পাহাড় থেকে কী বার্তা পেল আওয়ামী লীগ?

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই উপজেলা নির্বাচনে যে আওয়ামী লীগ প্রত্যাশিত ফল পেল না, এর কারণ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে নানা রকম আলোচনা চলছে। যতই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা এই নির্বাচনকে দলীয় সমর্থনের মাপকাঠি নয় বলে উল্লেখ করুন, দলের অভ্যন্তরে যে এ নিয়ে অস্বস্তি আছে, এটা বোঝার জন্য অন্তত বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। বৃহত্তর চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের ফলাফল শোচনীয়। এর ১০১টি কারণ বের করা সম্ভব। তবে প্রধান কারণ যে অন্তর্কোন্দল, তাতে সন্দেহ নেই। শুধু মিরসরাই উপজেলার নির্বাচনকেই যদি উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করাই, তাতে এ কথা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয় যে এখানে স্থানীয় সাংসদের ভূমিকার কারণেই পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আগেরবারের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিনকে দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেননি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং বর্তমান সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন গিয়াস উদ্দিনের। তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা স্থানীয় সাংসদের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল বলে মনে করেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। পর পর দুবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে গিয়াস উদ্দিন একসময় এখানকার সংসদ সদস্য পদের জন্য দলীয় মনোনয়নের দাবিদার হয়ে উঠবেন—এমন একটি ধারণা থেকেই তিনি অঙ্কুরেই তাঁর পথ রুদ্ধ করতে চেয়েছেন বলেও মনে করেন এখানকার রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।
গিয়াস উদ্দিন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরেছেন। তবে বিএনপি-সমর্থিত বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে তাঁরই। মোশাররফের প্রার্থী গিয়াসের পথ আগলেছেন, নিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেননি। এই একটি আসনের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করলাম। উপজেলা নির্বাচনে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে চাইলে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড উদাহরণটা সামনে রাখতে পারেন। সারা দেশের চিত্র এর চেয়ে ভিন্ন না-ও হতে পারে। তবে চট্টগ্রামের তিনটি পার্বত্যাঞ্চলের উপজেলা নির্বাচনে যে আওয়ামী লীগ একটি আসনেও জিততে পারল না, তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে অন্যত্র। পাহাড়িরা দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগকেই তাদের নির্ভরতার ক্ষেত্র মনে করে এসেছে। গত কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলই তার প্রমাণ। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করলেও রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির তিনটি সংসদীয় আসনেই জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। পাহাড়িরা বিশ্বাস করত, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তৎকালীন শান্তিবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেবার বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ায় শান্তি চুক্তির সম্ভাবনা তিরোহিত হলো। ১৯৯৬ সালেও যথারীতি পার্বত্যাঞ্চলের তিন আসনে জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি সারা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে তারা সরকার গঠন করলে ‘শান্তি চুক্তি’ বাস্তবায়নের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
১৯৯৭ সালেই সম্পাদিত হলো ‘শান্তি চুক্তি’র মতো একটি বিরল ঘটনা। তখনকার প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মুষ্টিমেয় পাহাড়ি ও পাহাড়ের বাঙালি সেটেলাররা এর বিরোধিতা করলেও দেশে-বিদেশে উচ্চ প্রশংসিত হলো এই উদ্যোগ। দীর্ঘকালের সশস্ত্র সংগ্রামের অবসান ঘটিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী তথা জনসংহতি সমিতি। পাহাড়ে বয়ে গেল আনন্দের বন্যা। কিন্তু শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হলেও এর বাস্তবায়ন যে দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া, তা বোঝা গেল অচিরেই। আওয়ামী লীগ সরকার তার মেয়াদের বাকি সময়ে তাই এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। চুক্তি নিয়ে হতাশ পাহাড়িরা সেবার তাদের মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছিল নির্বাচনে। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাই পার্বত্যাঞ্চলের তিনটির মধ্যে দুটি আসন হারায় আওয়ামী লীগ। তবে হতাশ ও অভিমান যতটা ছিল, ততটা দানা বেঁধে ওঠেনি ক্ষোভ। দুটি আসন ন্যূনতম ব্যবধানে হারালেও পাহাড়িরা তাদের বর্জন করেছে—এমন ধারণা করার কোনো সংগত কারণ ছিল না আওয়ামী লীগের। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগকেই নির্ভরতার ক্ষেত্র মনে করেছিল আদিবাসীরা। আওয়ামী লীগের ওপর যতটা আস্থা ও নির্ভরশীলতা পাহাড়ি মানুষের, ঠিক ততটাই অবিশ্বাস ও সন্দেহ বিএনপির প্রতি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদীভাঙনে ও অন্যান্য কারণে ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষদের এনে পুনর্বাসন করেছিলেন এখানে। আদিবাসীদের ভূমিব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন ও অপরিচিত কিছু মানুষকে পাহাড়ে এনে পুনর্বাসন করার কারণে এখানকার সামাজিক ভারসাম্য যেমন নষ্ট হয়েছে,
তেমনি প্রকট হয়েছিল পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। স্বল্প পরিসরে এ সম্পর্কে বলার সুযোগ নেই, তবে এটুকু বলা যায়, এই উদ্যোগের ফলে বাঙালি সেটেলাররা যতটা বিএনপির প্রতি আনুগত্য ও সমর্থন দেখিয়েছে, ঠিক ততটাই উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে আদিবাসী পাহাড়িরা। আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের আস্থা ও প্রত্যাশা বেড়েছে। ২০০৮ সালেও তাই জাতীয় নির্বাচনে তিন পার্বত্য আসনেই বিপুল ভোটে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। সেবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পাহাড়িরা আশায় বুক বেঁধেছে শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন দেখবে বলে। কিন্তু পাঁচ বছর পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরও এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে পারল না ক্ষমতাসীনেরা। বিশেষ করে ভূমিব্যবস্থা-সংক্রান্ত জটিলতার সমাধান না হওয়ায় এই দল সম্পর্কে যেন একধরনের মোহমুক্তি ঘটে আদিবাসীদের। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের বিরুদ্ধে জনসংহতি সমিতির প্রার্থী ঊষাতন তালুকদারকে বিজয়ী করে নিজেদের ক্ষোভ ও দুঃখের কথা জানান দিয়েছিলেন পাহাড়ি ভোটাররা। এবারের উপজেলা নির্বাচনে সব কটি আসনে হেরে আওয়ামী লীগ হয়তো উপলব্ধি করতে পারছে যে সেই ক্ষোভ ও দুঃখের মাত্রা কতটা তীব্র! তিন পার্বত্যাঞ্চলের বাঙালি-অধ্যুষিত ইউনিয়নগুলোয় জয় পেয়েছে বিএনপি।
অন্যদিকে, পাহাড়ি আদিবাসী-অধ্যুষিত ইউনিয়নগুলোয় জনসংহতি সমিতি ও শান্তি চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না করার কারণে চুক্তিবিরোধী পাহাড়িদের সংগঠন ইউপিডিএফ এখন আদিবাসীদের কাছে চুক্তির অসারতা প্রমাণ করতে পেরেছে অনেকটা। এতে অনৈক্যটা প্রকট হয়ে উঠছে পাহাড়িদের মধ্যে। অন্যদিকে, লামার মতো একটি বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকায় একজন আদিবাসী প্রার্থীকে বিএনপির মনোনয়ন দেওয়া ছিল একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। পাহাড়ি-বাঙালি উভয় গোষ্ঠীর সমর্থনে তাঁর জয় সুনিশ্চিত হয়েছে। এই মেরুকরণ আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসংকেত। পাহাড়ে পুনর্বাসিত বাঙালিদের অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এই ‘রেশন-নির্ভর’ উদ্বাস্তু জীবন কারও কাম্য হতে পারে না। তাই তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের বিষয়টা বিবেচনায় নেওয়া দরকার। পাশাপাশি শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা গড়িমসি আখেরে শুভ ফল বয়ে আনবে না। উপজেলা নির্বাচনে পাহাড় থেকে যে বার্তা পেল আওয়ামী লীগ, তা অনুধাবনে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে আম ও ছালা দুটিই হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে তাদের জন্য।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.