। ধীরে সুস্থে বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে সুঁই গেঁথে পাশে রাখলেন। কপালে দুশ্চিন্তার সরু রেখা চান-রাতের চাঁদের মতো দেখা দিলো কি দিলো না।

– রাহেলার বিয়ার পরে কতো দেইখা শুইনা তোর বিয়া ঠিক করলাম। রাহেলা যেমনে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার মুখ বুইজা সহ্য করে সেইটা আমার দুই চক্ষের বিষ। ভাবলাম বড় মেয়েরে এতো বড় পরিবারে বিয়া দিয়া যে ভুল করছি ছোট মেয়ের বেলায় সেই ভুল আর করবো না। তোরে বিয়া দিলাম এমন একজনের কাছে যার আগে পিছে কেউ নাই। দুলামিয়া সব দিক দিয়া সোনার টুকরা ছেলে। বড় চাকরি করে, দেখতে শুনতে ভালো, আদব লেহাজ আছে।… ফরিদা, আমার মুখের দিকে তাকা!

ফরিদার মাথা আরও এক বিঘা নিচে নেমে গেলো। সেই মুহূর্তে ফরিদা চাইছিলো মাটির সাথে মিশে যেতে। তার বয়স তখন ১৯। বিয়ের জন্য ১৯ বছর তখনকার দিনে ভালোই বয়স। তিন কূলে কেউ নাই এমন ছেলে খুঁজতে গিয়েই হয়তো এতোটা দেরি হলো।

– ফরিদা, আমার মুখের দিকে তাকা! এক কথা দুই বার বলা আমার পছন্দ না।

– উনি ভাইজানরে বলছিলেন বিয়া করতে চান না।

প্রাণপনে মুখ তুলে ফরিদা বললেন। আম্মার মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। কাটা মুরগির মতো তার চাউনি বার বার হোঁচট খেতে লাগলো।

– পুলাপান বয়সে আজাইরা কথা মানুষ কয়ই। আকবরের লগে পড়াশুনা করতো, বন্ধুর বইনের লগে বিয়ার প্রস্তাবে শরম পাইছিলো। পেচাইতাছিস কেন, সমস্যা কুথায়?

– উনার বিয়া করার ক্ষমতা নাই।

ফরিদা কথাটা এতোটাই আস্তে বললেন যে বাতাসের সাথে প্রায় মিশে গেলো। শুধু আম্মার কপালের দুশ্চিন্তা চোখে নেমে এলো। জীবনের প্রথম এবং শেষ তিনি তার মেয়ের সামনে দুর্বল হলেন। বিশাল খাটের প্রান্ত দুই হাতের শক্ত মুঠিতে ধরে থাকলেন আর হাঁ করে নিঃশ্বাস নিলেন। আম্মাকে এমন অবস্থায় দেখেও ফরিদা কিছুই করলেন না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলেন, এক চুলও নড়লেন না। কতোটা সময় যে পার হলো সেই হিসাব মা মেয়ে কারুরই জানা নাই। তবে অনেকক্ষণ পরে আম্মা নিজেকে সামলে নেয়ার ভান করলেন। পরম চেষ্টায় খাটের প্রান্ত ছেড়ে সোজা হয়ে উঠে বসলেন। মেয়ের চোখের দৃষ্টি এবার নিজেই সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলেন। ধরে আসা গলা খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করলেন।

– এই কথা কাক-পক্ষীও যেন টের না পায়। বড় বেটির কাম হইলো হজম করা, হজম কর — কপালে যা ছিলো হইছে। মানুষে যেন না হাসে — সেই সুযুগ কাউরে দিবি না। স্বামীর অপমান নিজের অপমান। এখন ঐ বাড়িই তোর সংসার, এই লোকই তোর স্বামী — যেমনই হোক।

আম্মার বলা প্রতিটা শব্দ হাতুড়ির বাড়ির মতো ফরিদার মগজে ঘা মারছিলো। অবশ্য তিনি জানতেন এই বিয়ে তাকে মেনে নিতে হবে, এখন নিজের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব তার নিজের। সারা জীবনে ফরিদার একটাই অনুতাপ, — ঘরের খবর কোনো অবস্থাতেই আম্মাকে বলা ঠিক হয় নাই। এছাড়া আর কোনো অনুতাপ তার নাই।

এই ঘটনার পর আর বেশি দিন ফরিদা বাপের বাড়ি থাকতে চাইলেন না — চার দিনের মাথায় এক রকম জোর করেই ফিরে এলেন স্বামীর কাজের জায়গায়। চাচাতো ফুপাতো ভাইবোনরা মুখ টিপাটিপি করতে লাগলো। দুই দিনেই স্বামীর বাড়ির জন্য টান দেখে টিকা টিপ্পনি শ্লেষ কিছুই বাদ গেলো না। সব কিছুকেই কখনও লাজুক হেসে, কখনও রাগ করবার ভান দেখিয়ে বাপের বাড়ি থেকে সুখী চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এলেন ফরিদা। মুখলেস সাহেব যারপরনাই অবাক হলেন। আসবার মুহূর্তে ফরিদা আব্বা, ভাইজান, বড় কাকা, কাকিমা সবাইকে সালাম করলেন। আম্মাকে সবার শেষে সালাম করলেন। আম্মা জামাইয়ের সামনে এসে সরাসরি বললেন, “দুলামিয়া, ফরিদা আমার মেয়ে, আমার মেয়েরা বড় বেটি এইটুকু মনে রাখবেন।”

আম্মার এই কথা বলার কারণ কেউ খুঁজে পেলো না। কাজেই শ্বাশুড়ির এত বড় দেমাক কেউ ভালো চোখে দেখলো না। এমনকি প্রথম বারের মতো ফরিদার বাবাও স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হলেন। সেই কথা তিনি মেয়ে, মেয়ে-জামাই বিদায় নেয়ার পর ভয়ে ভয়ে স্ত্রীকে বললেন। স্ত্রীও প্রথমবারের মতো স্বামীর কাছে দোষ স্বীকার করে নিলেন কিন্তু গুমর ভাঙলেন না।

ফরিদারা রওয়ানা হওয়ার সময় আম্মা তাকে ঘরে ডাকলেন। সারা গায়ে গয়না, দুই হাতে গুচ্ছ খানেক চুড়ি, পায়ে নুপূর, — ফরিদা ঘরে ঢুকলেন অর্কেস্ট্রা সাথে নিয়ে। একটু নড়াচড়াতেই বাদ্যবাজনার কোলাহল। দেখতে বড় ভালো লাগছিলো ফরিদাকে। মিনিট খানেক মুগ্ধ চোখে মেয়েকে দেখলেন আম্মা।

– আমি বড় খুশি হইছি গো মা, বড় খুশি হইছি। তুই আমার সাচ্চা বেটি।

ফরিদা হাসি হাসি মুখে আম্মার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন মাতা উঁচু করে। উঁচু করতে করতে তার গলা জিরাফের মতো হয়ে গেলো। সেই যে উঁচু করলেন সেই মাথা আর কখনও নামে নাই।

* * *

– খালাম্মা কাপড় ভিজাইছি, সাবান দেন।

রাবেয়ার মা নিঃশব্দে কখন ঘরে ঢুকেছে ফরিদা টের পান নাই। দরজায় সাড়াশব্দ করবে, তারপর ফরিদা বলবেন কী দরকার তবেই হয় ঘরে ঢুকবে নয় দরজার কাছ থেকে যা বলার বলবে, চাকর-বাকরের জন্য এই নিয়ম। কিন্তু কথাটা কিছুতেই রাবেয়ার মা’র মাথায় ঢুকানো যাচ্ছে না। আজ ছয় বছর ধরে সে এই বাড়িতে আছে তাও না।

– তুমারে না বলছি হুটহাট ঘরে ঢুকবা না। এই কথা দেখি কিছুতেই তুমার মগজে ঢুকে না।

– দরজায় খাড়ায়া দুইবার ডাক দিছিলাম খালাম্মা।

– ডাক দিছি মানে? আমি তুমারে ঘরে ঢুকতে বলছি?

