ইরান -হুজুগ আর বাস্তবতা এক নয় by ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন
বিদেশি নাগরিকদের জড়িয়ে যে জনকূটনীতি, তার সামনের কাতারে ফিরে এসেছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন ও ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নিকোলাস সারকোজির সঙ্গে মিলে যৌথভাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। মনে হলো আরও একবার তাঁরা ইরানকে এই ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের শর্ত মানার চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিলেন। তাঁদের ভাষায় এসব হলো ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দাবি’। ডিসেম্বরের মধ্যে দাবি মেনে নাও, নয়তো নতুন নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করো—এমনটাই তাদের অবস্থান। ওবামা বলেছেন, ‘ইরান এমন সব নিয়ম ভাঙছে যা সব দেশকে অবশ্যই মেনে চলতে হয়।’
এই হম্বিতম্বির চলতি উপলক্ষ হলো ইরানের একটি ঘোষণা। ইরান জানিয়েছে, দেশটি কুমের অঞ্চলের কাছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের লক্ষ্যে তিন হাজার সেন্ট্রিফিউজ-সংবলিত একটি স্থাপনা তৈরি করছে। ঘোষিত লক্ষ্য হলো বিদ্যুত্ উত্পাদন। ওবামার মতে, বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য এই সংখ্যা অত্যন্ত কম, কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের উপাদান তৈরির জন্য এটাই আদর্শ। সুতরাং ইরানের অভিসন্ধি পরিষ্কার; পারমানবিক বোমা বানানো।
মনে হয় পশ্চিমা গোয়েন্দারা এই স্থাপনা তৈরি সম্পর্কে আগেই জানতে পেরেছিল। এ বিষয়ে তাদের ভাষ্য হলো, ইরান যেই বুঝতে পেরেছে যে পাশ্চাত্য শক্তিরা এর কথা জেনে গেছে সেহেতু ইরান আগেভাগেই এই স্থাপনা তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বলেছেন, পারমাণবিক বিস্তার-নিয়ন্ত্রণ চুক্তি অনুযায়ী এসব স্থাপনা চালু হওয়ার ছয় মাস আগে ঘোষণা করার দরকার ছিল। তাই তিনি এ সময় ঘোষণা দিয়েছেন।
যা-ই ঘটুক না কেন, ওবামা একে বড় ঘটনা হিসেবে দেখাচ্ছেন এবং ইরানের ওপর জাতিসংঘের আরো আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপের ভিত্তি হিসেবে এই নতুন তথ্যটি ব্যবহার করছেন। তাঁর আশা, এতে করে চীন বা রাশিয়াকে নতুন নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করায় অথবা কমপক্ষে বিরোধিতা থেকে বিরত থাকতে রাজি করানো সম্ভব হবে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীরা বলছে, ‘আমরা তো এ কথা আগেই বলেছিলাম।’ তাদের মতে, ইরান সব সময় মিথ্যা বলছিল, এখনো বলছে। সেজন্যই একে অবশ্যই কঠিন শাস্তি দিতে হবে। আমরা কি তাহলে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কিনারে? অথবা যুক্তরাষ্ট্র নিজে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের মৌনসম্মতিতে ইসরায়েল কি ইরান আক্রমণ করতে যাচ্ছে? আমার তা মনে হয় না। মনে হয়, সবাই বিরাট এক ধাপ্পাবাজি চালাচ্ছে।
ইরানের কথা দিয়েই শুরু করি। যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী ও ইসরায়েলিদের মতো আমিও মনে করি, ইরান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হতে চায়। কিন্তু ওদের সঙ্গে আমার পার্থক্য কেবল এই যে, আমি মনে করি এই চাওয়া স্বাভাবিক, অপরিহার্য এবং আদৌ ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয় নয়।
ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে, ভারত, পাকিস্তান ও ইসরায়েল এই তিনটি পার্শ্ববর্তী পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দেশ এখনো পরমাণু অস্ত্র বিস্তার-নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করেনি। অথচ এদের প্রত্যেকেই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ নিয়ম ভাঙার দায়ে তাদের অভিযুক্ত করা হয় না। তাই ইরানিদের প্রশ্ন, তাদের আলাদাভাবে দেখা হবে কেন? ইরান তো এনপিটি-তে স্বাক্ষর করেছে এবং এখন পর্যন্ত সেই তিন পার্শ্ববর্তী দেশের মতো কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান লঙ্ঘন করেনি। ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুলা ডি সিলভা বলেছেন, তাঁর দেশও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। তিনি ইরানের এ কাজেও কোনো সমস্যা দেখেন না।
