পৌর নির্বাচন ২০১৫- ৭৪ শতাংশ ভোটকে স্বাভাবিক বলা যাবে না by এম সাখাওয়াত হোসেন
গত
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হলো প্রথমবারের মতো দলীয় ভিত্তিতে পৌরসভার মেয়র
পদে নির্বাচন। পৌরসভার বাদবাকি কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে
নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না হলেও অনুমেয় যে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সমর্থিত
ব্যক্তিরাই প্রার্থী হয়েছিলেন। এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে যেভাবে
নির্বাচনী প্রচার এবং আচরণবিধি পালিত হয়েছে, তা পূর্বাভাস দিচ্ছিল
নির্বাচনটি কেমন হবে। নির্বাচনের তিনটি ধাপের প্রথম ধাপ প্রাক-নির্বাচন
নিয়ে বহু মতামত এবং লেখাজোখা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ভোট গ্রহণ।
নির্বাচনের তফসিলের পরে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত ছিল ২৩৪টি পৌরসভা, যার মধ্যে সাতটি পৌরসভা নির্বাচন করতে হয়নি। কারণ মেয়র পদসহ বেশ কিছু কাউন্সিলর পদও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ভোট গ্রহণ হয়নি। এটাও বাংলাদেশের পৌর নির্বাচন-২০১৫-এর বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকবে। ওই সাতটি বাদ দিলে ফল পাওয়া গেছে ২০৭টিতে এবং ২০টি পৌরসভার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ স্থগিত করায় বাকি ১৯টিতে আংশিক ফলাফল পাওয়া গেলেও পূর্ণাঙ্গ ফলাফল হয়নি বিধায় স্থগিত রয়েছে।
এ ভোটের মেয়রভিত্তিক দলওয়ারি ফলাফল উল্লেখ করার তেমন প্রয়োজন না থাকলেও পরিসংখ্যানের ছোট বিশ্লেষণ উল্লেখ করছি। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক সরকারি দল আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১৬৮টি, অন্যতম বৃহত্তম দল বিএনপি ২২; বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাপা একটি এবং অন্যান্য পেয়েছিল ২৬টি, যার মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত তথাকথিত বিদ্রোহীরা। এই বিদ্রোহী জয়ী প্রার্থী এবং স্থগিত ২০ পৌরসভার বিজয়ীরা স্বীয় দলে ফিরে গেলে এবং স্থগিত পৌরসভাগুলোর নির্বাচন শেষ হলে সরকারি দলের সংখ্যা আরও বাড়বে।
যা-ই হোক, বিএনপি প্রায় সাত বছর পর স্বীয় দলীয় প্রতীক নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত ছিল, এটা ওই দলের জন্য বড় স্বস্তি হতে পারে। তবে ওই দলের এমনভাবে হেরে যাওয়ার কারণগুলো কী, তা দলটির বিচার-বিশ্লেষণে বের হবে। এই নির্বাচনে জাতীয় সংসদের জন্য নিবন্ধিত ৪০টি দলের ২০টি দল অংশগ্রহণ করলেও তাদের দলের অবস্থান তৃণমূলে কোন পর্যায়ে রয়েছে, তার প্রমাণ এই নির্বাচন। এমনকি জাতীয় পার্টিও তার ভোটব্যাংকের সমর্থন পায়নি, যেমন পায়নি বিএনপি। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অবস্থান খুবই নাজুক থাকলেও তাদের ভোটের শতাংশ ছিল ৩২ দশমিক ৪৯ এবং প্রাসঙ্গিক পর্যায়ে আসন ছিল ২৯টি। অপরদিকে আওয়ামী লীগের আসন ছিল ২৩০টি এবং প্রাপ্ত ভোটের গড় ছিল ৪৮ দশমিক ১৩, প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি।
এবারের পৌরসভা নির্বাচন কেমন হয়েছে, এমনটাই প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচনের পরপরই। কারণ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যমে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে এ নির্বাচনও ২০১৪ সাল থেকে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে যে নেতিবাচক সংস্কৃতির মাত্রা দেখা গিয়েছিল, সেখান থেকে তেমন উন্নত হয়েছে বলে মনে হয় না। সরকারের এই মেয়াদকালে নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় যে নিম্নমুখিতা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে, ভবিষ্যতে তার উন্নতির লক্ষণ দেখা যাবে বলে মনে হয় না। ২০০৮ সালের পরে ২০১৩ পর্যন্ত বর্তমান সরকারের ওই মেয়াদের কোনো নির্বাচন নিয়ে তেমন বড় কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যৌক্তিকতা ওই সময়ের জাতীয় সংসদে একাধিকবার রেফারেন্স হিসেবে উত্থাপিত হয়েছিল। তবে বিদ্যমান সংসদে এমন দাবি আর উচ্চারিত হয়নি।
আগেই বলেছি যে শুধু প্রতীক ছাড়া ২০১১ সালের নির্বাচনেও দলের সদস্যরাই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের নির্বাচনের সঙ্গে এ নির্বাচনের সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরছি। এ তুলনার জন্য ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হচ্ছে। পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক প্রাপ্ত ২০৭টি পৌরসভার গড় ভোটের ৭৩ দশমিক ৯২ শতাংশ (৭৪%)।
এবং উল্লেখিত পত্রিকার তথ্যমতে মেয়র পদে এই পরিসংখ্যানে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৭৪টি পৌরসভায় এবং ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৬৩টি পৌরসভায়। তার মানে ২০৭টি পৌরসভার মেয়র পদের মধ্যে ১৩৭টিতে ৭৫ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি পৌরসভায় গড়ে ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে। নলডাঙ্গার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট পড়েছে শতভাগ, যেমন ছিল যশোরের এমএম কলেজের কেন্দ্রটিতে। দৈবক্রমে ধরা পড়েছিল যশোরের ওই কেন্দ্র। কারণ, তিনটার সময় সেখানে ভোট গণনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল।
লক্ষণীয়, এসব জায়গায় গোলযোগের খবর পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শুধু মেয়র পদে গড়ে ৭৪ শতাংশ এবং ৭৫ থেকে ১০০ ভাগ ভোট পড়া অবাক কাণ্ড। কারণ, নিকট অতীতে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ হারে ভোট পড়ার উদাহরণ নেই এবং সোজা অঙ্কে তেমনটা সম্ভব নয়। ২০১১ সালের পৌর নির্বাচন যদি মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়, তবে ওই সময়ে নির্বাচন হয়েছিল পাঁচ ধাপে, জানুয়ারি ১২, ১৩, ১৭, ১৮ ও ২৭। ২৫৪টি পৌরসভায়। ওই নির্বাচনে ৫৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল এবং আওয়ামী লীগ ১১৬টি মেয়র এবং বিএনপি ১০৬টি পেয়েছিল। ওই নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি একটি আসন পেয়েছিল। ২০১১ সালে ভোটের শতাংশ নিরীক্ষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে প্রায় ৫৭ শতাংশ গড় ভোট মানে ৬০ শতাংশের ওপরে তেমন ভোট পড়েনি। ওই সময়ে প্রায় সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গড়পড়তা ভোটের শতাংশ প্রায় কাছাকাছি ছিল।
আমাদের দেশের সব স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত একাধিক ব্যালটে ভোট হয়ে থাকে। মেয়র, সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদের জন্য একটি করে ব্যালট পেপার ভোটারকে দেওয়া হয়। আমাদের ভোট প্রদানের জন্য ব্যালট-ব্যবস্থা এখনো যান্ত্রিক বা বৈদ্যুতিক নয়, তাই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া, ভোটার নিশ্চিত করা থেকে ব্যালট বাক্সে তিনটি ব্যালট পেপার প্রবেশ করানো পর্যন্ত সর্বনিম্ন দুই থেকে পাঁচ মিনিট সময় প্রয়োজন হয়। বয়স্ক এবং নারী ভোটারদের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তিন থেকে পাঁচ মিনিট সময়ের প্রয়োজন হয়।