এর উত্তর রাবেয়ার মা’র কাছে ছিলো না, যথারীতি সে চুপ করে গেলো। ফরিদার মনে গভীর সন্দেহ হলো, তিনি কি এতোটাই নিমগ্ন ছিলেন যে দুইবার ডাক দেয়ার পরও শুনতে পান নাই। কেন যে রাবেয়ার মা ঘরে ঢুকলো সেটা আবার এখন মনে করতে পারছেন না। হতাশ বোধ করলেন ফরিদা।

– কী চাও?

– গুঁড়া সাবান লাগবো, কাপড় ভিজাইছি।

– বাথরুমে যাও আমি আনতাছি।

এই আরেক বাতিক আছে ফরিদার — চাল, আলু, পিঁয়াজ, তেল আর গুঁড়া সাবান তালাবন্ধ করে রাখা। কাজের লোকরা ইচ্ছামতো নিয়ে ব্যবহার করলে পথে বসতে হবে, ভাবখানা তাই। নিজের হাতে বের করে দিলে যে পরিমাণ তেলে হেসে-খেলে মাস চলবে — ওদের হাতে দিয়ে দিলে ঐ একই পরিমাণ তেলে পনেরো দিনও যাবে না। এটা অবশ্য কখনও পরীক্ষা করে দেখা হয় নাই কিন্তু বিশ্বাস বদ্ধমূল।

– রাবেয়ার মা শুইনা যাও।

রাবেয়ার মা ডাক শুনে আবার ফিরে আসে।

– ছোট আপা উঠছে? নাস্তা টাস্তা কিছু খাইছে না কি এখনও ঘুমাইতেছে?

– হ উঠছে। চুলে ডিম দিছে, গরম পানি করতে কইছে গুসল করবো। গুসলের বাদে নাস্তা করবো।

সেই মুহূর্তে মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। এই বাসায় কোনো টেলিফোন লাইন নাই, কোনোদিনও ছিলো না। মোবাইল কালচার চালু হওয়ারও বহুদিন পরে এই বাড়িতে মোবাইল ঢুকেছে। ফোনটা সব সময় ফরিদার ড্রেসিং টেবিলের উপর চার্জারের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় থাকে। এই বাসায় কালে ভদ্রে ফোন আসে এবং অধিকতর কালেভদ্রে এই বাসা থেকে কেউ ফোন করে। স্প্রিং-এর মতো ফরিদা বসা থেকে উঠে পড়লেন — কে করলো, লাভলি না তো? কোনো কারণে দোকান বা কোথাও থেকে ফোন করেছে। কিন্তু লাভলির নাম্বারটা আদৌ মুখস্থ আছে কি না সেই ব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ হলো ফরিদার। নাহ্, যাওয়ার সময় ওর হাতে ফোন নাম্বারটা লিখে দেয়া উচিৎ ছিলো। আজকাল এমন মারাত্মক সব ভুল হচ্ছে যে নিজের উপর আর বিশ্বাস ধরে রাখতে পারছেন না।

– হ্যালো? কে?

– ফরিদা না কি? আমি।

– আমি? আমি কে?

– আমি আবদুল বশির।

ফরিদা শীতরাত্রির মতো জমে গেলেন। কপালের উপর ভ্রূকুটি কেটে বসলো। কথা বলবেন না কি ফোনটা কেটে দিবেন মনস্থির করার আগেই ফোনের অন্য পাশে জনৈক আবদুল বশির অস্থির হয়ে উঠলেন।

– লাইন কাইটা গেলো নাকি? হ্যালো, হ্যালো ফরিদা?

– এই বাসার নম্বর কই পাইছেন?

– সে ম্যালা কিচ্ছা! হেই কিচ্ছা বয়ান কইরা ফায়দা নাই। তুমরা আছো কেমুন? লাভলি, বিউটি?

– আপনেরে না বলা আছে এই বাড়ির সাথে কুনু যুগাযোগ করবেন না। আপনের সাহস তো কম না।

ফরিদার গলা নিজের অজান্তেই খাদে নেমে আসে আর সাপের মতো হিসহিস করে ওঠে। যদি বিউটি বা লাভলি ফোনটা ধরতো, এই লোক যেমন ইবলিশ, ওদেরকে কী বলতো কে জানে! সেই কল্পিত আলাপচারিতার সম্ভাবনায়ও ফরিদা শিউরে ওঠেন। সমস্ত শরীরে রক্তশূন্যতা বোধ হয়, দুই পা অসাড় হয়ে আসতে চায়।
– আমি ভাইবা দেখলাম ফরিদা, এতোদিন তুমি আমারে ডর দেখাইছো আর আমি বেহুদাই ডর খাইছি। আমার বয়স হইছে। আমাদের সবারই বয়স হইছে। কেউ আমরা কচি খোকা না।

– কী চান আপনে?

– আমি লাভলি, বিউটিরে দেখতে চাই।

– অসম্ভব। ডর আমি দেখাই নাই। সত্য বলছি। আপনের বউ পোলাপান যদি জানতে পারে, আপনেরে বাড়িতে জায়গা দিবে?

– তাইলে তুমি খবরটা পাও নাই। খোদেজার মৃত্যু হইছে দুই মাস হয়। এখন আর এইসব বইলা লাভ নাই ফরিদা, আমি কুনু কিছুর ধার ধারি না।

– আপনেরে স্পষ্ট কইরা একটা কথা বলতেছি। আপনে আমার মেয়ে দুইটার সাথে কুনু রকম যোগাযোগের যদি চেষ্টা করেন আমি আগুন লাগায় দিবো।

– আগুন তুমি লাগাইতে পারবা না। আগুন লাগাইলে তুমিই প্রথম জ্বইলা মরবা। যার জন্য আমি এতোদিন চুপ ছিলাম সে-ই যখন নাই…।

ফরিদা ঘট করে ফোন কেটে দিলেন। তার ভিতরটা জ্যান্ত কই মাছের মতো তড়পাচ্ছে। হাতের মুঠির ভিতর ফোন এমন শক্ত করে ধরে রাখলেন যেন জনৈক আবদুুল বশির সাহেবের টুটি চিপে ধরেছেন। অনেকক্ষণ অথবা খুবই অল্প সময় ফরিদা কী কী সব আকাশপাতাল ভাবলেন। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলেন। চেহারার কাঠিন্য, দুশ্চিন্তা খানিকটা পাতলা হলো। ফোনটা সুইচ অফ করে জায়গা মতো রাখলেন। ‘নিচের গেইট, কলাপসিবল গেইট সব বন্ধ আছে তো।’

রান্নাঘরে রাবেয়ার মা চুকচুক করে চা খাচ্ছে। ফরিদাকে ঢুকতে দেখে হাবিলদারের মতো বুকটান করে দাঁড়িয়ে পড়লো, চায়ের গ্লাস যে কোথায় রাখবে বুঝে উঠতে পারছে না।

– বাথরুমে গুঁড়া সাবান দিয়া আসছি। কাপড় ধুইয়া আমারে ডাকবা। পিচ্চি হারামজাদায় কই? সকাল থিকা কুনু খুঁজ নাই।

– খালুজানের পাকনা চুল বাছে। ডাকুম?

