সমাজের কথা ভাবছে কি? by সজল চৌধুরী
দিনের
বেলায় অতি উচ্চমাত্রার গাড়ির হর্ন আর রাতের বেলায় ভেসে আসা মাইকের
আওয়াজ—এই হচ্ছে আমাদের নাগরিক জীবন! আমাদের নিশ্চয় মনে আছে, কয়েক দিন আগে
ঢাকার গোপীবাগের আর কে মিশন রোডের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত
কর্মকর্তা মো. নাজমুল হক মারা গেলেন রাতের বেলায় অনুষ্ঠানে অতি উচ্চ স্বরে
দীর্ঘক্ষণ ধরে চলমান গান থামাতে বলায়। কারণ, কিছুদিন আগেই তঁার হার্টের
অপারেশন হয়েছিল। আর সেটি ছিল একটি গায়েহলুদের অনুষ্ঠান। আমাদের অনেকেরই
জানা নেই, সাধারণ কথাবার্তা হয় ৬৫ থেকে ৮৫ ডেসিবেলের (শব্দের একক) মধ্যে।
আর শব্দের মাত্রা ৮৫ ডেসিবেলের ওপরে হলে সেটি হয় জনস্বাস্থ্যের জন্য
ঝুঁকিপূর্ণ। আর সে ক্ষেত্রে জোরে গান বাজালে কিংবা কনসার্টে সেই শব্দের
মাত্রা যদি হয় ১২০ ডেসিবেলের ওপরে, তবে সেটি হবে যে কারও জন্য
মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ। হয়তো এ ক্ষেত্রে মো. নাজমুল হক শব্দের তীব্রতায় মারা
যাননি, তবু আমাদের কাছে এই মুহূর্তে দেশীয় এমন পরিসংখ্যান নেই যে প্রতিদিন
শব্দের দূষণজনিত কারণে শহরকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনে কত দুর্ঘটনা ঘটছে কিংবা
প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এ কারণে দিনে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে কতজন
নাগরিক মৃত্যুবরণ করছেন? কিছুদিন আগে চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের একদল
ছাত্রছাত্রীর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল চট্টগ্রাম শহরের শব্দের দূষণ
সাধারণ মাত্রার থেকে বিশেষ বিশেষ এলাকায় প্রায় ১০-১২ গুণ বেশি, যার আশপাশে
স্কুল-কলেজ বিদ্যমান। আরেকটি দুর্ঘটনার কথা এখানে না বললেই নয়। চট্টগ্রামের
রিমি কমিউনিটি সেন্টারে কিছুদিন আগেই পদদলিত হয়ে মারা গেলেন ১০ জন।
ধারণক্ষমতার বাইরে জনসমাগম, অপ্রশস্ত প্রবেশদ্বার ও ঢালু রাস্তা এর
প্রাথমিক কারণ হিসেবে চিহ্নিত। পাশাপাশি দুটো ঘটনাকে একসঙ্গে রাখলে একটি
যোগসূত্র দেখা যায়। সাধারণত সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে অধিক লোকসমাগম এবং অতি
উচ্চমাত্রার শব্দের উৎপত্তি (বিশেষ করে মিউজিক) হয়। এ লেখাটি যখন লিখছি,
তখন রাত প্রায় ১১টা ৪০ মিনিট। নিকটবর্তী কোনো কমিউনিটি সেন্টার থেকে
ক্রমাগত উচ্চ স্বরে হিন্দি সিনেমার গান ভেসে আসছে। না চাইলেও যেন আমরা
শুনতে বাধ্য। আর এভাবেই দিনের পর দিন শহরের আনাচকানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো
গজিয়ে ওঠা সামাজিক কেন্দ্রগুলো (কমিউনিটি সেন্টার) রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে
সঙ্গে শব্দদূষণের মাধ্যমে একজনের পারিবারিক অনুষ্ঠান পৌঁছে দিচ্ছে আশপাশের
সবার কাছে, বিনা অনুমতিতে, বিনা নিমন্ত্রণে। একদিকে যেমন শহরের রাস্তাঘাট
কিংবা নাগরিক সুবিধার কথা চিন্তা না করে যেখানে-সেখানে
স্কুল-কলেজ-হাসপাতালগড়ে উঠছে, তেমনি নিয়ম না মেনেই গড়ে উঠছে কমিউনিটি
সেন্টারগুলো শহরের গলির এদিক-সেদিক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, একতলা,
দোতলা কিংবা তিনতলা একটি স্থাপনার চারপাশে থাকছে সাধারণ মানের ইটের
দেয়াল-জানালা অথবা কাচ দিয়ে ঘেরা পার্টিশন। ছাদে দেখা যায় টিন-জাতীয় ছাউনির
ব্যবহার, যা সাধারণভাবে ঢালাইকৃত। নেই কোনো শব্দনিরোধক উপকরণের ব্যবহার
কিংবা ইনসুলেশন। এভাবেই গড়ে উঠছে কেন্দ্রগুলো। একটি কমিউনিটি সেন্টারের
সামনে যে পরিমাণ জায়গা অতিথিদের গাড়ি রাখার জন্য প্রয়োজন,
তা ঠিকঠাক মানা
হচ্ছে না। এতে করে যেকোনো অনুষ্ঠানের সময় অতিথিদের গাড়ি রাস্তায় পার্কিং
করা হচ্ছে আর সাধারণ নাগরিকদের চরম দুর্ভোগে রাস্তায় চলাফেরা করতে হচ্ছে।
তা ছাড়া প্রয়োজনীয় জায়গা না থাকার দরুন অতি জনসমাগমে আবারও যেকোনো সময় ঘটতে
পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা। অথচ নিয়ম থাকলেও দেখার তেমন কেউ নেই! শহরগুলোতে
এমনও দেখা গেছে, এসব সেন্টারে রাতের বেলায় হাজার রকম আলোকসজ্জা ঘণ্টার পর
ঘণ্টা ধরে অবিরাম চলতে থাকে। স্থানীয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটু এদিকে
নজর দিলে কিংবা আইনের সঠিক প্রয়োগ করলে বেশ কিছু সুফল পাওয়া সম্ভব। ব্যবসা
লাভজনক বলে যেকোনো জায়গায় গড়ে উঠছে এই সেন্টারগুলো। অথচ এ ধরনের সেন্টার
তৈরিতে দেশীয় নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী আছে অনেক ধরনের নীতিমালা। থাকতে হবে
পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের ব্যবস্থাপনা—সামনে প্রশস্ত রাস্তা এবং ভেতরে উৎপন্ন
শব্দ যেন বাইরে আসতে না পারে, সে জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ। তা ছাড়া
প্রয়োজনীয় অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থাপনা এবং বহির্গমন রাস্তা অতিগুরুত্বপূর্ণ। এ
ধরনের স্থাপনায় জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার জন্য সিঁড়ির ন্যূনতম প্রশস্ত
দুই মিটার হওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও হরহামেশাই এর ব্যতিক্রম দেখা যায়।
অন্যদিকে অনেক সুউচ্চ আবাসিক ভবনে নিচের তলার দিকে সামাজিক অনুষ্ঠান পালন
করার জন্য বিধি মোতাবেক নির্দিষ্ট জায়গা রাখা হলেও শব্দনিয়ন্ত্রণের বিষয়
বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। যেহেতু এ ধরনের স্থাপনায় অতি উচ্চমাত্রার শব্দ তৈরি
হয়, সেহেতু এ ধরনের স্থাপনার কক্ষের উচ্চতার ক্ষেত্রেও বিশেষ বিবেচনা
প্রয়োজন বৈকি! এমন পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট জায়গায় অনুষ্ঠান হলেও রাতের বেলায়
শব্দদূষণের কারণে আশপাশের সবাইকে অসীম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বাংলাদেশে
নির্মাণ বিধিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, যেকোনো ধরনের বিবাহ কিংবা পার্টি
সেন্টারের জন্য প্রতি এক শ বর্গমিটার গ্রস এরিয়ার জন্য একটি গাড়ি
পার্কিংয়ের ব্যবস্থাপনা থাকা বাধ্যতামূলক। বিধিমালায় এ–ও উল্লেখ আছে—তিন
হাজার বর্গমিটারের অধিক ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট আবাসিক ভবনে বসবাসকারীদের
ব্যবহারের জন্য ন্যূনতম চার শতাংশ জায়গা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য
বরাদ্দ রাখতে হবে। এমনকি নগরের বিশেষ কোনো জায়গায় এ ধরনের সেন্টার তৈরি করা
যাবে, তারও নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি আছে। আর এসব বিধিনিষেধ মেনে না চললে
অচিরেই এসব সামাজিক কেন্দ্র আশপাশের নাগরিক জীবন বিপন্ন করে তুলবে। আর তখন
হয়তো প্রতিবাদের ভাষাও কারও থাকবে না। কারণ, তত দিনে আমাদের শ্রবণশক্তি
নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়!
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
sajal_c@yahoo.com
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
sajal_c@yahoo.com
No comments