মালয়েশিয়ায় ব্যাপক ধরপাকড় পেরেশানিতে পাঁচ লাখ বাংলাদেশি
মালয়েশিয়ায়
অবৈধ হয়ে পড়া প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশির ভাগ্য অনিশ্চিত! গ্রেপ্তার আতঙ্কে
দিন কাটাচ্ছেন তারা। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে দেশটিতে অবৈধদের ধরতে অভিযান
শুরু হয়েছে। অভিযানে বাংলাদেশিসহ ৫০০ অবৈধ শ্রমিক এরইমধ্যে আটক হয়েছেন।
গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাংলাদেশিরা কাজকর্ম ছেড়ে বাসায় বসে আছেন। কিন্তু তাতেও
রেহাই মিলছে না। পুলিশ বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করছে। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছে
কুয়ালামপুরের বরাতে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো এমনটাই বলছে।
মালয়েশিয়া প্রবাসী সিলেটের এক শিক্ষার্থী রাতে মানবজমিনকে বলেন- গ্রেপ্তার
আতঙ্ক এখন দেশজুড়ে। কিন্তু সব দেশের তরফে তাদের কমিউনিটিতে যোগাযোগ করা
হলেও বাংলাদেশ হাইকমিশন এখনো নীরব।
বৈধতার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশিরা হাইকমিশন ও অভিবাসন অফিসে গিয়ে পদে পদে হয়রানি হয়েছেন জানিয়ে ওই প্রবাসী শিক্ষার্থী বলেন, তার পরিবারের অনেকে দেশটিতে রয়েছেন। তিনি যার মাধ্যমে সেখানে গেছেন তারাও এখন কাগজপত্র নিয়ে জটিলতায় রয়েছেন। অভিযান শুরু হওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন- এখনো মিশনের কারো সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারিনি। জরুরি যোগাযোগে মিশনের হটলাইন চালুর নিয়ম থাকলেও তা এখনো খোলা হয়নি বলে হতাশা ব্যক্ত করেন ওই প্রবাসী। এদিকে কুয়ালালামপুরের ডেটলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট মতে, সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে কঠোর এবং বাচ-বিচারহীন অভিযান শুরু হয়েছে। তাতে অবৈধদের রেহাই নেই। তাদের সামনে দুটি পথ খোলা। যত দ্রুত সম্ভব বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা, না হয় জেল-জরিমানা দিয়ে দেশে ফেরা।
কেবল বাংলাদেশি নয়, আতঙ্কে আছেন অন্য বিদেশিরাও। এক রিপোর্টে জানা গেছে, মালয়েশিয়াতে প্রায় ২০ লাখ বিদেশি কাজ করেন। ২০১৭ সালের জন-জরিপ মতে সেখানে বিদেশি শ্রমিকদের মধ্যে বেশির ভাগ ইন্দোনেশিয়ার। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ শীর্ষে। ওই তালিকায় ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও রয়েছে মিয়ানমার, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, লাউস, ভারত ও নেপাল। বিদেশি শ্রমিকদের বেশির ভাগেরই নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। অনলাইন দ্য ডেইলি স্টার মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনকে উদ্ধৃত করে তাতে প্রকাশিত রিপোর্টে বলছে- বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছে। এর মধ্যে অর্ধেকরই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। অভিবাসন ও অধিকার বিষয়ক কর্মীদের উদ্ধৃত করে স্টারের রিপোর্টে জানানো হয়েছে- বৈধ কাগজপত্র না থাকা বাংলাদেশিদের সময় কাটছে আতঙ্কে। শনিবারও তাদের বেশির ভাগই ছিলেন বাসার ভেতরে। বের হন নি। অনেকে আত্মগোপনে রয়েছেন।
অন্যান্য রিপোর্ট মতে, অবৈধ অভিবাসন বিরোধী ‘মেগা থ্রি পয়েন্ট জিরো’ অপারেশন গত শনিবার শেষ হয়েছে। এর আগে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বিশেষ এক সিদ্ধান্তের অধীনে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে নতুন করে শ্রমিক নেয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া ওই মেগা কর্মসূচির কথা হলো, অবৈধ শ্রমিকরা স্বেচ্ছামূলকভাবে ১শ’ রিঙ্গিত দিয়ে একটি বিশেষ পাস পাবে। এরপর সে ৩শ’ রিঙ্গিত জমা দিলে তাকে দেশে ফেরত পাঠাবে। আরব নিউজ ১লা সেপ্টেম্বরের এক রিপোর্টে বলেছে, ২০১৪ থেকে ৮ লাখ ৪০ হাজার বাংলাদেশি ওই কর্মসূচির আওতায় নিবন্ধিত হয়েছিল। এরমধ্যে চলতি বছরেই নিবন্ধিত হয়েছে ১৪৮৭৭৪ জন।
ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ ও হতাশার বর্ণনা: কুয়ালালামপুরে গত ৩ বছর ধরে আছেন মোহাম্মদ সোহাগ। তার কথায়, আমি আমার থাকার কাগজপত্র ঠিক করতে গত ১০ মাসে ১৩শ’ ডলার ব্যয় করেছি। এই সময়ের মধ্যে আমি ইমিগ্রেশন অফিসে ২০ বার গিয়েছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি।
যদি পুলিশ আমার কাছে আসে, তাহলে কী ঘটবে সেটা ভেবে আমি উদ্বিগ্ন। সোহাগ এবং অপর বাংলাদেশি সহকর্মী মাহফুজ আহমেদ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও ভীত। সে কারণে তারা কাজ শেষে বাইরে বের না হয়ে তারা তাদের কর্মস্থলের পাটাতনে রাতযাপন করছেন। গত ২৩ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় আছেন বাংলাদেশি অভিবাসী ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া অভিবাসন বিভাগ থেকে বাংলাদেশিরা ব্যাপকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তারা যথাসময়ে কোনো সেবা দিতে পারছে না। সোহাগের চাকরিদাতা আল মামুন। তিনি বলেন, সব সময় আমি আমার কর্মীদের নিয়ে অভিবাসন দপ্তরে যাই। কিন্তু গত ১০ মাস ধরে তারা আমাদের কাগজপত্র বিবেচনাধীন রেখেছে। আমি এখন আমার কর্মীর ওয়ার্ক পারমিট কখন পাবো, সেই কল পেতে অপেক্ষা করছি। আরব নিউজ প্রতিবেদন আরো জানায়, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ মেগা ৩.০ অপারেশনের শুরু থেকেই একটি কঠোর অবস্থান নিয়েছে। মালয়েশিয়ার অভিবাসন দপ্তরের মহাপরিচালক দাতুক মুস্তাফার আলী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘অ্যামনেস্টি ডেডলাইনটি প্রসারিত করা হবে না।
আমরা শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া অবৈধ অভিবাসী বিরোধী আমাদের অপারেশন আরো জোরদার করবো। আমরা তাদেরকে এই প্রোগ্রামের আওতায় সাইন আপ করার জন্য যথেষ্ট সময় দিয়েছি। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্টস (বায়রা)-এর সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার আরব নিউজ ডটকমকে বলেন, ‘অবৈধ অভিবাসন সবসময় শ্রমিকদের আইনি মাইগ্রেশন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। আমরা এই ধরনের অবৈধ মাইগ্রেশনের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, দরিদ্র শ্রমিকদের যারা মালয়েশিয়ায় ভিসা বৈধ করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের পথে কাঁটা হয়ে আছে ‘অবৈধ সিন্ডিকেট’। অন্যদিকে মুস্তাফার বলেন, ‘আধুনিক কালের ক্রীতদাস’ হিসেবে যারা শ্রমিকদের গণ্য করছে, তারাই চলতি অভিযানের মূল টার্গেট হবে। তিনি বলেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৯ হাজার ২০০ অভিযান চালিয়ে ২৮ হাজার ৬৩ জন অনথিভুক্ত অভিবাসী এবং ৭৯৯ জন নিয়োগকারী গ্রেপ্তার হয়েছেন। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সূত্র আরব নিউজকে জানায়, ওই গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই বাংলাদেশি হতে পারে। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহিদুল ইসলাম অবশ্য আরব নিউজকে জানান, মালয়েশিয়া সরকারের চলতি অপারেশন সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। ‘এটা স্পষ্ট যে কর্তৃপক্ষ অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন।
তারা (মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ) সারা বছর এই ধরনের অপারেশন পরিচালনা করে। বাংলাদেশ মিশন প্রধান নিশ্চিত করেছেন যে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় বসবাস করেন।