– না, দরকার নাই। পিচ্চি আইসা নিচের গেইট লাগাইছে? চাবি কই? আচ্ছা থাক, আমি দেইখা আসি চাবি লাগাইছে কি না।

রান্নাঘর থেকে ভীষণ তাড়া খেয়ে যেন বেরিয়ে এলেন, কোনো মতে সামনের দরজা খুলে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলেন ফরিদা। দোতালায় উঠবার মুখে লোহার গ্রিল দিয়ে দোতালা আর ছাদে উঠবার সিঁড়িকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, সেখানে ঢাওস সাইজের এক তালা ঝুলছে। শুধুশুধুই তালা টানাটানি করলেন, দেখাই যাচ্ছে লাগানো। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দু’পাশের ছোট ফ্ল্যাটগুলোর দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকালেন, যেন দু’টা ফ্ল্যাটের একটা থেকে কেউ তাদের উপর নজরদারি করছে। যদিও একটা ফ্ল্যাট ফাঁকা। গত মাসেই ভাড়াটে উঠে গেছে। এখনও বাড়ির গায়ে টু-লেট সাইনবোর্ড টাঙানো হয় নাই। ডান দিকের ফ্ল্যাটে অবশ্য ভাড়াটে আছে। মাঝবয়সী স্বামী-স্ত্রী। তাদের একমাত্র ছেলে বাইরে পড়ে, কোথায় কে জানে। ফরিদা কখনও জানতে চান নাই। ভাড়াটেদের সাথে আলগা পীড়িতি তার পছন্দ না। শুরুতে একতলাটাও তাদেরটার মতো একটা ফ্ল্যাট ছিলো। পরে চিন্তা ভাবনা করে বাঁ দিকে আরেকটা রান্নাঘর করে দু’টা ফ্ল্যাট বানিয়েছেন। এখন দু’টা ফ্ল্যাট মিলে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া পান।
তালা টানাটানি করে নিশ্চিন্ত হয়ে ফরিদা আবার উপরে উঠে গেলেন। না, যে চাবিটা পিচ্চির হাতে থাকে সেটা এখন থেকে তার কাছে নিয়ে রাখবেন। দোকানে-টোকানে যাবার সময় তার কাছ থেকে আবার নিয়ে গেলেই তো হলো। এতোদিন যে কেন এই বুদ্ধিটা হয় নাই! তবে ফরিদা বাসায় না থাকলে কখনই চাবি পিচ্চির কাছে থাকে না, তখন সব সময়ের ব্যবহারের চাবিটা থাকে মুখলেস সাহেবের কাছে। বাসায় থাকা অবস্থায় শুধুমাত্র চাবি পিচ্চির হাতে দিয়ে রাখেন তাও শুধু দিনের বেলায়। কারণ দিনের মধ্যে বত্রিশবার পিচ্চিকে কোনো না কোনো কারণে বাইরে পাঠাতে হয়। সন্ধ্যা নামার আগেই চাবি চলে আসে তার হাতে। এখন থেকে তাও করা যাবে না, ফরিদা মনে মনে ঠিক করলেন। নইলে কোনদিন দেখা যাবে আবদুুল বশির বসার রুমে বসে চা আর নোনতা বিস্কুট খাচ্ছে। গত সপ্তাহেই তো এরকম হলো। কলিংবেলের শব্দ শুনেই পিচ্চি চাবি নিয়ে দৌড়। আরে কে না কে আসছে আগে দেখ — বলার আগেই শয়তানটা হাওয়া। সেদিন অবশ্য সব্জিওয়ালা এসেছিলো। কিন্তু সব্জিওয়ালার বদলে বশিরও হতে পারতো। এই কথা ভেবেই বুকের ধুকপুকানি থেমে যাওয়ার জো হলো ফরিদার।

সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠার সময় ক্লান্তি অনুভব করলেন ফরিদা। ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিলো, ঢুকেই দরজার ডান পাশে খাবার ঘর বাঁ পাশে বসার। বসার ঘরে ঢোকার জন্য দরজা আছে। সেই দরজা বেশিরভাগ সময় ভিড়ানোই থাকে। প্রতিদিন সকাল বেলা পিচ্চি সব ঘরের সাথে বসার ঘরটাও ঝাড়ু দেয়, মোছে। জিনিসপত্রের ধুলা ঝাড়ে, তারপর দরজা ভিড়িয়ে দেয়। খাবার ঘরের সাথে লাগানো রান্নাঘর। ফরিদা খাবার ঘরে গিয়ে দেখলেন বিউটি নাস্তা করছে। মাথায় তোয়ালে পেঁচানো। ডিমের সূক্ষ্ম গন্ধ ঘরে পা দিয়েই টের পেলেন। বিউটি মাকে পাত্তা দিলো না, একমনে লুচি, ভাজি খেতে লাগলো। ছোট মেয়েকে দেখে ফরিদার মেজাজ সঙ্গে সঙ্গে তিরিক্ষি হয়ে উঠলো।

– সকাল বেলা আমি লাভলি যে তোর দরজা ভাইঙ্গা ফালাইলাম, তাও তোর কুনো হুঁশ নাই। তুই এমন শয়তানের শয়তান হইছস।

ফরিদার ঝাড়িতে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হলো না তাকে। ধীরেসুস্থে লুচি মুখে দিলো।

– লুচির এই অবস্থা কেন? তেনা তেনা!

– এগারোটার সময় নাস্তা খাইতে আইসা রাজরানীর তেনা তেনা লাগতেছে। রাবেয়ার মা ভাজছে। দিমু দুইটা ভাইজা?

– দেন। আপা কই?

– গাউছিয়া গেছে?

– গাউছিয়া গেছে, কেমনে?

প্রশ্নটা করে বিউটি চাবাতে ভুলে গেলো। হাঁ করে ফরিদার দিকে তাকিয়ে রইলো। ফরিদা তার হাঁ করা মুখের সামনে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে মোটেই রাজি না। বিউটি লুচির টুকরা মুখে না দিয়ে প্লেটে রেখে মাকে অনুসরণ করলো, ভিজে তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রাখা কাচা লুচির একটা তুলে তেলের কড়াইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন ফরিদা। তেল গরম হবে তবে লুচি ছাড়বেন। রাবেয়ার মাকে রান্নাঘরে দেখলেন না। কাপড় ধুচ্ছে নিশ্চয়ই।

– পিচ্চি কি আপার সাথে গেছে?

– পিচ্চি লাভলির সাথে যাবে কেন? ওর কাম নাই বাড়িতে?

– আপা তাইলে কার সাথে গেছে, আব্বার সাথে?

– না, কারও সাথে যায় নাই, একা গেছে।

– একা?

