‘আমার বাড়িটা আর নেই’: উত্তর গাজায় ফিরে যা দেখছেন ফিলিস্তিনিরা
এই নারী বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমরা আবার আমাদের পরিবার ও স্বজনদের দেখতে পেয়ে খুশি...(কিন্তু) সেই সঙ্গে কান্না আসছে বিধ্বস্ত বাড়িঘর, ধ্বংসস্তূপ দেখে।’
সাবরাইন আরও বলছিলেন, ‘নৈসর্গিক দৃশ্যের টানে লোকজন এখানে হাঁটতে আসতেন। এখন এর অধিকাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।’
গতকাল সোমবার উত্তর গাজায় নিজেদের বাড়িঘর তথা ধ্বংসস্তূপের মাঝে ফেরা লাখো ফিলিস্তিনিরই একজন সাবরাইন। সম্প্রতি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গাজার বিভিন্ন অংশে আশ্রয় নিয়ে থাকা দুর্দশাগ্রস্ত এ মানুষেরা নিজ এলাকায় ফিরতে শুরু করেছেন।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ১৫ মাসের বেশি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলার পর গাজা উপত্যকায় এ যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর গাজার অন্যান্য বাসিন্দাদের মতো সাবরাইনও কয়েকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সর্বশেষ বাস্তুচ্যুত হন মধ্যাঞ্চলীয় গাজার দেইর আল–বালাহ এলাকা থেকে।
যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার পর গতকাল সকালে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজায় ফিরতে উপত্যকার উপকূলীয় সড়ক ‘আল–রশিদ স্ট্রিট’ খুলে দেয় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। এ সময় বাড়িমুখী মানুষের ঢলে শামিল হন সাবরাইন।
গাজার একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, দুই ঘণ্টায় দুই লাখের বেশি ফিলিস্তিনি এ সড়ক ধরে উত্তরাঞ্চলে ফিরেছেন।
এ যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিবিসিকে অনেক ফিলিস্তিনি তাঁদের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা জানান। এমন ফিলিস্তিনিদের একজন ২৪ বছর বয়সী ইসরা শাহিন। গাজা সিটিতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর তিনি বলছিলেন, ‘এটা অনেক দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর এক যাত্রা।’
ইসরা বলছিলেন, ‘মাঝপথ পর্যন্ত লোকজন আনন্দেই ছিল, তারা গাইছিল ও সে রকমই কিছু করছিল। কিন্তু বাড়ি পৌঁছাতে যত সময় লাগছিল, ততই তারা হতাশ হচ্ছিল। শেষমেশ, আমরা যখন “গাজায় স্বাগতম” লেখা এক প্রতীকের কাছে পৌঁছালাম, তখন ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে বহু মানুষ আবার আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে।’
অনেকে আবার ভিন্নপথে গাড়িতে করে গাজার উত্তরে রওনা করেন।
৪২ বছর বয়সী আরেক ফিলিস্তিনি ওয়াফা হাসুনা বলছিলেন, ‘উত্তর গাজা অভিমুখী সড়কটিতে তখন হাজার হাজার মানুষ। গোটা সড়কজুড়ে শুধু তাঁরা...আমরা খুব আনন্দে ছিলাম। তবে মনে মনে আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম। কারণ, আমি জানি, আমি গাজা সিটিতে পৌঁছাব ঠিকই, কিন্তু আমার বাড়িটা সেখানে আর নেই।’
এই ফিলিস্তিনিরা যখন গন্তব্যে পৌঁছালেন, তখন বিধ্বস্ত বাড়িঘর আর ধ্বংসস্তূপ দেখে নিজেদের মধ্যে কষ্টের কথা বলাবলি করতে লাগলেন।
মোহাম্মদ ইমাদ আল–দীন ক্ষৌরকারের কাজ করতেন। সড়কে থাকা তল্লাশিচৌকি পেরিয়ে তিনি যখন গন্তব্যে পৌঁছলেন, দেখলেন তাঁর বাড়িটা মাটিতে মিশে আছে। স্যালুনটাও লুট করা হয়েছে। কাছাকাছি স্থানে ইসরায়েলি হামলায় সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্বামীর সঙ্গে আবার সাক্ষাতের আশায় দুই কন্যা ও ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলেন লুবানা নাসের। উত্তর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় স্বামী বেঁচে গেছেন, কিন্তু তাঁদের বাড়িটা আর নেই।
লুবানা বলছিলেন, ‘আনন্দঘন পুনর্মিলন তিক্ত–কঠিন বাস্তবতায় ঢাকা পড়ে গেল। আমাদের বাড়িটা নেই। তাই দক্ষিণ গাজায় তাঁবুতে কাটিয়ে এসে উত্তরেও সেই তাঁবুতেই উঠলাম।’
উত্তরে নিজ বাড়িঘরে ফিরতে বা পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দক্ষিণ গাজায় এখনো অপেক্ষায় আছেন বহু মানুষ।
এমনই একজন ফিলিস্তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও ছোট মেয়েটা না থাকলে তিনি উত্তরে এমনভাবে যেতেন, দেখে মনে হতো দৌঁড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় সড়কে লোকজনের ভিড় কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ও বাড়ির পথে ধীরে পা বাড়ানোর চিন্তা করছেন। তাঁর ধারণা, সেখানে গিয়ে দেখবেন বাড়ির আশপাশের সব মাটির সঙ্গে মিশে আছে।
তবু এই ফিলিস্তিনির আশা, এ যুদ্ধ একদিন শেষ হবে ও যা ধ্বংস হয়ে গেছে তার সব আবারও নির্মাণ করতে পারবেন।
আরেক ফিলিস্তিনি জানান, তাঁর ভাই এখনই ফিরতে তাঁকে মানা করেছেন। ভাই তাঁকে ফোন করে বলেছেন, ‘বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়িফেরা লোকজন রাস্তায় ঘুমাচ্ছেন। তাঁদের সাহায্য করার কেউ নেই।’
![]() |
উত্তর গাজায় ফেরার অপেক্ষায় এক শিশু। ছবি: রয়টার্স |
No comments