শিক্ষক সনদ বাস্তবায়ন করুন-বিশ্ব শিক্ষক দিবস by মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান
শিক্ষা মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকশিত করে, মানবজীবনকে পরিশীলিত করে এবং উন্নত ও সুন্দর সমাজ গঠনের সুপ্ত শক্তিকে করে জাগ্রত। তাই শিক্ষা জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান নিয়ামক। শিক্ষা কথাটি বললেই প্রথমেই যে কথাটি আসে তা হলো শিক্ষক। কেননা শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা, নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টার ওপরই নির্ভর করে শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত উত্কর্ষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা থেকে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠনের ক্রমাগত প্রচেষ্টা এবং ইউনেস্কো আইএলওর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সদিচ্ছায় ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর অর্জিত হয় এই ঐতিহাসিক শিক্ষক সনদ। ১৪৬ ধারা-উপধারাবিশিষ্ট এই সনদে যেমন শিক্ষাকে জাতি গঠন ও উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি এই সনদে শিক্ষকের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকার, মর্যাদা এবং তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশের প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ শিক্ষকের ২১০টি জাতীয় শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা ‘এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’। এ সংস্থার ক্রমাগত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনেসকোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেসকোর তত্কালীন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার ফলে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর সারা বিশ্বে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়। আজ ৫ অক্টোবর সারা বিশ্বে ১৫তম বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে, অথচ আমাদের দেশে এই দিবস পালনে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই।
শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয় বরং একটি মহান পেশা। একজন আদর্শ শিক্ষক জানেন তাঁর চলা পথ কণ্টকাকীর্ণ এবং ভবিষ্যত্ বিড়ম্বনাময়, তবু তিনি হূদয়ের টানে এই সুকঠিন জীবিকার পথ বেছে নেন। এ জন্য তাঁকে জীবনব্যাপী সংগ্রাম করতে হলেও তিনি আদর্শচ্যুত হন না। সর্বদা ন্যায়-নীতির প্রশ্নে তিনি আপসহীন। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর—এ নামেই তিনি আখ্যায়িত। শিক্ষানিকেতন তাঁর কর্মশালা। তিনি শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও আত্মশক্তির বিকাশ, পরিশীলন, উন্নয়ন ও প্রসার সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সমাজ গঠনে, দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে, দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বিশ্বের দরবারে নিজ দেশের গৌরবময় অবস্থান গড়ে তুলতে একজন আদর্শ শিক্ষকের অবদান কোনো রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ বা সমাজনেতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাই বলা যায়, একজন আদর্শ শিক্ষক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও শ্রেষ্ঠ মানুষের অন্যতম। জাতি সঙ্গত কারণেই শিক্ষকের কাছে অনেক আশা করে। তাই শিক্ষককে হতে হবে নিজ পেশার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। এখন প্রশ্ন, এই মহান পেশার প্রতি শিক্ষকসমাজ কতটুকু যত্নবান?
