প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য সুন্দরবনের নিরাপত্তাহীনতা -প্রতিবেশ by পাভেল পার্থ
বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং দেশের মোট বনভূমির ৪৪ শতাংশ জুড়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবন। স্থানীয়ভাবে বাদাবন, শুলোবন হিসেবে পরিচিত দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবনকে দেশের প্রথম রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে।
সম্প্রতি সুন্দরবন আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে। গত ২১ জুলাই পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য তালিকায় শীর্ষ আটাশের ভেতর নির্বাচিত হয়েছে এই জোয়ার-ভাটার বনভূমি। নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন আয়োজিত প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের তালিকায় সুন্দরবনকে ‘অফিশিয়াল ফাইনালিস্ট ক্যান্ডিডেট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’, ‘রামসার এলাকা’, ‘সংরক্ষিত বনভূমি’, ‘দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য’ কি হালের ‘প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য’ হিসেবে চিহ্নিত সুন্দরবন এক অদ্ভুত আশ্চর্য প্রশ্নহীন নিরাপত্তাহীনতার ভেতর কোনোরকমে টিকে আছে। সুন্দরবনের বাঘ, পশুপাখি, সুন্দরীগাছসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন উদ্ভিদ, সুন্দরবন-নির্ভর বনজীবী জনগণ কি বন বিভাগের স্থানীয় কা র্যালয়গুলো নানা নিরাপত্তাহীনতার ভেতরে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে দিন দিন জীবনযাপন ও প্রাণের বৈচিত্র্য ঝলসে যাচ্ছে, নিঃস্ব হয়ে পড়ছে প্রকৃতির জটিল সম্পর্ক।
সুন্দরীগাছের আধিক্যের জন্য অনেকেই বলে থাকে এই জোয়ার-ভাটার বনভূমির নাম সুন্দরবন। অথচ দিনে দিনে ‘উদ্ভিদ জাদুঘর’ কি হার্বেরিয়ামের প্রজাতি হয়ে যাচ্ছে সুন্দরী? প্রতিবেশ-ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আর দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে মরতে বসা শুকনো নদী পেরিয়ে বাঘ চলে আসছে মানুষের গ্রামে। বাঘ হামলে পড়ছে মানুষের ওপর, মানুষও জীবন বাঁচাতে পিটিয়ে মারছে বাঘ। সুন্দরবন রক্ষার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত বন বিভাগের কাছেও বনের বাঘ বনে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো রসদ জোগায়নি রাষ্ট্র। সিডর কি আইলার মতো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় জনপদকে অনেকাংশে রক্ষা করেছে এই সুন্দরবনই।
কেবল বাংলাদেশ নয়, দুনিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলের রাষ্ট্র কোনো নিরাপত্তা গড়ে তোলেনি এখনো। অথচ এই অঞ্চলকে নানাজন নানা সময়ে কত কিসিমের ‘সম্মান’ কি ‘স্বীকৃতির’ বহর দিয়ে ডুবিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে। সুন্দরবনের দৈন্যদুর্দশার শরীরে কি এত বিশাল ওজনের ‘স্বীকৃতির’ ভার সইবে? বলেশ্বর, রায়মঙ্গল, চুনা, পশুরসহ প্রায় সাড়ে চার শ ছোট-বড় নদ-নদীর প্লাবনভূমিতে গড়ে ওঠা এই বনের ছয় হাজার ১৭ কিলোমিটার এলাকায় ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩৭৫ প্রজাতির প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির ঝিনুকসহ অগণিত প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে স্থানীয় বাওয়ালি-মৌয়াল-মাঝি-জেলে-চুনরি-মুন্ডা-মাহাতো জনগণ গড়ে তুলেছে এক ঐতিহাসিক স্থায়িত্বশীল বাদাবন জীবন।
