আরও একটি শোকের মাস by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
আগস্ট মাস আমাদের শোকের মাস। একাধিক মহান ব্যক্তির তিরোধানে এ মাসটিকে আমরা গণ্য করছি আমাদের শোকের মাস হিসেবে। তবে বিশেষভাবে এ মাসটি আমাদের জাতীয় শোকের মাস হয়েছে এ মাসের ১৫ তারিখের ভোরে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও যে হত্যাযজ্ঞ রেহাই দেয়নি তাঁর নিকটতম আত্মীয়স্বজনকে, সেই কারণে।
এ বছর আগস্ট এসেছে একটু ভিন্ন অবয়বে। বিগত দিনের অনেক আগস্টে আমরা শোক প্রকাশেও সহজ ও স্বাভাবিক ছিলাম না। পঁচাত্তরের মধ্য-আগস্টের ওই হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মানবিক বিচারে যা ছিল নিষ্ঠুরতম বর্বরতা, আইনের বিচারে যা ছিল সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ—তাকেই অপরাধমুক্ত করে দিয়েছিল সেদিনের সরকার, তাকেই বৈধতা দিয়েছিল একটি অবৈধ সরকার। বৈধতা ও অবৈধতার, ন্যায় ও অন্যায়ের, শুভ ও অশুভের ভেদরেখা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সত্য যখন অসত্য হয়ে যায়, অসত্য হয়ে যায় সত্য, তখন রাজনীতির মঞ্চও হয়ে পড়ে জটিল ও কুটিল। আমরা সেই জটিল ও কুটিল রাজনীতির পথ বেয়ে এত দূর এসেছি। মিথ্যার ঘোর কুজ্ঝটিকা অনেকটাই কেটে গেছে। সত্য আবার স্বরূপে প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়ার সফল অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদা দিয়েছে দেশের মানুষ। বিপুল ভোটে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জয়ী করে, তাঁকে সরকার গঠনের পথ তৈরি করে দিয়ে দেশের মানুষ বোধ হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার অপরাধ মোচনের সুযোগ সৃষ্টি করে নিল। দেশের মানুষের অপরাধ, তারা ওই জঘন্যতম অপরাধের উত্তরাধিকার দীর্ঘকাল মাথা পেতে নিয়েছে, সেই অপরাধের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। অতীতের কোনো চেষ্টাই স্থায়ী সুফল বয়ে আনেনি। সর্বশেষ চেষ্টার সাফল্য থেকে আবার আশার আলো দেখতে পাচ্ছে দেশের মানুষ। আপাতত এইটুকু বলা যায়। এর বেশি বলার সময় আসেনি।
এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ অনেক দিন থেকেই তুলাদণ্ডে দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। কখনো এদিকে হেলছে, কখনো ওদিকে। ব্রিটিশ ভারত ভেঙে প্রথমে দুই টুকরা, পরে তিন টুকরা হয়েছে। ভারত হচ্ছে এর মধ্যে বড় টুকরা। ভারতে গণতন্ত্র একটা সুস্থির অবস্থায় আছে। যত দোদুল্যমানতা, তা পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে। অবশ্য তুলনামূলকভাবে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পাকিস্তানের চেয়ে দৃঢ়তা লাভ করেছে। এই যে তিন দেশে তিন পরিস্থিতি, চেষ্টা করলে এর একটা ব্যাখ্যা, একটা কার্যকারণ নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। যেকোনো দেশের প্রধান গণতান্ত্রিক শক্তি হচ্ছে সেদেশের রাজনৈতিক দল। সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পর ভারতে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস ছিল ক্ষমতায় এবং কংগ্রেস তার প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করেছে। কীভাবে? কংগ্রেস সরকার গঠন করেছে, কিন্তু দল হিসেবে তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছে। সরকারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়নি, সরকারের নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছে। যিনি সরকারপ্রধান অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রী, তিনিই দলপ্রধান—এটা ভারতে হয়নি, পাকিস্তানে হয়েছে, বাংলাদেশে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম পর্যায়ে হয়নি, বঙ্গবন্ধুর সময়ে হয়নি, পরবর্তীকালে হয়েছে। একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান ও দলপ্রধান হলে দলের ভূমিকা খর্ব হতে বাধ্য। দলের ভূমিকা খর্ব হলে দেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে যা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়ে গেল কদিন আগে। অধিবেশন যে আদৌ হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে, এ এক ইতিবাচক ঘটনা। যেভাবে হয়েছে, সেটা পুরোপুরি ইতিবাচক নয়। আরও স্বচ্ছতার প্রয়োজন ছিল। আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রয়োজন ছিল। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের। দল হিসেবে, সক্রিয়তা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক দৃঢ়তা দেয়। সেই লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশ এখনো দূরে রয়েছে।