ওবামা যদি আগেই জেনে গিয়ে থাকেন যে ইরান পারমাণবিক কেন্দ্র বানাচ্ছে তাহলে তিনি তা এখন জানাচ্ছেন কেন? তিনি বলেছেন, গোয়েন্দা তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে পুরোপরি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, ওবামার স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব এবং আফগানিস্তানে আরও সেনা পাঠানো নিয়ে দ্বিধা ডানপন্থীদের সমালোচনার কারণ হয়েছে। এ প্রেক্ষিতেই ইরানের উদ্দেশ্যে কড়া কথা বলে মুখরক্ষার কৌশল নিয়েছেন তিনি।
ইরানের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ওবামার মতো আহমেদিনেজাদকেও অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে কড়া কথা বলে তিনি জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগাতে পারবেন। আর পশ্চিম যদি পাল্টা কড়া কথা বলে, তাহলে তো এই জাতীয় আবেগকে কাজে লাগানো আরও সহজ হয়।
রাশিয়া ও চীন সব সময় কড়া নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছে। তারা মনে করে, এটি উল্টো ফল বয়ে আনবে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র বিরোধিতাও তারা খুব একটা করতে চায় না। তারা হয়তো তাদের অভিপ্রায় অস্পষ্ট রেখে ধীরে চলা নীতিই বজায় রাখবে।
ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রসঙ্গে কয়েকটি বিবেচনা জরুরি। আফগানিস্তানে সামরিক তত্পরতা তীব্রতর করার দাবির মুখে আছেন ওবামা। আফগানিস্তানে তাদের নাজুক পরিস্থিতিতে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান সমর্থন করবে কে? আর ইসরায়েলিদের উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষা যা-ই হোক না কেন, তাদের যুদ্ধবিমানগুলো কোনো দেশের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আক্রমণ করার মতো প্রয়োজনীয় সুবিধা পাবে না।
তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াল? আমরা এক অচলাবস্থার মধ্যেই পড়ে থাকলাম। কথার বাহার যত কাজ ততই কম। আহমাদিনেজাদও কি তা-ই চান? হয়তো চান। যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীরা কি এতে নিন্দা জানাবে? হয়তো জানাবে। এই পরিস্থিতি বদলাতে ওবামা কি কিছু করতে পারবেন? তেমন কোনো সম্ভাবনা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। হুজুগ আর বাস্তবতা তো এক নয়!
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া
ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন: মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ স্কলার।
এই হম্বিতম্বির চলতি উপলক্ষ হলো ইরানের একটি ঘোষণা। ইরান জানিয়েছে, দেশটি কুমের অঞ্চলের কাছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের লক্ষ্যে তিন হাজার সেন্ট্রিফিউজ-সংবলিত একটি স্থাপনা তৈরি করছে। ঘোষিত লক্ষ্য হলো বিদ্যুত্ উত্পাদন। ওবামার মতে, বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য এই সংখ্যা অত্যন্ত কম, কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের উপাদান তৈরির জন্য এটাই আদর্শ। সুতরাং ইরানের অভিসন্ধি পরিষ্কার; পারমানবিক বোমা বানানো।
মনে হয় পশ্চিমা গোয়েন্দারা এই স্থাপনা তৈরি সম্পর্কে আগেই জানতে পেরেছিল। এ বিষয়ে তাদের ভাষ্য হলো, ইরান যেই বুঝতে পেরেছে যে পাশ্চাত্য শক্তিরা এর কথা জেনে গেছে সেহেতু ইরান আগেভাগেই এই স্থাপনা তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বলেছেন, পারমাণবিক বিস্তার-নিয়ন্ত্রণ চুক্তি অনুযায়ী এসব স্থাপনা চালু হওয়ার ছয় মাস আগে ঘোষণা করার দরকার ছিল। তাই তিনি এ সময় ঘোষণা দিয়েছেন।
যা-ই ঘটুক না কেন, ওবামা একে বড় ঘটনা হিসেবে দেখাচ্ছেন এবং ইরানের ওপর জাতিসংঘের আরো আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপের ভিত্তি হিসেবে এই নতুন তথ্যটি ব্যবহার করছেন। তাঁর আশা, এতে করে চীন বা রাশিয়াকে নতুন নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করায় অথবা কমপক্ষে বিরোধিতা থেকে বিরত থাকতে রাজি করানো সম্ভব হবে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীরা বলছে, ‘আমরা তো এ কথা আগেই বলেছিলাম।’ তাদের মতে, ইরান সব সময় মিথ্যা বলছিল, এখনো বলছে। সেজন্যই একে অবশ্যই কঠিন শাস্তি দিতে হবে। আমরা কি তাহলে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কিনারে? অথবা যুক্তরাষ্ট্র নিজে অথবা যুক্তরাষ্ট্রের মৌনসম্মতিতে ইসরায়েল কি ইরান আক্রমণ করতে যাচ্ছে? আমার তা মনে হয় না। মনে হয়, সবাই বিরাট এক ধাপ্পাবাজি চালাচ্ছে।