সুন্দরবনকে জীবনের সঙ্গে আগলে রাখতে এখনো বাঘসহ অন্য প্রাণীকূল, উদ্ভিদ, বননির্ভর জনগণ এবং বন বিভাগের স্থানীয় কা র্যালয়ের বনকর্মী এমনকি বনপ্রহরীরাই জীবন দিয়ে চলেছেন। সুন্দরবনকে বাঁচাতে বাঘ-কুমির-কামট-সিডর-আইলা-জোয়ার-ভাটা-জলোচ্ছ্বাস-ঝড়-ঝঞ্ঝা সামাল দিতে হয় এদেরই। পাশাপাশি বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আমলাদের চোখরাঙানি আর বেসামাল চাহিদার চাপে গাছ কেটে নৌকাবোঝাই করা এবং হরিণ শিকার করতে হয় এই নিরীহ বনপ্রহরীদেরই। তার বাদেও রেহাই নেই। সুন্দরবনজুড়ে আছে ‘বনডাকাত’ আর ‘চাঁদাবাজ’ ‘অপহরণকারীদের’ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য আস্তানা। সব ধরনের দুর্যোগ, দুঃসহ অত্যাচার, পেশাগত নি র্যাতনের ভেতর বন বিভাগের স্থানীয় কা র্যালয়গুলোর দায়িত্ব হচ্ছে সুন্দরবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিজের জীবন ও পেশার কোনো নিরাপত্তা নেই তাকে দিয়ে কিসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় রাষ্ট্র? বাংলাদেশে সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্র এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবার জন্যই শতভাগ রেশন ও ঝুঁকিভাতা নিশ্চিত করেছে। বন বিভাগ, বন ও বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা বিধানের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। অথচ রাষ্ট্র বন বিভাগের নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য কোনো ধরনের রেশন ও ঝুঁকিভাতা দিতে পারেনি আজও। দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং রাষ্ট্রের প্রাণসম্পদ বাঁচাতে গিয়ে যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রহরীরা বাঘের হামলা কি ডাকাতের গুলি বা সিডরের ঝড়ে মারা যান কিংবা আহত হন তখন রাষ্ট্র তাঁর চিকিত্সাসেবা বা ক্ষতিপূরণ—কোনো কিছুই নিশ্চিত করে না।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছাড়াই ঐতিহাসিকভাবে এক প্রথাগত সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে সুন্দরবনের মূল সংরক্ষক হচ্ছেন সুন্দরবন-নির্ভর পেশাগত বনজীবী জনগণ। বনজীবীরা নিজেদের জীবন-জীবিকা এবং বেঁচেবর্তে থাকার প্রশ্নেই সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখছে এখনো। রাষ্ট্র সুন্দরবনের বনজীবীদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে তো দূরের কথা বরং বনজীবীদের কাছ থেকে বারবার টেনেহিঁচড়ে নিয়েছে বনের ওপর বননির্ভর জনগণের প্রথাগত অধিকারকে। বন বিভাগ সুন্দরবনের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য ও বনজীবীদের সঙ্গে বনের সম্পর্ককে বিবেচনা না করে আজ এটা আহরণ বন্ধ, কাল ওটা কাটা নিষিদ্ধ করেছে। ১৯৮৯ সন থেকে বন বিভাগ পশুর ও গরান আহরণ নিষিদ্ধ করেছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে বলে গেওয়া কাঠ ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে খুলনার দেশলাই কারখানাগুলোয়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের পর গোল ও গরান আহরণ নিষিদ্ধ করেছিল বন বিভাগ। অথচ বন বিভাগ একটিবারও সরেজমিনে দেখতে চাইল না কাদের মাধ্যমে এবং কীভাবে এখনো টিকে আছে এই সুন্দরবন। বনজীবীরা ঋতুভিত্তিক মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ না করলে, গোলপাতার ঝাড় কেটে সাফ না করলে, গরানের ছিটা কেটে পরিষ্কার না রাখলে কোনোভাবেই যে সুন্দরবনের বিকাশ ও বিরাজমানতা টিকে থাকবে না, তা বন বিভাগ বুঝতে চায় না। ঠিক একইভাবে বন বিভাগের স্থানীয় কা র্যালয়ের বনপ্রহরীরা নিজেদের পরিবার-পরিজন দূরে ফেলে রেখে নিতান্তই হাতেগোনা কটি মাইনের আশায় নিজেদের জীবনবাজি রেখে সুন্দরবনকে রক্ষা না করলে এই বন এখনো টিকে থাকত না। অথচ আজ সবাই জানে, এই বনের করুণ পরিণতির জন্য কারা দায়ী? বন বিভাগের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা, কি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রভাবশালী, দুর্বৃত্ত রাজনীতিক—এঁরাই তো দিনে দিনে গলাটিপে হত্যা করে চলেছে দুনিয়ার এক অনন্য বনভূমিকে। রাষ্ট্রের মাধ্যমেই এসব দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের অনেক কিছুই প্রমাণিত হলেও যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার এখনো করা যায়নি।
সুন্দরবন এলাকায় বৃক্ষ-প্রাণী-পতঙ্গ-মানুষ কারও জীবন ও যাপনের কোনো নিরাপত্তা নেই। নেই বসতি ও বসবাসের নিশ্চয়তা, এক ফোঁটা পানি নেই জীবনধারণের, খাদ্য ও জ্বালানির আকাল চারদিকে। অথচ বারবার এই বনকে বানিয়ে তোলা হচ্ছে ‘ঐশ্বর্যময়’ ও ‘আশ্চর্যকর’!