পাশাপাশি প্রশ্ন আসে, শিক্ষকের দায়িত্ব পালনে পারিপার্শিক অবস্থা ও পরিবেশ কতটুকু সহায়ক? আবার দেশের এই শ্রেষ্ঠ মানুষ শিক্ষকেরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা পান কতটুকু? এ প্রসঙ্গে নির্দ্বিধায় বলা যায়, বহু উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে কয়েক দফা শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও আজও কোনো শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন হয়নি। অর্থাত্ শিক্ষাব্যবস্থাপনায় নেই কোনো দিকনির্দেশনা, বরং রয়েছে প্রচুর অসঙ্গতি। তা ছাড়া শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের পরস্পরবিরোধী অস্পষ্ট, জটিল ও বৈষম্যমূলক বিধিবিধান, নিয়ম-নির্দেশনা ও কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের অভাবে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের জন্য জাতীয় পর্যায়ে কোনো নিয়োগ কমিটি বা কর্মকমিশন না থাকায় তথাকথিত ডোনেশনের নামে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে স্থানীয়ভাবে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা কেবল দুঃখজনকই নয় বরং সামাজিক অনাচার। এ কথা সত্য যে শিক্ষকের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। সে জন্য প্রতিভাবান, মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষককে জ্ঞানসমৃদ্ধ, কুশলী ও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকতা জীবনের প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মের প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও আজও ব্রিটিশ শাসন আমলের ঔপনিবেশিক বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বিরাজমান। যদিও একটি স্বাধীন দেশে কোনোক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়, তাই স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষকসমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যের অবসানকল্পে শিক্ষাব্যবহার সব স্তরকে জাতীয়করণের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তা ছাড়া ইউনেসকো এবং আইএলওর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষকদের জন্য ১৯৬৬ সালে গৃহীত ‘শিক্ষক সনদ’ থেকে আমাদের শিক্ষকসমাজ বঞ্চিত।
মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষকতা পেশার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি উপযুক্ত মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অতি দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলেই শিক্ষকতা পেশা মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকের বৈষম্য দূর করে অবিলম্বে যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অনুসারে শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রদান ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি গঠনে অসঙ্গতিপূর্ণ নীতিমালা থাকার কারণে বেসরকারি শিক্ষকের চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই। যেহেতু সরকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ১০০ ভাগ বেতন প্রদান করছে সে কারণে তথাকথিত এই ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির প্রথা অনতিবিলম্বে বাতিল করে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুরূপ বিধিমালায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য যেমন নেই কোনো আবাসিক ব্যবস্থা তেমনি নেই নিজ কর্মস্থলে যাতায়াত করার ব্যবস্থা। আবার ভ্রমণভাতা ও চিত্তবিনোদনের নেই কোনো ব্যবস্থা। তাতে মনে হয়, শিক্ষকদের জীবনে কোনো ভ্রমণ বা চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন নেই। সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে এ কথাই বলতে হয় যে শিক্ষকেরা এক চরম হতাশার মধ্যে দিন যাপন করছেন। যার ফলে নতুন কিছু সৃষ্টি তো দূরের কথা বরং স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করার স্পৃহাও থাকে না।
আর বঞ্চনা বা করুণা নয়, বরং মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষকতা পেশার প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করতে হবে এবং শিক্ষক সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমাদের শিক্ষার গুণগতমান বিকশিত হবে—বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এই প্রত্যাশাই করি।
মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান: সভাপতি, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা থেকে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষক সংগঠনের ক্রমাগত প্রচেষ্টা এবং ইউনেস্কো আইএলওর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সদিচ্ছায় ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর অর্জিত হয় এই ঐতিহাসিক শিক্ষক সনদ। ১৪৬ ধারা-উপধারাবিশিষ্ট এই সনদে যেমন শিক্ষাকে জাতি গঠন ও উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি এই সনদে শিক্ষকের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকার, মর্যাদা এবং তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশের প্রায় দুই কোটি ৩০ লাখ শিক্ষকের ২১০টি জাতীয় শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা ‘এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’। এ সংস্থার ক্রমাগত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনেসকোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেসকোর তত্কালীন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার ফলে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর সারা বিশ্বে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হয়। আজ ৫ অক্টোবর সারা বিশ্বে ১৫তম বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে, অথচ আমাদের দেশে এই দিবস পালনে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই।
শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয় বরং একটি মহান পেশা। একজন আদর্শ শিক্ষক জানেন তাঁর চলা পথ কণ্টকাকীর্ণ এবং ভবিষ্যত্ বিড়ম্বনাময়, তবু তিনি হূদয়ের টানে এই সুকঠিন জীবিকার পথ বেছে নেন। এ জন্য তাঁকে জীবনব্যাপী সংগ্রাম করতে হলেও তিনি আদর্শচ্যুত হন না। সর্বদা ন্যায়-নীতির প্রশ্নে তিনি আপসহীন। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর—এ নামেই তিনি আখ্যায়িত। শিক্ষানিকেতন তাঁর কর্মশালা। তিনি শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও আত্মশক্তির বিকাশ, পরিশীলন, উন্নয়ন ও প্রসার সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সমাজ গঠনে, দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে, দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বিশ্বের দরবারে নিজ দেশের গৌরবময় অবস্থান গড়ে তুলতে একজন আদর্শ শিক্ষকের অবদান কোনো রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ বা সমাজনেতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাই বলা যায়, একজন আদর্শ শিক্ষক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ও শ্রেষ্ঠ মানুষের অন্যতম। জাতি সঙ্গত কারণেই শিক্ষকের কাছে অনেক আশা করে। তাই শিক্ষককে হতে হবে নিজ পেশার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। এখন প্রশ্ন, এই মহান পেশার প্রতি শিক্ষকসমাজ কতটুকু যত্নবান?
পাশাপাশি প্রশ্ন আসে, শিক্ষকের দায়িত্ব পালনে পারিপার্শিক অবস্থা ও পরিবেশ কতটুকু সহায়ক? আবার দেশের এই শ্রেষ্ঠ মানুষ শিক্ষকেরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা পান কতটুকু? এ প্রসঙ্গে নির্দ্বিধায় বলা যায়, বহু উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে কয়েক দফা শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও আজও কোনো শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন হয়নি। অর্থাত্ শিক্ষাব্যবস্থাপনায় নেই কোনো দিকনির্দেশনা, বরং রয়েছে প্রচুর অসঙ্গতি। তা ছাড়া শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের পরস্পরবিরোধী অস্পষ্ট, জটিল ও বৈষম্যমূলক বিধিবিধান, নিয়ম-নির্দেশনা ও কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের অভাবে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের জন্য জাতীয় পর্যায়ে কোনো নিয়োগ কমিটি বা কর্মকমিশন না থাকায় তথাকথিত ডোনেশনের নামে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে স্থানীয়ভাবে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা কেবল দুঃখজনকই নয় বরং সামাজিক অনাচার। এ কথা সত্য যে শিক্ষকের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। সে জন্য প্রতিভাবান, মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষককে জ্ঞানসমৃদ্ধ, কুশলী ও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকতা জীবনের প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মের প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও আজও ব্রিটিশ শাসন আমলের ঔপনিবেশিক বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বিরাজমান। যদিও একটি স্বাধীন দেশে কোনোক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়, তাই স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষকসমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যের অবসানকল্পে শিক্ষাব্যবহার সব স্তরকে জাতীয়করণের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তা ছাড়া ইউনেসকো এবং আইএলওর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষকদের জন্য ১৯৬৬ সালে গৃহীত ‘শিক্ষক সনদ’ থেকে আমাদের শিক্ষকসমাজ বঞ্চিত।
মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষকতা পেশার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি উপযুক্ত মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অতি দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলেই শিক্ষকতা পেশা মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকের বৈষম্য দূর করে অবিলম্বে যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অনুসারে শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রদান ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি গঠনে অসঙ্গতিপূর্ণ নীতিমালা থাকার কারণে বেসরকারি শিক্ষকের চাকরির কোনো নিরাপত্তা নেই। যেহেতু সরকার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ১০০ ভাগ বেতন প্রদান করছে সে কারণে তথাকথিত এই ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির প্রথা অনতিবিলম্বে বাতিল করে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুরূপ বিধিমালায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য যেমন নেই কোনো আবাসিক ব্যবস্থা তেমনি নেই নিজ কর্মস্থলে যাতায়াত করার ব্যবস্থা। আবার ভ্রমণভাতা ও চিত্তবিনোদনের নেই কোনো ব্যবস্থা। তাতে মনে হয়, শিক্ষকদের জীবনে কোনো ভ্রমণ বা চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন নেই। সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে এ কথাই বলতে হয় যে শিক্ষকেরা এক চরম হতাশার মধ্যে দিন যাপন করছেন। যার ফলে নতুন কিছু সৃষ্টি তো দূরের কথা বরং স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করার স্পৃহাও থাকে না।
আর বঞ্চনা বা করুণা নয়, বরং মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষকতা পেশার প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করতে হবে এবং শিক্ষক সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমাদের শিক্ষার গুণগতমান বিকশিত হবে—বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এই প্রত্যাশাই করি।
মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান: সভাপতি, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট।
No comments