আস্থার সম্পর্ক আদৌ তৈরি হবে কি? by তারেক শামসুর রেহমান

বহুল আলোচিত পৌর নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই নির্বাচন কি দুটি বড় দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) মাঝে আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে আদৌ সহায়ক হবে? বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মাঝে যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে গণতন্ত্রকে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কিংবা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে নানা ‘প্রশ্ন’ থাকলেও পৌর নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণে একটা সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল যে, এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর দুই বড় দলের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হবে! এখন সে সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, সংঘাত-সহিংসতার মধ্য দিয়ে যে নির্বাচনটি শেষ হল, তা রেখে গেছে অনেক প্রশ্ন। এবং একটি ‘সমঝোতাকে’ বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
বিএনপি এরই মধ্যে এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে। সংবাদপত্রগুলো গত ৩১ ডিসেম্বর বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের যে ছবি ছেপেছে, তা একটি শুদ্ধ নির্বাচনের ধারণাকে সমর্থন করে না। কিন্তু তারপরও এ নির্বাচন অনেকগুলো ‘সাফল্য’ দাবি করতে পারে। প্রথমত, এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। মিডিয়ার কারণে দুপুরের আগেই কোথাও কোথাও সহিংসতা, জাল ভোট প্রদান, ভোট কেন্দ্র দখলের খবর এলেও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের কথা বলেনি। বরং দু’দুবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তাদের ‘প্রতিবাদ’ লিপিবদ্ধ করেছে। এর মধ্য দিয়ে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত করে নির্বাচন কমিশন একটি বাহবা নিতেই পারে। দ্বিতীয়ত, নারীরা সেদিন সকালেই প্রায় প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা প্লাস পয়েন্ট। তৃতীয়ত, এবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কোনো খবর আমরা পাইনি, অথচ আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, অতীতে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে ও পরে বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর লোকদের ওপর হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এবার তেমনটি হয়নি। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। চতুর্থত, বেসরকারি নির্বাচন-পর্যবেক্ষকদের প্রায় কেউই পৌর নির্বাচনকে শতকরা একশ’ ভাগ শুদ্ধ বলেননি। তবে বলেছেন, তুলনামূলক বিচারে ভালো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, শতকরা ৭৩ ভাগ ভোট পড়েছে। এটা নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু ছোট ছোট ‘ঘটনা’ যেমনি বড় অর্জনকে ম্লান করে দেয়, ঠিক তেমনি পৌর নির্বাচন সম্পন্ন করতে সফলতার চেয়ে ইসির সীমাবদ্ধতাই বেশি ফুটে উঠেছে।
এ নির্বাচনের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে এ দেশে আগামীতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদৌ সম্ভব কি-না? ৫ জানুয়ারির (২০১৪) জাতীয় সংসদ (দশম) নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন (শেষের তিনটি) এবং সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচন প্রমাণ করল নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেটা ছিল সংসদীয় রাজনীতির একটা ‘কালো অধ্যায়’। এখন এর সঙ্গে যোগ হল ৭ জন মেয়রের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার খবর। এটা কোনো ভালো খবর নয়। ইসি এ ব্যাপারে আদৌ তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ঘটনা ইসির ভূমিকাকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করল। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতির এখতিয়ার বলে নিজ স্বাক্ষরে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিলেন। অন্যদিকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি আমলারা। এক্ষেত্রে সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের ওপর যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ‘চাপ’ ছিল, তা কি অস্বীকার করা যাবে?