ভোট সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটায় শেষ করতে প্রতি বুথে ৩৫০ থেকে ৪০০ ভোটারের ভোটের ব্যবস্থা করা হয়। এই বিভাজনে কেন্দ্রের মোট ভোটারের ভিত্তিতে বুথ বা ভোটকক্ষ তৈরি করা হয়। কাজেই ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০টি এবং সর্বনিম্ন ১২ থেকে ১৫টি ভোট হতে পারে। ৩০টি ভোটের হিসাবেও ধরলে সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত আট ঘণ্টায় ২৪০টি ভোট হতে পারে। তবে অভিজ্ঞতা বলে যে একটি বুথে এক ঘণ্টায় ২০ থেকে ২৫টি ভোট পড়তে পারে। অবশ্য বৈদ্যুতিক ভোটিং মেশিন হলে এর অধিকসংখ্যক ভোট নেওয়া সম্ভব।
অভিজ্ঞতার আলোকে এটি পর্যবেক্ষণমাত্র, তবে পত্রপত্রিকার তথ্যে বহু জায়গায় সকালে ভোটার সমাগম বেশি ছিল, সে ক্ষেত্রেও ভোট গ্রহণের গতি ২০ থেকে ৩০টির বেশি হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও বৈদ্যুতিন মিডিয়ার তথ্য মোতাবেক দুপুর ১২টার পর থেকে ভোটার সমাগম একেবারেই কম ছিল। অবশ্য ওই সময়ে ভোট পড়েছে অস্বাভাবিক গতি ও সংখ্যায়। নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী প্রদত্ত ব্যালট পেপারের গণনা এবং ভোটের ফলাফলে ব্যবহৃত ফরম পর্যালোচনা করলে কোনো গরমিল থাকলে তা সহজেই ধরা পড়বে।
আলোচিত ফরম দুটির সরল ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছি, যাতে পাঠকদের বোধগম্য হয়। বিধিমোতাবেক ভোটের আগে প্রাপ্ত ব্যালট পেপারের মোট সংখ্যার বিপরীতে ব্যবহৃত মোট পেপারের সংখ্যা উল্লেখ করতে হয়, যার মধ্যে ব্যালট বাক্স থেকে প্রাপ্ত ব্যালট টেন্ডারকৃত, আপত্তিকৃত, হারিয়ে যাওয়া, নষ্ট হওয়া ইত্যাদির যোগফল প্রাপ্ত ব্যালটের সমান হতে হবে। অন্যথায় বিধির ব্যত্যয় হবে, যা আইনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা যায়। পৌরসভার ক্ষেত্রে মেয়র এবং কাউন্সিলরদের ব্যালটের হিসাব আলাদাভাবে দিতে হবে। বাক্স থেকে প্রাপ্ত ব্যালট পেপারের সংখ্যা মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদের সমান হতে হবে। কাজেই কোনো কেন্দ্রে ৩০০টি ব্যালট পেপার ব্যবহৃত হলে তা সব পদের জন্যই সমান হতে হবে। কোনো পদের হারে তারতম্য হলে সে ক্ষেত্রে কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তার স্বাক্ষর এবং এজেন্টদের প্রতিস্বাক্ষরের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই গণনার কপি ব্যাগে এবং এক কপি নির্বাচন কমিশনে অবশ্যই প্রেরণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনে প্রাপ্ত ফলাফলের ফরমের সঙ্গে ব্যালট পেপারের পরিসংখ্যান এবং বৈধ ভোট খতিয়ে দেখতে পারে। অপর দিকে একজন ভোটারের তিনটি ব্যালট গ্রহণ করার আগে প্রতিটির মুড়িতে স্বাক্ষর এবং টিপসই প্রদান বাধ্যতামূলক। মুড়িতে টিপসই না থাকলে তা বৈধ ব্যালট বলে গণ্য করা যায় না। তবে মুড়ি কেন্দ্র থেকে সিলগালা করা অবস্থায় রিটার্নিং অফিসে আনা হয়, যা পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য মামলার আলামত হিসেবে রক্ষিত থাকে; অবশ্য যদি কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের আশ্রয় নেন।
যা-ই হোক, পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণে প্রায় ৭৪ শতাংশ ভোট এবং তদূর্ধ্ব বৈধ ভোট প্রাপ্তিকে স্বাভাবিক বলা যায় না। দৃশ্যত, বেশির ভাগ শান্ত পরিবেশ থাকলেও তথ্যে প্রকাশ যে ব্যালট স্টাফিং হয়েছে কক্ষের বা বুথের ভেতরে। ওপরে বর্ণিত হিসাবের আঙ্গিকে মেলালে হয়তো তা সহজে ধরা যায়, তবে সে ক্ষেত্রে শুধু নির্বাচন কমিশন ও আদালতের ভূমিকা হবে মুখ্য। সেসবের ভিত্তিতে মনে করা স্বাভাবিক যে ২০১৪ সালের পর থেকে নির্বাচন সংস্কৃতির নিম্নগামী চলনে তেমন পার্থক্য দেখা যায়নি।