আশির দশক থেকে খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিজমিগুলোকে চিংড়িঘেরে রূপান্তরিত করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাপ ও করপোরেট বাজার। সুন্দরবন অঞ্চলে ব্যাপক চিংড়িঘেরের বিস্তৃতি যেমন লবণাক্ততা বাড়িয়েছে আবার এই চিংড়ি চাষ করতে গিয়ে দিনের পর দিন বাঁধের অত্যাচারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে সুন্দরবন এলাকার নদীপ্রণালী। এই পরিবর্তন সরাসরি আঘাত করছে সুন্দরবনের জটিল প্রতিবেশ-ব্যবস্থায়, বদলে যাচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্যের আচার ও আচরণ। পাশাপাশি বননির্ভর মানুষও উদ্বাস্তু ও অপরিণামদর্শী হতে বাধ্য হচ্ছে। স্থানীয় মানুষ এবং প্রাণবৈচিত্র্যের ঐতিহাসিক ধারাবাহিক সম্পর্কের ভেতর দিয়েই ক্রমবিকাশের পরিবর্তনশীল চলমানতা বজায় থাকে। সুন্দরবন অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট জীবনের চলমানতাকে বিবেচনা করে সবার জীবন ও যাপনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কারণ সুন্দরবন অঞ্চলে যদি এমন বেহাল আশ্চর্য নিরাপত্তা বহাল থাকে তবে কোনোভাবেই তা ‘প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের’ কোনো কারণ হতে পারে না। ‘প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য’ হিসেবেও সুন্দরবনকে দেখতে চাইলে রাষ্ট্রের কাজ হবে এই অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্য ও এর সম্পর্কের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করা।
পাভেল পার্থ: পরিবেশ ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com
সম্প্রতি সুন্দরবন আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে। গত ২১ জুলাই পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য তালিকায় শীর্ষ আটাশের ভেতর নির্বাচিত হয়েছে এই জোয়ার-ভাটার বনভূমি। নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন আয়োজিত প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের তালিকায় সুন্দরবনকে ‘অফিশিয়াল ফাইনালিস্ট ক্যান্ডিডেট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’, ‘রামসার এলাকা’, ‘সংরক্ষিত বনভূমি’, ‘দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য’ কি হালের ‘প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য’ হিসেবে চিহ্নিত সুন্দরবন এক অদ্ভুত আশ্চর্য প্রশ্নহীন নিরাপত্তাহীনতার ভেতর কোনোরকমে টিকে আছে। সুন্দরবনের বাঘ, পশুপাখি, সুন্দরীগাছসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন উদ্ভিদ, সুন্দরবন-নির্ভর বনজীবী জনগণ কি বন বিভাগের স্থানীয় কা র্যালয়গুলো নানা নিরাপত্তাহীনতার ভেতরে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে দিন দিন জীবনযাপন ও প্রাণের বৈচিত্র্য ঝলসে যাচ্ছে, নিঃস্ব হয়ে পড়ছে প্রকৃতির জটিল সম্পর্ক।
সুন্দরীগাছের আধিক্যের জন্য অনেকেই বলে থাকে এই জোয়ার-ভাটার বনভূমির নাম সুন্দরবন। অথচ দিনে দিনে ‘উদ্ভিদ জাদুঘর’ কি হার্বেরিয়ামের প্রজাতি হয়ে যাচ্ছে সুন্দরী? প্রতিবেশ-ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আর দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে মরতে বসা শুকনো নদী পেরিয়ে বাঘ চলে আসছে মানুষের গ্রামে। বাঘ হামলে পড়ছে মানুষের ওপর, মানুষও জীবন বাঁচাতে পিটিয়ে মারছে বাঘ। সুন্দরবন রক্ষার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত বন বিভাগের কাছেও বনের বাঘ বনে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো রসদ জোগায়নি রাষ্ট্র। সিডর কি আইলার মতো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় জনপদকে অনেকাংশে রক্ষা করেছে এই সুন্দরবনই।