এই প্রাতিষ্ঠানিক দৃঢ়তা থাকলে সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে কাজ করে। আর এই দৃঢ়তার অভাবে পাকিস্তানে প্রথম থেকেই প্রতিরক্ষা বাহিনী অনেকটা সমান্তরাল শক্তি হিসেবে রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। এরই প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের মিলিটারির নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা পাকিস্তানি মিলিটারির শিক্ষায় শিক্ষিত। সুতরাং একটি গণতান্ত্রিক দেশে মিলিটারির প্রকৃত ভূমিকা তাঁরা প্রায়শই ভুলে গিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে দেশের প্রয়োজনে বাংলাদেশের মিলিটারি পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছে। একটি দুর্গম অঞ্চলে শান্তিরক্ষার দুরূহ কাজ করেছে। অনেক সৈন্য, অনেক তরুণ কর্মকর্তা প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু দেশের প্রয়োজন আর সেনাবাহিনীর প্রয়োজন, দুটিকে এক করে দেখা যায় না। দেশের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী যেকোনো উপদ্রুত অঞ্চলে যাবে, সেখানে অবস্থান করবে, যত দিন প্রয়োজন, তার বেশি এক দিনও নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের জমিতে বাইরে থেকে সমতল ভূমির মানুষের বসতি গড়ার কাজটি ঠিক হয়নি। কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে এ ধরনের অবিবেকি, এ ধরনের অদূরদর্শী কাজ হয় না। বাংলাদেশে হয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশে মধ্য-পঁচাত্তরের পর থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর, কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষ সামরিক শাসন চালু ছিল। সামরিক শাসকেরা অস্ত্র চালনায় দক্ষ হলেও দেশ পরিচালনার শিক্ষা তাঁদের নেই, হওয়ার কথা নয়। এ দায়িত্ব পালন তাঁদের জন্য অস্বাভাবিক ও অবাঞ্ছিত। প্রতীকীভাবে হলেও যিনি রাষ্ট্রপ্রধান, তিনিই প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান। যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সে জন্য বেসামরিক সরকারের, কোনো জেনারেলের নয় বা কোনো ফিল্ড মার্শালের নয়। সেনাবাহিনীর আসল শক্তি তার শৃঙ্খলা। তার চেইন অব কমান্ড। এটি ভাঙলে যেকোনো অঘটন ঘটতে পারে, রাষ্ট্রনায়কের হত্যা হতে পারে, নিজেদের মধ্যে হানাহানি হতে পারে—আত্মকলহ থেকে আত্মঘাতী হওয়া, সবই হতে পারে। একাত্তরের স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীর কত সদস্য প্রাণ দিয়েছেন, যুদ্ধে নয়, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তার হিসাব নেই। আমাদের ডিসিপ্লিনড আর্মি কতবার ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করেছে। কেন করেছে, কত অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে। একসময় সেটা সুস্থিরভাবে চিন্তা করতে হবে।
এটি বলা আমার উদ্দেশ্য নয় যে এই প্রয়োজনীয় দায়িত্ববোধের অভাব রয়েছে। তা যদি হতো, তাহলে নিকট অতীতের বিডিআর বিদ্রোহের সময় সেনাবাহিনী, নিজের প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির মুখেও অমন ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারত না। ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করে সেনাবাহিনী তার হূতসম্মান পুনরুদ্ধার করেছে, অনেকটাই। সেনাবাহিনীর এই দৃষ্টান্তটি ইতিবাচক। তার পরও বলব, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ এখনো আমরা সন্দেহমুক্ত করতে পারিনি। যে অপশক্তি কখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করেনি, যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার জন্য দায়ী, যারা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, গণতন্ত্রকেও হত্যা করেছে, তারা এখনো সক্রিয়, দেশে ও বিদেশে। আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর অতীতের রেকর্ড ভালো নয়। কোনো দুর্ঘটনারই আগাম হুঁশিয়ারি দিতে পারেনি তারা। এ জন্য এই বাহিনীগুলোকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কদিন আগে এদেরই মধ্য থেকে কোনো একটি বাহিনী খবর দিয়েছে যে অতীতে যারা বারবার অঘটন ঘটিয়েছে, অনেক হত্যকাণ্ডের যারা নেপথ্যের কুশীলব, তারা আবার তত্পর হয়ে উঠেছে এমন কিছু করতে, যাতে প্রশাসনের স্থিতিশীলতার ওপর আঘাত পড়ে। নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলো পুলিশ ও র্যাবের সকল নজরদারির আড়ালে এখনো ভিন্ননামে তাদের অভিন্ন সংকল্প সিদ্ধির কাজে লিপ্ত রয়েছে। মতাদর্শের দিক দিয়ে এরা মৌলবাদী। আন্তর্জাতিক মৌলবাদী তথা সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ যে বহুদিনের, সে খবর ওরাই দিয়েছে ধরা পড়ার পর। এদের একটা বড় অংশ বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করছে বছরের পর বছর, মাদ্রাসাশিক্ষকের ছদ্মবেশ ধারণ করে। বেশ কিছু তথাকথিত মাদ্রাসাই যে আসলে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি, তাদের অভয়াশ্রম, এটা কোনো নতুন সংবাদ নয়।
প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এ জন্য গৃহীত ব্যবস্থা নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। তবে বিশেষ ব্যবস্থার সীমা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ উচিত হবে না, যা অপ্রয়োজনীয় বা চিরাচরিত ব্যবস্থার বাইরে। এতে অসমর্থক সন্দেহ ও বিতর্কের সৃষ্টি হবে। যে ভুল অতীতে একবার করা হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি হোক, কেউ চাইবে না। সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ভীষণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে—প্রতিদিনের সংবাদপত্রে আমরা সে খবর পাচ্ছি। এই বিরস সত্য অস্বীকার করার মূর্খতা যেন সরকারের না হয়। শোকের মাস আমরা পালন করব অশ্রুসিক্ত বেদনায়, নম্রতায় এবং প্রার্থনা করব, যেন আর কোনো নতুন শোকের কারণ না ঘটে।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এ বছর আগস্ট এসেছে একটু ভিন্ন অবয়বে। বিগত দিনের অনেক আগস্টে আমরা শোক প্রকাশেও সহজ ও স্বাভাবিক ছিলাম না। পঁচাত্তরের মধ্য-আগস্টের ওই হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। মানবিক বিচারে যা ছিল নিষ্ঠুরতম বর্বরতা, আইনের বিচারে যা ছিল সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ—তাকেই অপরাধমুক্ত করে দিয়েছিল সেদিনের সরকার, তাকেই বৈধতা দিয়েছিল একটি অবৈধ সরকার। বৈধতা ও অবৈধতার, ন্যায় ও অন্যায়ের, শুভ ও অশুভের ভেদরেখা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল সেদিন। সত্য যখন অসত্য হয়ে যায়, অসত্য হয়ে যায় সত্য, তখন রাজনীতির মঞ্চও হয়ে পড়ে জটিল ও কুটিল। আমরা সেই জটিল ও কুটিল রাজনীতির পথ বেয়ে এত দূর এসেছি। মিথ্যার ঘোর কুজ্ঝটিকা অনেকটাই কেটে গেছে। সত্য আবার স্বরূপে প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়ার সফল অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদা দিয়েছে দেশের মানুষ। বিপুল ভোটে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জয়ী করে, তাঁকে সরকার গঠনের পথ তৈরি করে দিয়ে দেশের মানুষ বোধ হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার অপরাধ মোচনের সুযোগ সৃষ্টি করে নিল। দেশের মানুষের অপরাধ, তারা ওই জঘন্যতম অপরাধের উত্তরাধিকার দীর্ঘকাল মাথা পেতে নিয়েছে, সেই অপরাধের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। অতীতের কোনো চেষ্টাই স্থায়ী সুফল বয়ে আনেনি। সর্বশেষ চেষ্টার সাফল্য থেকে আবার আশার আলো দেখতে পাচ্ছে দেশের মানুষ। আপাতত এইটুকু বলা যায়। এর বেশি বলার সময় আসেনি।
এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ অনেক দিন থেকেই তুলাদণ্ডে দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। কখনো এদিকে হেলছে, কখনো ওদিকে। ব্রিটিশ ভারত ভেঙে প্রথমে দুই টুকরা, পরে তিন টুকরা হয়েছে। ভারত হচ্ছে এর মধ্যে বড় টুকরা। ভারতে গণতন্ত্র একটা সুস্থির অবস্থায় আছে। যত দোদুল্যমানতা, তা পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে। অবশ্য তুলনামূলকভাবে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পাকিস্তানের চেয়ে দৃঢ়তা লাভ করেছে। এই যে তিন দেশে তিন পরিস্থিতি, চেষ্টা করলে এর একটা ব্যাখ্যা, একটা কার্যকারণ নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। যেকোনো দেশের প্রধান গণতান্ত্রিক শক্তি হচ্ছে সেদেশের রাজনৈতিক দল। সাতচল্লিশের স্বাধীনতার পর ভারতে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস ছিল ক্ষমতায় এবং কংগ্রেস তার প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করেছে। কীভাবে? কংগ্রেস সরকার গঠন করেছে, কিন্তু দল হিসেবে তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছে। সরকারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়নি, সরকারের নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছে। যিনি সরকারপ্রধান অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রী, তিনিই দলপ্রধান—এটা ভারতে হয়নি, পাকিস্তানে হয়েছে, বাংলাদেশে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম পর্যায়ে হয়নি, বঙ্গবন্ধুর সময়ে হয়নি, পরবর্তীকালে হয়েছে। একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান ও দলপ্রধান হলে দলের ভূমিকা খর্ব হতে বাধ্য। দলের ভূমিকা খর্ব হলে দেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে যা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়ে গেল কদিন আগে। অধিবেশন যে আদৌ হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে, এ এক ইতিবাচক ঘটনা। যেভাবে হয়েছে, সেটা পুরোপুরি ইতিবাচক নয়। আরও স্বচ্ছতার প্রয়োজন ছিল। আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রয়োজন ছিল। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের। দল হিসেবে, সক্রিয়তা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক দৃঢ়তা দেয়। সেই লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশ এখনো দূরে রয়েছে।
এই প্রাতিষ্ঠানিক দৃঢ়তা থাকলে সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে কাজ করে। আর এই দৃঢ়তার অভাবে পাকিস্তানে প্রথম থেকেই প্রতিরক্ষা বাহিনী অনেকটা সমান্তরাল শক্তি হিসেবে রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। এরই প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের মিলিটারির নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা পাকিস্তানি মিলিটারির শিক্ষায় শিক্ষিত। সুতরাং একটি গণতান্ত্রিক দেশে মিলিটারির প্রকৃত ভূমিকা তাঁরা প্রায়শই ভুলে গিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে দেশের প্রয়োজনে বাংলাদেশের মিলিটারি পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছে। একটি দুর্গম অঞ্চলে শান্তিরক্ষার দুরূহ কাজ করেছে। অনেক সৈন্য, অনেক তরুণ কর্মকর্তা প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু দেশের প্রয়োজন আর সেনাবাহিনীর প্রয়োজন, দুটিকে এক করে দেখা যায় না। দেশের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী যেকোনো উপদ্রুত অঞ্চলে যাবে, সেখানে অবস্থান করবে, যত দিন প্রয়োজন, তার বেশি এক দিনও নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের জমিতে বাইরে থেকে সমতল ভূমির মানুষের বসতি গড়ার কাজটি ঠিক হয়নি। কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে এ ধরনের অবিবেকি, এ ধরনের অদূরদর্শী কাজ হয় না। বাংলাদেশে হয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশে মধ্য-পঁচাত্তরের পর থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর, কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষ সামরিক শাসন চালু ছিল। সামরিক শাসকেরা অস্ত্র চালনায় দক্ষ হলেও দেশ পরিচালনার