পরিশেষে বলতে হয়, বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই যে ১০০ শতাংশ বিশুদ্ধ নির্বাচন হয়, তা নয়। উন্নত বিশ্বের নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে শতভাগ শুদ্ধ হয় না আর উঠতি অথবা নতুন গণতান্ত্রিক দেশে ব্যবস্থাপনা নয়, কারচুপির কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়। আর দুটো একত্র হলে তাকে সুষ্ঠু বা প্রায় সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় কি না, তা ভেবে দেখার বিষয়। নির্বাচন কতখানি গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তার সঠিক বিচার করতে পারেন অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ও অংশগ্রহণকারী ভোটাররা।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
নির্বাচনের তফসিলের পরে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত ছিল ২৩৪টি পৌরসভা, যার মধ্যে সাতটি পৌরসভা নির্বাচন করতে হয়নি। কারণ মেয়র পদসহ বেশ কিছু কাউন্সিলর পদও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় ভোট গ্রহণ হয়নি। এটাও বাংলাদেশের পৌর নির্বাচন-২০১৫-এর বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকবে। ওই সাতটি বাদ দিলে ফল পাওয়া গেছে ২০৭টিতে এবং ২০টি পৌরসভার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ স্থগিত করায় বাকি ১৯টিতে আংশিক ফলাফল পাওয়া গেলেও পূর্ণাঙ্গ ফলাফল হয়নি বিধায় স্থগিত রয়েছে।
এ ভোটের মেয়রভিত্তিক দলওয়ারি ফলাফল উল্লেখ করার তেমন প্রয়োজন না থাকলেও পরিসংখ্যানের ছোট বিশ্লেষণ উল্লেখ করছি। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক সরকারি দল আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১৬৮টি, অন্যতম বৃহত্তম দল বিএনপি ২২; বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাপা একটি এবং অন্যান্য পেয়েছিল ২৬টি, যার মধ্যে বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত তথাকথিত বিদ্রোহীরা। এই বিদ্রোহী জয়ী প্রার্থী এবং স্থগিত ২০ পৌরসভার বিজয়ীরা স্বীয় দলে ফিরে গেলে এবং স্থগিত পৌরসভাগুলোর নির্বাচন শেষ হলে সরকারি দলের সংখ্যা আরও বাড়বে।
যা-ই হোক, বিএনপি প্রায় সাত বছর পর স্বীয় দলীয় প্রতীক নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত ছিল, এটা ওই দলের জন্য বড় স্বস্তি হতে পারে। তবে ওই দলের এমনভাবে হেরে যাওয়ার কারণগুলো কী, তা দলটির বিচার-বিশ্লেষণে বের হবে। এই নির্বাচনে জাতীয় সংসদের জন্য নিবন্ধিত ৪০টি দলের ২০টি দল অংশগ্রহণ করলেও তাদের দলের অবস্থান তৃণমূলে কোন পর্যায়ে রয়েছে, তার প্রমাণ এই নির্বাচন। এমনকি জাতীয় পার্টিও তার ভোটব্যাংকের সমর্থন পায়নি, যেমন পায়নি বিএনপি। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অবস্থান খুবই নাজুক থাকলেও তাদের ভোটের শতাংশ ছিল ৩২ দশমিক ৪৯ এবং প্রাসঙ্গিক পর্যায়ে আসন ছিল ২৯টি। অপরদিকে আওয়ামী লীগের আসন ছিল ২৩০টি এবং প্রাপ্ত ভোটের গড় ছিল ৪৮ দশমিক ১৩, প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি।
এবারের পৌরসভা নির্বাচন কেমন হয়েছে, এমনটাই প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচনের পরপরই। কারণ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যমে যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে এ নির্বাচনও ২০১৪ সাল থেকে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে যে নেতিবাচক সংস্কৃতির মাত্রা দেখা গিয়েছিল, সেখান থেকে তেমন উন্নত হয়েছে বলে মনে হয় না। সরকারের এই মেয়াদকালে নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় যে নিম্নমুখিতা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে, ভবিষ্যতে তার উন্নতির লক্ষণ দেখা যাবে বলে মনে হয় না। ২০০৮ সালের পরে ২০১৩ পর্যন্ত বর্তমান সরকারের ওই মেয়াদের কোনো নির্বাচন নিয়ে তেমন বড় কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যৌক্তিকতা ওই সময়ের জাতীয় সংসদে একাধিকবার রেফারেন্স হিসেবে উত্থাপিত হয়েছিল। তবে বিদ্যমান সংসদে এমন দাবি আর উচ্চারিত হয়নি।
