সবাইকে উচ্চতর পদমর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয় -রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম by আকবর আলি খান
মিজানুর রহমান খানের প্রবন্ধে বিচারকদের নিম্নলিখিত সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে: ১. বেতনের অপ্রতুলতা, ২. সর্বোচ্চ পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বাধা, ৩. নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেন না।
বেতনের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেতনের সঙ্গে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের কোনো সম্পর্ক নেই। বেতনের প্রশ্ন হলো সম্পদের। ভারত ও পাকিস্তানে শুধু বিচারকদেরই বেশি বেতন দেওয়া হয় না, বাংলাদেশের তুলনায় অন্যান্য পদে অনেক বেশি বেতন দেওয়া হয়। যেহেতু সরকারের বিঘোষিত নীতি অনুসারে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের মধ্যে ১০ গুণের বেশি ব্যবধান রাখা সম্ভব হয় না, সেহেতু সর্বোচ্চ পদে বেতন বাড়ানো সরকারের পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বনিম্ন পদে এত বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন, তাঁদের বেতন বাড়লে সরকারের পক্ষে সে অর্থের সংস্থান করা অত্যন্ত কঠিন হবে। দ্রব্যমূল্যের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বিচারপতিদের বিশেষ বেতন স্কেল প্রবর্তনের প্রস্তাব অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। তবে বর্তমানে জাতীয় বেতন স্কেল The Services (Reorganization and conditions) Act, 1975 (XXXII 0f 1975) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই আইনে প্রজাতন্ত্রের সব পদের জন্য ইউনিফর্ম স্কেল প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে জেলা জজ এবং তাঁর অধীন কর্মকর্তাদের বেতন তাঁদের সমমানের কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি হতে পারে না। ওই সমস্যা সমাধানের জন্য বিচারকদের বেতন নির্ধারণের পদ্ধতি পরিবর্তন করা যেতে পারে। ১৯৭৫ সালের আইন অনুসারে, বিচারকদের বেতন নির্ধারণ না করে একটি স্বতন্ত্র আইনের মাধ্যমে তাঁদের বেতন নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বেতনের যেকোনো পরিবর্তন সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হবে। বর্তমানে একটি স্বতন্ত্র বেতন কমিশনের মাধ্যমে বিচারকদের বেতন নির্ধারণ সম্পর্কে সুপারিশ প্রদানের বিধান করা হয়েছে। এর পরিবর্তে বিচারকদের বেতন সুপারিশ করার দায়িত্ব সংসদের আইন ও বিচারবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির ওপর দেওয়া যেতে পারে।
পদোন্নতি প্রশ্নে মিজানুর রহমান খান যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা প্রকৃতপক্ষে তথ্যনির্ভর নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই সব কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদে সমাসীন হতে পারেন না। বাংলাদেশে বিসিএস প্রশাসনের কর্মকর্তারা অন্য কোনো কর্মকর্তার চেয়ে হয়তো বেশি পদোন্নতি পান, এর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে যেসব ক্যাডার আছেন, তাঁদের সবাই সচিবের পদে পদোন্নতি পান না। যেমন ধরা যাক, আয়কর অথবা হিসাব-নিরীক্ষা অথবা শুল্ক বিভাগের কোনো সচিবের পদ নেই। তবে সচিবের পরের যতগুলো পদ আছে, এর ১০ শতাংশ পদে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সচিবের বেতন স্কেল দেওয়া হয়ে থাকে। এটা সব ক্যাডারের জন্য প্রযোজ্য। অবশ্য আলাদা আইন করে ভিন্ন বেতন স্কেল দেওয়া হলে বিচারকদের ওই সমস্যা থাকবে না।
তৃতীয় সমস্যাটি সম্পর্কে মিজানুর রহমান খান বিস্তারিত লেখেননি। তবে মুখে জানিয়েছেন, বিচারপতিদের সার্কিট হাউসে অবস্থানের সময় যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না। প্লেন, ট্রেন ও স্টিমারের টিকিটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া হয় না। কাজেই তাঁদের মানক্রম উন্নীত করার প্রয়োজন রয়েছে। সার্কিট হাউসের সমস্যা হলো, সেখানে আসনসংখ্যা সীমিত এবং এর ফলে সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয় না। সার্কিট হাউস মূলত সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য, ব্যক্তিগত কাজের জন্য নয়। যদি কক্ষ শূন্য থাকে, তবে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য উচ্চতর ভাড়ায় দেওয়া যেতে পারে। দেশে বর্তমানে অনেক শহরে মানসম্মত হোটেল স্থাপন করা হয়েছে। সার্কিট হাউসে উপযুক্ত কক্ষ পাওয়া না গেলে, বিচারপতিদের হোটেল ভাড়া সরকার থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে এই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে।
