গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের রায় যে কোনো দিন
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের
সাবেক আমীর গোলাম আযমের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে যে কোনো দিন। বুধবার এ
আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
বুধবার
আসামিপক্ষের যুক্তির বিপক্ষে পাল্টা ও আইনি পয়েন্টে যুক্তিতর্ক
(আর্গুমেন্ট) ও সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর
অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী, ড. তুরিন আফরোজ ও অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ
সীমন। আদালতের অনুমোদনক্রমে সংক্ষিপ্তভাবে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তির জবাবে
যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন গোলাম আযমের আইনজীবী।
এরই মধ্য দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় যে কোনো দিন গোলাম আযমের মামলার রায় দেওয়ার জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) বলে রেখে দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
এ আদেশের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল এখন তার সুবিধামতো সময়ে যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করবেন বলে সাংবাদিকদের জানান রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গঠনের ৩ বছর পর এসে ৫ম কোনো অভিযুক্তের ব্যাপারে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হলো। এর মধ্যে অন্য ৩ জনের মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে আর ১ জনের মামলার রায় দেওয়ার জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রেখে দেওয়া হয়েছে।
তবে গোলাম আযমের মামলার মধ্য দিয়ে প্রথম ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে শেষ হলো দ্বিতীয় কোনো মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
বাকি দুই মামলার রায় ঘোষণা করেছেন গত বছরের ২২ মার্চ গঠিত দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে ২১ জানুয়ারি ফাঁসির আদেশ দিয়ে জামায়াতের সাবেক রোকন (সদস্য) আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন ওই ট্রাইব্যুনাল। একই ট্রাইব্যুনাল গত ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন।
আর মঙ্গলবার জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার রায় যে কোনো দিন ঘোষণা করা হবে বলে সিএভি হিসেবে রেখে দিয়েছেন একই ট্রাইব্যুনাল।
পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ
গত ৩ জানুয়ারি শুনানি শেষে গোলাম আযমের মামলা পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান গোলাম আযমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ কার্যদিবসে আবেদনগুলোর ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আসামিপক্ষে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এমপি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সিনিয়র আইনজীবী বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। অপরদিকে আবেদনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস প্রবাসী বাংলাদেশি আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল-১ এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে এ আবেদন করেন আসামিপক্ষ।
ওই স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে বিচারাধীন জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা ৪টিরও পুনরায় শুরু করার আবেদন গত ৩ ও ৭ জানুয়ারি খারিজ করে দেন দু’টি ট্রাইব্যুনাল।
১০ জানুয়ারি এসব খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন। ১৫-১৬ জানুয়ারি শুনানি শেষে ২১ জানুয়ারি সেসব আবেদনও ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দেওয়ায় মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রমের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে।
অন্যদিকে একই ঘটনার সূত্র ধরে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাশাপাশি পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালও। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর প্রথম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন এ ট্রাইব্যুনালেরই বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম
২০১০ সালের ১৫ জুলাই গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর তদন্ত শেষে তদন্ত প্রতিবেদন, অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ, এবং আলামত তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কাছে দাখিল করা হয়।
১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের কাছে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়। ২৬ ডিসেম্বর অভিযোগপত্রে উল্লেখিত অভিযোগগুলো আমলে নেওয়ার জন্য ধার্য দিনে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রটি সঠিক বিন্যাসে উপস্থাপিত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তা আবার প্রসিকিউশনের কাছে ফেরত পাঠান।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি ফেরতপ্রাপ্ত অভিযোগপত্রটিকে সঠিকভাবে বিন্যস্ত করে প্রসিকিউশন টিম পুনরায় ট্রাইব্যুনালের কাছে দাখিল করেন।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের জমা দেওয়া ওই আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মোট ৬২টি অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। মোট ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র সংযুক্ত করা হয়।
৯ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল ১১ জানুয়ারি সশরীরে গোলাম আযমকে হাজির করতে তার আইনজীবীদের নির্দেশ দেন। ওই দিন হাজির না হলে ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কথা জানান ট্রাইব্যুনাল। ১০ জানুয়ারি গোলাম আযমের আইনজীবীরা তার জামিনের আবেদন করেন।
১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় গোলাম আযমকে। ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগ আমলে নেন এবং জামিন নামঞ্জুর করে গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তার স্বাস্থ্য ও বয়সের দিকটি বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখার নির্দেশ দেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম অভিযোগ গঠনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। অন্যদিকে গোলাম আযমকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন জানিয়ে যুক্তি দেন তার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম।
মানবতাবিরোধী ৫ ধরনের অপরাধের ৬১টি অভিযোগে অভিযুক্ত করে গত বছরের ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
৩০ মে গোলাম আযমের মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তরের আবেদন করেন আসামিপক্ষ। শুনানি শেষে ১৮ জুন তা খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
১০ জুন গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। ১৪২ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, নূরজাহান বেগম মুক্তা, এ কে এম সাইফুল ইসলাম, সুলতান মাহমুদ ও মীর ইকবাল হোসেন।
১ জুলাই থেকে শুরু করে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে জব্দ তালিকার ৭ সাক্ষীসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া জবানবন্দিকেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া ঘটনার সাক্ষীরা হলেন, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকারকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা দক্ষিণপাড়া গ্রামের সোনা মিয়া, একজন শহীদ পরিবারের নারী(ক্যামেরা ট্রায়াল), দেশবরেণ্য গীতিকার ও সুরকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, রাজধানীর নাখালপাড়ার ফরিদ আলম এবং মহসিন আলী খান।
আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন- বাংলা একাডেমীর সহ গ্রন্থাগারিক মো. এজাব উদ্দিন মিয়া, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) রাজনৈতিক শাখার উচ্চমান সহকারী সেলিনা আফরোজ, কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের উচ্চমান সহকারী কাজী আইয়ুব হোসেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার কামালের বোন ডা. মুনিয়া ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় যাদুঘরের কিপার ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত সাঁট মুদ্রাক্ষরিক জামিনুর শেখ।
অন্যদিকে গোলাম আযমের পক্ষে তার আইনজীবীরা দুই হাজার ৯৩৯ জন সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১২ জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দেবেন বলে নির্ধারণ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। নির্ধারিত ১২ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন সাফাই সাক্ষীকে হাজির করে সাক্ষ্য দেওয়াতে পেরেছেন আসামিপক্ষ। একমাত্র সাফাই সাক্ষী গোলাম আযমের ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী গত বছরের ১২ নভেম্বর থেকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাফাই সাক্ষ্য দেন তার বাবার পক্ষে। রাষ্ট্রপক্ষ তার জেরা শেষ করেন ১১ ফেব্রুয়ারি।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত এবং বুধবার ১২ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ, প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম ও প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ সীমন। অন্যদিকে ১০ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এবং বুধবার ১২ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট ইমরান সিদ্দিকী।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ হলো, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র, সহযোগিতা, উস্কানি, সম্পৃক্ততা ও বাধা না দেওয়া এবং ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতন।
অভিযোগগুলোর মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত ৬টি, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা সংক্রান্ত ৩টি, উস্কানি দেওয়ার ২৮টি, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেওয়ার ২৩টি এবং ব্যক্তিগত হত্যা ও নির্যাতন সংক্রান্ত ১টি অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ ১: গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত প্রথম ধরনের অভিযোগটি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। এ ধরনের অভিযোগে ছয়টি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: একাত্তরের ৪ এপ্রিল গোলাম আযম, নুরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়েরউদ্দিন, এ কে এম শফিকুল ইসলাম, মাওলান নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, মোহসিনউদ্দিন আহমেদ, এ টি সাদীসহ ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করেন। আগের সাক্ষাতের সূত্র ধরে ৬ এপ্রিল গোলাম আযম আবারও টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং পূর্বোল্লিখিত ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। ১৯ জুন এই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় গোলাম আযম রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক করেন। ১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে আবারও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে মোকাবিলার জন্য রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
অভিযোগ ২: এ ধাপে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে তিনটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। ৪ মে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে এ কিউ এম শফিকুল ইসলামের বাসভবনে খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির সভা হয়, যেখানে গোলাম আযম উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়।
অভিযোগ ৩: তৃতীয় অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানির ২৮টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে: ৭ এপ্রিল গোলাম আযম এক যুক্ত বিবৃতিতে স্বাধীনতাকামী মানুষকে ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তাদের যেখানেই দেখা যাবে, সেখানেই ধ্বংস করা হবে। ২২ এপ্রিল শান্তি কমিটির সভা শেষে এক বিবৃতিতে গোলাম আযম অধীনস্থ সংগঠনগুলোর সদস্যদের ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক’ উল্লেখ করে দেশের সাধারণ নাগরিকদের ধ্বংস করার আহ্বান জানান।
১৭ মে গোলাম আযম ঢাকায় এক সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ উল্লেখ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নমের সেনা অভিযানের প্রশংসা করেন। একাত্তরের ১৬ জুলাই রাজশাহী, ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৪ আগস্ট খুলনা, ৭ আগস্ট কুষ্টিয়া প্রভৃতি এলাকায় আয়োজিত বিভিন্ন সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও উত্তেজনাকর বক্তব্য দেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ২৫তম আজাদী দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে, ১৭ ও ২৩ আগস্ট দলীয় সভায় এবং ২৬ আগস্ট পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত দলীয় অনুষ্ঠানে গোলাম আযম বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন।
১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে শিক্ষা গ্রহণরত রাজাকারদের শিবির পরিদর্শন করে তাদের সশস্ত্র হওয়ার আহ্বান জানান। ৩ অক্টোবর ঢাকায় মজলিসে শুরার সভায় একই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন গোলাম আযম।
অভিযোগ ৪: চতুর্থ অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। ৪ ও ৬ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে গোলাম আযমসহ অন্যরা সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ৯ এপ্রিল গোলাম আযমের সহযোগিতায় নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হলে ১৫ এপ্রিল এর নাম পরিবর্তন করে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি করা হয়। শান্তি কমিটির ২১ সদস্যের কার্যকরী কমিটির একজন সদস্য ছিলেন গোলাম আযম।
১৮ জুন লাহোর বিমানবন্দরে গোলাম আযম বলেন, জনগণ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে চায়। ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানান। পরদিন লাহোরে জামায়াতের পশ্চিম পাকিস্তান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে দুষ্কৃতকারীরা সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের প্রতিরোধে ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রসজ্জিত হওয়া উচিত।
অভিযোগ-৫: পঞ্চম অভিযোগে হত্যা ও নির্যাতনের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের সিরু মিয়া একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ তিনি স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ও ১৪ বছরের ছেলে আনোয়ার কামালকে নিয়ে কুমিল্লার নিজ বাড়িতে যান। সেখানে সিরু মিয়া শরণার্থীদের ভারতে যাতায়াতে সাহায্য করতেন।
২৭ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে কসবা থানার তন্তর চেকপোস্টের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেসহ ছয়জন ভারতে যাওয়ার সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। তাদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে কয়েক দিন নির্যাতনের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্বামী-সন্তানের ধরা পড়ার খবর পেয়ে সিরু মিয়ার স্ত্রী গোলাম আযমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সিরু মিয়ার ভগ্নিপতি ছিলেন গোলাম আযমের দুই ছেলে আজমী ও আমীনের শিক্ষক। তিনি গোলাম আযমের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে মুক্তি দিতে অনুরোধ জানান।
গোলাম আযম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে একটি চিঠি পাঠান, যাতে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে হত্যার নির্দেশ ছিল। চিঠি পাওয়ার পর ঈদের দিন রাতে সিরু মিয়াসহ ৩৯ জনকে পাকিস্তানি সেনারা রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় কারাগার থেকে বের করে নিয়ে পৈরতলা রেলব্রিজের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ৩৮ জন মারা গেলেও একজন প্রাণে বেঁচে যান।
এরই মধ্য দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় যে কোনো দিন গোলাম আযমের মামলার রায় দেওয়ার জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) বলে রেখে দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
এ আদেশের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল এখন তার সুবিধামতো সময়ে যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করবেন বলে সাংবাদিকদের জানান রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গঠনের ৩ বছর পর এসে ৫ম কোনো অভিযুক্তের ব্যাপারে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হলো। এর মধ্যে অন্য ৩ জনের মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে আর ১ জনের মামলার রায় দেওয়ার জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রেখে দেওয়া হয়েছে।
তবে গোলাম আযমের মামলার মধ্য দিয়ে প্রথম ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে শেষ হলো দ্বিতীয় কোনো মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
বাকি দুই মামলার রায় ঘোষণা করেছেন গত বছরের ২২ মার্চ গঠিত দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে ২১ জানুয়ারি ফাঁসির আদেশ দিয়ে জামায়াতের সাবেক রোকন (সদস্য) আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন ওই ট্রাইব্যুনাল। একই ট্রাইব্যুনাল গত ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন।
আর মঙ্গলবার জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার রায় যে কোনো দিন ঘোষণা করা হবে বলে সিএভি হিসেবে রেখে দিয়েছেন একই ট্রাইব্যুনাল।
পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ
গত ৩ জানুয়ারি শুনানি শেষে গোলাম আযমের মামলা পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান গোলাম আযমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ কার্যদিবসে আবেদনগুলোর ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আসামিপক্ষে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এমপি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সিনিয়র আইনজীবী বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। অপরদিকে আবেদনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস প্রবাসী বাংলাদেশি আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল-১ এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে এ আবেদন করেন আসামিপক্ষ।
ওই স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে বিচারাধীন জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী ও নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা ৪টিরও পুনরায় শুরু করার আবেদন গত ৩ ও ৭ জানুয়ারি খারিজ করে দেন দু’টি ট্রাইব্যুনাল।
১০ জানুয়ারি এসব খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন। ১৫-১৬ জানুয়ারি শুনানি শেষে ২১ জানুয়ারি সেসব আবেদনও ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দেওয়ায় মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রমের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে।
অন্যদিকে একই ঘটনার সূত্র ধরে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাশাপাশি পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালও। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর প্রথম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন এ ট্রাইব্যুনালেরই বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম
২০১০ সালের ১৫ জুলাই গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর তদন্ত শেষে তদন্ত প্রতিবেদন, অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ, এবং আলামত তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কাছে দাখিল করা হয়।
১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের কাছে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়। ২৬ ডিসেম্বর অভিযোগপত্রে উল্লেখিত অভিযোগগুলো আমলে নেওয়ার জন্য ধার্য দিনে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রটি সঠিক বিন্যাসে উপস্থাপিত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তা আবার প্রসিকিউশনের কাছে ফেরত পাঠান।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি ফেরতপ্রাপ্ত অভিযোগপত্রটিকে সঠিকভাবে বিন্যস্ত করে প্রসিকিউশন টিম পুনরায় ট্রাইব্যুনালের কাছে দাখিল করেন।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের জমা দেওয়া ওই আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মোট ৬২টি অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। মোট ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র সংযুক্ত করা হয়।
৯ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল ১১ জানুয়ারি সশরীরে গোলাম আযমকে হাজির করতে তার আইনজীবীদের নির্দেশ দেন। ওই দিন হাজির না হলে ট্রাইব্যুনাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির কথা জানান ট্রাইব্যুনাল। ১০ জানুয়ারি গোলাম আযমের আইনজীবীরা তার জামিনের আবেদন করেন।
১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় গোলাম আযমকে। ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগ আমলে নেন এবং জামিন নামঞ্জুর করে গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
তার স্বাস্থ্য ও বয়সের দিকটি বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখার নির্দেশ দেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম অভিযোগ গঠনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। অন্যদিকে গোলাম আযমকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন জানিয়ে যুক্তি দেন তার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম।
মানবতাবিরোধী ৫ ধরনের অপরাধের ৬১টি অভিযোগে অভিযুক্ত করে গত বছরের ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
৩০ মে গোলাম আযমের মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তরের আবেদন করেন আসামিপক্ষ। শুনানি শেষে ১৮ জুন তা খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
১০ জুন গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। ১৪২ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, নূরজাহান বেগম মুক্তা, এ কে এম সাইফুল ইসলাম, সুলতান মাহমুদ ও মীর ইকবাল হোসেন।
১ জুলাই থেকে শুরু করে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে জব্দ তালিকার ৭ সাক্ষীসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া জবানবন্দিকেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া ঘটনার সাক্ষীরা হলেন, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকারকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা দক্ষিণপাড়া গ্রামের সোনা মিয়া, একজন শহীদ পরিবারের নারী(ক্যামেরা ট্রায়াল), দেশবরেণ্য গীতিকার ও সুরকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, রাজধানীর নাখালপাড়ার ফরিদ আলম এবং মহসিন আলী খান।
আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন- বাংলা একাডেমীর সহ গ্রন্থাগারিক মো. এজাব উদ্দিন মিয়া, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) রাজনৈতিক শাখার উচ্চমান সহকারী সেলিনা আফরোজ, কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের উচ্চমান সহকারী কাজী আইয়ুব হোসেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার কামালের বোন ডা. মুনিয়া ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় যাদুঘরের কিপার ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত সাঁট মুদ্রাক্ষরিক জামিনুর শেখ।
অন্যদিকে গোলাম আযমের পক্ষে তার আইনজীবীরা দুই হাজার ৯৩৯ জন সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১২ জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দেবেন বলে নির্ধারণ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। নির্ধারিত ১২ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন সাফাই সাক্ষীকে হাজির করে সাক্ষ্য দেওয়াতে পেরেছেন আসামিপক্ষ। একমাত্র সাফাই সাক্ষী গোলাম আযমের ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী গত বছরের ১২ নভেম্বর থেকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাফাই সাক্ষ্য দেন তার বাবার পক্ষে। রাষ্ট্রপক্ষ তার জেরা শেষ করেন ১১ ফেব্রুয়ারি।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত এবং বুধবার ১২ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ, প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম ও প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ সীমন। অন্যদিকে ১০ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এবং বুধবার ১২ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট ইমরান সিদ্দিকী।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ হলো, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র, সহযোগিতা, উস্কানি, সম্পৃক্ততা ও বাধা না দেওয়া এবং ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতন।
অভিযোগগুলোর মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত ৬টি, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা সংক্রান্ত ৩টি, উস্কানি দেওয়ার ২৮টি, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেওয়ার ২৩টি এবং ব্যক্তিগত হত্যা ও নির্যাতন সংক্রান্ত ১টি অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ ১: গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত প্রথম ধরনের অভিযোগটি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। এ ধরনের অভিযোগে ছয়টি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: একাত্তরের ৪ এপ্রিল গোলাম আযম, নুরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়েরউদ্দিন, এ কে এম শফিকুল ইসলাম, মাওলান নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, মোহসিনউদ্দিন আহমেদ, এ টি সাদীসহ ১২ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করেন। আগের সাক্ষাতের সূত্র ধরে ৬ এপ্রিল গোলাম আযম আবারও টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং পূর্বোল্লিখিত ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। ১৯ জুন এই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় গোলাম আযম রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক করেন। ১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে আবারও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে মোকাবিলার জন্য রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
অভিযোগ ২: এ ধাপে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগে তিনটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারা দেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। ৪ মে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে এ কিউ এম শফিকুল ইসলামের বাসভবনে খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির সভা হয়, যেখানে গোলাম আযম উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়।
অভিযোগ ৩: তৃতীয় অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে উস্কানির ২৮টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে: ৭ এপ্রিল গোলাম আযম এক যুক্ত বিবৃতিতে স্বাধীনতাকামী মানুষকে ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তাদের যেখানেই দেখা যাবে, সেখানেই ধ্বংস করা হবে। ২২ এপ্রিল শান্তি কমিটির সভা শেষে এক বিবৃতিতে গোলাম আযম অধীনস্থ সংগঠনগুলোর সদস্যদের ‘দেশপ্রেমিক নাগরিক’ উল্লেখ করে দেশের সাধারণ নাগরিকদের ধ্বংস করার আহ্বান জানান।
১৭ মে গোলাম আযম ঢাকায় এক সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ’ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ উল্লেখ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নমের সেনা অভিযানের প্রশংসা করেন। একাত্তরের ১৬ জুলাই রাজশাহী, ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৪ আগস্ট খুলনা, ৭ আগস্ট কুষ্টিয়া প্রভৃতি এলাকায় আয়োজিত বিভিন্ন সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও উত্তেজনাকর বক্তব্য দেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ২৫তম আজাদী দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে, ১৭ ও ২৩ আগস্ট দলীয় সভায় এবং ২৬ আগস্ট পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত দলীয় অনুষ্ঠানে গোলাম আযম বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন।
১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে শিক্ষা গ্রহণরত রাজাকারদের শিবির পরিদর্শন করে তাদের সশস্ত্র হওয়ার আহ্বান জানান। ৩ অক্টোবর ঢাকায় মজলিসে শুরার সভায় একই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন গোলাম আযম।
অভিযোগ ৪: চতুর্থ অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে সহযোগিতা বা সম্পৃক্ততার ২৩টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। ৪ ও ৬ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে গোলাম আযমসহ অন্যরা সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ৯ এপ্রিল গোলাম আযমের সহযোগিতায় নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হলে ১৫ এপ্রিল এর নাম পরিবর্তন করে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি করা হয়। শান্তি কমিটির ২১ সদস্যের কার্যকরী কমিটির একজন সদস্য ছিলেন গোলাম আযম।
১৮ জুন লাহোর বিমানবন্দরে গোলাম আযম বলেন, জনগণ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে চায়। ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানান। পরদিন লাহোরে জামায়াতের পশ্চিম পাকিস্তান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে দুষ্কৃতকারীরা সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের প্রতিরোধে ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রসজ্জিত হওয়া উচিত।
অভিযোগ-৫: পঞ্চম অভিযোগে হত্যা ও নির্যাতনের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের সিরু মিয়া একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ তিনি স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ও ১৪ বছরের ছেলে আনোয়ার কামালকে নিয়ে কুমিল্লার নিজ বাড়িতে যান। সেখানে সিরু মিয়া শরণার্থীদের ভারতে যাতায়াতে সাহায্য করতেন।
২৭ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে কসবা থানার তন্তর চেকপোস্টের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেসহ ছয়জন ভারতে যাওয়ার সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। তাদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে কয়েক দিন নির্যাতনের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্বামী-সন্তানের ধরা পড়ার খবর পেয়ে সিরু মিয়ার স্ত্রী গোলাম আযমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সিরু মিয়ার ভগ্নিপতি ছিলেন গোলাম আযমের দুই ছেলে আজমী ও আমীনের শিক্ষক। তিনি গোলাম আযমের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে মুক্তি দিতে অনুরোধ জানান।
গোলাম আযম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে একটি চিঠি পাঠান, যাতে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে হত্যার নির্দেশ ছিল। চিঠি পাওয়ার পর ঈদের দিন রাতে সিরু মিয়াসহ ৩৯ জনকে পাকিস্তানি সেনারা রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় কারাগার থেকে বের করে নিয়ে পৈরতলা রেলব্রিজের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ৩৮ জন মারা গেলেও একজন প্রাণে বেঁচে যান।
No comments