কেবল বাংলাদেশ নয়, দুনিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলের রাষ্ট্র কোনো নিরাপত্তা গড়ে তোলেনি এখনো। অথচ এই অঞ্চলকে নানাজন নানা সময়ে কত কিসিমের ‘সম্মান’ কি ‘স্বীকৃতির’ বহর দিয়ে ডুবিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে। সুন্দরবনের দৈন্যদুর্দশার শরীরে কি এত বিশাল ওজনের ‘স্বীকৃতির’ ভার সইবে? বলেশ্বর, রায়মঙ্গল, চুনা, পশুরসহ প্রায় সাড়ে চার শ ছোট-বড় নদ-নদীর প্লাবনভূমিতে গড়ে ওঠা এই বনের ছয় হাজার ১৭ কিলোমিটার এলাকায় ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৩৭৫ প্রজাতির প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির ঝিনুকসহ অগণিত প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে স্থানীয় বাওয়ালি-মৌয়াল-মাঝি-জেলে-চুনরি-মুন্ডা-মাহাতো জনগণ গড়ে তুলেছে এক ঐতিহাসিক স্থায়িত্বশীল বাদাবন জীবন।
সুন্দরবনকে জীবনের সঙ্গে আগলে রাখতে এখনো বাঘসহ অন্য প্রাণীকূল, উদ্ভিদ, বননির্ভর জনগণ এবং বন বিভাগের স্থানীয় কা র্যালয়ের বনকর্মী এমনকি বনপ্রহরীরাই জীবন দিয়ে চলেছেন। সুন্দরবনকে বাঁচাতে বাঘ-কুমির-কামট-সিডর-আইলা-জোয়ার-ভাটা-জলোচ্ছ্বাস-ঝড়-ঝঞ্ঝা সামাল দিতে হয় এদেরই। পাশাপাশি বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আমলাদের চোখরাঙানি আর বেসামাল চাহিদার চাপে গাছ কেটে নৌকাবোঝাই করা এবং হরিণ শিকার করতে হয় এই নিরীহ বনপ্রহরীদেরই। তার বাদেও রেহাই নেই। সুন্দরবনজুড়ে আছে ‘বনডাকাত’ আর ‘চাঁদাবাজ’ ‘অপহরণকারীদের’ প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য আস্তানা। সব ধরনের দুর্যোগ, দুঃসহ অত্যাচার, পেশাগত নি র্যাতনের ভেতর বন বিভাগের স্থানীয় কা র্যালয়গুলোর দায়িত্ব হচ্ছে সুন্দরবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিজের জীবন ও পেশার কোনো নিরাপত্তা নেই তাকে দিয়ে কিসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় রাষ্ট্র? বাংলাদেশে সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্র এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবার জন্যই শতভাগ রেশন ও ঝুঁকিভাতা নিশ্চিত করেছে। বন বিভাগ, বন ও বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা বিধানের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। অথচ রাষ্ট্র বন বিভাগের নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য কোনো ধরনের রেশন ও ঝুঁকিভাতা দিতে পারেনি আজও। দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং রাষ্ট্রের প্রাণসম্পদ বাঁচাতে গিয়ে যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রহরীরা বাঘের হামলা কি ডাকাতের গুলি বা সিডরের ঝড়ে মারা যান কিংবা আহত হন তখন রাষ্ট্র তাঁর চিকিত্সাসেবা বা ক্ষতিপূরণ—কোনো কিছুই নিশ্চিত করে না।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছাড়াই ঐতিহাসিকভাবে এক প্রথাগত সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে সুন্দরবনের মূল সংরক্ষক হচ্ছেন সুন্দরবন-নির্ভর পেশাগত বনজীবী জনগণ। বনজীবীরা নিজেদের জীবন-জীবিকা এবং বেঁচেবর্তে থাকার প্রশ্নেই সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখছে এখনো। রাষ্ট্র সুন্দরবনের বনজীবীদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে তো দূরের কথা বরং বনজীবীদের কাছ থেকে বারবার টেনেহিঁচড়ে নিয়েছে বনের ওপর বননির্ভর জনগণের প্রথাগত অধিকারকে। বন বিভাগ সুন্দরবনের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য ও বনজীবীদের সঙ্গে বনের সম্পর্ককে বিবেচনা না করে আজ এটা আহরণ বন্ধ, কাল ওটা কাটা নিষিদ্ধ করেছে। ১৯৮৯ সন থেকে বন বিভাগ পশুর ও গরান আহরণ নিষিদ্ধ করেছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে বলে গেওয়া কাঠ ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে খুলনার দেশলাই কারখানাগুলোয়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের পর গোল ও গরান আহরণ নিষিদ্ধ করেছিল বন বিভাগ। অথচ বন বিভাগ একটিবারও সরেজমিনে দেখতে চাইল না কাদের মাধ্যমে এবং কীভাবে এখনো টিকে আছে এই সুন্দরবন। বনজীবীরা ঋতুভিত্তিক মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ না করলে, গোলপাতার ঝাড় কেটে সাফ না করলে, গরানের ছিটা কেটে পরিষ্কার না রাখলে কোনোভাবেই যে সুন্দরবনের বিকাশ ও বিরাজমানতা টিকে থাকবে না, তা বন বিভাগ বুঝতে চায় না। ঠিক একইভাবে বন বিভাগের স্থানীয় কা র্যালয়ের বনপ্রহরীরা নিজেদের পরিবার-পরিজন দূরে ফেলে রেখে নিতান্তই হাতেগোনা কটি মাইনের আশায় নিজেদের জীবনবাজি রেখে সুন্দরবনকে রক্ষা না করলে এই বন এখনো টিকে থাকত না। অথচ আজ সবাই জানে, এই বনের করুণ পরিণতির জন্য কারা দায়ী? বন বিভাগের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা, কি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রভাবশালী, দুর্বৃত্ত রাজনীতিক—এঁরাই তো দিনে দিনে গলাটিপে হত্যা করে চলেছে দুনিয়ার এক অনন্য বনভূমিকে। রাষ্ট্রের মাধ্যমেই এসব দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের অনেক কিছুই প্রমাণিত হলেও যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার এখনো করা যায়নি।
সুন্দরবন এলাকায় বৃক্ষ-প্রাণী-পতঙ্গ-মানুষ কারও জীবন ও যাপনের কোনো নিরাপত্তা নেই। নেই বসতি ও বসবাসের নিশ্চয়তা, এক ফোঁটা পানি নেই জীবনধারণের, খাদ্য ও জ্বালানির আকাল চারদিকে। অথচ বারবার এই বনকে বানিয়ে তোলা হচ্ছে ‘ঐশ্বর্যময়’ ও ‘আশ্চর্যকর’!
আশির দশক থেকে খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিজমিগুলোকে চিংড়িঘেরে রূপান্তরিত করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাপ ও করপোরেট বাজার। সুন্দরবন অঞ্চলে ব্যাপক চিংড়িঘেরের বিস্তৃতি যেমন লবণাক্ততা বাড়িয়েছে আবার এই চিংড়ি চাষ করতে গিয়ে দিনের পর দিন বাঁধের অত্যাচারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে সুন্দরবন এলাকার নদীপ্রণালী। এই পরিবর্তন সরাসরি আঘাত করছে সুন্দরবনের জটিল প্রতিবেশ-ব্যবস্থায়, বদলে যাচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্যের আচার ও আচরণ। পাশাপাশি বননির্ভর মানুষও উদ্বাস্তু ও অপরিণামদর্শী হতে বাধ্য হচ্ছে। স্থানীয় মানুষ এবং প্রাণবৈচিত্র্যের ঐতিহাসিক ধারাবাহিক সম্পর্কের ভেতর দিয়েই ক্রমবিকাশের পরিবর্তনশীল চলমানতা বজায় থাকে। সুন্দরবন অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট জীবনের চলমানতাকে বিবেচনা করে সবার জীবন ও যাপনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কারণ সুন্দরবন অঞ্চলে যদি এমন বেহাল আশ্চর্য নিরাপত্তা বহাল থাকে তবে কোনোভাবেই তা ‘প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের’ কোনো কারণ হতে পারে না। ‘প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য’ হিসেবেও সুন্দরবনকে দেখতে চাইলে রাষ্ট্রের কাজ হবে এই অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্য ও এর সম্পর্কের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করা।
পাভেল পার্থ: পরিবেশ ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com
No comments