মত প্রকাশের প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পথচলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় by মাহফুজ উল্লাহ
বিদায়ী বছরে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর
জন্য মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। জীবনযাপনের এ উৎসাহী মানসিকতা মানুষ
অনেকদিন থেকেই লালন করে আসছে। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা না হয়েও মানুষ কল্পনা করে
নতুন বছরটি তার জীবনে বয়ে আনবে প্রত্যাশিত সুখ ও শান্তি। সাংস্কৃতিক
উত্তরাধিকারের অংশ না হলেও বাংলাদেশের শহুরে মানুষদের কাছে ধীরে ধীরে বাড়ছে
ইংরেজি নববর্ষ উদ্যাপনের প্রয়োজনীয়তা। এ জন্য সরকারকেও হতে হচ্ছে সক্রিয় ও
কঠোর। সরকারের এ কঠোরতা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে
দৃশ্যমান ও কার্যকর হলে নাগরিকরা আশ্বস্ত হতে পারতেন। অথচ বিদায়ী বছরের
শেষের আগের দিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলীয় পরিচয়ে পৌরসভা নির্বাচনের
ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে।
টেলিভিশন পরিচিতির কারণে বছরের শেষদিনে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, নির্বাচন কেমন হল? জবাবটা তৈরি ছিল। সেটাও সংবাদপত্রের কল্যাণেই। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর একটি ইংরেজি দৈনিকের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় যে খবরটি ছাপা হয়েছে তার বাংলা অনুবাদ মোটামুটি এ রকম : ফেনী জেলার দাগনভূঞার একটি ভোট কেন্দ্রে একজন মহিলা চারটি ভোট দিয়ে আসার পর সরকারদলীয় একজন তাকে অনুরোধ করেন আরেকটি ভোট দেয়ার জন্য। মহিলা রাজি হচ্ছিলেন না, বলছিলেন পুলিশ ধরলে জেলে যেতে হবে। অনেক পীড়াপীড়িতে তিনি রাজি হলেন এ শর্তে যে, পুলিশ ধরলে সরকারি দলের লোকজন নিরাপত্তা দেবেন।
এ ঘটনা সাম্প্রতিক পৌরসভা নির্বাচনের একটি ছবি। এরকম আরও অসংখ্য ছবি আছে। নাগরিক সমাজের অনেকের কাছেই সংখ্যার হিসাবে এসব অনিয়ম তুচ্ছ। তাদের অনেকে বলেন, তেমন ভায়োলেন্স হয়নি, মাত্র একজন মারা গেছেন। অবস্থাটা এমন যে, আরও অনেক লোকের মৃত্যু হওয়া উচিত ছিল। এ তর্কে জড়িয়ে না পড়েও যে কথাটি জোর গলায় বলা প্রয়োজন তা হচ্ছে, এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক উদ্যোগ, বঞ্চিত হয়েছে অসংখ্য মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে, একটি সুন্দর নতুন বছরের প্রত্যাশা ঢেকে গেছে অন্ধকারে।
গণতন্ত্রকে অনেকভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায় এবং সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছেও। ইতিহাসে পরদেশ আক্রমণ বা দখল করে নেয়ার সংস্কৃতিও স্বদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থারই অংশ। কিন্তু যেভাবেই দেখা হোক না কেন, গণতন্ত্রের সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক অনেক গভীর, সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রকে দিতে পারে মর্যাদা। গণতন্ত্র হচ্ছে মত প্রকাশের এবং নেতা বাছাইয়ের স্বাধীনতা। জনগণ তাদের নেতা হিসেবে কাকে বাছাই করবেন সেটি তাদের ব্যাপার। তাদের ওপর যদি নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে তারা সেটা গ্রহণ করতে চান না। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব এমনভাবে গড়ে উঠেছে যাতে তারা জনগণের ওপর তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনেকদিন ধরে চাপিয়ে রাখতে পারেন। এ ব্যাপারে একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ জিম্বাবুয়ে, যেখানে রবার্ট মুগাবে বিরোধী দলের উপস্থিতি সত্ত্বেও নিজেকে কয়েক দশক ধরে জনগণের ওপর চাপিয়ে রেখেছেন। গণতন্ত্রের চর্চায় সাম্প্রতিক সময়ে আরও যে বিষয়টি যুক্ত হয়েছে তা হচ্ছে বংশলতিকা। এ বংশলতিকা ব্যবহার করে দলের ও সরকারের নেতৃত্ব ভ্রমণ করছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মন্তরে।