এমন আশ্চর্য কথা সে জীবনে শুনে নাই, প্রথমে বুঝতেই পারলো না ঘটনা কী, পরে প্রচণ্ড রাগ হলো বিউটির। তার কখনও কোথাও একা যাবার সুযোগ তো দূরের কথা প্রশ্নই ওঠে নাই, আর আপা কী সুন্দর একা একা গাউছিয়া চলে গেলো, তাও লুকিয়ে না, ফরিদাই পাঠিয়েছেন। এতো বড় অন্যায় চোখের সামনে ঘটতে দেখে মাথায় আগুন ধরে গেলো বিউটির। ফরিদার কাছে সব সময় দুইজনের জন্য দুই রকম বিচার।

– আপনে আমারে কুনুদিন কুথাও একা যাইতে দিছেন? আপারে দিলেন কেন? আমিও এক্ষণ গাউছিয়া যাবো।

– যায়া দেখ তুই। একা যাইতে দিছি সাধে — দরজা ধাক্কাইতে ধাক্কাইতে দুইজনের হাত ব্যথা হয়ে গেছে। লজ্জা নাই আবার কথা কয়, এক চড় খাবি। যা, টেবিলে যা, লুচি আনতাছি।

– আমারে কবে যাইতে দিবেন, বলেন?

– কুথায় যাইতে দিবো?

– সের আমি কী জানি, একা আমারে কবে যাইতে দিবেন, সেইটা বলেন?

– কুথায় যাইতে চাস সেইটাই তো জানস না। সারাদিন শুধু আজাইরা প্যাঁচাল। কুনু কাজ নাই কাম নাই, এতো বড় ধাড়ি মেয়ে, তোর লজ্জা লাগে না। যা আমার চোখের সামনে থিকা।

– আম্মা, আমি কিন্তু সত্যি বলতেছি, কালকে আমি একা বাইর হবো। আপারে সঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।

ঠাণ্ডা গলায় কথা শেষ করলো বিউটি। এই বিউটিকে ভয় পান ফরিদা। সে কখনও মায়ের কথার অবাধ্য হয় না কিন্তু ফরিদা ঠিকই জানেন এই মেয়ে চাইলে অনায়াসে অবাধ্য হতে পারে। লাভলির সেই ক্ষমতাই নাই।

– বিউটি নাস্তা শেষ কর কইলাম।

– খিদা নাই। নাস্তা আপনে আপনের বড় মেয়েরে খাওয়ান।

– কত্তো বড় বেয়াদপ। তর দিন ঘনাইছে, কথাটা মনে রাখিস।

আর কোনো কথায় গেলো না বিউটি। সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। এখন আরাম করে আধশোয়া হয়ে হিন্দি সিনেমা দেখবে, ‘যোধা আকবর’। আম্মাকে খুব ভালো রকম শাসানি দেয়া গেছে, বেশ একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করছে বিউটি। তবে একটা ব্যাপারে সে চমৎকৃত হয়েছে, আর তা হচ্ছে লাভলির সাহস। ফরিদা বললেন একা যেতে আর সেও রওয়ানা হলো! তাকে বললেই তো সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যেতো। মুখে যতো হাতি-ঘোড়া-বাঘ-ভালুক মারুক না কেন এই সাহস তারও হতো কি না সন্দেহ। আরে খেলা কথা না কি? জীবনে যে কোত্থাও একা যায় নাই তার জন্য তো বিশাল ব্যাপার। বড় বোনের প্রতি তার বেশ সমীহ বোধ হলো।  আপার একা বের হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে আম্মাকে দিয়ে ভালো কিছু আদায় করা যাবে, ভাবলো বিউটি আর হাসলো। কিন্তু কী আদায় করা যায় এই নিয়ে কিঞ্চিৎ চিন্তিত হলো আর ভিসিআর কেনার ঘটনা মনে পড়ে গেলো। যেদিন বিউটি ফরিদার কাছে ভিসিআর কিনে দেয়ার কথা বলেছিলো সেদিন তিনি যাকে বলে আকাশ থেকে পড়েছিলেন। বিকাল সাড়ে চারটা কি পাঁচটা বাজে, চা দেয়ার সময় হয়েছে। সেই সময় গম্ভীর মুখে বিউটি ফরিদার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো।

— আম্মা, ঘরে আসবো?

— কেন, কী দরকার?

— আসবো, না কি আসবো না?

— এইসব কী ঢং, আয়।

বিউটি ফরিদার ঘরে প্রবেশ করলো। কোনো রকম ধানাই-পানাইয়ের ধার দিয়েও গেলো না। সরাসরি ফরিদাকে বললো, “আম্মা, আমাকে একটা ভিসিআর কিনা দেন।”

— কী কিনা দিবো?

— ভিসিআর।

ফরিদা দুপুরের খাবারের পর একটু জিরান। ঠিক ঘুমিয়ে পড়েন না, কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। সেইদিন সেই পর্ব তার তখনও চলছিলো। মেয়ে ঘরে ঢোকার পরেও আলস্য পুরোপুরি কাটে নাই, তাই ঠাহর করতে পারেন না মেয়ে কী বলছে।

— কয়েকদিন পরে পরীক্ষা না?

— হ্যাঁ, পরীক্ষার পরেই কিনা দেন।

— জিনিসটা কী?

— সিনেমা দেখার মেশিন। ঘরে বইসা সিনেমা দেখা যায়। বেশি দাম না। আমি টেলিভিশনে এ্যাড দেখছি।

ফরিদা মেয়ের আহ্লাদে হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পেলেন না। স্পর্ধা দেখে তিনি রীতিমতো স্তম্ভিত হলেন।

— দুই দিন পরে পরীক্ষা সেইদিকে খেয়াল নাই, ঘরে বইসা সিনেমা দেখবে? থাপড়াইয়া সবগুলা দাঁত ফালায় দিমু। তোর বুকের পাটা তো কম না। আমারে ঘুম থিকা তুইলা সিনেমা দেখার মেশিন চাস!

— সিঙ্গার থিকা কিনতে পারেন। সিঙ্গার থিকা কিনলে একটা ইস্তারি ফ্রি!

— তুই এক্ষণ এই ঘর থিকা বার হ। শয়তানের বাচ্চা শয়তান — দুপুর বেলা ফাইজলামি করতে আসছে।

— ফ্রি ইস্তারি আর এক সপ্তাহ দিবে।

— আমি হাবিজাবি জিনিস কিনা দিবো না।

— কেন দিবেন না? আপনের ন্যায্য-অন্যায্য সব কথা আমরা শুনি। সারাদিন বাসায় বইসা থাইকা আমরা করবোটা কী? বাসার ভিতরে আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দেন।

ঠাণ্ডা গলায় কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো বিউটি। তার ঠিক চার দিন পরে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে মুখলেস সাহেব ভিসিআর নিয়ে বাসায় ফিরলেন, সাথে ফ্রি ইস্তারি। এবং সেই ভিসিআর অনিবার্য কারণেই বিউটির ঘরে রাখা হলো। সেই ভিসিআর মাঝেমধ্যে বসার ঘরে নিয়ে যাওয়া হতো আর তখন সবাই মিলে কোনো পুরানো বাংলা সিনেমা দেখা হতো। উত্তম-সুচিত্রার একটাও ছবি এই পারিবারিক মুভি-নাইট থেকে বাদ পড়ে নাই। আজকাল অবশ্য সবাই মিলে সিনেমা দেখা আর হয় না। বরং মা আর দুই মেয়ে প্রায়শই একসাথে রাত জেগে সিনেমা দেখেন। যোধা আকবর-ও একসাথে দেখার কথা। কিন্তু বিউটি ভাবছে রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ছবিটা একাই দেখে ফেলবে। আবার গরম গরম লুচি খাওয়ার জন্যও প্রাণটা আঁইঢাই করছে। লুচি খেয়ে সিনেমা দেখতে বসবে বলে ঠিক করলো। রাগ করে সে নিজেকে কষ্ট দিবে কেন। এই রকম ফালতু রাগ বিউটি করে না! বরং রাগ করে এমন ব্যবস্থা করবে যেন সে ছাড়া আর কেউ লুচি খেতে না পারে।

বিউটি সিনেমা দেখা আপাতত বন্ধ রেখে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো। ফরিদা নিজেই গরম গরম লুচি প্লেটে নিয়ে বসে আছেন। বিউটি এসে বসাতে খুশি হলেন। বেশ আয়োজন করে বেড়ে-ধরে মেয়েকে খাওয়ালেন।

— আম্মা, হাঁসের মাংস রানবেন না? ঝাল দিয়েন।

— বেশি ঝাল দেয়া যাবে না।

— কেন, বেশি ঝাল দেয়া যাবে না কেন?