আগেই বলেছি যে শুধু প্রতীক ছাড়া ২০১১ সালের নির্বাচনেও দলের সদস্যরাই প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের নির্বাচনের সঙ্গে এ নির্বাচনের সংক্ষিপ্ত তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরছি। এ তুলনার জন্য ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হচ্ছে। পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক প্রাপ্ত ২০৭টি পৌরসভার গড় ভোটের ৭৩ দশমিক ৯২ শতাংশ (৭৪%)।
এবং উল্লেখিত পত্রিকার তথ্যমতে মেয়র পদে এই পরিসংখ্যানে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৭৪টি পৌরসভায় এবং ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৬৩টি পৌরসভায়। তার মানে ২০৭টি পৌরসভার মেয়র পদের মধ্যে ১৩৭টিতে ৭৫ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি পৌরসভায় গড়ে ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে। নলডাঙ্গার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট পড়েছে শতভাগ, যেমন ছিল যশোরের এমএম কলেজের কেন্দ্রটিতে। দৈবক্রমে ধরা পড়েছিল যশোরের ওই কেন্দ্র। কারণ, তিনটার সময় সেখানে ভোট গণনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল।
লক্ষণীয়, এসব জায়গায় গোলযোগের খবর পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শুধু মেয়র পদে গড়ে ৭৪ শতাংশ এবং ৭৫ থেকে ১০০ ভাগ ভোট পড়া অবাক কাণ্ড। কারণ, নিকট অতীতে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ হারে ভোট পড়ার উদাহরণ নেই এবং সোজা অঙ্কে তেমনটা সম্ভব নয়। ২০১১ সালের পৌর নির্বাচন যদি মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়, তবে ওই সময়ে নির্বাচন হয়েছিল পাঁচ ধাপে, জানুয়ারি ১২, ১৩, ১৭, ১৮ ও ২৭। ২৫৪টি পৌরসভায়। ওই নির্বাচনে ৫৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল এবং আওয়ামী লীগ ১১৬টি মেয়র এবং বিএনপি ১০৬টি পেয়েছিল। ওই নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি একটি আসন পেয়েছিল। ২০১১ সালে ভোটের শতাংশ নিরীক্ষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে প্রায় ৫৭ শতাংশ গড় ভোট মানে ৬০ শতাংশের ওপরে তেমন ভোট পড়েনি। ওই সময়ে প্রায় সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গড়পড়তা ভোটের শতাংশ প্রায় কাছাকাছি ছিল।
আমাদের দেশের সব স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত একাধিক ব্যালটে ভোট হয়ে থাকে। মেয়র, সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদের জন্য একটি করে ব্যালট পেপার ভোটারকে দেওয়া হয়। আমাদের ভোট প্রদানের জন্য ব্যালট-ব্যবস্থা এখনো যান্ত্রিক বা বৈদ্যুতিক নয়, তাই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া, ভোটার নিশ্চিত করা থেকে ব্যালট বাক্সে তিনটি ব্যালট পেপার প্রবেশ করানো পর্যন্ত সর্বনিম্ন দুই থেকে পাঁচ মিনিট সময় প্রয়োজন হয়। বয়স্ক এবং নারী ভোটারদের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তিন থেকে পাঁচ মিনিট সময়ের প্রয়োজন হয়।
ভোট সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটায় শেষ করতে প্রতি বুথে ৩৫০ থেকে ৪০০ ভোটারের ভোটের ব্যবস্থা করা হয়। এই বিভাজনে কেন্দ্রের মোট ভোটারের ভিত্তিতে বুথ বা ভোটকক্ষ তৈরি করা হয়। কাজেই ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০টি এবং সর্বনিম্ন ১২ থেকে ১৫টি ভোট হতে পারে। ৩০টি ভোটের হিসাবেও ধরলে সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত আট ঘণ্টায় ২৪০টি ভোট হতে পারে। তবে অভিজ্ঞতা বলে যে একটি বুথে এক ঘণ্টায় ২০ থেকে ২৫টি ভোট পড়তে পারে। অবশ্য বৈদ্যুতিক ভোটিং মেশিন হলে এর অধিকসংখ্যক ভোট নেওয়া সম্ভব।