বিমান ও রেলের ক্ষেত্রে জরুরি প্রয়োজনে সরকারের ব্যবহারের জন্য অল্প কিছু শহরে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এই আসনগুলো ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের ভিত্তিতে বণ্টন না করে, প্রয়োজন বিবেচনা করে অথবা আগে এলে আগে পাবে ভিত্তিতে বিতরণ করা যেতে পারে। অবশ্যই এই রিজার্ভেশন ব্যবস্থা তুলেও দেওয়া যেতে পারে—বর্তমানে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা এত উন্নত হয়েছে যে সরকারের জরুরি প্রয়োজনের জন্য রিজার্ভেশন না রাখলেও চলে।
ওপরের আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে বিচারকদের মুখ্য সমস্যা হলো বেতনের অপ্রতুলতা। এ সমস্যার সমাধান ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে মিলবে না।
বিচারকেরা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে বেশি হইচই করলে আমাদের মনে অন্য ধরনের শঙ্কা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এ উপমহাদেশে বিচারকদের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। তাঁরা তাঁদের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সামাজিক কর্মকাণ্ড ও আনুষ্ঠানিকতা থেকে নিজেদের দূরে রাখেন। কাজটি অবশ্যই বেদনাদায়ক। যেকোনো সাধারণ মানুষ সামাজিক শানশওকত চায়। তবু বিচারকের মহান ও পবিত্র দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁদের অনেক ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমাদের দেশে যে সামাজিক পরিস্থিতি, তাতে বিচারকেরা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে বেশি সম্পৃক্ত হলে তাঁদের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। উচ্চতর আদালত কর্তৃক ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সম্পর্কে রায়ের ফলে বিচারকেরা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যদি উত্সাহিত হন, তাহলে সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। কাজেই তাঁদের ভাবমূর্তি সম্পর্কে তাঁদের নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের ভিত্তিতে যে পদমর্যাদা দেওয়া হয়, তার ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। শ্রদ্ধা অর্জন করতে হয়, লোকজনকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য করা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার শর্তেও প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জনমনে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন হতে পারেননি। পুরোনো ভুল পথে না গিয়ে বাংলাদেশের বিচারকদের তাঁদের কাজের ভিত্তিতে জনমনে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
ওপরের বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি শুধু সমস্যা তুলে ধরেছি। সমস্যা সমাধান যে পর্যায়ে হবে, সে পর্যায়ে আমার সে বক্তব্য কোনো দিনই পৌঁছাতে পারবে না। তবু আমি মনে মনে ভাবি, বিষয়টি হয়তো নিচে বর্ণিত সূত্র অনুসারে নিষ্পন্ন হতে পারে:
১. ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো বিষয়টি নিছক প্রটোকলের বিষয় থাকতে পারে।
২. ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের পদাধিকার সরকারের সব উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হতে পারে না। আদালত এর ব্যাখ্যা চাইতে পারেন, যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে সব ক্রিয়াকাণ্ডে সরকার এটি ব্যবহার করবে; তাহলে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি প্রার্থনা করি, আদালতও এটিকে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বেআইনি ঘোষণা করবেন। এই রায়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মানমর্যাদা জড়িত। উপরন্তু যদি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সরকারের সব কাজে ব্যবহূত হয়, তাহলে প্রশাসনেও নৈরাজ্য দেখা দেবে। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স-বলে একজন সচিব কর বিভাগের ডেপুটি কমিশনারের কাছে বিশেষ কোনো মর্যাদা দাবি করতে পারেন না। কাজেই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স রাখতে হলে এটি শুধু সরকারি অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
৩. সরকার নিজ উদ্যোগে প্রয়োজনবোধে বিচারকদের বর্তমান পদমর্যাদা পুনর্বিবেচনা করতে পারে। বিচারকদের স্বতন্ত্র বেতন সম্পর্কে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে শুধু বিচারকেরা অসন্তুষ্ট নন, শিক্ষকেরাও অসন্তুষ্ট। যেমন ধরা যাক, যদি আদালতের নির্দেশে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স জারি করা হয়, তাহলে অতিরিক্ত জেলা জজেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অথবা জাতীয় অধ্যাপকদের ঊর্ধ্বে স্থান পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা তখন হয়তো অভিযোগ করবেন, যাঁদের মাত্র কিছুদিন আগে পড়িয়েছেন, তাঁরা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী। প্রকৌশলীরা অভিযোগ করবেন, তাঁরা সর্বাধিক মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে তাঁদের স্থান অনেক নিচে। চিকিত্সকদেরও একই অভিযোগ। সারাজীবন চাকরি করার পর ডাইরেক্টর জেনারেল হেলথ সার্ভিসের পদে উত্তীর্ণ হলে অতিরিক্ত সচিবের মর্যাদাও পান না। সরকারের পক্ষ থেকে যে যুক্তি দেওয়া হয়ে থাকে, সরকারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাঁদের প্রয়োজন বেশি, তাঁদের আগে স্থান দেওয়া হয়। যেমন ধরা যাক, মন্ত্রিপরিষদের পদমর্যাদা সাংসদদের ঊর্ধ্বে। সাংসদেরা নির্বাচিত প্রতিনিধি। একজন অনির্বাচিত আমলাকে তাঁদের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে? সরকারের পক্ষ থেকে এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয়, সরকারের সব অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি থাকা দরকার। যদি ৩৫০ জন সাংসদের পেছনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে বসানো হয়, তাহলে জরুরি প্রয়োজনের সময় তাঁকে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। উপরন্তু প্রজাতন্ত্রের সামরিক-বেসামরিক বিভাগে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, তাঁদের সর্বোচ্চ পদধারী উপযুক্ত পদমর্যাদা প্রদান বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।
বিষয়টি যদি শেষ পর্যন্ত আদালতের মাধ্যমে নিষ্পন্ন হয়, তাহলে সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হবে না। সরকারের জন্য বহু নতুন ধরনের অস্বস্তিকর সমস্যা সৃষ্টি হবে। এ ক্ষেত্রে অন্য একটি বিকল্প হতে পারে, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স একেবারে তুুলে দেওয়া এবং প্রতিটি অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কাকে কোথায় বসানো হবে, সে সম্পর্কে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা সিদ্ধান্ত নেবেন।
সমস্যা হলো, সবাই উচ্চতর পদমর্যাদা চান। বাস্তবতা হলো, সবাইকে উচ্চতর পদমর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয়। এ সংকট প্রসঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জেনারেল আজম খানের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আজম খান ফজলুল হক হলে একটি অনুষ্ঠানে এলেন। তিনি বক্তৃতার শুরুতে বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফজলুল হক হল হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ হল। তিনি তাকিয়ে দেখেন, তাঁর সামনে বসে আছেন সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট। তাঁকে খুশি করার জন্য বললেন, সলিমুল্লাহ হলও শ্রেষ্ঠ। আরেক দিকে বসে আছেন ইকবাল হলের প্রভোস্ট। তাঁকে দেখে বললেন, ইকবাল হলও। আজম খানের বক্তৃতার মতো যদি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স করা যেত, তাহলে কোনো সমস্যা হতো না। আমরা তখন সবাই দাবি করতাম, ‘আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’ [শেষ]
