দ্বিতীয় রায় নিয়ে অসন্তোষ এবং বিএনপির টগর বোষ্টমীর ভূমিকা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের
দ্বিতীয় রায় ঘোষিত হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের
জন্য অভিযুক্ত কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে।
তাতে দেশে জনগণের অনেকের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রায় শুনে
জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। তাদের মতে, দ-াদেশ লঘু হয়েছে।
একশ্রেণীর সন্দেহবাদী লোক এমন সন্দেহও প্রকাশ করছেন যে, এই বিচার ভ-ুল করার
জন্য জামায়াত দেশময় যে ভাংচুর, জ্বালাও পোড়াও নীতি গ্রহণ করেছে,
গৃহযুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে, তাতে সরকার হয়ত ভয় পেয়েছে। হয়ত ট্রাইব্যুনালও।
আমি এই সন্দেহ পোষণ করি না। ট্রাইব্যুনালে বিচারকদের ন্যায়পরায়ণতা ও সাহসের ওপর আমি আস্থা রাখি। তাদের দায়িত্ব ফেয়ার ট্রায়াল বা ন্যায় বিচার করা। জনমতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা পাইকারিভাবে ফাঁসির আদেশ দিতে পারে না। আবার জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের হুমকির মুখে বিচারকার্যে দুর্বলতা দেখাতে পারে না। কাদের মোল্লাকে তারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। জামায়াতের হুমকির মুখে দ- দেয়া থেকে সরে দাঁড়াননি। তাঁদের বিচারে যেটা ন্যায়দ- বলে মনে হয়েছে সেই দণ্ড দিয়েছেন।
এই রায়ের সঙ্গে সকলেই একমত হবেন এমন কথা নেই। এই রায়ের বিরুদ্ধে দ-িতদের আপীল করার যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি এই রায়ে যাঁরা সন্তুষ্ট হননি, তাদেরও ক্ষোভ প্রকাশের অধিকার আছে। এই বিচার সম্পর্কে সরকার ও ট্রাইব্যুনালকে নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি দেশপ্রেমিক কোন মহলেরই উচিত নয়। তাতে বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার জামায়াতী অভিসন্ধিকেই সাহায্য জোগানো হবে।
বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী এবং অন্যান্য মুখপাত্রও বলেছেন, কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপীল করবেন। তাঁরা মনে করেন, এই অপরাধীকে লঘুদ- দেয়া হয়েছে। কাদের মোল্লার বিচারের রায় এবং এ সম্পর্কে সরকার ও আওয়ামী লীগের অসন্তোষ কি একথা প্রমাণ করে না যে, এই বিচার বা ট্রাইব্যুনালের ওপর সরকারের কোন প্রভাব নেই? আমার মতে, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার করতে গিয়ে সেই মামলায় বিচারকদের যে চাপ ও প্রাণনাশের হুমকির মুখে বিচার শেষ করতে হয়েছিল (কোন কোন বিচারক তো সেই বিচারে বিব্রত বোধও করেছিলেন), যুদ্ধাপরাধী বিচারের এই ট্রাইব্যুনালকে তার চাইতে অনেক বেশি চাপ ও হুমকির মুখে কাজ করতে হচ্ছে।
দেশের ভেতরে জামায়াতীদের গৃহযুদ্ধের হুমকি এবং নাশকতামূলক দৌরাত্ম্য তো আছেই, সেই সঙ্গে বহির্জগতেÑবিশেষ করে পাকিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত শক্তিশালী মহলগুলো প্রকাশ্যে চাপ সৃষ্টি করছে এই বিচার ব্যাহত করার জন্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশের এই মানবতার শত্রুদের মৃত্যুদ- না দেয়ার। আমেরিকার প্রশাসনেও এই মানবতার শত্রুদের সমর্থক শক্তিশালী মহল আছে। তারা অর্থ, প্রচার ও প্রোপাগা-া দ্বারা জামায়াতকে সাহায্য ও সমর্থন জোগাচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচারের মুহূর্তে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ভূমিকাও মোটেই রহস্যপূর্ণ নয়, বরং রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে বলে অনেকেই মনে করেন। তিনি ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় স্বনামে প্রবন্ধ লিখে বাংলাদেশে আমেরিকার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। তাঁর প্রবন্ধটি পড়ে মনে হয়, তিনি ‘৭১ সালের মতো বাংলাদেশে মার্কিন সপ্তম নৌবহর ডেকে আনতে চান, চাইকি, পাকিস্তানে গণতন্ত্র রক্ষার নামে আমেরিকা যে ভয়াবহ ড্রোন হামলা চালাচ্ছে, বাংলাদেশেও সেই ধরনের হামলা আমেরিকা চালাক, এটাই বোধ হয় তাঁর মনের গোপন বাসনা।
৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় জামায়াতীদের গৃহযুদ্ধ শুরু করার পাঁয়তারা, পাশাপাশি বিএনপি নেত্রীর দেশে সরাসরি মার্কিন হস্তক্ষেপ কামনা, ৭১-এর মিত্র রাশিয়ার সঙ্গে হাসিনা সরকারের অস্ত্র ক্রয় চুক্তির তীব্র বিরোধিতা এসব কি আলামত বহন করে? মার্কিন সাংবাদিক লিফ্ৎসুজ তাঁর বইয়ে বাংলাদেশের ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘একটি অসমাপ্ত বিপ্লব (অহ ঁহভরহরংযবফ ৎবাড়ষঁঃরড়হ)। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দৃষ্টে কি মনে হয় না যে, তখনকার পরাজিত শত্রুরা এখন সেই অসমাপ্ত যুদ্ধকে নিজেদের অনুকূলে সমাপ্ত করার এবং একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মরিয়া হয়ে শেষ প্রচেষ্টায় নেমেছে?
’৭১-এর সঙ্গে বর্তমান সময়ের একটাই পার্থক্য, তখন শত্রুর বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। বর্তমান মুহূর্তে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বহুধাবিভক্ত, জাতি বিভ্রান্ত এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের সাহায্যে শত্রুপক্ষ শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ। মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ নিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে সুবিধাবাদী ভূমিকা গ্রহণ করেছে এবং দেশময় এমন বিতর্ক ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে যা স্বাধীনতার শত্রুপক্ষের অভিসন্ধি পূরণে সহায়ক হচ্ছে।
বিএনপি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাসক দল (এখন বিরোধীদলের ভূমিকায়)। কিন্তু তাদের অবস্থান শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের টগর বোষ্টমী চরিত্রের মতো। টগর বোষ্টমী তার নীচু জাতপাতের স্বামী সম্পর্কে বলেছে, মিনসের সঙ্গে বিশ বছর ঘর করছি বটে, কিন্তু হেঁসেলে কি ঢুকতে দিয়েছি? একই অবস্থা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের বেলায় দেখা যায়। দেশের মানুষের ক্রোধের সম্মুখীন হবে এই ভয়ে বিএনপি বলছে, যুদ্ধাপরাধী বিচারের ট্রাইব্যুনালের তারা বিরোধী নয়। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা সম্পর্কে তারা অনবরত প্রচার চালাচ্ছে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভ-ুল করার জন্য জামায়াত যখনই কোন হরতাল ডাকে, ভাংচুরে নামে তখন নানা অজুহাতে তাতে সমর্থন ও সাহায্য দেয়। বিএনপির হিপোক্রেসি বাংলাদেশে ‘৭১-এর যুদ্ধপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত ও শেষ করার পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়।
কাদের মোল্লা সম্পর্কে ট্রাইব্যুনালের রায় যদি নমনীয় হয়ে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আপীল করার সুযোগ আছে এবং সরকার তা করবে বলেছে। তারপরও এই রায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা চলে। সাধারণ মানুষ তা করছেও। কিন্তু এই ক্ষোভ ও হতাশাকে মূলধন করে জামায়াত-বিএনপি চক্র যে প্রচারণাটি উস্কে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে তা হলো ট্রাইব্যুনাল ও সরকার ভয় পেয়েছে অথবা জামায়াতীদের হুমকির মুখে আপস করেছে। ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সঙ্গে গোটা পুলিশ বাহিনীকেও ডিসক্রেডিট করার অপচেষ্টা চলছে। কোন কোন স্থানে জামায়াতী ক্যাডাররা পূর্বপরিকল্পনামত পুলিশের হাতে ফুল গুঁজে দিয়ে তার ছবি তুলে পুলিশ তাদের সঙ্গে সমঝোতা করেছে বলেও দেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। অর্থাৎ গণআন্দোলন সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ জামায়াত-বিএনপি এখন নানাভাবে সরকার, ট্রাইব্যুনাল ও পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কেও জনমনে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এই বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য ডেসপারেট চেষ্টা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এই বিভ্রান্তির ফাঁদে পা দেয়া উচিত নয়; বরং এই প্রোপাগা-া ও প্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার।
দেশ-বিদেশের অনেকের কাছেই এটা এখন স্পষ্ট, জামায়াত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য আন্দোলন সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়ে তাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত ক্যাডার বাহিনী দ্বারা দেশেরÑবিশেষ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে আকস্মিক ও ঝটিকা হামলা, গাড়ি বাড়ি মানুষ পোড়ানো ইত্যাদি নাশকতামূলক কাজ চালিয়েÑঅর্থাৎ উগ্রনীতি গ্রহণ করে সরকারকেও যুদ্ধের মাঠে টেনে নামাতে চায় এবং বহির্বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকার তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠোরভাবে দমন করতে চায়। সরকার জামায়াতের এই ফাঁদে পা না দিয়ে ভালই করেছে। স্থান বিশেষে পুলিশ জামায়াতী গু-াদের হাতে মার খেয়েছে, কিন্তু দেশের এবং বিদেশের মানুষও দেখেছে, সহিংস নীতি জামায়াতীদের; সরকারের নয়। জামায়াতের নাশকতামূলক কাজ তাদের জন্যই ব্যুমেরাং হচ্ছে।
’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হাসিনা সরকার ম্যাচুরিটির পরিচয় দিচ্ছে; ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার প্রমাণ দেখাচ্ছে। অধৈর্য্য ও অসহিষ্ণু হয়ে শত্রুপক্ষের ফাঁদে পা দিচ্ছে না এটা আমার মতো অনেকের কাছেই একটি পরম আশ্বাস। জামায়াতের ঠ্যাঙারু বাহিনীর চোরাগোপ্তা হামলা, নাশকতামূলক কাজ বন্ধ করার জন্য পুলিশের সঙ্গে গণপ্রতিরোধ যুক্ত করা প্রয়োজন। এই ব্যাপারে ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোর ভূমিকা কোথায়? তাদের আমি পাল্টা সন্ত্রাস সৃষ্টির কাজে নামতে বলি না। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে প্রতিরোধ সৃষ্টি করলে এই ঠ্যাঙারু বাহিনী ভয়েই মূষিকের মতো বিবরে পালাবে। এরা ভীরু এবং কাপুরুষ। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও তাদের খুন ধর্ষণের ঘটনাতেও এই সত্যই ধরা পড়েছিল। প্রকাশ্যে যুদ্ধের মাঠে নামার নৈতিক সাহস এদের নেই।
ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় রায়ে যাঁরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ আমার সেই বন্ধুদের বলেছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচ- চাপ এবং নিজের জীবনের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করায় সাহস ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালও প্রথম রায়েই একটি ফাঁসির আদেশ দিয়েছে। অপেক্ষা করুন এবং দেখুন, তারা ভবিষ্যতে আরও কি রায় দেয়? তারা যাতে ন্যায় বিচার করতে পারেন, সাহসী রায় দিতে পারেন, সেজন্য দেশময় ঐক্যবদ্ধ জনগণের সমর্থনের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটা উচিত। জামায়াতী দুর্বৃত্তদের রোখার জন্য রাজপথে স্বাধীনতার পক্ষের সকল দল ও মতের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ প্রয়োজন। তা সরকারের হাতে শক্তি জোগাবে, ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারকদের মনেও সাহস জোগাবে। তা না করে কেবল ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই বলে চিৎকার জুড়লে এবং সরকার ও ট্রাইব্যুনালের কাজে ক্রমাগত অসন্তোষ ও সন্দেহ প্রকাশ করলে এই বিচারের কাজটি সুষ্ঠু ও ত্বরান্বিত করা যাবে না।
লন্ডন : ৫ জানুয়ারি মঙ্গবার, ২০১৩
আমি এই সন্দেহ পোষণ করি না। ট্রাইব্যুনালে বিচারকদের ন্যায়পরায়ণতা ও সাহসের ওপর আমি আস্থা রাখি। তাদের দায়িত্ব ফেয়ার ট্রায়াল বা ন্যায় বিচার করা। জনমতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা পাইকারিভাবে ফাঁসির আদেশ দিতে পারে না। আবার জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের হুমকির মুখে বিচারকার্যে দুর্বলতা দেখাতে পারে না। কাদের মোল্লাকে তারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। জামায়াতের হুমকির মুখে দ- দেয়া থেকে সরে দাঁড়াননি। তাঁদের বিচারে যেটা ন্যায়দ- বলে মনে হয়েছে সেই দণ্ড দিয়েছেন।
এই রায়ের সঙ্গে সকলেই একমত হবেন এমন কথা নেই। এই রায়ের বিরুদ্ধে দ-িতদের আপীল করার যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি এই রায়ে যাঁরা সন্তুষ্ট হননি, তাদেরও ক্ষোভ প্রকাশের অধিকার আছে। এই বিচার সম্পর্কে সরকার ও ট্রাইব্যুনালকে নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি দেশপ্রেমিক কোন মহলেরই উচিত নয়। তাতে বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার জামায়াতী অভিসন্ধিকেই সাহায্য জোগানো হবে।
বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী এবং অন্যান্য মুখপাত্রও বলেছেন, কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপীল করবেন। তাঁরা মনে করেন, এই অপরাধীকে লঘুদ- দেয়া হয়েছে। কাদের মোল্লার বিচারের রায় এবং এ সম্পর্কে সরকার ও আওয়ামী লীগের অসন্তোষ কি একথা প্রমাণ করে না যে, এই বিচার বা ট্রাইব্যুনালের ওপর সরকারের কোন প্রভাব নেই? আমার মতে, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার করতে গিয়ে সেই মামলায় বিচারকদের যে চাপ ও প্রাণনাশের হুমকির মুখে বিচার শেষ করতে হয়েছিল (কোন কোন বিচারক তো সেই বিচারে বিব্রত বোধও করেছিলেন), যুদ্ধাপরাধী বিচারের এই ট্রাইব্যুনালকে তার চাইতে অনেক বেশি চাপ ও হুমকির মুখে কাজ করতে হচ্ছে।
দেশের ভেতরে জামায়াতীদের গৃহযুদ্ধের হুমকি এবং নাশকতামূলক দৌরাত্ম্য তো আছেই, সেই সঙ্গে বহির্জগতেÑবিশেষ করে পাকিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত শক্তিশালী মহলগুলো প্রকাশ্যে চাপ সৃষ্টি করছে এই বিচার ব্যাহত করার জন্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশের এই মানবতার শত্রুদের মৃত্যুদ- না দেয়ার। আমেরিকার প্রশাসনেও এই মানবতার শত্রুদের সমর্থক শক্তিশালী মহল আছে। তারা অর্থ, প্রচার ও প্রোপাগা-া দ্বারা জামায়াতকে সাহায্য ও সমর্থন জোগাচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচারের মুহূর্তে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ভূমিকাও মোটেই রহস্যপূর্ণ নয়, বরং রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে বলে অনেকেই মনে করেন। তিনি ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় স্বনামে প্রবন্ধ লিখে বাংলাদেশে আমেরিকার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। তাঁর প্রবন্ধটি পড়ে মনে হয়, তিনি ‘৭১ সালের মতো বাংলাদেশে মার্কিন সপ্তম নৌবহর ডেকে আনতে চান, চাইকি, পাকিস্তানে গণতন্ত্র রক্ষার নামে আমেরিকা যে ভয়াবহ ড্রোন হামলা চালাচ্ছে, বাংলাদেশেও সেই ধরনের হামলা আমেরিকা চালাক, এটাই বোধ হয় তাঁর মনের গোপন বাসনা।
৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় জামায়াতীদের গৃহযুদ্ধ শুরু করার পাঁয়তারা, পাশাপাশি বিএনপি নেত্রীর দেশে সরাসরি মার্কিন হস্তক্ষেপ কামনা, ৭১-এর মিত্র রাশিয়ার সঙ্গে হাসিনা সরকারের অস্ত্র ক্রয় চুক্তির তীব্র বিরোধিতা এসব কি আলামত বহন করে? মার্কিন সাংবাদিক লিফ্ৎসুজ তাঁর বইয়ে বাংলাদেশের ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘একটি অসমাপ্ত বিপ্লব (অহ ঁহভরহরংযবফ ৎবাড়ষঁঃরড়হ)। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দৃষ্টে কি মনে হয় না যে, তখনকার পরাজিত শত্রুরা এখন সেই অসমাপ্ত যুদ্ধকে নিজেদের অনুকূলে সমাপ্ত করার এবং একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মরিয়া হয়ে শেষ প্রচেষ্টায় নেমেছে?
’৭১-এর সঙ্গে বর্তমান সময়ের একটাই পার্থক্য, তখন শত্রুর বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। বর্তমান মুহূর্তে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বহুধাবিভক্ত, জাতি বিভ্রান্ত এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের সাহায্যে শত্রুপক্ষ শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ। মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ নিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে সুবিধাবাদী ভূমিকা গ্রহণ করেছে এবং দেশময় এমন বিতর্ক ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে যা স্বাধীনতার শত্রুপক্ষের অভিসন্ধি পূরণে সহায়ক হচ্ছে।
বিএনপি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাসক দল (এখন বিরোধীদলের ভূমিকায়)। কিন্তু তাদের অবস্থান শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের টগর বোষ্টমী চরিত্রের মতো। টগর বোষ্টমী তার নীচু জাতপাতের স্বামী সম্পর্কে বলেছে, মিনসের সঙ্গে বিশ বছর ঘর করছি বটে, কিন্তু হেঁসেলে কি ঢুকতে দিয়েছি? একই অবস্থা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের বেলায় দেখা যায়। দেশের মানুষের ক্রোধের সম্মুখীন হবে এই ভয়ে বিএনপি বলছে, যুদ্ধাপরাধী বিচারের ট্রাইব্যুনালের তারা বিরোধী নয়। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা সম্পর্কে তারা অনবরত প্রচার চালাচ্ছে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভ-ুল করার জন্য জামায়াত যখনই কোন হরতাল ডাকে, ভাংচুরে নামে তখন নানা অজুহাতে তাতে সমর্থন ও সাহায্য দেয়। বিএনপির হিপোক্রেসি বাংলাদেশে ‘৭১-এর যুদ্ধপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত ও শেষ করার পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়।
কাদের মোল্লা সম্পর্কে ট্রাইব্যুনালের রায় যদি নমনীয় হয়ে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আপীল করার সুযোগ আছে এবং সরকার তা করবে বলেছে। তারপরও এই রায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা চলে। সাধারণ মানুষ তা করছেও। কিন্তু এই ক্ষোভ ও হতাশাকে মূলধন করে জামায়াত-বিএনপি চক্র যে প্রচারণাটি উস্কে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে তা হলো ট্রাইব্যুনাল ও সরকার ভয় পেয়েছে অথবা জামায়াতীদের হুমকির মুখে আপস করেছে। ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সঙ্গে গোটা পুলিশ বাহিনীকেও ডিসক্রেডিট করার অপচেষ্টা চলছে। কোন কোন স্থানে জামায়াতী ক্যাডাররা পূর্বপরিকল্পনামত পুলিশের হাতে ফুল গুঁজে দিয়ে তার ছবি তুলে পুলিশ তাদের সঙ্গে সমঝোতা করেছে বলেও দেশে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। অর্থাৎ গণআন্দোলন সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ জামায়াত-বিএনপি এখন নানাভাবে সরকার, ট্রাইব্যুনাল ও পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কেও জনমনে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এই বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য ডেসপারেট চেষ্টা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এই বিভ্রান্তির ফাঁদে পা দেয়া উচিত নয়; বরং এই প্রোপাগা-া ও প্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার।
দেশ-বিদেশের অনেকের কাছেই এটা এখন স্পষ্ট, জামায়াত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য আন্দোলন সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়ে তাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত ক্যাডার বাহিনী দ্বারা দেশেরÑবিশেষ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে আকস্মিক ও ঝটিকা হামলা, গাড়ি বাড়ি মানুষ পোড়ানো ইত্যাদি নাশকতামূলক কাজ চালিয়েÑঅর্থাৎ উগ্রনীতি গ্রহণ করে সরকারকেও যুদ্ধের মাঠে টেনে নামাতে চায় এবং বহির্বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে চায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সরকার তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠোরভাবে দমন করতে চায়। সরকার জামায়াতের এই ফাঁদে পা না দিয়ে ভালই করেছে। স্থান বিশেষে পুলিশ জামায়াতী গু-াদের হাতে মার খেয়েছে, কিন্তু দেশের এবং বিদেশের মানুষও দেখেছে, সহিংস নীতি জামায়াতীদের; সরকারের নয়। জামায়াতের নাশকতামূলক কাজ তাদের জন্যই ব্যুমেরাং হচ্ছে।
’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হাসিনা সরকার ম্যাচুরিটির পরিচয় দিচ্ছে; ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার প্রমাণ দেখাচ্ছে। অধৈর্য্য ও অসহিষ্ণু হয়ে শত্রুপক্ষের ফাঁদে পা দিচ্ছে না এটা আমার মতো অনেকের কাছেই একটি পরম আশ্বাস। জামায়াতের ঠ্যাঙারু বাহিনীর চোরাগোপ্তা হামলা, নাশকতামূলক কাজ বন্ধ করার জন্য পুলিশের সঙ্গে গণপ্রতিরোধ যুক্ত করা প্রয়োজন। এই ব্যাপারে ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলোর ভূমিকা কোথায়? তাদের আমি পাল্টা সন্ত্রাস সৃষ্টির কাজে নামতে বলি না। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে প্রতিরোধ সৃষ্টি করলে এই ঠ্যাঙারু বাহিনী ভয়েই মূষিকের মতো বিবরে পালাবে। এরা ভীরু এবং কাপুরুষ। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও তাদের খুন ধর্ষণের ঘটনাতেও এই সত্যই ধরা পড়েছিল। প্রকাশ্যে যুদ্ধের মাঠে নামার নৈতিক সাহস এদের নেই।
ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় রায়ে যাঁরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ আমার সেই বন্ধুদের বলেছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচ- চাপ এবং নিজের জীবনের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনা ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করায় সাহস ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালও প্রথম রায়েই একটি ফাঁসির আদেশ দিয়েছে। অপেক্ষা করুন এবং দেখুন, তারা ভবিষ্যতে আরও কি রায় দেয়? তারা যাতে ন্যায় বিচার করতে পারেন, সাহসী রায় দিতে পারেন, সেজন্য দেশময় ঐক্যবদ্ধ জনগণের সমর্থনের বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটা উচিত। জামায়াতী দুর্বৃত্তদের রোখার জন্য রাজপথে স্বাধীনতার পক্ষের সকল দল ও মতের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ প্রয়োজন। তা সরকারের হাতে শক্তি জোগাবে, ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারকদের মনেও সাহস জোগাবে। তা না করে কেবল ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই বলে চিৎকার জুড়লে এবং সরকার ও ট্রাইব্যুনালের কাজে ক্রমাগত অসন্তোষ ও সন্দেহ প্রকাশ করলে এই বিচারের কাজটি সুষ্ঠু ও ত্বরান্বিত করা যাবে না।
লন্ডন : ৫ জানুয়ারি মঙ্গবার, ২০১৩
No comments