— তোর আব্বা খাবে জানস না, সব কথায় তর্ক করস।

— আব্বা কবে থিকা ঝাল খায় না?

বিউটির তর্ক করার রোখ চাপলে সে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে তর্ক চালিয়ে যায়। ফরিদা কঠিন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বিউটিও পাল্টা তাকিয়ে রইলো যেন এটা একটা খেলা। কে কতোক্ষণ চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়ে থাকতে পারে।

— তোর বড় বাড় বাড়ছে বিউটি। দিন কইলাম ঘনাইছে।

ফরিদার হিসহিস গলা শুনে বিউটি হেসে ফেললো। ফরিদা আরও কয়েক মুহূর্ত কঠিন দৃষ্টি ধরে রাখলেন। তারপর স্বাভাবিক গলায় বললেন, “শুকনা মরিচ ভাইজা রাখমু নে। ঝাল খাইতে ইচ্ছা করলে ডলা দিয়া নিস।”

— আম্মা, সিনেমা দেখবেন?

— না, এখন রান্না বসাবো। ইচ্ছা হইলে তুই দ্যাখ। এক সিনেমা তো বহুবার দেখতে পারস, পরে আমাদের সাথে আবার দেখবি।

ফরিদা মন্থর পায়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। মেয়ের সাথে টুকটাক কথা বলে তার কিঞ্চিৎ হালকা লাগছে, কিন্তু তারপরও কপালের ভ্রূকুটি একেবারে মিলিয়ে যাচ্ছে না।

রাবেয়ার মা পিঁয়াজ কেটে রান্নার সব যোগাড়যন্ত করে রেখে গেছে কাপড় ধুতে, সেদিকে তাকিয়ে ফরিদা সন্তুষ্ট হলেন। মাঝারির চেয়ে বড় একটা কড়াই চুলায় বসালেন। তেল দিলেন অল্প, এমনিতেই হাঁস থেকে বিস্তর তেল বের হয়। গত মাসে মুখলেস সাহেবের কোলেস্টরাল চেক করা হয়েছে, বেশ হাই। হাঁস-মাস এখন তার না খাওয়াই ভালো। কিন্তু রান্না করলে দুই এক টুকরা মুখে তো দিবেনই। চার জনের সংসারে তিনজন খাবে একজন খাবে না, সেটা হয় না। ডানা, পাখা, গলা, আর দুই টুকরা হাড় রাবেয়ার মা আর পিচ্চির জন্য বেড়ে দেওয়ার পর মাংস থাকে অনেক। হাঁসের চামড়া বড় মেয়ের খুব পছন্দ। ফরিদারও ভালো লাগে, সত্যি কথা বলতে কী তারই সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু কখনও তা প্রকাশ করেন নাই, এমনকি খাওয়ার সময়ও এমন ভাব করেন যেন অনুরোধে ঢেঁকি গিলছেন। ঠিক করলেন, আজকে ভালো করে কষিয়ে ভূনা ভূনা করে রান্না করবেন। তেল মশলা একটু বেশিই খাওয়া হবে — থাক, ডেইলি ডেইলি তো আর খাচ্ছেন না। তাছাড়া ইলিশ-পোলাওটাও চড়িয়ে দিতে হবে। রান্নার সময় হাতের কাছে সব কিছু যেন পান, রাবেয়ার মা’কে মনে করিয়ে দিতে হবে। নইলে শেষ মুহূর্তে দেখা যাবে মাছ-ই ডিপ থেকে বের করে নাই।

এসব তুচ্ছ কথা ভেবে ফরিদা মনকে ব্যস্ত রাখছেন, নইলে এতক্ষণে আবদুুল বশির বিষয়ক চিন্তায় অস্থির থাকতেন। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, তার একবারও লাভলির কথা মনে আসে নাই এবং সচেতনভাবেই তিনি মনে আসতে দেন নাই। তিনি নিশ্চিত দু’টার অন্তত দশ-পনেরো মিনিট আগে লাভলি বাসায় এসে যাবে, শুধু শুধু ব্লাড প্রেশার চড়িয়ে ফায়দা কী!

— কাপড় ধোয়া হইছে, ছাদের চাবি দেন খালাম্মা, নাইড়া দিয়া আসি।

— ইলিশ মাছ পরিষ্কার করছো?

— না, ভিজাইয়া রাখছি।

— এখন ইলিশ মাছটারে ভালো কইরা পরিষ্কার করো। পোলাওর চাল বাইছা রাখো, কাঙ্করে ভরা — ঠিক একটার সময় রান্না বসাবো, গরম গরম খাইতে পারবে।

— খালাম্মা, কাপড়?

— তুমারে যেইটা করতে বলি সেইটা করো, খালি প্যাচাল।

ফরিদা এক গাদা হুকুম দিয়ে মাংস কষানোতে মনোনিবেশ করেন। কষানো হয়ে গেলে অল্প পানি দিয়ে ঢেকে দিলেন, জ্বালও কমিয়ে দিলেন।

— রাবেয়ার মা, মাংস তেলের উপর উঠলে চুলা নিবায় দিও।

রাবেয়ার মা নিঃশব্দে ইলিশ মাছের আঁশ ছাড়াচ্ছিলো, কোনো রকমে মাথা নাড়লো। ফরিদা হুকুম দিয়েই তড়িঘড়ি করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলেন পিছনের বারান্দায়। বারান্দায় ঢোকার আগেই পুরানো হিন্দি গানের একটা লাইন কানে ঢোকায় ভ্রূজোড়ার সাথে তার বাঁ চোখটাও কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো।

‘… যো ভি হো তুম খুদা কি কসম লা জওয়াব হো…’