আকবর আলি খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
বেতনের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেতনের সঙ্গে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের কোনো সম্পর্ক নেই। বেতনের প্রশ্ন হলো সম্পদের। ভারত ও পাকিস্তানে শুধু বিচারকদেরই বেশি বেতন দেওয়া হয় না, বাংলাদেশের তুলনায় অন্যান্য পদে অনেক বেশি বেতন দেওয়া হয়। যেহেতু সরকারের বিঘোষিত নীতি অনুসারে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের মধ্যে ১০ গুণের বেশি ব্যবধান রাখা সম্ভব হয় না, সেহেতু সর্বোচ্চ পদে বেতন বাড়ানো সরকারের পক্ষে দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বনিম্ন পদে এত বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন, তাঁদের বেতন বাড়লে সরকারের পক্ষে সে অর্থের সংস্থান করা অত্যন্ত কঠিন হবে। দ্রব্যমূল্যের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বিচারপতিদের বিশেষ বেতন স্কেল প্রবর্তনের প্রস্তাব অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। তবে বর্তমানে জাতীয় বেতন স্কেল The Services (Reorganization and conditions) Act, 1975 (XXXII 0f 1975) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই আইনে প্রজাতন্ত্রের সব পদের জন্য ইউনিফর্ম স্কেল প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে জেলা জজ এবং তাঁর অধীন কর্মকর্তাদের বেতন তাঁদের সমমানের কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি হতে পারে না। ওই সমস্যা সমাধানের জন্য বিচারকদের বেতন নির্ধারণের পদ্ধতি পরিবর্তন করা যেতে পারে। ১৯৭৫ সালের আইন অনুসারে, বিচারকদের বেতন নির্ধারণ না করে একটি স্বতন্ত্র আইনের মাধ্যমে তাঁদের বেতন নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বেতনের যেকোনো পরিবর্তন সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হবে। বর্তমানে একটি স্বতন্ত্র বেতন কমিশনের মাধ্যমে বিচারকদের বেতন নির্ধারণ সম্পর্কে সুপারিশ প্রদানের বিধান করা হয়েছে। এর পরিবর্তে বিচারকদের বেতন সুপারিশ করার দায়িত্ব সংসদের আইন ও বিচারবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির ওপর দেওয়া যেতে পারে।
পদোন্নতি প্রশ্নে মিজানুর রহমান খান যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা প্রকৃতপক্ষে তথ্যনির্ভর নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই সব কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদে সমাসীন হতে পারেন না। বাংলাদেশে বিসিএস প্রশাসনের কর্মকর্তারা অন্য কোনো কর্মকর্তার চেয়ে হয়তো বেশি পদোন্নতি পান, এর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে যেসব ক্যাডার আছেন, তাঁদের সবাই সচিবের পদে পদোন্নতি পান না। যেমন ধরা যাক, আয়কর অথবা হিসাব-নিরীক্ষা অথবা শুল্ক বিভাগের কোনো সচিবের পদ নেই। তবে সচিবের পরের যতগুলো পদ আছে, এর ১০ শতাংশ পদে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সচিবের বেতন স্কেল দেওয়া হয়ে থাকে। এটা সব ক্যাডারের জন্য প্রযোজ্য। অবশ্য আলাদা আইন করে ভিন্ন বেতন স্কেল দেওয়া হলে বিচারকদের ওই সমস্যা থাকবে না।
তৃতীয় সমস্যাটি সম্পর্কে মিজানুর রহমান খান বিস্তারিত লেখেননি। তবে মুখে জানিয়েছেন, বিচারপতিদের সার্কিট হাউসে অবস্থানের সময় যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না। প্লেন, ট্রেন ও স্টিমারের টিকিটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া হয় না। কাজেই তাঁদের মানক্রম উন্নীত করার প্রয়োজন রয়েছে। সার্কিট হাউসের সমস্যা হলো, সেখানে আসনসংখ্যা সীমিত এবং এর ফলে সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয় না। সার্কিট হাউস মূলত সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য, ব্যক্তিগত কাজের জন্য নয়। যদি কক্ষ শূন্য থাকে, তবে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য উচ্চতর ভাড়ায় দেওয়া যেতে পারে। দেশে বর্তমানে অনেক শহরে মানসম্মত হোটেল স্থাপন করা হয়েছে। সার্কিট হাউসে উপযুক্ত কক্ষ পাওয়া না গেলে, বিচারপতিদের হোটেল ভাড়া সরকার থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে এই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে।