ইরানের কথা দিয়েই শুরু করি। যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী ও ইসরায়েলিদের মতো আমিও মনে করি, ইরান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হতে চায়। কিন্তু ওদের সঙ্গে আমার পার্থক্য কেবল এই যে, আমি মনে করি এই চাওয়া স্বাভাবিক, অপরিহার্য এবং আদৌ ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয় নয়।
ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে, ভারত, পাকিস্তান ও ইসরায়েল এই তিনটি পার্শ্ববর্তী পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দেশ এখনো পরমাণু অস্ত্র বিস্তার-নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করেনি। অথচ এদের প্রত্যেকেই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ নিয়ম ভাঙার দায়ে তাদের অভিযুক্ত করা হয় না। তাই ইরানিদের প্রশ্ন, তাদের আলাদাভাবে দেখা হবে কেন? ইরান তো এনপিটি-তে স্বাক্ষর করেছে এবং এখন পর্যন্ত সেই তিন পার্শ্ববর্তী দেশের মতো কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান লঙ্ঘন করেনি। ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুলা ডি সিলভা বলেছেন, তাঁর দেশও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। তিনি ইরানের এ কাজেও কোনো সমস্যা দেখেন না।
ওবামা যদি আগেই জেনে গিয়ে থাকেন যে ইরান পারমাণবিক কেন্দ্র বানাচ্ছে তাহলে তিনি তা এখন জানাচ্ছেন কেন? তিনি বলেছেন, গোয়েন্দা তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে পুরোপরি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, ওবামার স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব এবং আফগানিস্তানে আরও সেনা পাঠানো নিয়ে দ্বিধা ডানপন্থীদের সমালোচনার কারণ হয়েছে। এ প্রেক্ষিতেই ইরানের উদ্দেশ্যে কড়া কথা বলে মুখরক্ষার কৌশল নিয়েছেন তিনি।
ইরানের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ওবামার মতো আহমেদিনেজাদকেও অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে কড়া কথা বলে তিনি জাতীয়তাবাদী আবেগকে কাজে লাগাতে পারবেন। আর পশ্চিম যদি পাল্টা কড়া কথা বলে, তাহলে তো এই জাতীয় আবেগকে কাজে লাগানো আরও সহজ হয়।
রাশিয়া ও চীন সব সময় কড়া নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছে। তারা মনে করে, এটি উল্টো ফল বয়ে আনবে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র বিরোধিতাও তারা খুব একটা করতে চায় না। তারা হয়তো তাদের অভিপ্রায় অস্পষ্ট রেখে ধীরে চলা নীতিই বজায় রাখবে।
ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রসঙ্গে কয়েকটি বিবেচনা জরুরি। আফগানিস্তানে সামরিক তত্পরতা তীব্রতর করার দাবির মুখে আছেন ওবামা। আফগানিস্তানে তাদের নাজুক পরিস্থিতিতে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান সমর্থন করবে কে? আর ইসরায়েলিদের উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষা যা-ই হোক না কেন, তাদের যুদ্ধবিমানগুলো কোনো দেশের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আক্রমণ করার মতো প্রয়োজনীয় সুবিধা পাবে না।
তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াল? আমরা এক অচলাবস্থার মধ্যেই পড়ে থাকলাম। কথার বাহার যত কাজ ততই কম। আহমাদিনেজাদও কি তা-ই চান? হয়তো চান। যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীরা কি এতে নিন্দা জানাবে? হয়তো জানাবে। এই পরিস্থিতি বদলাতে ওবামা কি কিছু করতে পারবেন? তেমন কোনো সম্ভাবনা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। হুজুগ আর বাস্তবতা তো এক নয়!
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া
ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন: মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ স্কলার।
No comments