এই বিরাজমান বাস্তবতার পরও নিজের ও রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এর কারণ পৃথিবীতে সবসময় সুচিন্তার ওপর বিকৃত চিন্তা বিজিত হয়েছে, অন্ধকার থেকে মানুষের উত্তরণ ঘটেছে আলোয়। এ কারণেই আজ থেকে ৬৭ বছর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ঘোষণার ২১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে : স্বাধীনভাবে পছন্দকৃত প্রতিনিধির মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় প্রত্যেকের অধিকার আছে। জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি এবং এ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে গোপন ও সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে। এ ঘোষণার প্রতি পুনরায় ২০০৫ সালের শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। কিন্তু এ অঙ্গীকার থেকে বাংলাদেশ কত দূরে দাঁড়িয়ে আছে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অন্যতম উপাদান ছিল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ তাদের মতামত যেভাবে প্রকাশ করেছিল তার অস্বীকৃতিই পাকিস্তান সম্পর্কে তাদের মোহভঙ্গের কারণ হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনী ফলাফলের পর প্রায় অনুরূপ ঘটনা ঘটলেও মানুষ ভেবেছিল এটি হবে সাময়িক সংকট। কিন্তু সংকট আরও তীব্র হয়েছে এবং পাকিস্তানিরা উপলব্ধিও করতে পারেনি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারহীনতা পূর্ব বাংলার মানুষের মনোজগতে কী পরিবর্তন এনেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ক্ষমতাসীনরা জনগণের মনোজগতের এ পরিবর্তনকে পূর্বাহ্নে উপলব্ধি করতে পারে না। দু-একটি উদাহরণই যথেষ্ট। যা ঘটেছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষেত্রে।
মোহিনী চরিত্রের অধিকারী এই দুই নেতা জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদাকে হিমালয়সম উচ্চতায় নিয়ে গেলেও রাজনীতিতে শেষ রক্ষা করতে পারেননি। মানুষের মনোজগতের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের ফলে এ দু’জন তাদের রাজনৈতিক দলকে বর্তমান সময়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছেন।
বাংলাদেশে ঘটনাগুলো ঘটেছে অন্যভাবে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে যে জনইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতে পারত তা হয়নি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই দীর্ঘস্থায়ী সমালোচনামুক্ত হয়নি। সমালোচনা সত্ত্বেও ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভব হয়েছিল দেশের একমাত্র রংধনু পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার। সংখ্যার হিসাবে নয়, মতাদর্শের ভিত্তিতে সমাজের প্রায় সব পেশা ও শ্রেণীর মানুষ ওই সংসদে মত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছিল।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াইটি কষ্টকর ও দীর্ঘস্থায়ী। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ তিন দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী অনিয়ম যে পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা অবিশ্বাস্য। মার্কিন সমাজ সে সমস্যা কাটিয়ে উঠলেও ২০০৪ সালের নির্বাচনে মার্কিন গণতন্ত্র পুনরায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল।
নির্বাচনের সময় সীমিত সময়ের জন্য হলেও জনগণ ক্ষমতাসীন হয়ে ওঠে। তখন নেতাদের ছুটতে হয় ভোটারদের কাছে, করতে হয় মনোরঞ্জন। কিন্তু রাজনীতিকরা যেহেতু অনেক বুদ্ধিমান তাই মনোরঞ্জনে ব্যর্থ হয়ে তারা বেছে নেন জনগণের ভোট চুরির পথ। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা সহজেই ভোট চুরি করে সরকারের মালিক বনে যেতে পারেন। আবার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার সুযোগে এ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন দুর্বৃত্তের শাসন, যা ঘটেছে ১৯৩০-এর দশকে হিটলারের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
গণতন্ত্র হচ্ছে উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যার ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতা। মানুষকে ভয় দেখানো, ভোট ডাকাতি করা, নির্বাচনের আগেই ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা, নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে বলে ঘোষণা দেয়া এবং সর্বোপরি ভয়ভীতি প্রদর্শন করে নির্বাচনী মাঠ শূন্য করে নিজে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া গণতন্ত্র নয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া মানেই ভোটারদের ওপর ভীতির চাদর বিছিয়ে দেয়া, যাতে কেউ প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস না পায়। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেছিলেন, মানুষ যখন ভোট দিতে যায় তখন শুধু তাদের নেতাই নির্বাচন করে না, একই সঙ্গে নিজের রাষ্ট্রের জন্য লক্ষ্যও ঠিক করে দেয়। এ অভিমত প্রকাশের প্রক্রিয়াটি বিপর্যস্ত হলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পথচলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা একদিকে মানুষের মনোবেদনার কারণ হয়েছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এ বিষয়টি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পুরোপুরি উপলব্ধি করতে চাইবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ যে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে দুটি বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা না গেলে জাতীয় অগ্রগতি ও প্রগতি ব্যাহত হবে।
তিন বছর আগে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্য গ্লোবাল কমিশন রিপোর্ট অব ইলেকশন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার ব্যাপারে পাঁচটি শর্তের কথা বলেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে- আইনের শাসনকে শক্তিশালী করা যাতে ভোটার ও প্রার্থীর স্বার্থ সংরক্ষিত হয়; এমন একটি নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা যারা স্বাধীন, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন পরিচালনায় সক্ষম; এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে বহুদলীয় শাসন ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন করবে না; সর্বজনীন রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পথে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অর্থের ব্যবহারকে নিয়ম-কানুনের মধ্যে নিয়ে আসা।
বর্তমান সময় থেকে শুরু করে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পবিত্রতা রক্ষা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য এখনই রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসতে হবে। আর সংলাপের মাধ্যমেই সম্ভব হবে ভোটারের একই নির্বাচনে পরপর পাঁচবার ভোট দেয়ার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি। অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতীয় প্রগতি ও অর্থনীতি, সংকটাপন্ন হবে জাতীয় নিরাপত্তা।
মাহফুজ উল্লাহ : সাংবাদিক
টেলিভিশন পরিচিতির কারণে বছরের শেষদিনে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, নির্বাচন কেমন হল? জবাবটা তৈরি ছিল। সেটাও সংবাদপত্রের কল্যাণেই। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর একটি ইংরেজি দৈনিকের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় যে খবরটি ছাপা হয়েছে তার বাংলা অনুবাদ মোটামুটি এ রকম : ফেনী জেলার দাগনভূঞার একটি ভোট কেন্দ্রে একজন মহিলা চারটি ভোট দিয়ে আসার পর সরকারদলীয় একজন তাকে অনুরোধ করেন আরেকটি ভোট দেয়ার জন্য। মহিলা রাজি হচ্ছিলেন না, বলছিলেন পুলিশ ধরলে জেলে যেতে হবে। অনেক পীড়াপীড়িতে তিনি রাজি হলেন এ শর্তে যে, পুলিশ ধরলে সরকারি দলের লোকজন নিরাপত্তা দেবেন।
এ ঘটনা সাম্প্রতিক পৌরসভা নির্বাচনের একটি ছবি। এরকম আরও অসংখ্য ছবি আছে। নাগরিক সমাজের অনেকের কাছেই সংখ্যার হিসাবে এসব অনিয়ম তুচ্ছ। তাদের অনেকে বলেন, তেমন ভায়োলেন্স হয়নি, মাত্র একজন মারা গেছেন। অবস্থাটা এমন যে, আরও অনেক লোকের মৃত্যু হওয়া উচিত ছিল। এ তর্কে জড়িয়ে না পড়েও যে কথাটি জোর গলায় বলা প্রয়োজন তা হচ্ছে, এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক উদ্যোগ, বঞ্চিত হয়েছে অসংখ্য মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে, একটি সুন্দর নতুন বছরের প্রত্যাশা ঢেকে গেছে অন্ধকারে।
গণতন্ত্রকে অনেকভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায় এবং সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছেও। ইতিহাসে পরদেশ আক্রমণ বা দখল করে নেয়ার সংস্কৃতিও স্বদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থারই অংশ। কিন্তু যেভাবেই দেখা হোক না কেন, গণতন্ত্রের সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক অনেক গভীর, সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রকে দিতে পারে মর্যাদা। গণতন্ত্র হচ্ছে মত প্রকাশের এবং নেতা বাছাইয়ের স্বাধীনতা। জনগণ তাদের নেতা হিসেবে কাকে বাছাই করবেন সেটি তাদের ব্যাপার। তাদের ওপর যদি নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে তারা সেটা গ্রহণ করতে চান না। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব এমনভাবে গড়ে উঠেছে যাতে তারা জনগণের ওপর তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনেকদিন ধরে চাপিয়ে রাখতে পারেন। এ ব্যাপারে একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ জিম্বাবুয়ে, যেখানে রবার্ট মুগাবে বিরোধী দলের উপস্থিতি সত্ত্বেও নিজেকে কয়েক দশক ধরে জনগণের ওপর চাপিয়ে রেখেছেন। গণতন্ত্রের চর্চায় সাম্প্রতিক সময়ে আরও যে বিষয়টি যুক্ত হয়েছে তা হচ্ছে বংশলতিকা। এ বংশলতিকা ব্যবহার করে দলের ও সরকারের নেতৃত্ব ভ্রমণ করছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মন্তরে।
এই বিরাজমান বাস্তবতার পরও নিজের ও রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ধারণের ব্যাপারে মানুষের আকাঙ্ক্ষার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এর কারণ পৃথিবীতে সবসময় সুচিন্তার ওপর বিকৃত চিন্তা বিজিত হয়েছে, অন্ধকার থেকে মানুষের উত্তরণ ঘটেছে আলোয়। এ কারণেই আজ থেকে ৬৭ বছর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ঘোষণার ২১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে : স্বাধীনভাবে পছন্দকৃত প্রতিনিধির মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় প্রত্যেকের অধিকার আছে। জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি এবং এ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে গোপন ও সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে। এ ঘোষণার প্রতি পুনরায় ২০০৫ সালের শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। কিন্তু এ অঙ্গীকার থেকে বাংলাদেশ কত দূরে দাঁড়িয়ে আছে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অন্যতম উপাদান ছিল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ তাদের মতামত যেভাবে প্রকাশ করেছিল তার অস্বীকৃতিই পাকিস্তান সম্পর্কে তাদের মোহভঙ্গের কারণ হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনী ফলাফলের পর প্রায় অনুরূপ ঘটনা ঘটলেও মানুষ ভেবেছিল এটি হবে সাময়িক সংকট। কিন্তু সংকট আরও তীব্র হয়েছে এবং পাকিস্তানিরা উপলব্ধিও করতে পারেনি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারহীনতা পূর্ব বাংলার মানুষের মনোজগতে কী পরিবর্তন এনেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই ক্ষমতাসীনরা জনগণের মনোজগতের এ পরিবর্তনকে পূর্বাহ্নে উপলব্ধি করতে পারে না। দু-একটি উদাহরণই যথেষ্ট। যা ঘটেছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষেত্রে।
মোহিনী চরিত্রের অধিকারী এই দুই নেতা জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদাকে হিমালয়সম উচ্চতায় নিয়ে গেলেও রাজনীতিতে শেষ রক্ষা করতে পারেননি। মানুষের মনোজগতের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের ফলে এ দু’জন তাদের রাজনৈতিক দলকে বর্তমান সময়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছেন।
বাংলাদেশে ঘটনাগুলো ঘটেছে অন্যভাবে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচনের মাধ্যমে যে জনইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতে পারত তা হয়নি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই দীর্ঘস্থায়ী সমালোচনামুক্ত হয়নি। সমালোচনা সত্ত্বেও ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভব হয়েছিল দেশের একমাত্র রংধনু পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার। সংখ্যার হিসাবে নয়, মতাদর্শের ভিত্তিতে সমাজের প্রায় সব পেশা ও শ্রেণীর মানুষ ওই সংসদে মত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছিল।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াইটি কষ্টকর ও দীর্ঘস্থায়ী। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ তিন দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনী অনিয়ম যে পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা অবিশ্বাস্য। মার্কিন সমাজ সে সমস্যা কাটিয়ে উঠলেও ২০০৪ সালের নির্বাচনে মার্কিন গণতন্ত্র পুনরায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল।
নির্বাচনের সময় সীমিত সময়ের জন্য হলেও জনগণ ক্ষমতাসীন হয়ে ওঠে। তখন নেতাদের ছুটতে হয় ভোটারদের কাছে, করতে হয় মনোরঞ্জন। কিন্তু রাজনীতিকরা যেহেতু অনেক বুদ্ধিমান তাই মনোরঞ্জনে ব্যর্থ হয়ে তারা বেছে নেন জনগণের ভোট চুরির পথ। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা সহজেই ভোট চুরি করে সরকারের মালিক বনে যেতে পারেন। আবার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতার সুযোগে এ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন দুর্বৃত্তের শাসন, যা ঘটেছে ১৯৩০-এর দশকে হিটলারের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
গণতন্ত্র হচ্ছে উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যার ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতা। মানুষকে ভয় দেখানো, ভোট ডাকাতি করা, নির্বাচনের আগেই ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা, নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্বাচন শেষ হয়ে গেছে বলে ঘোষণা দেয়া এবং সর্বোপরি ভয়ভীতি প্রদর্শন করে নির্বাচনী মাঠ শূন্য করে নিজে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া গণতন্ত্র নয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া মানেই ভোটারদের ওপর ভীতির চাদর বিছিয়ে দেয়া, যাতে কেউ প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস না পায়। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেছিলেন, মানুষ যখন ভোট দিতে যায় তখন শুধু তাদের নেতাই নির্বাচন করে না, একই সঙ্গে নিজের রাষ্ট্রের জন্য লক্ষ্যও ঠিক করে দেয়। এ অভিমত প্রকাশের প্রক্রিয়াটি বিপর্যস্ত হলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পথচলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা একদিকে মানুষের মনোবেদনার কারণ হয়েছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এ বিষয়টি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পুরোপুরি উপলব্ধি করতে চাইবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ যে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে দুটি বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা না গেলে জাতীয় অগ্রগতি ও প্রগতি ব্যাহত হবে।
তিন বছর আগে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্য গ্লোবাল কমিশন রিপোর্ট অব ইলেকশন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার ব্যাপারে পাঁচটি শর্তের কথা বলেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে- আইনের শাসনকে শক্তিশালী করা যাতে ভোটার ও প্রার্থীর স্বার্থ সংরক্ষিত হয়; এমন একটি নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা যারা স্বাধীন, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন পরিচালনায় সক্ষম; এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে বহুদলীয় শাসন ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন করবে না; সর্বজনীন রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পথে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অর্থের ব্যবহারকে নিয়ম-কানুনের মধ্যে নিয়ে আসা।
বর্তমান সময় থেকে শুরু করে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পবিত্রতা রক্ষা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য এখনই রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসতে হবে। আর সংলাপের মাধ্যমেই সম্ভব হবে ভোটারের একই নির্বাচনে পরপর পাঁচবার ভোট দেয়ার বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি। অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতীয় প্রগতি ও অর্থনীতি, সংকটাপন্ন হবে জাতীয় নিরাপত্তা।
মাহফুজ উল্লাহ : সাংবাদিক
No comments