প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন
সে সময় দিনাজপুরে ছাত্রলীগ নেতা দবিরুল
ইসলাম, নুরুল হুদা, কাদের বক্স, এম আখতার মুকুল কারারুদ্ধ হন। ১৯৪৯ সালের
মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীরা কতিপয় দাবি আদায়ের
জন্য ধর্মঘট শুরু করেন।
এদের সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছাত্ররা ৩ ও ৫ মার্চ ধর্মঘট এবং বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলর ড.
মোয়াজ্জেম হোসেনের বাস ভবনে গমন করে। এই ঘটনার জের এবং ১১ মার্চ থেকে
প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের সময় ছাত্ররা যাতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে
না পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১১ মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়
অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। এর বিরুদ্ধে ছাত্ররা বিক্ষোভ অব্যাহত
রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একসিকিউটিভ কাউন্সিলের ২৯ মার্চ এক সভায় ২৭ জন
ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এরা হচ্ছেনÑ (১) দবিরুল
ইসলাম, আইন ছাত্র, ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ
(২) হামিদ চৌধুরী (এমএ ক্লাস), (৩) অলি আহাদ (বি.কম, দ্বিতীয় বর্ষ), (৪)
আবদুল মান্নান (বিএ, ক্লাস), (৫) উমাপতি মিত্র (এমএসসি পরীক্ষার্থী), (৬)
সমীর কুমার বসু (এমএ, ক্লাস) বিভিন্ন হল হইতে বহিষ্কার (১) আবদুর রহমান
চৌধুরী (আইন ছাত্র) সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ) (২)
মোল্লা জালাল উদ্দিন আহমদ, (এমএ, ক্লাস) (৩) দেওয়ান মাহবুব আলী (আইন ছাত্র)
(৪) আবদুল মতিন (এমএ ক্লাস), (৫) আবদুল মতিন খান চৌধুরী (আইন ছাত্র) (৬)
আবদুর রশিদ ভূইয়া (এমএ, ছাত্র) (৭) হেমায়েত উদ্দিন আহমদ (বিএ ক্লাস)। (৮)
আবদুল মতিন খান (এমএ, পরীক্ষার্থী), (৯) নুরুল ইসলাম চৌধুরী (এমএ ক্লাস)
(১০) সৈয়দ জামাল কাদেরী (এমএসসি ক্লাস), (১১) আবদুস সামাদ (এম.কম ক্লাস)
(১২) সিদ্দিক আলী (এমএ, ক্লাস) (১৩) আবদুল বাকী (বিএ ক্লাস), (১৪) জে,
পাত্রনবিশ (এমএসসি ক্লাস), (১৫) অরবিন্দু বসু, সহ-সভাপতি, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (আইন ছাত্র)।
যাদের পনেরো টাকা জরিমানা করা হয়েছিল তারা হলেনÑ
শেখ মুজিবুর রহমান (আইন ছাত্র), (২) কল্যাণ দাশগুপ্ত (এমএ ক্লাস) সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা হল ছাত্র সংসদ (৩) নঈমুদ্দিন আহমদ, আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, (৪) মিস নাদেরা বেগম (এমএ ক্লাস) (৫) আবদুল ওয়াদুদ (বিএল ক্লাস)।
দশ টাকা জরিমানা : (১) মিস লুলু বিলকিস বানু (আইন ছাত্রী)।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ বছরের জন্য বহিষ্কৃত ছাত্ররা ছাড়া সাজাপ্রাপ্ত ১৮ জন ছাত্রকে ১৭ এপ্রিলের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অঙ্গীকারপত্র দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয়। অধিকাংশ ছাত্ররা সে সময় অঙ্গীকার দিয়েছিল।
১৯৪৯ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় খুললে ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে। ১৯ এপ্রিল ছাত্ররা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাইস চ্যান্সেলের বাসভবনের সামনে ধর্মঘট শুরু করে। আগে থেকেই সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং ঘটনাস্থল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২০ এপ্রিল ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়ামে এক সভা করে। সভা শেষে মিছিল এগিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এই সময় বন্দী হন অলি আহাদ, খালেক নেওয়াজ খান, আবদুল মতিন, বাহাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী, নিতাই গাঙ্গুলি, আতাউর রহমান, আবুল হাসনাত, মাজহারুল ইসলাম, মফিজুলাহ প্রমুখ। ২৫ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিরাট ছাত্র-জনতার সভাশেষে বিরাট মিছিল বের হয়।
১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ ছাত্ররা আগের বছরের ১১ মার্চ স্মরণে ভাষা দিবস পালন করে। ১২ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, আরবি চাই না, ধ্বনি তোলে এবং সে সময় সৈয়দ আফজাল হোসেন, মৃণাল কান্তি বাড়রী, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, ইকবাল আনসারী খান, আবদুুস সালাম, একেএম মনিরুজ্জামান চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদ সাংবিধানিক মূলনীতি নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করে। এই কমিটি পাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’ বলে রিপোর্ট পেশ করে। ২ অক্টোবর করাচীতে গণপরিষদে রিপোর্টটির ওপর আলোচনার সময় পূর্ববাংলার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পাকিস্তানবাসীর জন্য বাংলা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি করেন। এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ নবেম্বর ‘জাতীয়’ সম্মেলন করে। এতে লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তানের সাংবিধানিক মূলনীতি সম্বন্ধে যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়Ñ পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। বাংলার সর্বত্র বিক্ষোভ প্রদর্শিত হলে গণপরিষদে আলোচনা স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৯ সালের ২৯ মার্চ চট্টগ্রামের ও ৮ এপ্রিল ঢাকা ক্লাবের অনুষ্ঠানে ড. আব্দুল হক উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পরের ঘটনাবলির মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ২৩/৬/৪৯ তারিখে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি। উপমহাদেশের কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের চাইতেও ঈর্ষণীয় ঘটনার নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হওয়ার অধিকারী দলটি সৃষ্টির প্রেক্ষিতে এবং মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের কিছু চিত্র উল্লেখ করা প্রয়োজন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যার অবদান ছিল সবচইতে বেশি তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তান ইস্যুতে গণভোট। বঙ্গ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কর্ণধার শহীদ সোহরাওয়ার্দী নির্বাচনে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেন, ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৩টিতে বিজয়ী হয়ে মুখ্যন্ত্রী নির্বাচিত হন, স্পীকার নুরুল আমীন। সোহরাওয়ার্দী আবুল হাসিমরা চেয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলা। জিন্নাহর ইচ্ছা প্রয়োজনে খ-িত বঙ্গ নিয়ে পাকিস্তান।
জিন্নার প্রতারণা এখানেই শুরু; তাই পুনরায় মুসলিম লীগের কাউন্সিল ডাকেন ১৯৪৬ সালের ৯ ও ১০ এপ্রিল এবং সোহারাওয়ার্দীকে দিয়ে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ঝঃধঃবং শব্দটির পরিবর্তে ঝঃধঃব সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন ও কাউন্সিলে গ্রহণ করে এক পাকিস্তানের পটভূমি সৃষ্টি করেন। ইতিপূর্বে ৩ এপ্রিল (৪৬) শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিনকে পরাজিত করে নেতা নির্বাচিত এবং ২৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে সিলেটের পাকিস্তানভুক্তির গণভোটে নির্বাচিত ১৪ জন সদস্যদের মধ্য থেকে তিনজনকে মন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে জিন্নার ষড়যন্ত্রে ৫/৮/৪৭ তারিখে পুনরায় নেতা নির্বাচনে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ৭৫-৩৯ ভোটে পরাজিত করে নেতা নির্বাচিত হন খাজা নাজিমুদ্দিন। ২০/৬/৪৭ তারিখে প্রাদেশিক পরিষদে অধিকাংশ হিন্দু সদস্য ভোটে বঙ্গ বিভক্তি চূড়ান্ত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ববঙ্গের ক্ষমতা খাজা নাজিমুদ্দিন এবং ইতিপূর্বে ডা. প্রফুল চন্দ্র ঘোষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। (৩.৭.৪৭)। যার ফলে ১৪ আগস্ট (৪৭) পাকিস্তান জন্ম নিলেও সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় থেকে যান এবং গান্ধীর সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গ বন্ধে তৎপর ছিলেন। কিন্তু তিনি ১৯৪৮ সালের ৩ জুন শান্তি মিশন নিয়ে ঢাকায় এলে তাকে দুই বাংলা এক করার কল্পিত অজুহাতে বন্দী করে দেশ থেকে বহিষ্কার করেন। তার গণপরিষদ সদস্য পদটি কেড়ে নেওয়া হয় যে অজুহাতে সেই একই কারণে বাবু রাজকুমার চক্রবর্তী কলকাতায় অবস্থান করলেও তার গণপরিষদ সদস্যপদ বাতিল করা হয়নি। পরবর্তীতে জিন্নাহর মৃত্যুর (১১/৯/৪৮) পরে ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচীতে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। কিন্তু তার কলকাতায় বিশ্বস্ত অনুসারীরা ঢাকায় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টায় সচেষ্ট ঢাকার ১৫০ মোগলটুলী কেন্দ্রিক ওয়ার্কার্স ক্যাম্পখ্যাত কর্মী শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, শামসুল হক প্রমুখের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী ভারত বিভক্তির সময় ছিলেন জেলে অথচ তিনি ১০ বছর অসম প্রদেশে মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। (ক্রমশ.)
যাদের পনেরো টাকা জরিমানা করা হয়েছিল তারা হলেনÑ
শেখ মুজিবুর রহমান (আইন ছাত্র), (২) কল্যাণ দাশগুপ্ত (এমএ ক্লাস) সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা হল ছাত্র সংসদ (৩) নঈমুদ্দিন আহমদ, আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, (৪) মিস নাদেরা বেগম (এমএ ক্লাস) (৫) আবদুল ওয়াদুদ (বিএল ক্লাস)।
দশ টাকা জরিমানা : (১) মিস লুলু বিলকিস বানু (আইন ছাত্রী)।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ বছরের জন্য বহিষ্কৃত ছাত্ররা ছাড়া সাজাপ্রাপ্ত ১৮ জন ছাত্রকে ১৭ এপ্রিলের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অঙ্গীকারপত্র দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করা হয়। অধিকাংশ ছাত্ররা সে সময় অঙ্গীকার দিয়েছিল।
১৯৪৯ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় খুললে ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে। ১৯ এপ্রিল ছাত্ররা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভাইস চ্যান্সেলের বাসভবনের সামনে ধর্মঘট শুরু করে। আগে থেকেই সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং ঘটনাস্থল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২০ এপ্রিল ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়ামে এক সভা করে। সভা শেষে মিছিল এগিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এই সময় বন্দী হন অলি আহাদ, খালেক নেওয়াজ খান, আবদুল মতিন, বাহাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী, নিতাই গাঙ্গুলি, আতাউর রহমান, আবুল হাসনাত, মাজহারুল ইসলাম, মফিজুলাহ প্রমুখ। ২৫ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিরাট ছাত্র-জনতার সভাশেষে বিরাট মিছিল বের হয়।
১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ ছাত্ররা আগের বছরের ১১ মার্চ স্মরণে ভাষা দিবস পালন করে। ১২ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, আরবি চাই না, ধ্বনি তোলে এবং সে সময় সৈয়দ আফজাল হোসেন, মৃণাল কান্তি বাড়রী, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, ইকবাল আনসারী খান, আবদুুস সালাম, একেএম মনিরুজ্জামান চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদ সাংবিধানিক মূলনীতি নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করে। এই কমিটি পাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’ বলে রিপোর্ট পেশ করে। ২ অক্টোবর করাচীতে গণপরিষদে রিপোর্টটির ওপর আলোচনার সময় পূর্ববাংলার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পাকিস্তানবাসীর জন্য বাংলা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি করেন। এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ নবেম্বর ‘জাতীয়’ সম্মেলন করে। এতে লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তানের সাংবিধানিক মূলনীতি সম্বন্ধে যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়Ñ পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। বাংলার সর্বত্র বিক্ষোভ প্রদর্শিত হলে গণপরিষদে আলোচনা স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৯ সালের ২৯ মার্চ চট্টগ্রামের ও ৮ এপ্রিল ঢাকা ক্লাবের অনুষ্ঠানে ড. আব্দুল হক উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পরের ঘটনাবলির মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ২৩/৬/৪৯ তারিখে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি। উপমহাদেশের কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের চাইতেও ঈর্ষণীয় ঘটনার নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হওয়ার অধিকারী দলটি সৃষ্টির প্রেক্ষিতে এবং মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের কিছু চিত্র উল্লেখ করা প্রয়োজন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যার অবদান ছিল সবচইতে বেশি তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তান ইস্যুতে গণভোট। বঙ্গ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কর্ণধার শহীদ সোহরাওয়ার্দী নির্বাচনে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেন, ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৩টিতে বিজয়ী হয়ে মুখ্যন্ত্রী নির্বাচিত হন, স্পীকার নুরুল আমীন। সোহরাওয়ার্দী আবুল হাসিমরা চেয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলা। জিন্নাহর ইচ্ছা প্রয়োজনে খ-িত বঙ্গ নিয়ে পাকিস্তান।
জিন্নার প্রতারণা এখানেই শুরু; তাই পুনরায় মুসলিম লীগের কাউন্সিল ডাকেন ১৯৪৬ সালের ৯ ও ১০ এপ্রিল এবং সোহারাওয়ার্দীকে দিয়ে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ঝঃধঃবং শব্দটির পরিবর্তে ঝঃধঃব সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন ও কাউন্সিলে গ্রহণ করে এক পাকিস্তানের পটভূমি সৃষ্টি করেন। ইতিপূর্বে ৩ এপ্রিল (৪৬) শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিনকে পরাজিত করে নেতা নির্বাচিত এবং ২৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে সিলেটের পাকিস্তানভুক্তির গণভোটে নির্বাচিত ১৪ জন সদস্যদের মধ্য থেকে তিনজনকে মন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে জিন্নার ষড়যন্ত্রে ৫/৮/৪৭ তারিখে পুনরায় নেতা নির্বাচনে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ৭৫-৩৯ ভোটে পরাজিত করে নেতা নির্বাচিত হন খাজা নাজিমুদ্দিন। ২০/৬/৪৭ তারিখে প্রাদেশিক পরিষদে অধিকাংশ হিন্দু সদস্য ভোটে বঙ্গ বিভক্তি চূড়ান্ত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ববঙ্গের ক্ষমতা খাজা নাজিমুদ্দিন এবং ইতিপূর্বে ডা. প্রফুল চন্দ্র ঘোষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। (৩.৭.৪৭)। যার ফলে ১৪ আগস্ট (৪৭) পাকিস্তান জন্ম নিলেও সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় থেকে যান এবং গান্ধীর সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গ বন্ধে তৎপর ছিলেন। কিন্তু তিনি ১৯৪৮ সালের ৩ জুন শান্তি মিশন নিয়ে ঢাকায় এলে তাকে দুই বাংলা এক করার কল্পিত অজুহাতে বন্দী করে দেশ থেকে বহিষ্কার করেন। তার গণপরিষদ সদস্য পদটি কেড়ে নেওয়া হয় যে অজুহাতে সেই একই কারণে বাবু রাজকুমার চক্রবর্তী কলকাতায় অবস্থান করলেও তার গণপরিষদ সদস্যপদ বাতিল করা হয়নি। পরবর্তীতে জিন্নাহর মৃত্যুর (১১/৯/৪৮) পরে ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচীতে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। কিন্তু তার কলকাতায় বিশ্বস্ত অনুসারীরা ঢাকায় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টায় সচেষ্ট ঢাকার ১৫০ মোগলটুলী কেন্দ্রিক ওয়ার্কার্স ক্যাম্পখ্যাত কর্মী শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, শামসুল হক প্রমুখের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী ভারত বিভক্তির সময় ছিলেন জেলে অথচ তিনি ১০ বছর অসম প্রদেশে মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। (ক্রমশ.)
No comments