মুখলেস সাহেব চিৎপাত হয়ে বেতের সোফা টাইপ চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন আর তার দুই পা সামনে রাখা সাইড টেবিলের উপর তুলে দেয়া। গানের আবেশে আর চুল টানার আরামে দুই চোখই বন্ধ। পিচ্চি টুইজার দিয়ে মন লাগিয়ে পাকা চুল তুলছে আর গানের তালে তালে মাথাটা ডানে বাঁয়ে দুলছে। ঠোঁটও নড়ছে কিন্তু কিছু শোনা যাচ্ছে না। পাকা চুল তুলতে পিচ্চির বড় ভালো লাগে। একটা একটা করে তোলে আর গোনে। কুড়িটা পযন্ত তোলা হলে আবার এক থেকে শুরু করে। এই পর্যন্ত তিন কুড়ি বারোটা পাকা চুল তোলা হয়েছে। গতকাল তুলেছে দুই কুড়ি আঠারোটা আজকে তার চাইতে অনেক বেশি। ফরিদা বারান্দায় ঢোকা মাত্র পিচ্চি তটস্থ হয়ে গেলো, মুখলেস সাহেব কিছুই টের পেলেন না, তিনি হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছেন। খবরের কাগজ মুখের উপর ফেলে বা গান শুনতে শুনতে বারান্দায় উনি এরকম হরদম ঘুমান। ফরিদা ইশারায় পিচ্চিকে তার সাথে আসতে বললেন। মুখে কিছু বললেন না। আসলে মুখলেস সাহেবের ঘুম ভাঙাতে চান নাই।

এই লোকটার জন্য ফরিদার মায়াই লাগে। ভিনদেশী গাছের মতো শুধু বুনে দেয়া হয়েছে এই সংসারে, এছাড়া এই সংসারের সাথে তার কোনো সাত নাই। মেয়েদেরকে তিনি আদরও করেন না অনাদরও করেন না। সব কিছুকে ঘিরেই এরকম বন্ধনহীন সম্পর্ক। তবে ফরিদার উপর তার নির্ভর আর বিশ্বাস অন্ধত্ব ছুঁয়েছে। স্বামীর দিকে এক রকমের মমতা নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ফরিদা। বারান্দা থেকে বেরিয়ে পিচ্চিকে ধোয়া কাপড়ের গামলা নিয়ে তার সাথে ছাদে যেতে বললেন।

— আমি ছাদে যাইতেছি, বাথরুম থিকা ভিজা কাপড়গুলা নিয়া আয়। একবারে পারবি?

— হ পারুম।

— সিঁড়ির গেইটের চাবি কই? বাইরে থিকা আইসা চাবি কইলজার মধ্যে নিয়া বইসা থাকস কেন? আসার সাথে সাথে আমার হাতে চাবি দিয়া যাবি, মনে থাকবে?

— হ থাকবো।

— চাবি কই? চাবি দে।

— খালুজান ডাকলো, হের বাদে বারান্দার টেবিলের উপরে রাখছি।

— যা নিয়া আয়, তারপরে কাপড় নিয়া ছাদে আয়।

পিচ্চি দৌড় দিলো চাবির জন্য আর তক্ষুনি কয়টা বাজে দেখার জন্য ফরিদার ভিতরটা কোনো রকম ওয়ার্নিং ছাড়াই ক্ষেপে উঠলো। বসার ঘরের দেয়াল-ঘড়িতে প্রায় তিন মাস ধরে পোনে একটা বেজে আছে। ব্যাটারি বদলাতে হবে কিন্তু সেটাই হয়ে উঠছে না। ফরিদা শোবার ঘরের দিকে এক রকম ছুটে গেলেন। শোবার ঘরের উল্টা দিকের দেয়াল-ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলেন এগারোটা কুড়ি বাজে। না, বিস্তর সময় আছে। এতো উতলা কেন বোধ করছেন সেটাও ভেবে পাচ্ছেন না। একবারেই যে ভেবে পাচ্ছেন না তাও ঠিক না। সকালে আবদুল বশিরের ফোন তার দুনিয়াকে মোটামুটি একটা ভালো রকম নাড়া দিয়ে গেছে। চমক জীবনে ফরিদা কম দেখেন নাই আর সেগুলিকে বলতে গেলে একাই সামলেছেন। কিন্তু সকাল বেলার চমকটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। অবশ্য কোন চমকের জন্যই বা প্রস্তুত ছিলেন। অন্যগুলিকে যখন বাগে আনতে পেরেছেন এইবারেরটাকেও পারবেন ইনশাল্লাহ।

ত্রস্ত পায়ে ছাদে উঠে এলেন ফরিদা। কীসের এতো তাড়া কে জানে! এসে দেখলেন ছাদের দরজার সামনে পিচ্চি দাঁড়িয়ে আছে, কাপড়ের গামলাটা তার সামনে মাটিতে রাখা। ফরিদা চাবি দিয়ে ছাদের দরজা খুললেন। সিঁড়ি ঘর জুড়ে জমাট অন্ধকার কিন্তু দরজার নিচ দিয়ে এক চিলতে তীব্র রোদ মাথা কুটে মরছে ভিতরে ঢোকার জন্য। দরজা খোলার সাথে সাথে রোদের প্রখর তেজ এক লাফ দিয়ে সিঁড়ি ঘরে ঢুকে ওদের চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। নিজের অজান্তেই ভ্রƒজোড়ার সাথে সাথে আরেক দফা চোখ কুঁচকে গেলো ফরিদার আর রোদের তীব্রতা ঠেকাতে পিচ্চি চোখের উপরে হাত উঠালো। ছাদে পা দিয়ে চমৎকার লাগলো ফরিদার। শীতের রোদের কোনো জবাব নাই।

— নিচের গেইটের চাবি আনছস? দে।

চাবির কথা ভুলতেই পারছেন না ফরিদা। পিচ্চির হাত থেকে চাবিটা নিয়ে আঁচলের প্রান্তে গিঁঠ দিলেন। এইবার শান্তি শান্তি লাগছে।

পিচ্চি কাপড়-শুকানো-দড়িতে ভেজা কাপড়গুলি মেলে দিচ্ছে। ফরিদা আড়চোখে দেখে নিলেন কাপড়গুলি টান টান করে মেলছে কি না। একটু দেখে ক্লান্ত লাগলো। ‘মেলুক যেভাবে খুশি মেলুক’ — এরকম একটা ভাব এলো মনে যা তার জন্য খুবই বেমানান। ধীর পায়ে ফরিদা ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ালেন।

আজ ১৬ নভেম্বর ২০০৭, লাভলির জন্মদিন। আজকের দিনটাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না ফরিদা। হাতের কঠিন মুঠি থেকে কেবলই ফসকে ফসকে যাচ্ছে। মুখলেস সাহেবকে কি বলবেন বশিরের ফোনের খবর — বলেই বা কী লাভ। তাকে বলা আর না বলা সমান কথা। থাক, এমনিতেও শরীরটা ভালো না।

— খালাম্মা, নিচে যামু।

— হ্যাঁ, নিচে যা। রাবেয়ার মা’রে গিয়া ক’ আমি ছাদ থিকা নাইমাই ইলিশ-পোলাও বসাবো। তুই টেবিল পরিষ্কার কর গিয়া, প্লেট বাসন যা আছে ধুইয়া ফালা।

পিচ্চি ছাদ থেকে বের হয়ে গেলো, সিঁড়িতে তার দুমদাম পায়ের শব্দ ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ফরিদা ছাদে এখন সম্পূর্ণ একা, ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা দুইবার পায়চারি করলেন।

* * *

লাভলিকে পেটে নিয়ে আট মাস নয় দিন পোয়াতি অবস্থায় ফরিদা আবার বাপের বাড়ি ফিরে যান। বিয়ের পর বাপের বাড়িতে সেই তার দ্বিতীয় যাত্রা। মাঝে পোনে দুই বছর কেটে গেছে। বাপের বাড়ি যানও নাই, চিঠিপত্রও দেন নাই। মুখলেস সাহেব দু’একবার যাওয়ার প্রসঙ্গ আনলে ফরিদার সাফ জবাব, “বিয়ার পরে মেয়েদের আর বাপের বাড়ি থাকে না, স্বামীর বাড়িই সব। আমার বাপের বাড়ি যাওনের জন্য তুমার এতো চুলকানি উঠে কেন? বেশি চুলকানি উঠলে তুমি যাও।”