বিমান ও রেলের ক্ষেত্রে জরুরি প্রয়োজনে সরকারের ব্যবহারের জন্য অল্প কিছু শহরে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এই আসনগুলো ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের ভিত্তিতে বণ্টন না করে, প্রয়োজন বিবেচনা করে অথবা আগে এলে আগে পাবে ভিত্তিতে বিতরণ করা যেতে পারে। অবশ্যই এই রিজার্ভেশন ব্যবস্থা তুলেও দেওয়া যেতে পারে—বর্তমানে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা এত উন্নত হয়েছে যে সরকারের জরুরি প্রয়োজনের জন্য রিজার্ভেশন না রাখলেও চলে।
ওপরের আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে বিচারকদের মুখ্য সমস্যা হলো বেতনের অপ্রতুলতা। এ সমস্যার সমাধান ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে মিলবে না।
বিচারকেরা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে বেশি হইচই করলে আমাদের মনে অন্য ধরনের শঙ্কা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এ উপমহাদেশে বিচারকদের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। তাঁরা তাঁদের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সামাজিক কর্মকাণ্ড ও আনুষ্ঠানিকতা থেকে নিজেদের দূরে রাখেন। কাজটি অবশ্যই বেদনাদায়ক। যেকোনো সাধারণ মানুষ সামাজিক শানশওকত চায়। তবু বিচারকের মহান ও পবিত্র দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁদের অনেক ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমাদের দেশে যে সামাজিক পরিস্থিতি, তাতে বিচারকেরা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে বেশি সম্পৃক্ত হলে তাঁদের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। উচ্চতর আদালত কর্তৃক ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সম্পর্কে রায়ের ফলে বিচারকেরা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যদি উত্সাহিত হন, তাহলে সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। কাজেই তাঁদের ভাবমূর্তি সম্পর্কে তাঁদের নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের ভিত্তিতে যে পদমর্যাদা দেওয়া হয়, তার ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। শ্রদ্ধা অর্জন করতে হয়, লোকজনকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য করা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার শর্তেও প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জনমনে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন হতে পারেননি। পুরোনো ভুল পথে না গিয়ে বাংলাদেশের বিচারকদের তাঁদের কাজের ভিত্তিতে জনমনে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
ওপরের বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি শুধু সমস্যা তুলে ধরেছি। সমস্যা সমাধান যে পর্যায়ে হবে, সে পর্যায়ে আমার সে বক্তব্য কোনো দিনই পৌঁছাতে পারবে না। তবু আমি মনে মনে ভাবি, বিষয়টি হয়তো নিচে বর্ণিত সূত্র অনুসারে নিষ্পন্ন হতে পারে:
১. ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো বিষয়টি নিছক প্রটোকলের বিষয় থাকতে পারে।
২. ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের পদাধিকার সরকারের সব উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হতে পারে না। আদালত এর ব্যাখ্যা চাইতে পারেন, যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে সব ক্রিয়াকাণ্ডে সরকার এটি ব্যবহার করবে; তাহলে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি প্রার্থনা করি, আদালতও এটিকে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বেআইনি ঘোষণা করবেন। এই রায়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মানমর্যাদা জড়িত। উপরন্তু যদি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সরকারের সব কাজে ব্যবহূত হয়, তাহলে প্রশাসনেও নৈরাজ্য দেখা দেবে। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স-বলে একজন সচিব কর বিভাগের ডেপুটি কমিশনারের কাছে বিশেষ কোনো মর্যাদা দাবি করতে পারেন না। কাজেই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স রাখতে হলে এটি শুধু সরকারি অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