শিক্ষা তাঁদের নেই, হওয়ার কথা নয়। এ দায়িত্ব পালন তাঁদের জন্য অস্বাভাবিক ও অবাঞ্ছিত। প্রতীকীভাবে হলেও যিনি রাষ্ট্রপ্রধান, তিনিই প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান। যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সে জন্য বেসামরিক সরকারের, কোনো জেনারেলের নয় বা কোনো ফিল্ড মার্শালের নয়। সেনাবাহিনীর আসল শক্তি তার শৃঙ্খলা। তার চেইন অব কমান্ড। এটি ভাঙলে যেকোনো অঘটন ঘটতে পারে, রাষ্ট্রনায়কের হত্যা হতে পারে, নিজেদের মধ্যে হানাহানি হতে পারে—আত্মকলহ থেকে আত্মঘাতী হওয়া, সবই হতে পারে। একাত্তরের স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীর কত সদস্য প্রাণ দিয়েছেন, যুদ্ধে নয়, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তার হিসাব নেই। আমাদের ডিসিপ্লিনড আর্মি কতবার ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করেছে। কেন করেছে, কত অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে। একসময় সেটা সুস্থিরভাবে চিন্তা করতে হবে।
এটি বলা আমার উদ্দেশ্য নয় যে এই প্রয়োজনীয় দায়িত্ববোধের অভাব রয়েছে। তা যদি হতো, তাহলে নিকট অতীতের বিডিআর বিদ্রোহের সময় সেনাবাহিনী, নিজের প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতির মুখেও অমন ধৈর্যের পরিচয় দিতে পারত না। ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করে সেনাবাহিনী তার হূতসম্মান পুনরুদ্ধার করেছে, অনেকটাই। সেনাবাহিনীর এই দৃষ্টান্তটি ইতিবাচক। তার পরও বলব, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ এখনো আমরা সন্দেহমুক্ত করতে পারিনি। যে অপশক্তি কখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করেনি, যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার জন্য দায়ী, যারা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, গণতন্ত্রকেও হত্যা করেছে, তারা এখনো সক্রিয়, দেশে ও বিদেশে। আমাদের গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর অতীতের রেকর্ড ভালো নয়। কোনো দুর্ঘটনারই আগাম হুঁশিয়ারি দিতে পারেনি তারা। এ জন্য এই বাহিনীগুলোকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কদিন আগে এদেরই মধ্য থেকে কোনো একটি বাহিনী খবর দিয়েছে যে অতীতে যারা বারবার অঘটন ঘটিয়েছে, অনেক হত্যকাণ্ডের যারা নেপথ্যের কুশীলব, তারা আবার তত্পর হয়ে উঠেছে এমন কিছু করতে, যাতে প্রশাসনের স্থিতিশীলতার ওপর আঘাত পড়ে। নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলো পুলিশ ও র্যাবের সকল নজরদারির আড়ালে এখনো ভিন্ননামে তাদের অভিন্ন সংকল্প সিদ্ধির কাজে লিপ্ত রয়েছে। মতাদর্শের দিক দিয়ে এরা মৌলবাদী। আন্তর্জাতিক মৌলবাদী তথা সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ যে বহুদিনের, সে খবর ওরাই দিয়েছে ধরা পড়ার পর। এদের একটা বড় অংশ বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করছে বছরের পর বছর, মাদ্রাসাশিক্ষকের ছদ্মবেশ ধারণ করে। বেশ কিছু তথাকথিত মাদ্রাসাই যে আসলে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি, তাদের অভয়াশ্রম, এটা কোনো নতুন সংবাদ নয়।
প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এ জন্য গৃহীত ব্যবস্থা নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। তবে বিশেষ ব্যবস্থার সীমা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ উচিত হবে না, যা অপ্রয়োজনীয় বা চিরাচরিত ব্যবস্থার বাইরে। এতে অসমর্থক সন্দেহ ও বিতর্কের সৃষ্টি হবে। যে ভুল অতীতে একবার করা হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি হোক, কেউ চাইবে না। সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ভীষণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে—প্রতিদিনের সংবাদপত্রে আমরা সে খবর পাচ্ছি। এই বিরস সত্য অস্বীকার করার মূর্খতা যেন সরকারের না হয়। শোকের মাস আমরা পালন করব অশ্রুসিক্ত বেদনায়, নম্রতায় এবং প্রার্থনা করব, যেন আর কোনো নতুন শোকের কারণ না ঘটে।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments