দীপন হত্যায় অংশ নেয় প্রশিক্ষিত দুর্বৃত্তরা- গোয়েন্দাদের সন্দেহ নেপথ্যে আনসারউল্লাহ বাংলা টিম by শহিদুল ইসলাম রাজী
নিহত ফয়সাল আরেফিন দীপনের লাশ জড়িয়ে ধরে নির্বাক স্ত্রী ডা: রাজিয়া রহমান : নয়া দিগন্ত |
দুপুর
১২টা ছুঁই ছুঁই। কাফনের কাপড়ে মোড়ানো ফয়সাল আরেফিন দীপনের লাশ। শেষ বিদায়
জানাতে তখন বহু মানুষের ভিড়। এক দিন আগেও যে মানুষটি বাসা থেকে বের হয়ে
আজিজ সুপার মার্কেটের জাগৃতি প্রকাশনীর অফিসে গিয়েছিলেন, তিনি স্বজনদের
মাঝে ফিরলেন লাশ হয়ে। দীপনের নিথর দেহ ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা।
দৃশ্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের শিক কোয়ার্টারের সামনে।
যখন দীপনকে চোখের জলে শেষ বিদায় জানাচ্ছিলেন স্বজনরা তখন তার বড় ছেলে রিদাদ
পরীক্ষার হলে জেএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। কোয়ার্টারের সামনে লাশ আনার
কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসেন দীপনের স্ত্রী রাজিয়া। তার বুকফাটা চিৎকার আর
স্বজনদের চোখের জলে ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। এর কিছুক্ষণ পরই লাশ নিয়ে যাওয়া
হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে নামাজে জানাজা শেষে
আজিমপুর কবরস্থানে দীপনকে দাফন করা হয়। এ সময় পরীক্ষার হল থেকে সোজা বাবার
নামাজে জানাজায় অংশ নিতে ছুটে আসে দীপনের বড় ছেলে রিদাদ। তবে এ নৃশংস
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে
পারেনি পুলিশ। এ হত্যার নেপথ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে সন্দেহ করছে
গোয়েন্দারা।
পুলিশ বলছে, এর আগে ব্লগার রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয়, নীলাদ্রী নিলয়, অভিজিৎ ভট্টাচার্য হত্যাকাণ্ড ও আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যা চেষ্টার প্রতিটি ঘটনায় নিষিদ্ধঘোষিত আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সবকটি ঘটনায় হামলাকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে এক কোপে হত্যা বা হত্যা চেষ্টা করেছে। গোয়েন্দারা বলছেন, আগের ব্লগার হত্যার ঘটনার ধরন ও দীপনকে হত্যা ও শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলার ধরন একই। এ ছাড়া আগেকার ঘটনায় আনসার আল বাংলা, কখনো আনসার আল বাংলা সেভেন, কখনো বা আনসার আল বাংলা ফোর দায় স্বীকার করে। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসে আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের নাম। এ জন্য পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, প্রকাশক হত্যার ঘটনাও অভিন্ন। হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছেও ঠিক একই সময়ে। ঘাতকেরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে হামলা করলেও নেপথ্যে কাজ করেছেন একই হুকুমদাতা। আর হামলাকারীরাও প্রশিক্ষিত। তবে লালমাটিয়ায় হত্যার মূল টার্গেট ছিল শুদ্ধস্বর প্রকাশনের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল। তারেক রহিম ও রণদীপম বসু হয়তো ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কারণে হামলার শিকার হয়েছেন।
এ দিকে দীপনের হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে আজিজ সুপার মার্কেটের কোজসার্কিট ক্যামেরায় ধারণ হওয়া ফুটেজ সংরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। এসব ফুটেজ এখনো পুলিশ জব্দ না করলেও তা পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হেফাজতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহীন ফকির। তিনি বলেন, যেহেতু দীপনের পরিবারের প থেকে এখনো এফআইআর করা হয়নি, সেহেতু ঘটনাস্থল থেকে কোনো আলামত তারা জব্দ করেননি। তবে যেসব জিনিস জব্দ করা হবে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। দীপনের পরিবারের প থেকে জানানো হয়েছে যে, দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর তারা মামলা বা এফআইআরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। পরিবারের প থেকে মামলা বা এফআইআর করার পরই ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে পুলিশের হেফাজতে আনা হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, দুই প্রকাশনা কার্যালয়ে হামলা কোনো সাধারণ ক্রাইম নয়। প্রশিক্ষিত তবে অপেশাদার কিলারেরা একই ছাতার নিচে থেকে পরিকল্পিতভাবে দু’টি ঘটনা ঘটিয়েছে। চাপাতি দিয়ে কোপানোর আলামত ও বিভিন্নভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটি আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের কাজ। তবে অন্য কোনো হত্যাকাণ্ডের সাথে এ দু’টি ঘটনার যোগসূত্র আছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয় থেকে পিস্তলের দু’টি তাজা গুলি ও একটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো দেশীয় পিস্তলের গুলি। আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা সাধারণত ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে; কিন্তু আত্মরক্ষার্থে তারা পিস্তলও সাথে রাখে। লালমাটিয়ার ঘটনায় কোনো ধরনের বাধা এসেছে মনে করেই হয়তো তারা গুলি চালিয়েছে। তবে তাজা বুলেট উদ্ধারের ঘটনায় হামলাকারীদের অপেশাদার মনে করছেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর পুলিশ তার হুমকির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে। তিনি যখন নিরাপত্তা চেয়েছেন, নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। তবে আরো কোনো ব্লগার নিজেদের ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে পুলিশকে জানাতে পারেন। পুলিশও গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে বিষয়টি দেখছে। তিনি বলেন, পুলিশে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গঠন করা হলে এমন হামলার ঘটনা কমে আসবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম জানান, অভিজিৎ রায় হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের টিম এসে পুলিশের কাছ থেকে মামলার ১১ ধরনের আলামত নিয়েছিল। কিন্তু এখনো এসব আলামত পরীক্ষার ফলাফল আসেনি। মামলার তদন্তে তাদের সহায়তাও পাওয়া যায়নি।
গত শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে তৃতীয়তলার অফিসে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে বাইর থেকে দরজা বন্ধ করে চালে যায় দুর্বৃত্তরা। ওই দিন বেলা দেড়টায় শোরুমের সামনে থেকে তৃতীয়তলার অফিসে যান দীপন। বিকেল সাড়ে ৫টায় জাগৃতি প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক আলাউদ্দিন অফিসে গিয়ে দেখেন কক্ষের লাইট ফ্যান বন্ধ। ভেতরে কোনো সারা শব্দ নেই। দরজা ধাক্কা দিয়ে দেখেন দরজাও আটকানো। বিষয়টি তার সন্দেহ হলে তিনি দরজার নিচে থেকে চেয়ে দেখেন রক্ত গড়িয়ে আসছে। এর পরপরই মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদককে ফোন করেন তিনি। পরে মার্কেট কমিটির লোকজন ও দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক মিলে অফিসের দরজা ভেঙে দেখেন মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে দীপনের নিথর দেহ। খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়।
মাথা ও ঘাড়ে চারটি বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন : ফয়সল আরেফিন দীপনের মাথা ও ঘাড়ের সংযোগস্থলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে চারটি কোপ দেয় দুর্বৃত্তরা। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার মৃত্যু। ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পর গতকাল বেলা ১১টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ডা: কাজী মুহাম্মদ আবু শামা এ কথা জানান। এর আগে সকাল ১০টা ৫ মিনিটে দীপনের লাশের ময়নাতদন্ত শুরু হয়। ৩৫ মিনিটে ময়নাতদন্ত শেষ করেন ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক প্রদীপ বিশ্বাস।
ডা: কাজী মুহাম্মদ আবু শামা বলেন, মাথা ও ঘাড়ে চারটি বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এখানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে প্রচণ্ড রক্তরণের কারণে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে খুনিরা প্রশিক্ষিত।
তিনি বলেন, ঘাড়ের পেছনের দিকে একটি বড় আঘাত করা হয়েছে, যেটি ছিল ১১ ইঞ্চি লম্বা, দুই ইঞ্চি চওড়া ও চার ইঞ্চি গভীর। এটি খুবই গুরুতর। ভারী ধারালো অস্ত্রের উপর্যুপরি কোপের মাধ্যমে একটি মারাত্মক গর্তের মতো করে মাথাটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সেখানে মেরুদণ্ডসহ মাথায় রক্ত সরবরাহকারী ব্লাড ভেসেল (রক্তনালি) সবই কেটে যায়। মাথার সামনের দিকে আরেকটি কোপের চিহ্ন পাওয়া যায়। প্রত্যেক কোপেই হাড় কেটে যায়। এমনকি মাথার ভেতরে ব্রেন হেমারেজ (মস্তিষ্কে রক্তরণ) পাই আমরা।
দাফন সম্পন্ন : গতকাল বেলা ২টা ৪২ মিনিটে আজিমপুর কবরস্থানে ফয়সাল আরেফিন দীপনের দাফন সম্পন্ন হয়। এ সময় তার পরিবারের সদস্য ছাড়াও লেখক, প্রকাশক বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে জোহরের নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক-শিার্থীরা এবং আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন। এর আগে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় ফয়সাল আরেফিন দীপনের লাশের ময়নাতদন্ত শেষ হয়। ময়নাতদন্ত শেষে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে লাশ হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অ্যাম্বুলেন্সে (ঢাকা মেট্রো ছ-৭১-১১৩৩) লাশ বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় নিহত দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, শ্বশুর ডা: জালালুর রহমান ও বন্ধু আজিজুল ইসলাম ওয়ালি লাশ গ্রহণ করেন।
পুলিশ বলছে, এর আগে ব্লগার রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয়, নীলাদ্রী নিলয়, অভিজিৎ ভট্টাচার্য হত্যাকাণ্ড ও আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যা চেষ্টার প্রতিটি ঘটনায় নিষিদ্ধঘোষিত আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সবকটি ঘটনায় হামলাকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে এক কোপে হত্যা বা হত্যা চেষ্টা করেছে। গোয়েন্দারা বলছেন, আগের ব্লগার হত্যার ঘটনার ধরন ও দীপনকে হত্যা ও শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলার ধরন একই। এ ছাড়া আগেকার ঘটনায় আনসার আল বাংলা, কখনো আনসার আল বাংলা সেভেন, কখনো বা আনসার আল বাংলা ফোর দায় স্বীকার করে। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসে আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের নাম। এ জন্য পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, প্রকাশক হত্যার ঘটনাও অভিন্ন। হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছেও ঠিক একই সময়ে। ঘাতকেরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে হামলা করলেও নেপথ্যে কাজ করেছেন একই হুকুমদাতা। আর হামলাকারীরাও প্রশিক্ষিত। তবে লালমাটিয়ায় হত্যার মূল টার্গেট ছিল শুদ্ধস্বর প্রকাশনের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল। তারেক রহিম ও রণদীপম বসু হয়তো ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কারণে হামলার শিকার হয়েছেন।
এ দিকে দীপনের হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে আজিজ সুপার মার্কেটের কোজসার্কিট ক্যামেরায় ধারণ হওয়া ফুটেজ সংরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। এসব ফুটেজ এখনো পুলিশ জব্দ না করলেও তা পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হেফাজতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহীন ফকির। তিনি বলেন, যেহেতু দীপনের পরিবারের প থেকে এখনো এফআইআর করা হয়নি, সেহেতু ঘটনাস্থল থেকে কোনো আলামত তারা জব্দ করেননি। তবে যেসব জিনিস জব্দ করা হবে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। দীপনের পরিবারের প থেকে জানানো হয়েছে যে, দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর তারা মামলা বা এফআইআরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। পরিবারের প থেকে মামলা বা এফআইআর করার পরই ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করে পুলিশের হেফাজতে আনা হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, দুই প্রকাশনা কার্যালয়ে হামলা কোনো সাধারণ ক্রাইম নয়। প্রশিক্ষিত তবে অপেশাদার কিলারেরা একই ছাতার নিচে থেকে পরিকল্পিতভাবে দু’টি ঘটনা ঘটিয়েছে। চাপাতি দিয়ে কোপানোর আলামত ও বিভিন্নভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটি আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের কাজ। তবে অন্য কোনো হত্যাকাণ্ডের সাথে এ দু’টি ঘটনার যোগসূত্র আছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয় থেকে পিস্তলের দু’টি তাজা গুলি ও একটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো দেশীয় পিস্তলের গুলি। আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা সাধারণত ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে; কিন্তু আত্মরক্ষার্থে তারা পিস্তলও সাথে রাখে। লালমাটিয়ার ঘটনায় কোনো ধরনের বাধা এসেছে মনে করেই হয়তো তারা গুলি চালিয়েছে। তবে তাজা বুলেট উদ্ধারের ঘটনায় হামলাকারীদের অপেশাদার মনে করছেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর পুলিশ তার হুমকির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে। তিনি যখন নিরাপত্তা চেয়েছেন, নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। তবে আরো কোনো ব্লগার নিজেদের ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে পুলিশকে জানাতে পারেন। পুলিশও গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে বিষয়টি দেখছে। তিনি বলেন, পুলিশে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গঠন করা হলে এমন হামলার ঘটনা কমে আসবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম জানান, অভিজিৎ রায় হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের টিম এসে পুলিশের কাছ থেকে মামলার ১১ ধরনের আলামত নিয়েছিল। কিন্তু এখনো এসব আলামত পরীক্ষার ফলাফল আসেনি। মামলার তদন্তে তাদের সহায়তাও পাওয়া যায়নি।
গত শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে তৃতীয়তলার অফিসে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে বাইর থেকে দরজা বন্ধ করে চালে যায় দুর্বৃত্তরা। ওই দিন বেলা দেড়টায় শোরুমের সামনে থেকে তৃতীয়তলার অফিসে যান দীপন। বিকেল সাড়ে ৫টায় জাগৃতি প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক আলাউদ্দিন অফিসে গিয়ে দেখেন কক্ষের লাইট ফ্যান বন্ধ। ভেতরে কোনো সারা শব্দ নেই। দরজা ধাক্কা দিয়ে দেখেন দরজাও আটকানো। বিষয়টি তার সন্দেহ হলে তিনি দরজার নিচে থেকে চেয়ে দেখেন রক্ত গড়িয়ে আসছে। এর পরপরই মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদককে ফোন করেন তিনি। পরে মার্কেট কমিটির লোকজন ও দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক মিলে অফিসের দরজা ভেঙে দেখেন মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে দীপনের নিথর দেহ। খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়।
মাথা ও ঘাড়ে চারটি বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন : ফয়সল আরেফিন দীপনের মাথা ও ঘাড়ের সংযোগস্থলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে চারটি কোপ দেয় দুর্বৃত্তরা। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার মৃত্যু। ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পর গতকাল বেলা ১১টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ডা: কাজী মুহাম্মদ আবু শামা এ কথা জানান। এর আগে সকাল ১০টা ৫ মিনিটে দীপনের লাশের ময়নাতদন্ত শুরু হয়। ৩৫ মিনিটে ময়নাতদন্ত শেষ করেন ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক প্রদীপ বিশ্বাস।
ডা: কাজী মুহাম্মদ আবু শামা বলেন, মাথা ও ঘাড়ে চারটি বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এখানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে প্রচণ্ড রক্তরণের কারণে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে খুনিরা প্রশিক্ষিত।
তিনি বলেন, ঘাড়ের পেছনের দিকে একটি বড় আঘাত করা হয়েছে, যেটি ছিল ১১ ইঞ্চি লম্বা, দুই ইঞ্চি চওড়া ও চার ইঞ্চি গভীর। এটি খুবই গুরুতর। ভারী ধারালো অস্ত্রের উপর্যুপরি কোপের মাধ্যমে একটি মারাত্মক গর্তের মতো করে মাথাটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সেখানে মেরুদণ্ডসহ মাথায় রক্ত সরবরাহকারী ব্লাড ভেসেল (রক্তনালি) সবই কেটে যায়। মাথার সামনের দিকে আরেকটি কোপের চিহ্ন পাওয়া যায়। প্রত্যেক কোপেই হাড় কেটে যায়। এমনকি মাথার ভেতরে ব্রেন হেমারেজ (মস্তিষ্কে রক্তরণ) পাই আমরা।
দাফন সম্পন্ন : গতকাল বেলা ২টা ৪২ মিনিটে আজিমপুর কবরস্থানে ফয়সাল আরেফিন দীপনের দাফন সম্পন্ন হয়। এ সময় তার পরিবারের সদস্য ছাড়াও লেখক, প্রকাশক বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে জোহরের নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক-শিার্থীরা এবং আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন। এর আগে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় ফয়সাল আরেফিন দীপনের লাশের ময়নাতদন্ত শেষ হয়। ময়নাতদন্ত শেষে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে লাশ হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অ্যাম্বুলেন্সে (ঢাকা মেট্রো ছ-৭১-১১৩৩) লাশ বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় নিহত দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, শ্বশুর ডা: জালালুর রহমান ও বন্ধু আজিজুল ইসলাম ওয়ালি লাশ গ্রহণ করেন।
No comments