প্রত্যাশিত ধমক খেয়ে মুখলেস সাহেব এই নিয়ে আর কথা বলতেন না। তবে ফরিদা নিজেই একদিন বাপের বাড়িতে যেতে চাইলেন। তার তখন ভরা অবস্থা। মুখলেস সাহেব জান জীবন দিয়ে ফরিদার সেবা করছেন। কীসে সুবিধা, কীসে অসুবিধা দেখতে গিয়ে খুশি করার চাইতে ধমক খাচ্ছেন বেশি। সেই সময়টা ফরিদার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। বিউটি যখন পেটে এলো তখনকার সময়টাও ভালো ছিলো কিন্তু প্রথমবারের সাথে তার তুলনা চলে না। একবারের জন্যও ফরিদা বা মুখলেস সাহেব, এই দু’জনার একজনেরও মনে হয় নাই কোথাও কোনো ছন্দপতন আছে।

মুখলেস সাহেব চিঠি লিখে শ্বাশুড়ি আম্মাকে ফরিদার সন্তান পেটে আসার সুসংবাদ আগেই জানিয়েছিলেন। অনেক দিন মেঝো মেয়ের কোনো খবরাখবর পান না, খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়েই তিনি চিঠিটা খুললেন, এক নিঃশ্বাসে চিঠির আদ্যোপান্ত পড়লেন। পড়তে পড়তে ঠোঁটের বাঁ প্রান্ত কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো। তবে তা মুহূর্তের জন্য কেবল। পরক্ষণেই তার চোখে-মুখে হাসির চ্ছটা ভোরের আলো ফোটার মতো ধীরে উদ্ভাসিত হলো। আর সেই আলোকিত উদ্ভাস বজায় রইলো ফরিদার বাপের বাড়ি অবস্থানের শেষ দিন পর্যন্ত। মেয়ের জন্য অসম্ভব গর্ব অনুভব করলেন তিনি। এমন না হলে তার মেয়ে।

মুন্সিগঞ্জে তাদের সেই বিশাল বাড়িটাতে সাড়া পড়ে গেলো, বাচ্চা যেন আর কারো হয় না! অক্টোবর মাসের শেষ নাগাদ ফরিদা বাচ্চা প্রসবের জন্য বাপের বাড়িতে গেলেন। হেমন্তকাল! নতুন ধানের গন্ধ উঠানময় ছড়ানো। কামলা বেটিরা ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল কুটছে আর গুন গুন করে গান গাইছে। প্রতিদিন সকালে নতুন চালের পিঠা, খেজুরের রস আর ডাবের শাঁস। অপার্থিব সুখ আর আরাম। ফরিদার ফুট-ফরমাশ খাটার জন্য হাতের কাছে গোটা তিনেক মেয়ে। কেউ মাথায় তেল মালিশ করছে, কেউ কাঁঠালের বিচি আর শুঁটকি মাছের ভর্তা করছে আবার কেউ ফরিদার তলপেটে সেঁক দেওয়ার জন্য উনুন জিইয়ে রাখছে। ব্যতিব্যস্ত অবস্থা। ফরিদার বড় ভাবি, মেঝো ভাবি দু’জনেই তখন মুন্সিগঞ্জের বাড়িতে থাকেন, ফরিদার ছোটো বোনের তখনও বিয়ে হয় নাই। এতো যতœ-আত্তি দেখে ওদের তিনজনেরই চোখ ঠারাতো। বিশেষ করে ছোটো বোন শিরিনের।

ফরিদার মা বরাবরই ছিলেন মাপা মানুষ। নিতান্ত সাধারণ পরিবেশও তার উপস্থিতিতে বিশেষ দাম পেতো। সেই আম্মার আহ্লাদটাই সবার চোখে পড়লো সবচেয়ে বেশি। পরিবারে ফরিদার বাচ্চাই প্রথম না, তার আগে বড় বোন আর বড় দুই ভাইয়ের বাচ্চা হয়ে গেছে। প্রত্যেকেরই অন্তত দু’টা করে। সুতরাং ফরিদার বাচ্চা হওয়া নিয়ে এতো মাতামাতি কীসের তা কেউ ধরতে পারলো না, তাই হিংসার পরিমাণও গেলো বেড়ে। ফরিদার পেটে যাতে দাগ না পড়ে সেকারণে আম্মা সকালে, আর রাতে পরম নিষ্ঠায় তিলের তেল মালিশ করে দিতেন। গরম পানিতে নিজে গোসল করিয়ে দিতেন। ফরিদার পছন্দের খাবার নিজের হাতে রাঁধতেন। যতেœর চূড়ান্ত করতেন, চুল আঁচড়ে পাটপাট বেণী করতেন, ছায়ার মতো সাথে সাথে থাকতেন। মায়ের এই মনোযোগী-সেবায় ফরিদা নিজেও বুঝতে পারলেন যে ব্যক্তিত্বের দিক থেকে তিনি আম্মার চাইতে কোনো অংশেই কম না। ফরিদার মাথা আরও উঁচুতে উঠে গেলো, তার মঙ্গলের চাইতেও উঁচুতে।

‘… কা কা কা … ’

কাকের ডাকের কর্কশ ধাক্কায় ফরিদার সম্বিৎ ফিরে এলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একটা কাক বেশ নিচু দিয়ে তাদের ছাদটাকে কেন্দ্র করে ঘুরে ঘুরে উড়ছে আর কা… কা… কা… ডেকে যাচ্ছে। আশে পাশে আর কোনো কাক দেখা যাচ্ছে না। কাকটাকে হাত উঁচু করে ‘হুস’ ‘হুস’ বলে তাড়াবার চেষ্টা করলেন। লাভ হলো না, কাকটা বরং আরও মরিয়া হয়ে ফরিদার থেকে বিপজ্জনক দূরত্বে বৃত্তাকারে ঘুরতে শুরু করলো আর তারস্বরে ডাকছে তো ডাকছেই। নির্জন দুপুর, আশেপাশের ছাদে একটা প্রাণীও নাই, এরকম সময়ে একটা কাক কর্কশ তীব্র স্বরে কা… কা… কা… ডেকে চলেছে। ঢেউহীন পুকুরের মতো সেই নিস্তরঙ্গ দুপুরে কাকের কর্কশ স্বর মনে হলো অন্য কোনো দুনিয়া থেকে আসছে, শুধু ফরিদাকে সাবধান করবার জন্য।

কাকটাকে তাড়াবার জন্য ফরিদার জিদ চেপে গেলো। ছাদের কোণা থেকে একটা ঢিল নিয়ে ছুঁড়ে মারলেন। ঢিলটা কাকের আশেপাশেও যেতে পারলো না, মাঝপথেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লো। ঢিলটাকে গ্রাহ্যই করলো না কাকটা। আশেপাশে কোনো কাক মারা যায় নাই তো — একবার ভাবলেন ফরিদা। না না, তাহলে একটা না সাথে আরও কয়েকটা জুটে যেতো। মনের ভিতরের ‘কু’ ডাক আবারও প্রবল বিক্রমে ফিরে এলো।

অনেক উঁচু থেকে দেখলে দৃশ্যটা এরকম দেখাবে: একটা নির্জন ছাদ, দুপুরের নিস্তব্ধতা চারদিক থেকে ছাদটাকে চেপে ধরেছে, সেই ছাদে ততোধিক নির্জন একজন প্রৌঢ়া এলোপাথাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছেন আর মাথার উপরে দু’হাত ছুঁড়ে অন্ধের মতো ‘হুস’ ‘হুস’ করছেন। তার ঠিক চোখের তারার উপরেই কালো মখমলে মোড়ানো একটা কাক বৃত্তাকারে ঘুরছে আর বিরামহীন কা… কা… ডেকে চলেছে। কিছু একটা ঘটবে, ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটবে — কুল ছাপানো নদীর মতো এই অমঙ্গল চিন্তা বার বার ফরিদার মনে আছড়ে পড়ছে আর তখন তার সমস্ত রোষ গিয়ে পড়ছে কাকটার উপর। যেন কাকটাকে তাড়াতে পারলেই তার এবং তার পরিবারের উপর থেকে সমস্ত বালা মুসিব্বত কেটে যাবে।

* * *

বিউটির ছবি দেখায় মন নাই। ফরিদার কাছ থেকে কী বাগানো যায় মাথায় শুধু সেই চিন্তা ঘুরছে। দামি কিছু বাগাতে হবে। প্রতিদিন ধীরেসুস্থে একটু একটু করে একটা ভয় আম্মার বুকের ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে, যাতে আম্মার অবস্থা ‘চাহিবা মাত্র প্রাপককে দিতে বাধ্য থাকিবে’ টাইপ হয়। তারপর সুযোগ বুঝে চাহিদা নিয়ে উপস্থিত হওয়া। ফরিদার কাছ থেকে জিনিসপত্র আদায় করা এতদিনে বিউটির কাছে ডাল-ভাত হয়ে গেছে। অবশ্য এতদিন সে বড় কোনো দাও মারে নাই। সর্বোচ্চ দাও ছিলো ভিসিআর। এবার এমন কিছু চাইতে হবে যেটা সে সম্পূর্ণ একা ভোগ করতে পারবে। কী চাওয়া যায়! একটা বিশাল সাইজের টিভি চাইতে পারে। না না টিভি চাওয়া যাবে না। তখন এই ঘর থেকে আর কাউকে নড়ানো যাবে না। আব্বাও হয়তো বারান্দার বেতের চেয়ারটা নিয়ে এসে এখানে ঘাঁটি গাড়বেন, কিছুই বলা যায় না।

আম্মা কোন বিবেকে আপাকে একা ছাড়লেন, কোন বিবেকে! আপার একা একা গাউছিয়ায় যাওয়ার দরকারটা কী? লাভলিকে একা পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত বিউটি কিছুতেই হজম করতে পারছে না। এখন যদি সে দরজা খুলে নিচে যেতে চায়, একটু ঘোরাঘুরি করে আসতে চায় আম্মা কি সেটা দিবেন করতে, কোনোদিনও না। সে তো কখনও আম্মার অবাধ্য হয় নাই। লাভলি ভাব-ভালোবাসা করার দুঃসাহস পর্যন্ত দেখিয়েছে; সে বড়জোর ফরিদার সাথে অহেতুক তর্ক করে। এই তর্কে কারো কোনো ক্ষতি নাই, এটা বিউটি যেমন জানে ফরিদাও জানেন।

রিয়াজের কথা বিউটি যেদিন ফরিদার কানে তুললো সেদিন বিউটি ভেবেছিলো এইবার লাভলির ইহলীলা সাঙ্গ হবে, হওয়াই উচিৎ। কিন্তু সেই তুলনায় ফরিদা কিছুই করলেন না — দুইবোন শুধু আঠারো দিন ঘরবন্দি ছিলো। অথচ বিউটি যদি এরকম কোনো কাণ্ড করতো তাহলে খুন জখম হওয়াও আশ্চর্যের হতো না। এইবার একটা হেস্তনেস্ত— করতে হবে, এত শস্তা না! সবাই তার সাথেই কেন এরকম করবে বিউটি ভেবে পায় না। এই যেমন, সে হলো লাভলির চেয়ে সাড়ে তিন বছরের ছোট, একটা দু’টা বছর না, সাড়ে তিন বছর। অথচ রিয়াজ কি না ওর দিকে তাকিয়েও দেখলো না। লাভলির জন্য প্রেম-পাগল ইউসুফ বনে গেলো। বিউটি হলফ করে বলতে পারে সে লাভলির চেয়ে অন্তত দশগুণ সুন্দর, থাকেও সুন্দরভাবে। তাহলে, রহস্যটা কোথায়! আপা ভাব ধরে থাকে যেন কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না। আম্মাও তাই বিশ্বাস করেন, কিন্তু সে ঠিকই জানে লাভলি কত বড়ো সেয়ানা। আজকে কী কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে কে জানে। আম্মা যদি তাকে ঘরবন্দি করে রাখেন লাভলিকে উচিৎ শিকল দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা।

এইসব ভাবতে ভাবতে অসহ্য ক্রোধে বিউটির শরীর জ্বলে গেলো। বিছানা ছেড়ে এক ঝটকায় উঠে টিভি বন্ধ করে দিলো।

— রাবেয়ার মা, রাবেয়ার মা…

— কী কন…

— আম্মা কই?

— খালাম্মা ছাদে কাপড়…

রাবেয়ার মা’র কথা শেষ করতে দিলো না তার আগেই রাতের ট্রেনের মতো ঘর ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে গেলো। ছাদে উঠতে গিয়ে পিচ্চির সাথে তুমুল ধাক্কা লাগলো। দুপদাপ করে পিচ্চি নামছে, দুড়দাড় করে বিউটি উঠছে। হেডঅন কলিশন। পিচ্চি-ই ব্যথা পেলো বেশি। ধাক্কার চোটে সিঁড়ির গায়ে হেলে পড়লো। সেইদিকে তাকালো কি তাকালো না, একটা গালি দিয়ে যেই বেগে উঠছিলো সেই বেগেই আবার ছাদমুখী ছুটলো বিউটি।

ছাদে পা দিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বিউটি স্থবির হয়ে গেলো। সে অবাক হয়ে দেখলো তার মা, মিসেস ফরিদা খানম মাথা খারাপের মতো ছোটাছুটি করছেন, সমানে দু’হাত ছুঁড়ছেন শূন্যে। একটা কাক তার সেই দু’হাত অনুসরণ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। একবার মনে হলো ঠোকর দিবে বা! কাকটা ফরিদার মাথার খুব কাছে নেমে আসছে আবার হুস খেয়ে গজ খানিক উপরে উঠে যাচ্ছে। মায়ের এই মূর্তি দেখে বিউটি ভীষণ রকম চমকালো, তাদের সমগ্র জীবনের অস্বাভাবিকত্ব চোখের সামনে নিয়ন সাইনের মতো জ্বলতে লাগলো। কষ্ট হলো বিউটির; ফরিদার জন্য কষ্ট হলো, লাভলির জন্য আর নিজের জন্য। অস্তিত্ব জানান না দিয়ে চুপচাপ নিচে নেমে এলো।

============================
লীসা গাজী
লেখক, অভিনেত্রী, নির্দেশক
leesa@morphium.co.uk

bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ লীসা গাজী

অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ

No comments

Powered by Blogger.