চলমান অভিযানের নেপথ্যে: মালয়েশিয়ার অনলাইন দ্য স্টার বলছে- মালয়েশিয়ায় ৩+১ সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অভিযান শুরু করেছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হয়েছে অপারেশন মেগা ৩.০। এর অধীনে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৪ হাজার বিদেশির কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয়েছে। অভিবাসন বিষয়ক মহাপরিচাক মুস্তাফার আলী বলেছেন, সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে ঘেরাও করে এ অভিযান পরিচালনা করছেন অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তারা। ২০১৪ থেকে গত ২৮শে আগস্ট পর্যন্ত ৮ লাখেরও বেশি অবৈধ অভিবাসী সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছেন এবং তারা হয় বৈধতা পেয়েছেন না হয় নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন। মুস্তাফার আলীর ভাষ্যমতে, একটি গ্লোভ কারখানায় কর্মরত দেড় হাজারের বেশি বিদেশি শ্রমিকের কাগজপত্র যাচাই করে দেখা হয়েছে। অভিযানটি নির্বিঘ্নেই চলছিল, তখন কয়েকজন বিদেশি শ্রমিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন।
এ সময় অভিবাসন বিভাগের একজন নারী কর্মকর্তা আহত হন। নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে নিয়ে হলেও অভিবাসন বিভাগের কর্মীরা দিনরাত আইন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। অভিবাসন বিভাগের প্রধান বলেন- বিদেশি শ্রমিকরা যথাযথ কাগজপত্র জমা দিতে পারেনি বলে তাদের কাজের অনুমতি বিলম্বিত হচ্ছে। তার ভাষায় ‘যদি চাকরিদাতারা তাদের শ্রমিকদের দ্রুততার সঙ্গে নিতে চান তাহলে তাদের সব ডকুমেন্ট যথাযথভাবে পূরণ করে তা জমা দেয়া হয়েছে এটা তাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে’। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বারনামা এক রিপোর্টে বলেছে, সেপাংয়ে বান্দার বারু সালাক টিঙ্গি এলাকায় থাকা গ্লোভ কারখানায় অভিযানকালে আহত ওই বাংলাদেশি পালানোর চেষ্টা করছিলেন। অবশ্য তিনি পালাতে পারেননি। পালাতে গিয়ে তিনি পড়ে যান এবং আহত হন। সেখানে একজন অবৈধ নারী শ্রমিককে ধরতে গিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তা নূর এরা এলিনা জাহারুদ্দিন (২৪)। অবশ্য স্থানীয় অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো এই ধরপাকড় বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
হাইকমিশনার যা বললেন- বৈধতার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অবৈধ অভিবাসীদের ধরতে মালয়েশিয়াজুড়ে যে পুলিশি অভিযান চলছে তাতে ৫০০ অবৈধ অভিবাসী আটক হয়েছেন মর্মে খবর বেরিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তার মধ্যে বেশ কয়েক জন বাংলাদেশিও রয়েছেন। কুয়ালালামপুরে অধিকার বিষয়ক সংস্থা নর্থ সাউথ ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক আদ্রিয়ান পেরেইরা বলেছেন, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে বহু সংখ্যক বাংলাদেশি থাকতে পারেন। গত বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়ায় সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দেশটির পুলিশ অবৈধদের ধরতে ওই অভিযানে নামে। কুয়ালালামপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শহীদুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেছেন, এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করে কোনো বাংলাদেশি আটকের তথ্য হাইকমিশন পায়নি। তার দাবি, প্রায় শতাধিক ব্যক্তি আটক হয়েছেন এমন রিপোর্ট তিনিও পেয়েছেন, তবে সেখানে কোন দেশের কতজন রয়েছেন তা আলাদা করে প্রকাশ করা হয়নি। নাগরিকত্ব নিশ্চিতকরণের বিষয়টি খানিকটা জটিল উল্লেখ করে হাইকমিশনার বলেন- অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতার জন্য সাধারণ ক্ষমার আওতায় দফায় দফায় সুযোগ দিয়েছে দেশটির সরকার।
প্রায় আড়াই বছর ধরে চলা ওই সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছেন ৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি। তারা রেজিস্ট্রেশন করেছেন। অনেক বাংলাদেশি বৈধ হয়েছেন। অনেকে দেশে ফিরে গেছেন। সুযোগটি বন্ধ করে দেয়ার পরও বাংলাদেশ সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে জানিয়ে হাইকমিশনার বলেন- বৈধতার পূর্ব নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশি অভিযান চালাবে-এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে যারা আটক হয়েছে তাদের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি আছেন কি-না তা জানতে কাল অফিস খোলার পর থেকেই হাইকমিশন যোগাযোগ শুরু করবে বলে জানান তিনি। হাইকমিশনার এ নিয়ে অহেতুক আতঙ্কিত না হতে মালয়েশিয়া প্রবাসী স্বজনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বৈধতার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশিরা হাইকমিশন ও অভিবাসন অফিসে গিয়ে পদে পদে হয়রানি হয়েছেন জানিয়ে ওই প্রবাসী শিক্ষার্থী বলেন, তার পরিবারের অনেকে দেশটিতে রয়েছেন। তিনি যার মাধ্যমে সেখানে গেছেন তারাও এখন কাগজপত্র নিয়ে জটিলতায় রয়েছেন। অভিযান শুরু হওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন- এখনো মিশনের কারো সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারিনি। জরুরি যোগাযোগে মিশনের হটলাইন চালুর নিয়ম থাকলেও তা এখনো খোলা হয়নি বলে হতাশা ব্যক্ত করেন ওই প্রবাসী। এদিকে কুয়ালালামপুরের ডেটলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট মতে, সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে কঠোর এবং বাচ-বিচারহীন অভিযান শুরু হয়েছে। তাতে অবৈধদের রেহাই নেই। তাদের সামনে দুটি পথ খোলা। যত দ্রুত সম্ভব বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা, না হয় জেল-জরিমানা দিয়ে দেশে ফেরা।
কেবল বাংলাদেশি নয়, আতঙ্কে আছেন অন্য বিদেশিরাও। এক রিপোর্টে জানা গেছে, মালয়েশিয়াতে প্রায় ২০ লাখ বিদেশি কাজ করেন। ২০১৭ সালের জন-জরিপ মতে সেখানে বিদেশি শ্রমিকদের মধ্যে বেশির ভাগ ইন্দোনেশিয়ার। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ শীর্ষে। ওই তালিকায় ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও রয়েছে মিয়ানমার, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, লাউস, ভারত ও নেপাল। বিদেশি শ্রমিকদের বেশির ভাগেরই নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। অনলাইন দ্য ডেইলি স্টার মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনকে উদ্ধৃত করে তাতে প্রকাশিত রিপোর্টে বলছে- বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছে। এর মধ্যে অর্ধেকরই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। অভিবাসন ও অধিকার বিষয়ক কর্মীদের উদ্ধৃত করে স্টারের রিপোর্টে জানানো হয়েছে- বৈধ কাগজপত্র না থাকা বাংলাদেশিদের সময় কাটছে আতঙ্কে। শনিবারও তাদের বেশির ভাগই ছিলেন বাসার ভেতরে। বের হন নি। অনেকে আত্মগোপনে রয়েছেন।
অন্যান্য রিপোর্ট মতে, অবৈধ অভিবাসন বিরোধী ‘মেগা থ্রি পয়েন্ট জিরো’ অপারেশন গত শনিবার শেষ হয়েছে। এর আগে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বিশেষ এক সিদ্ধান্তের অধীনে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে নতুন করে শ্রমিক নেয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া ওই মেগা কর্মসূচির কথা হলো, অবৈধ শ্রমিকরা স্বেচ্ছামূলকভাবে ১শ’ রিঙ্গিত দিয়ে একটি বিশেষ পাস পাবে। এরপর সে ৩শ’ রিঙ্গিত জমা দিলে তাকে দেশে ফেরত পাঠাবে। আরব নিউজ ১লা সেপ্টেম্বরের এক রিপোর্টে বলেছে, ২০১৪ থেকে ৮ লাখ ৪০ হাজার বাংলাদেশি ওই কর্মসূচির আওতায় নিবন্ধিত হয়েছিল। এরমধ্যে চলতি বছরেই নিবন্ধিত হয়েছে ১৪৮৭৭৪ জন।
ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ ও হতাশার বর্ণনা: কুয়ালালামপুরে গত ৩ বছর ধরে আছেন মোহাম্মদ সোহাগ। তার কথায়, আমি আমার থাকার কাগজপত্র ঠিক করতে গত ১০ মাসে ১৩শ’ ডলার ব্যয় করেছি। এই সময়ের মধ্যে আমি ইমিগ্রেশন অফিসে ২০ বার গিয়েছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি।
যদি পুলিশ আমার কাছে আসে, তাহলে কী ঘটবে সেটা ভেবে আমি উদ্বিগ্ন। সোহাগ এবং অপর বাংলাদেশি সহকর্মী মাহফুজ আহমেদ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও ভীত। সে কারণে তারা কাজ শেষে বাইরে বের না হয়ে তারা তাদের কর্মস্থলের পাটাতনে রাতযাপন করছেন। গত ২৩ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় আছেন বাংলাদেশি অভিবাসী ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া অভিবাসন বিভাগ থেকে বাংলাদেশিরা ব্যাপকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তারা যথাসময়ে কোনো সেবা দিতে পারছে না। সোহাগের চাকরিদাতা আল মামুন। তিনি বলেন, সব সময় আমি আমার কর্মীদের নিয়ে অভিবাসন দপ্তরে যাই। কিন্তু গত ১০ মাস ধরে তারা আমাদের কাগজপত্র বিবেচনাধীন রেখেছে। আমি এখন আমার কর্মীর ওয়ার্ক পারমিট কখন পাবো, সেই কল পেতে অপেক্ষা করছি। আরব নিউজ প্রতিবেদন আরো জানায়, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ মেগা ৩.০ অপারেশনের শুরু থেকেই একটি কঠোর অবস্থান নিয়েছে। মালয়েশিয়ার অভিবাসন দপ্তরের মহাপরিচালক দাতুক মুস্তাফার আলী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘অ্যামনেস্টি ডেডলাইনটি প্রসারিত করা হবে না।
আমরা শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া অবৈধ অভিবাসী বিরোধী আমাদের অপারেশন আরো জোরদার করবো। আমরা তাদেরকে এই প্রোগ্রামের আওতায় সাইন আপ করার জন্য যথেষ্ট সময় দিয়েছি। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্টস (বায়রা)-এর সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার আরব নিউজ ডটকমকে বলেন, ‘অবৈধ অভিবাসন সবসময় শ্রমিকদের আইনি মাইগ্রেশন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। আমরা এই ধরনের অবৈধ মাইগ্রেশনের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, দরিদ্র শ্রমিকদের যারা মালয়েশিয়ায় ভিসা বৈধ করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের পথে কাঁটা হয়ে আছে ‘অবৈধ সিন্ডিকেট’। অন্যদিকে মুস্তাফার বলেন, ‘আধুনিক কালের ক্রীতদাস’ হিসেবে যারা শ্রমিকদের গণ্য করছে, তারাই চলতি অভিযানের মূল টার্গেট হবে। তিনি বলেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৯ হাজার ২০০ অভিযান চালিয়ে ২৮ হাজার ৬৩ জন অনথিভুক্ত অভিবাসী এবং ৭৯৯ জন নিয়োগকারী গ্রেপ্তার হয়েছেন। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন সূত্র আরব নিউজকে জানায়, ওই গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই বাংলাদেশি হতে পারে। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহিদুল ইসলাম অবশ্য আরব নিউজকে জানান, মালয়েশিয়া সরকারের চলতি অপারেশন সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। ‘এটা স্পষ্ট যে কর্তৃপক্ষ অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন।
তারা (মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ) সারা বছর এই ধরনের অপারেশন পরিচালনা করে। বাংলাদেশ মিশন প্রধান নিশ্চিত করেছেন যে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় বসবাস করেন।
চলমান অভিযানের নেপথ্যে: মালয়েশিয়ার অনলাইন দ্য স্টার বলছে- মালয়েশিয়ায় ৩+১ সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অভিযান শুরু করেছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুরু হয়েছে অপারেশন মেগা ৩.০। এর অধীনে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৪ হাজার বিদেশির কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয়েছে। অভিবাসন বিষয়ক মহাপরিচাক মুস্তাফার আলী বলেছেন, সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে ঘেরাও করে এ অভিযান পরিচালনা করছেন অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তারা। ২০১৪ থেকে গত ২৮শে আগস্ট পর্যন্ত ৮ লাখেরও বেশি অবৈধ অভিবাসী সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছেন এবং তারা হয় বৈধতা পেয়েছেন না হয় নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন। মুস্তাফার আলীর ভাষ্যমতে, একটি গ্লোভ কারখানায় কর্মরত দেড় হাজারের বেশি বিদেশি শ্রমিকের কাগজপত্র যাচাই করে দেখা হয়েছে। অভিযানটি নির্বিঘ্নেই চলছিল, তখন কয়েকজন বিদেশি শ্রমিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন।
এ সময় অভিবাসন বিভাগের একজন নারী কর্মকর্তা আহত হন। নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে নিয়ে হলেও অভিবাসন বিভাগের কর্মীরা দিনরাত আইন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। অভিবাসন বিভাগের প্রধান বলেন- বিদেশি শ্রমিকরা যথাযথ কাগজপত্র জমা দিতে পারেনি বলে তাদের কাজের অনুমতি বিলম্বিত হচ্ছে। তার ভাষায় ‘যদি চাকরিদাতারা তাদের শ্রমিকদের দ্রুততার সঙ্গে নিতে চান তাহলে তাদের সব ডকুমেন্ট যথাযথভাবে পূরণ করে তা জমা দেয়া হয়েছে এটা তাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে’। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বারনামা এক রিপোর্টে বলেছে, সেপাংয়ে বান্দার বারু সালাক টিঙ্গি এলাকায় থাকা গ্লোভ কারখানায় অভিযানকালে আহত ওই বাংলাদেশি পালানোর চেষ্টা করছিলেন। অবশ্য তিনি পালাতে পারেননি। পালাতে গিয়ে তিনি পড়ে যান এবং আহত হন। সেখানে একজন অবৈধ নারী শ্রমিককে ধরতে গিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তা নূর এরা এলিনা জাহারুদ্দিন (২৪)। অবশ্য স্থানীয় অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো এই ধরপাকড় বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
হাইকমিশনার যা বললেন- বৈধতার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অবৈধ অভিবাসীদের ধরতে মালয়েশিয়াজুড়ে যে পুলিশি অভিযান চলছে তাতে ৫০০ অবৈধ অভিবাসী আটক হয়েছেন মর্মে খবর বেরিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তার মধ্যে বেশ কয়েক জন বাংলাদেশিও রয়েছেন। কুয়ালালামপুরে অধিকার বিষয়ক সংস্থা নর্থ সাউথ ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক আদ্রিয়ান পেরেইরা বলেছেন, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে বহু সংখ্যক বাংলাদেশি থাকতে পারেন। গত বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়ায় সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দেশটির পুলিশ অবৈধদের ধরতে ওই অভিযানে নামে। কুয়ালালামপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শহীদুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেছেন, এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করে কোনো বাংলাদেশি আটকের তথ্য হাইকমিশন পায়নি। তার দাবি, প্রায় শতাধিক ব্যক্তি আটক হয়েছেন এমন রিপোর্ট তিনিও পেয়েছেন, তবে সেখানে কোন দেশের কতজন রয়েছেন তা আলাদা করে প্রকাশ করা হয়নি। নাগরিকত্ব নিশ্চিতকরণের বিষয়টি খানিকটা জটিল উল্লেখ করে হাইকমিশনার বলেন- অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতার জন্য সাধারণ ক্ষমার আওতায় দফায় দফায় সুযোগ দিয়েছে দেশটির সরকার।
প্রায় আড়াই বছর ধরে চলা ওই সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছেন ৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি। তারা রেজিস্ট্রেশন করেছেন। অনেক বাংলাদেশি বৈধ হয়েছেন। অনেকে দেশে ফিরে গেছেন। সুযোগটি বন্ধ করে দেয়ার পরও বাংলাদেশ সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে জানিয়ে হাইকমিশনার বলেন- বৈধতার পূর্ব নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশি অভিযান চালাবে-এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে যারা আটক হয়েছে তাদের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি আছেন কি-না তা জানতে কাল অফিস খোলার পর থেকেই হাইকমিশন যোগাযোগ শুরু করবে বলে জানান তিনি। হাইকমিশনার এ নিয়ে অহেতুক আতঙ্কিত না হতে মালয়েশিয়া প্রবাসী স্বজনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
No comments