পৌর নির্বাচন নিয়ে যা ‘ঘটল’, মিডিয়ায় যা প্রকাশিত হয়েছে, কিংবা চ্যানেলগুলোতে যা সম্প্রচারিত হয়েছে, তা সরকার কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টি যখন অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করে, ইসি ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করে, তখন সরকারের গুরুত্ব দেয়া উচিত। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আমাদের সংবিধানের ১১নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ আমরা বারবার সাংবিধানিক প্রাধান্যের কথা বলি। সেক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই ১১নং অনুচ্ছেদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন একটি প্রশ্ন থাকবেই, পৌর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ১১নং ধারার মূল স্পিরিটটি কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে? আমরা যতই বলি ইসি স্বাধীন এবং যতই সংবিধানের দোহাই দিই না কেন (১১৮-৪), বাস্তবতাই বলে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়। আমরা যে অর্থে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে তাদের ‘অধিকার’ চর্চা করতে দেখি, আমাদের এখানে এটা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। ইসিকে অর্থের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়। ইসি নিজে কোনো ‘বাজেট’ প্রণয়ন করতে পারে না। ইসির নিজের কোনো ‘ক্যাডার কর্মকাণ্ড’ নেই, যারা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিজেরা পরিচালনা করতে পারে। পৌর নির্বাচনে প্রায় ৭০ লাখ ভোটার ছিল। জড়িত ছিল কয়েক কোটি মানুষ। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। সরকারের সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন ছিল। আর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত হয়ে গেলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কারণ আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে ‘দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা’ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমলাদের অনেকে ভালো পোস্টিং, সুযোগ-সুবিধা নেয়ার আশায় অনেকটা জ্ঞাতসারেই সরকারি দলের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন। এ প্রবণতা খারাপ। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা অনেক বেশি বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এ ‘প্রবণতা’ বড় ধরনের প্রতিবন্ধক।
এখন যে বিষয়টির ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তা হচ্ছে, একটি ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন আয়োজন করা কীভাবে সম্ভব? সংবিধানের ১১৮-৪ ধারা আমাদের ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। সংবিধানের ৫৮ ধারায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান ছিল। এখন যা অতীত। বিদেশী পর্যবেক্ষক, বিশেষ করে জাতিসংঘ কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব। যেমনটি করেছে নেপাল। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন আছে। নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘বিদেশীদের’ ডেকে আনা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। উপরন্তু জাতিসংঘ তখনই নির্বাচন-পর্যবেক্ষক পাঠাবে অথবা নির্বাচনের আয়োজন করবে (যেমন- নেপাল, কম্বোডিয়া) যখন বিবদমান ‘পক্ষ’ জাতিসংঘকে অনুরোধ করবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এরকম কোনো সম্ভাবনা নেই।
তাহলে কি এ রকম চলতেই থাকবে? নির্বাচন মানেই জাল ভোট, ব্যালট পেপার ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, কিংবা সহিংসতা! এই বৃত্ত আমাদের ভাঙা দরকার। কিন্তু কীভাবে? দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দলীয় সরকারের (ওই সময় সরকার থাকে নির্বাচনকালীন সরকার। তাদের কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকে না) অধীনে নির্বাচন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতি একটু ভিন্ন। বুদ্ধিজীবীরা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারতেন। আমি দুঃখজনকভাবে অনেক তথাকথিত সুশীলকে দেখছি টক-শোতে, যারা কিছুদিন আগেও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলতেন, পত্রিকায় কলাম লিখতেন; আজ দেখি তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে দেখি, যারা সাংবিধানিক পদে আছেন, শপথ নিয়েছেন, তারা টক-শোতে দলীয় রাজনৈতিক বক্তব্য রাখছেন। অতীতে কখনোই এমনটি হয়নি। অতীতেও রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় ছিল। ভিসিরা ছিলেন, মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানরা ছিলেন। তারা সাধারণ ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ এড়িয়ে চলতেন। আজ পাল্টে গেছে সব। আর এভাবেই আমরা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পাল্টে দিয়েছি। পাল্টে দিয়েছি নির্বাচনের সংস্কৃতি।
আজ যখন সংবাদপত্রগুলো বলে ‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন’, ‘শতাধিক পৌরসভায় হামলা, সংঘাত, গুলি, ব্যালট ছিনতাই’, ‘বিএনপির এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা’; কিংবা যখন বহিরাগতদের ভোট কেন্দ্রে ঢুকে জাল ভোট প্রদানের দৃশ্য প্রথম পাতায় ছাপা হয়, কিংবা ভাঙা ব্যালট বাক্স জঙ্গলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়ার ছবি ছাপা হয়, তখন আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। এই যে সংস্কৃতি, এই সংস্কৃতি সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার জন্য সহায়ক নয়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও দূরত্ব আরও বৃদ্ধি করবে। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে হয়ে পড়বে একদলীয়। লংঘিত হবে মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সুস্থ চিন্তার চর্চা।
বিএনপি মাত্র ২৩টি আসনে, আর আওয়ামী লীগ ১৭০+৭ আসনে বিজয়ী হল। এই পরিসংখ্যান সত্য হলে বলতে হবে বিএনপি তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছে(?)। সেটা কি বর্তমানে এমন পর্যায়ে এসেছে (২৩ আসন)? প্রশ্ন এখানেও। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস বলে, অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এমনকি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপির ভোট প্রাপ্তির হার ছিল শতকরা ৩৩ ভাগের ওপরে। সেই পরিসংখ্যানের সঙ্গে ‘২৩ আসনের’ হিসাব মেলে না।
একটি নির্বাচন হয়েছে। এটাকে ভালো নির্বাচন বলা যাবে না। এ নির্বাচন এই অভিমতকে আরও শক্তিশালী করবে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। আর ইসিও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তারপরও সব ‘ত্র“টি’কে ফেলে দিয়ে দুই বড় দলের মাঝে যদি একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.