যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কাদের মোল্লার

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই রায় দেন।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, ছাত্র ও আইনজীবীসহ আরো অনেককে হত্যার মোট ৬টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের মধ্যে ৫টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

এসব অপরাধের দুইটিতে তাকে যাবজ্জীবন কারদণ্ড ও তিনটি অপরাধে ১৫ বছরের সাজা দেওয়া হলো বলে মামলার রায়ে উল্লেখ করা হয়।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে এর আগে ২১ জানুয়ারি অপর যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায় দেন একই ট্রাইব্যুনাল। অন্যদিকে প্রথম ট্রাইব্যুনালে গত ২৯ জানুয়ারি শেষ হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে অপর অভিযুক্ত জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া। এ মামলার রায়ও যেকোনো দিন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১।  

মঙ্গলবার সকালে ট্রাইব্যুনাল-২ এর আদালত বসে ট্রাইব্যুনাল-১ এ। জনাকীর্ণ এই আদালতে কাদের মোল্লার মামলার রায় তিনটি অংশে ভাগ করে পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মজিবুর রহমান মিঞা ও বিচারক শাহীনুর ইসলাম। 

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কালে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৫টিই প্রমাণিত হয়েছে। একথা তার বিরুদ্ধে করা মামলার রায়ে বলা হয়েছে।

বেলা সাড়ে ১০টায় এজলাসে হাজির করা হয় কাদের মোল্লাকে। এরপরপরই শুরু হয় রায়ের কার্যক্রম। শুরুতেই কাদের মোল্লা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি কিছু বলতে চাই। বিচারপতি বলেন, আপনার কিছু বলার নেই, পরে বলবেন। কাদের মোল্লা জানতে চান কখন, রায় ঘোষণার পর। আদালত বলেন প্লিজ বসুনতো।

এরপর কাদের মোল্লা বসে পড়লে ১৩২ পৃষ্ঠায় ৪২৯টি অনুচ্ছেদের রায়টি তিন ভাগে ভাগ করে পাঠ শুরু হয়। প্রথমাংশ পাঠ করেন শাহীনুর ইসলাম।

শাহীনুর ইসলাম রায়ের প্রথমাংশ পাঠ করেন বেলা সোয়া ১১টা পর্যন্ত। এ অংশে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও সেসময় কাদের মোল্লার ভূমিকা বিশেষ করে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা হিসেবে তার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সহিংস ও সশস্ত্র অবস্থান তুলে ধরা হয় এ অংশে।

তার পাঠ শেষ হলে সোয়া ১১টায় দ্বিতীয় অংশের রায় পড়া শুরু করেন বিচারপতি মজিবুর রহমান মিঞা। দ্বিতীয় অংশও পাঠ সম্পন্ন হয়ে পৌনে ১২টায়। এরপরপরই তৃতীয় ও চ’ড়ান্ত পর্ব পাঠ শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, কবি মেহেরুন্নেছাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, পল্লবীর আলোকদি গ্রামে ৩৪৪ জনকে হত্যা, আইনজীবী-সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা, বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাত জনকে হত্যা, কেরাণীগঞ্জের শহীদনগর গ্রামের ভাওয়াল খান বাড়ি ও ঘাটারচরসহ পাশের আরো দু’টি গ্রামের অসংখ্য লোককে হত্যার ঘটনা।

এর মধ্যে ঘাটের চরের ঘটনা ছাড়া বাকি সবকটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলেই রায়ে বলা হয়েছে।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগ
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ৫টি অভিযোগ সন্দোহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে আর একটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি রাষ্ট্রপক্ষ।

প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথম অভিযোগ, একাত্তরের ৫ এপ্রিল মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন কাদের মোল্লা।

দ্বিতীয় অভিযোগ, একাত্তরের ২৭ মার্চ কাদের মোল্লা সহযোগীদের নিয়ে কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দুই ভাইকে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাসায় গিয়ে হত্যা করেন।

প্রমাণিত তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৯ মার্চ বিকেলে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে আরামবাগ থেকে কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা জল্লাদখানা পাম্পহাউসে নিয়ে জবাই করে হত্যা করেন।

পঞ্চম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা ও অবাঙালি রাজাকারদের সঙ্গে কাদের মোল্লা মিরপুরের আলোকদী (আলুব্দী) গ্রামে হামলা চালান। ওই ঘটনায় ৩৪৪ জনের বেশি নিহত হন।

ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৬ মার্চ কাদের মোল্লা, তার সহযোগী এবং পাকিস্তানি সেনারা মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের বাসায় যান। কাদের মোল্লার নির্দেশে হযরত, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা করা হয়, ধর্ষণের শিকার হন এক মেয়ে।

প্রমাণিত হয়নি ঘাটারচর গণহত্যা
তবে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেছেন, ঘটনা ঘটলেও কেরাণীগঞ্জের ঘাটারচর গণহত্যার সঙ্গে কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতা সন্দোতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি রাষ্ট্রপক্ষ। এ অভিযোগ আনা হয়েছিল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে চতুর্থ অভিযোগে। এ অভিযোগ অনুসারে, ২৫ নভেম্বর কাদের মোল্লা ও ৬০-৭০ জন রাজাকার কেরানীগঞ্জ থানার ভাওয়াল খানবাড়ি এবং ঘাটারচরে (শহীদনগর) শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করেন।

মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম
মুক্তিযুদ্ধকালে গোলাম মোস্তফা নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে কেরাণীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলাটি করেছিলেন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এই মামলার প্রথম সাক্ষী মোস্তফার কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ খান। ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় কাদের মোল্লাসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে। ওই মামলার অভিযোগে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে ট্রাইব্যুনাল-১ এ যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় ২০১০ সালের ২১ জুলাই।

২০১১ সালের ১ নভেম্বর জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) তার বিরুদ্ধে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। ২৮ ডিসেম্বর এসব অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল-১।

গত বছরের ১৬ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাসহ তিনটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।

গত বছরের ২৮ মে একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানিসহ ৬টি অভিযোগ এনে কাদের মোল্লার বিরদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৩(১), ৩(২)(এ)(এইচ) অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। গত বছরের ২০ জুন তার বিরুদ্ধে ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ও সুলতান মাহমুদ। তারা ৯৬ পৃষ্ঠার এ সূচনা বক্তব্যে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ৬টি অভিযোগ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। 

এর পর ৩ জুলাই থেকে শুরু করে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খান ও মনোয়ারা বেগমসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১২ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদেরকে জেরা করেন।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া রাষ্ট্রপক্ষের অন্য সাক্ষীরা হলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহম্মেদ খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মামা বাহিনীর প্রধান ও কমান্ডার শহিদুল হক খান মামা, কাদের মোল্লার হাতে ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী সাক্ষী (ক্যামেরা ট্রায়াল), কবি কাজী রোজি, শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ও আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবের পুত্র সরকারি কর্মকর্তা খন্দকার আবুল আহসান, সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী সাফিউদ্দিন মোল্লা, আব্দুল মজিদ পালোয়ান, কেরাণীগঞ্জের ঘাটারচর গ্রামের শহীদ নবী হোসেন বুলুর স্ত্রী নূরজাহান বেগম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মোল্লা এবং সৈয়দ আব্দুল কাইয়ুম।

অন্যদিকে ১৫ নভেম্বর থেকে শুরু করে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাদের মোল্লা নিজেসহ ৬ জন সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পক্ষে। এর আগে ৪ নভেম্বর সাফাই সাক্ষীর জন্য আসামীপক্ষের দাখিল করা ৯৬৫ জনের তালিকা থেকে ৬জন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অনুমোদন করেন ট্রাইব্যুনাল।  অন্য ৫ সাফাই সাক্ষী হচ্ছেন, সুশীল চন্দ্র মণ্ডল, মোসলেম উদ্দিন মাস্টার, সাহেরা খাতুন, আলতাফ উদ্দিন মোল্লা ও এ আই এম লোকমান। রাষ্ট্রপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেন।

গত ৭ থেকে ১৭ জানুয়ারি মোট ৮ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আসামিপক্ষ। এর মধ্যে কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ৪ দিন এবং অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস সোবহান তরফদার ৪ দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। অন্যদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী গত বছরের ১৭ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ও গত ১৬ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রপক্ষও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে সময় নেন ৮ কার্যদিবস।

এর আগে গত ৭ জানুয়ারি শুনানি শেষে কাদের মোল্লার মামলা পুনর্বিচারের জন্য আসামিপক্ষের আবেদনটি খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। সে আদেশে পুনর্বিচারের আবেদন করার আগে মামলাটি যে পর্যায়ে ছিল, সেখান থেকেই শুরু করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরুর মধ্য দিয়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে পৌঁছে।
---
প্রতিবেদকঃ ইশতিয়াক হুসাইন, জাকিয়া আহমেদ, জেসমিন পাঁপড়ি, মেহেদী হাসান পিয়াস

No comments

Powered by Blogger.