৩. সরকার নিজ উদ্যোগে প্রয়োজনবোধে বিচারকদের বর্তমান পদমর্যাদা পুনর্বিবেচনা করতে পারে। বিচারকদের স্বতন্ত্র বেতন সম্পর্কে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স নিয়ে শুধু বিচারকেরা অসন্তুষ্ট নন, শিক্ষকেরাও অসন্তুষ্ট। যেমন ধরা যাক, যদি আদালতের নির্দেশে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স জারি করা হয়, তাহলে অতিরিক্ত জেলা জজেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অথবা জাতীয় অধ্যাপকদের ঊর্ধ্বে স্থান পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা তখন হয়তো অভিযোগ করবেন, যাঁদের মাত্র কিছুদিন আগে পড়িয়েছেন, তাঁরা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী। প্রকৌশলীরা অভিযোগ করবেন, তাঁরা সর্বাধিক মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে তাঁদের স্থান অনেক নিচে। চিকিত্সকদেরও একই অভিযোগ। সারাজীবন চাকরি করার পর ডাইরেক্টর জেনারেল হেলথ সার্ভিসের পদে উত্তীর্ণ হলে অতিরিক্ত সচিবের মর্যাদাও পান না। সরকারের পক্ষ থেকে যে যুক্তি দেওয়া হয়ে থাকে, সরকারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাঁদের প্রয়োজন বেশি, তাঁদের আগে স্থান দেওয়া হয়। যেমন ধরা যাক, মন্ত্রিপরিষদের পদমর্যাদা সাংসদদের ঊর্ধ্বে। সাংসদেরা নির্বাচিত প্রতিনিধি। একজন অনির্বাচিত আমলাকে তাঁদের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে? সরকারের পক্ষ থেকে এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয়, সরকারের সব অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি থাকা দরকার। যদি ৩৫০ জন সাংসদের পেছনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে বসানো হয়, তাহলে জরুরি প্রয়োজনের সময় তাঁকে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। উপরন্তু প্রজাতন্ত্রের সামরিক-বেসামরিক বিভাগে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, তাঁদের সর্বোচ্চ পদধারী উপযুক্ত পদমর্যাদা প্রদান বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।
বিষয়টি যদি শেষ পর্যন্ত আদালতের মাধ্যমে নিষ্পন্ন হয়, তাহলে সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হবে না। সরকারের জন্য বহু নতুন ধরনের অস্বস্তিকর সমস্যা সৃষ্টি হবে। এ ক্ষেত্রে অন্য একটি বিকল্প হতে পারে, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স একেবারে তুুলে দেওয়া এবং প্রতিটি অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কাকে কোথায় বসানো হবে, সে সম্পর্কে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা সিদ্ধান্ত নেবেন।
সমস্যা হলো, সবাই উচ্চতর পদমর্যাদা চান। বাস্তবতা হলো, সবাইকে উচ্চতর পদমর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয়। এ সংকট প্রসঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জেনারেল আজম খানের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আজম খান ফজলুল হক হলে একটি অনুষ্ঠানে এলেন। তিনি বক্তৃতার শুরুতে বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফজলুল হক হল হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ হল। তিনি তাকিয়ে দেখেন, তাঁর সামনে বসে আছেন সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট। তাঁকে খুশি করার জন্য বললেন, সলিমুল্লাহ হলও শ্রেষ্ঠ। আরেক দিকে বসে আছেন ইকবাল হলের প্রভোস্ট। তাঁকে দেখে বললেন, ইকবাল হলও। আজম খানের বক্তৃতার মতো যদি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স করা যেত, তাহলে কোনো সমস্যা হতো না। আমরা তখন সবাই দাবি করতাম, ‘আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’ [শেষ]
আকবর আলি খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments