ফেসবুকের সমাধিক্ষেত্র : ‘আমি কবে মরে গেছি, আজও মনে করো?’ by ফারুক ওয়াসিফ
দুনিয়ায়
যত কাল আছে, এর বাইরে আরেকটি কাল হচ্ছে—ফেসবুককাল। সেখানে একটাই
সময়—বর্তমান। আমার এক বন্ধু ক্যানসারে মারা গেছে চার বছর আগে। কিন্তু
খুঁজলে এখনো তাকে পাই। ইহজগতে সে নেই। তার স্মৃতিও একটু একটু করে মুছে
যাচ্ছে মন থেকে। কিন্তু এখনো ফেসবুক তার জন্মদিনের কথা জানায়। হঠাৎ
টাইমলাইনে ঘোষণা আসে : ‘অন দিস ডে ইউ হ্যাভ মেমোরি উইথ...।’ হয়তো ভুল করে
ক্লিক করি তার প্রোফাইলে। তার অ্যাকাউন্টটি কেউ বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ
করেনি ফেসবুককে। সব তেমনই আছে। অনেক ছবি, অনেক কথা, অনেক পোস্ট। না থেকেও
এভাবে সে আছে। ফেসবুক হয়ে থাকছে অক্ষয় স্মৃতির জাদুঘর। মানুষ ভোলে, ডিজিটাল
মেমোরি ভোলে না কিছুই। ফেসবুকে রয়ে গেছে তার স্থায়ী ডিজিটাল উত্তরাধিকার।
ডিজিটাল যুগের ভার্চ্যুয়াল রিয়্যালিটি বদলে দিচ্ছে আমাদের জীবন। এমনকি
মৃত্যুর অর্থও বদলে যাচ্ছে। শারীরিকভাবে মরে গেলেও আপনি বাঁচিয়ে রাখতে
পারেন আপনার আপনজনের ডিজিটাল অস্তিত্ব। ফেসবুককে অনুরোধ করে, মৃত্যুর
সনদনামা দেখিয়ে একটা ফরম পূরণ করে তার অ্যাকাউন্টটি চালু রাখতে পারেন।
ওটাকে বানিয়ে ফেলতে পারেন তার স্মৃতির স্মারক, নয়তো যেমন ছিল, তেমনই রাখতে
পারেন। শুধু ওই না-থাকা মানুষটির নিজের কোনো সাড়া মাথা কুটলেও মিলবে না।
কেবল বৈধ উত্তরাধিকারই পারবে ওই অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে। আউটলুক
ম্যাগাজিনে দিলীপ বব লিখেছেন, ‘এখন এই ডিজিটাল যুগে, সব সময়ই অতীতও
বর্তমান। মরে গেলেও আমরা সবাই জীবিত, যদিও তারা পারবে না আপনার প্রশ্নে
সাড়া দিতে ।’ তারপরও হয়তো অনেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবে, তার পোস্টে
ট্যাগ করবে। পোক করবে কেউ, কিন্তু আমি টেরটি পাব না। কবি জীবনানন্দ দাশের
কবিতার মতো করে মরে যাওয়া কারও কথা মনে হবে অন্য কারও : সে বোধ হয় ভাবছে,
‘আমি কবে মরে গেছি, আজও মনে করো?’
এ থেকে এক চিন্তা এসেছে। মৃত্যুর পর কাউকে উত্তরাধিকারী করে যাব আমার অ্যাকাউন্টের। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মতো কাউকে করে যাব আমার ডিজিটাল স্মৃতির উত্তরাধিকারী। জন্মদিনে-মৃত্যুদিনে সে হয়তো আমার পৃষ্ঠাগুলোতে বিষণ্ন মনে ঘুরে বেড়াবে। হয়তো পুরোনো কোনো কথা বা ছবি থেকে আমার সম্পর্কে নতুন কোনো উপলব্ধি জন্মাবে তার। আমি নিজে যেমন ভাবতাম না নিজেকে, আমার অতীত তার সামনে তেমন কোনো রূপে হাজির হবে হয়তো। কিংবা জেনে যাবে কেউ যা জানেনি, তা-ও। তখন আমার কিছুই করার থাকবে না। হয়তো, এটাই একধরনের ডিজিটাল অমরত্ব। লোকে যেমন কবরস্থানে যায়, হয়তো সে সময়ের মানুষ কারও স্মরণে ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে এক তোড়া ডিজিটাল-পুষ্প দিয়ে আসবে। কষ্ট করে দূরের কোনো কবরস্থানে গিয়ে মুছে যাওয়া সমাধিলিপিগুলো থেকে কারও নাম খুঁজে বের করতে হবে না। তা ছাড়া কবরের ওপর যখন কবর উঠছে, তখন কজনারই বা নিজস্ব কবর কিনে রাখার সামর্থ্য থাকবে? বরং ফেসবুকের সমাধিটা হবে একদম নিজস্ব। আমার স্মৃতির উত্তরাধিকারী চাইলে সেটাকে আমার নামেই রেখে দিতে পারবে। সেটাই হয়তো হয়ে উঠবে মৃতকে স্মরণ করার নতুন প্রথা। কে জানে?
আমরা যার যার জায়গায় মরে যাব। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মেনলো পার্ক নামের জায়গার কোনো এক সার্ভারে আমি বেঁচে থাকব ডিজিটাল তথ্যপুঞ্জের ভেতর। এই তথ্য আমাকে বিষণ্ন না সুখী করে? জানি না। এক অর্থে ফেসবুক ক্রমেই কবরস্থান হয়ে উঠছে। ফেসবুক চালু হয়েছে এক যুগ হলো। গত বছরের এক হিসাবে, এই ১২ বছরে ৫ কোটি ফেসবুকার মারা গেছেন। এখন বিশ্বে ফেসবুকারের সংখ্যা ১৬০ কোটি। এদের মধ্যে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ৮ হাজার জন। সুতরাং, নিকট ভবিষ্যতে জীবিত ব্যক্তিদের চেয়ে মৃত ফেসবুকারের সংখ্যা বেশি হবে। ঢাকার রায়ের বাজার বধ্যভূমির পেছনে এশিয়ার বৃহত্তম কবরস্থান নির্মাণ করে গর্বিত বাংলাদেশ সরকার। ফেসবুক তাদেরও ছাপিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে তা হয়ে উঠেছে দুনিয়ার বৃহত্তম ডিজিটাল কবরস্থান। অনলাইনে আমরা যা-ই করি, তার চিহ্ন রয়ে যায়। দিলীপ বব বলছেন, ‘এভাবে আমরা আসলে রচনা করে যাচ্ছি আমাদেরই আত্মজীবনী। আমরা তো সবই করি সেখানে। আর আছে আমাদের ছবি—অফুরান। মারাত্মক এক বিপদও আছে এই রয়ে যাওয়ার। ফেসবুক ও গুগলের ব্যবহারকারীদের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকা বিপজ্জনকও। আমেরিকায় রক্ষিত সেই তথ্যভান্ডারে আমেরিকান সরকার প্রবেশ করতে পারবে। কোনো কোম্পানি সেগুলো কিনে নিতে পারবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য এসবের ব্যবহার ঠেকানো যাবে কেমন করে?’
গত বছরের অক্টোবর মাসে বেলজিয়ামে অবস্থিত ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস একটা রায় দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষিত ইউরোপীয় নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য খারাপ উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হতে পারে। এই যুগান্তকারী রায় ফেসবুক, গুগল, আমাজনসহ অনেক প্রাযুক্তিক কোম্পানিকে জনতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে বেশ কজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করেছে ফেসবুক। এতে করে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হলো না? যেখানে আমাদের সরকারই ফেসবুকের গোপন তথ্য ব্যবহার করছে, সেখানে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের নামে নেওয়া আঙুলের ছাপের অপব্যবহার না হওয়ার নিশ্চয়তা কে দেবে? জীবিতর মতো, মৃত ব্যক্তির তথ্যেরও দাম আছে। একেকজনের আস্ত জীবনের সব তথ্য, ছবি, কথা, আবেগ কত দামে বিক্রি হবে? কিংবা কোনো রাজনৈতিক চক্রান্তে সেসবের ব্যবহার হবে? আমরা জানি না। শুধু এটুকু জানি, এই বিশ্বে জীবনে যেমন মরণের পরও আমরা অনিরাপদ। তারপরও অমরত্বের বাসনা রয়ে গেছে আমাদের। ইতিহাসের হাতছানি ডাকে আমাদের। তাই অনেকেই চাইবে, মরে গিয়ে ফেসবুকের তথ্যভান্ডারে রয়ে যেতে। রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে, ‘রূপনারানের কূলে/জেগে উঠিলাম’ । উঠে দেখলাম, সব বন্ধু ও শত্রুর সঙ্গে একসঙ্গে তথ্য হয়ে আছি। কিংবা জীবনানন্দ দাশের মতো ভাবতে ইচ্ছা তো হয়ই, ‘আমরা মরে যাইনি আজও—তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’।
এ থেকে এক চিন্তা এসেছে। মৃত্যুর পর কাউকে উত্তরাধিকারী করে যাব আমার অ্যাকাউন্টের। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মতো কাউকে করে যাব আমার ডিজিটাল স্মৃতির উত্তরাধিকারী। জন্মদিনে-মৃত্যুদিনে সে হয়তো আমার পৃষ্ঠাগুলোতে বিষণ্ন মনে ঘুরে বেড়াবে। হয়তো পুরোনো কোনো কথা বা ছবি থেকে আমার সম্পর্কে নতুন কোনো উপলব্ধি জন্মাবে তার। আমি নিজে যেমন ভাবতাম না নিজেকে, আমার অতীত তার সামনে তেমন কোনো রূপে হাজির হবে হয়তো। কিংবা জেনে যাবে কেউ যা জানেনি, তা-ও। তখন আমার কিছুই করার থাকবে না। হয়তো, এটাই একধরনের ডিজিটাল অমরত্ব। লোকে যেমন কবরস্থানে যায়, হয়তো সে সময়ের মানুষ কারও স্মরণে ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে এক তোড়া ডিজিটাল-পুষ্প দিয়ে আসবে। কষ্ট করে দূরের কোনো কবরস্থানে গিয়ে মুছে যাওয়া সমাধিলিপিগুলো থেকে কারও নাম খুঁজে বের করতে হবে না। তা ছাড়া কবরের ওপর যখন কবর উঠছে, তখন কজনারই বা নিজস্ব কবর কিনে রাখার সামর্থ্য থাকবে? বরং ফেসবুকের সমাধিটা হবে একদম নিজস্ব। আমার স্মৃতির উত্তরাধিকারী চাইলে সেটাকে আমার নামেই রেখে দিতে পারবে। সেটাই হয়তো হয়ে উঠবে মৃতকে স্মরণ করার নতুন প্রথা। কে জানে?
আমরা যার যার জায়গায় মরে যাব। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মেনলো পার্ক নামের জায়গার কোনো এক সার্ভারে আমি বেঁচে থাকব ডিজিটাল তথ্যপুঞ্জের ভেতর। এই তথ্য আমাকে বিষণ্ন না সুখী করে? জানি না। এক অর্থে ফেসবুক ক্রমেই কবরস্থান হয়ে উঠছে। ফেসবুক চালু হয়েছে এক যুগ হলো। গত বছরের এক হিসাবে, এই ১২ বছরে ৫ কোটি ফেসবুকার মারা গেছেন। এখন বিশ্বে ফেসবুকারের সংখ্যা ১৬০ কোটি। এদের মধ্যে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ৮ হাজার জন। সুতরাং, নিকট ভবিষ্যতে জীবিত ব্যক্তিদের চেয়ে মৃত ফেসবুকারের সংখ্যা বেশি হবে। ঢাকার রায়ের বাজার বধ্যভূমির পেছনে এশিয়ার বৃহত্তম কবরস্থান নির্মাণ করে গর্বিত বাংলাদেশ সরকার। ফেসবুক তাদেরও ছাপিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে তা হয়ে উঠেছে দুনিয়ার বৃহত্তম ডিজিটাল কবরস্থান। অনলাইনে আমরা যা-ই করি, তার চিহ্ন রয়ে যায়। দিলীপ বব বলছেন, ‘এভাবে আমরা আসলে রচনা করে যাচ্ছি আমাদেরই আত্মজীবনী। আমরা তো সবই করি সেখানে। আর আছে আমাদের ছবি—অফুরান। মারাত্মক এক বিপদও আছে এই রয়ে যাওয়ার। ফেসবুক ও গুগলের ব্যবহারকারীদের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকা বিপজ্জনকও। আমেরিকায় রক্ষিত সেই তথ্যভান্ডারে আমেরিকান সরকার প্রবেশ করতে পারবে। কোনো কোম্পানি সেগুলো কিনে নিতে পারবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য এসবের ব্যবহার ঠেকানো যাবে কেমন করে?’
গত বছরের অক্টোবর মাসে বেলজিয়ামে অবস্থিত ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস একটা রায় দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষিত ইউরোপীয় নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য খারাপ উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হতে পারে। এই যুগান্তকারী রায় ফেসবুক, গুগল, আমাজনসহ অনেক প্রাযুক্তিক কোম্পানিকে জনতার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে বেশ কজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সরবরাহ করেছে ফেসবুক। এতে করে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হলো না? যেখানে আমাদের সরকারই ফেসবুকের গোপন তথ্য ব্যবহার করছে, সেখানে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের নামে নেওয়া আঙুলের ছাপের অপব্যবহার না হওয়ার নিশ্চয়তা কে দেবে? জীবিতর মতো, মৃত ব্যক্তির তথ্যেরও দাম আছে। একেকজনের আস্ত জীবনের সব তথ্য, ছবি, কথা, আবেগ কত দামে বিক্রি হবে? কিংবা কোনো রাজনৈতিক চক্রান্তে সেসবের ব্যবহার হবে? আমরা জানি না। শুধু এটুকু জানি, এই বিশ্বে জীবনে যেমন মরণের পরও আমরা অনিরাপদ। তারপরও অমরত্বের বাসনা রয়ে গেছে আমাদের। ইতিহাসের হাতছানি ডাকে আমাদের। তাই অনেকেই চাইবে, মরে গিয়ে ফেসবুকের তথ্যভান্ডারে রয়ে যেতে। রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে, ‘রূপনারানের কূলে/জেগে উঠিলাম’ । উঠে দেখলাম, সব বন্ধু ও শত্রুর সঙ্গে একসঙ্গে তথ্য হয়ে আছি। কিংবা জীবনানন্দ দাশের মতো ভাবতে ইচ্ছা তো হয়ই, ‘আমরা মরে যাইনি আজও—তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’।
No comments