অভিজ্ঞতার আলোকে এটি পর্যবেক্ষণমাত্র, তবে পত্রপত্রিকার তথ্যে বহু জায়গায় সকালে ভোটার সমাগম বেশি ছিল, সে ক্ষেত্রেও ভোট গ্রহণের গতি ২০ থেকে ৩০টির বেশি হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও বৈদ্যুতিন মিডিয়ার তথ্য মোতাবেক দুপুর ১২টার পর থেকে ভোটার সমাগম একেবারেই কম ছিল। অবশ্য ওই সময়ে ভোট পড়েছে অস্বাভাবিক গতি ও সংখ্যায়। নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী প্রদত্ত ব্যালট পেপারের গণনা এবং ভোটের ফলাফলে ব্যবহৃত ফরম পর্যালোচনা করলে কোনো গরমিল থাকলে তা সহজেই ধরা পড়বে।
আলোচিত ফরম দুটির সরল ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছি, যাতে পাঠকদের বোধগম্য হয়। বিধিমোতাবেক ভোটের আগে প্রাপ্ত ব্যালট পেপারের মোট সংখ্যার বিপরীতে ব্যবহৃত মোট পেপারের সংখ্যা উল্লেখ করতে হয়, যার মধ্যে ব্যালট বাক্স থেকে প্রাপ্ত ব্যালট টেন্ডারকৃত, আপত্তিকৃত, হারিয়ে যাওয়া, নষ্ট হওয়া ইত্যাদির যোগফল প্রাপ্ত ব্যালটের সমান হতে হবে। অন্যথায় বিধির ব্যত্যয় হবে, যা আইনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা যায়। পৌরসভার ক্ষেত্রে মেয়র এবং কাউন্সিলরদের ব্যালটের হিসাব আলাদাভাবে দিতে হবে। বাক্স থেকে প্রাপ্ত ব্যালট পেপারের সংখ্যা মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদের সমান হতে হবে। কাজেই কোনো কেন্দ্রে ৩০০টি ব্যালট পেপার ব্যবহৃত হলে তা সব পদের জন্যই সমান হতে হবে। কোনো পদের হারে তারতম্য হলে সে ক্ষেত্রে কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তার স্বাক্ষর এবং এজেন্টদের প্রতিস্বাক্ষরের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই গণনার কপি ব্যাগে এবং এক কপি নির্বাচন কমিশনে অবশ্যই প্রেরণ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনে প্রাপ্ত ফলাফলের ফরমের সঙ্গে ব্যালট পেপারের পরিসংখ্যান এবং বৈধ ভোট খতিয়ে দেখতে পারে। অপর দিকে একজন ভোটারের তিনটি ব্যালট গ্রহণ করার আগে প্রতিটির মুড়িতে স্বাক্ষর এবং টিপসই প্রদান বাধ্যতামূলক। মুড়িতে টিপসই না থাকলে তা বৈধ ব্যালট বলে গণ্য করা যায় না। তবে মুড়ি কেন্দ্র থেকে সিলগালা করা অবস্থায় রিটার্নিং অফিসে আনা হয়, যা পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য মামলার আলামত হিসেবে রক্ষিত থাকে; অবশ্য যদি কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের আশ্রয় নেন।
যা-ই হোক, পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণে প্রায় ৭৪ শতাংশ ভোট এবং তদূর্ধ্ব বৈধ ভোট প্রাপ্তিকে স্বাভাবিক বলা যায় না। দৃশ্যত, বেশির ভাগ শান্ত পরিবেশ থাকলেও তথ্যে প্রকাশ যে ব্যালট স্টাফিং হয়েছে কক্ষের বা বুথের ভেতরে। ওপরে বর্ণিত হিসাবের আঙ্গিকে মেলালে হয়তো তা সহজে ধরা যায়, তবে সে ক্ষেত্রে শুধু নির্বাচন কমিশন ও আদালতের ভূমিকা হবে মুখ্য। সেসবের ভিত্তিতে মনে করা স্বাভাবিক যে ২০১৪ সালের পর থেকে নির্বাচন সংস্কৃতির নিম্নগামী চলনে তেমন পার্থক্য দেখা যায়নি।
পরিশেষে বলতে হয়, বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই যে ১০০ শতাংশ বিশুদ্ধ নির্বাচন হয়, তা নয়। উন্নত বিশ্বের নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে শতভাগ শুদ্ধ হয় না আর উঠতি অথবা নতুন গণতান্ত্রিক দেশে ব্যবস্থাপনা নয়, কারচুপির কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়। আর দুটো একত্র হলে তাকে সুষ্ঠু বা প্রায় সুষ্ঠু নির্বাচন বলা যায় কি না, তা ভেবে দেখার বিষয়। নির্বাচন কতখানি গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তার সঠিক বিচার করতে পারেন অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ও অংশগ্রহণকারী ভোটাররা।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments