বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে রোডম্যাপ প্রয়োজন by এম তামিম
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে কোনো প্রকল্পই স্বল্প মেয়াদে করা সম্ভব নয়। এখানে সবই দীর্ঘমেয়াদি। তাই অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বাজেট বেশ ব্যতিক্রমধর্মী। অবকাঠামোগত অন্য অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্বল্প সময়েই একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যেমন ধরা যাক, একটি সেতু তৈরি হবে। এখন সেতু তৈরির জন্য আমাদের কী কী লাগবে? পাথর, সিমেন্ট, রড ইত্যাদি। অর্থাৎ, সবকিছুই চাইলে আমরা পেয়ে যাব, হাতের নাগালে। কিন্তু বিদ্যুৎ বা জ্বালানির উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। ধরুন, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এখন এ কাজের জন্য যা যা লাগবে, চাইলেই তার সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়া যাবে না। আর বিদুৎকেন্দ্র নির্মাণ বা উৎপাদন যেহেতু অনেক ব্যয়বহুল একটি বিষয়, তাই এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের জন্য অর্থের সংস্থান করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য লাগবে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক জ্বালানি, সেটারও নিশ্চয়তা থাকতে হবে বা তার ব্যবস্থা করতে হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি, তাই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বাজেটের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। কোনো রকম পরিকল্পনাহীন বাজেট দিয়ে আর যা-ই হোক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কার্যকর উন্নয়ন সম্ভব নয়। আগের বাজেটগুলোর মতো এবারও এর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হচ্ছে না।
বাজেটের আগে অবশ্যই পরিকল্পনা জরুরি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি হলেও কমপক্ষে পাঁচ বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। আর দীর্ঘমেয়াদি হলে সর্বোচ্চ ১০ বছর। আপনি কী ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্থ আসবে কোত্থেকে কিংবা প্রাথমিক জ্বালানিটাই বা কী হবে—এ বিষয়গুলো অবশ্যই আগে ভেবে রাখতে হবে।
এবারের বাজেটে আগামী চার বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এবং তারই ভিত্তিতে ঘোষণা করা হচ্ছে এবারের বিদ্যুৎ-জ্বালানির বাজেট। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে দুই হাজার ২২০ মেগাওয়াট, কয়লাভিত্তিক প্রায় দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, চার হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক এবং সৌরশক্তিভিত্তিক এক হাজার মেগাওয়াট। পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো—এই উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আসবে কোত্থেকে? এখানেই বড় দুর্বলতা। ধরা যাক গ্যাসের কথা। যদি তা আমদানি করা হয়, তবে বিশাল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগ যে পরিকল্পনা দিয়েছে, তার কোনো রকম বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
যদি ধরে নিই, সরকারের পক্ষে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব, সে ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেবে তা হলো, অর্থের জোগান আসবে কোথা থেকে। এই বিষয়টি সবার আগে ঠিক করা জরুরি। হিসাব করলে দেখা যায়, যে পরিমাণ গ্যাস আমদানি করতে হবে, তার দাম পড়বে গড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার। আগামী চার বছরের মধ্যে এর সংস্থান আমরা কী করে করব? তাই পরিকল্পনা করার আগে সবকিছু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা চাই। পরিকল্পনা ও সামর্থ্যের সমন্বয় করতে না পারলে সবকিছুই বিফল। তাই প্রথমেই বলেছি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিক্ষেত্রের বাজেট একদম ব্যতিক্রমী। এখানে সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া সুফল পাওয়া অসম্ভব।
বাজেটের আগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ থাকা প্রয়োজন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ভালো অনুশীলনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনই তো শেষ কথা নয়, এটার সুষ্ঠু বিতরণও অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হিসাব করলে দেখা যায়, আগামী চার বছরের জন্য যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, তা বিতরণের জন্যও আরও ১০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। মানে মোটমাট আমাদের দরকার ২৫ বিলিয়ন ডলার!
এ ছাড়া বেসরকারি খাতকে যদি আমরা যুক্ত করতে চাই, তাহলে কী প্রয়োজন? প্রয়োজন পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা। কিন্তু অতীতে যেমনটা দেখা গেছে, এবারও তেমন অনিশ্চিত বাস্তবতা সামনে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা কী করবেন? নিশ্চয়ই উৎসাহ দেখাবেন না! তাই বিনিয়োগকারীদের ব্যাপারেও ধারণা রাখা প্রয়োজন।
এর আগে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা অর্থ ফেরত গেছে, অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবশ্য এমনটা ঘটেছে। এটাও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ভর্তুকির বিষয়ে বললে, ভর্তুকি বেড়ে গেলে উৎপাদন-খরচ বাড়বেই। বাজেটে ভর্তুকির বড় প্রভাব আছে। এখন বাজারে ফার্নেস তেলের দাম বেড়েছে, তাই ফার্নেসভিত্তিক বিদ্যুতের দামও বেড়ে যাবে নিঃসন্দেহে।
এ বছর বার্ষিক ভর্তুকির ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর থেকে বের হওয়ার উপায় হলো সর্বজনীন ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া। যেসব ক্ষেত্র বা যারা ভর্তুকি পাওয়ার যোগ্য, তাদেরই ভর্তুকি দিলে সমস্যা কমে যায়। সরাসরি ভর্তুকিটাও গ্রহণযোগ্য। এটা ধীরে ধীরে করতে হবে। উৎপাদনমূল্যের চেয়ে ক্রয়মূল্য বেশি হলে সমস্যা বাড়বে, এটা সবাই জানেন। ভর্তুকি কী পরিমাণ এবং কত দিন দেওয়া হবে, তা-ও ঠিক করতে হবে।
সব সময় দেখা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেই বেশি বাজেট বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা তো এখানে নয়, প্রাথমিক জ্বালানির স্বল্পতাই সমস্যার কারণ। এখান থেকে সমাধান খুঁজতে চাইলে আমাদের গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে। কয়লা উত্তোলনের দিকে নজর দিতে হবে। মোট কথা, এখন যেটা চলছে, সেটাকে ঠ্যাক দিয়ে কাজ চালানো বলা যায়। এক কথায় উচ্চমূল্যে আমরা সময় কিনছি! স্থায়ী সমস্যা সমাধানের জন্য গ্যাস ও কয়লা অনুসন্ধান জরুরি। আর উচ্চমূল্যে যদি প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি করতেই হয়, তার আগে আমাদের অর্থনীতির ভিত আরও শক্ত করতে হবে।
ড. এম তামিম: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ); অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
বাজেটের আগে অবশ্যই পরিকল্পনা জরুরি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি হলেও কমপক্ষে পাঁচ বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। আর দীর্ঘমেয়াদি হলে সর্বোচ্চ ১০ বছর। আপনি কী ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অর্থ আসবে কোত্থেকে কিংবা প্রাথমিক জ্বালানিটাই বা কী হবে—এ বিষয়গুলো অবশ্যই আগে ভেবে রাখতে হবে।
এবারের বাজেটে আগামী চার বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এবং তারই ভিত্তিতে ঘোষণা করা হচ্ছে এবারের বিদ্যুৎ-জ্বালানির বাজেট। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে দুই হাজার ২২০ মেগাওয়াট, কয়লাভিত্তিক প্রায় দুই হাজার ৬০০ মেগাওয়াট, চার হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক এবং সৌরশক্তিভিত্তিক এক হাজার মেগাওয়াট। পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো—এই উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আসবে কোত্থেকে? এখানেই বড় দুর্বলতা। ধরা যাক গ্যাসের কথা। যদি তা আমদানি করা হয়, তবে বিশাল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগ যে পরিকল্পনা দিয়েছে, তার কোনো রকম বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
যদি ধরে নিই, সরকারের পক্ষে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব, সে ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেবে তা হলো, অর্থের জোগান আসবে কোথা থেকে। এই বিষয়টি সবার আগে ঠিক করা জরুরি। হিসাব করলে দেখা যায়, যে পরিমাণ গ্যাস আমদানি করতে হবে, তার দাম পড়বে গড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার। আগামী চার বছরের মধ্যে এর সংস্থান আমরা কী করে করব? তাই পরিকল্পনা করার আগে সবকিছু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা চাই। পরিকল্পনা ও সামর্থ্যের সমন্বয় করতে না পারলে সবকিছুই বিফল। তাই প্রথমেই বলেছি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিক্ষেত্রের বাজেট একদম ব্যতিক্রমী। এখানে সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া সুফল পাওয়া অসম্ভব।
বাজেটের আগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ থাকা প্রয়োজন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ভালো অনুশীলনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনই তো শেষ কথা নয়, এটার সুষ্ঠু বিতরণও অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হিসাব করলে দেখা যায়, আগামী চার বছরের জন্য যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, তা বিতরণের জন্যও আরও ১০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। মানে মোটমাট আমাদের দরকার ২৫ বিলিয়ন ডলার!
এ ছাড়া বেসরকারি খাতকে যদি আমরা যুক্ত করতে চাই, তাহলে কী প্রয়োজন? প্রয়োজন পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা। কিন্তু অতীতে যেমনটা দেখা গেছে, এবারও তেমন অনিশ্চিত বাস্তবতা সামনে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা কী করবেন? নিশ্চয়ই উৎসাহ দেখাবেন না! তাই বিনিয়োগকারীদের ব্যাপারেও ধারণা রাখা প্রয়োজন।
এর আগে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা অর্থ ফেরত গেছে, অন্যান্য ক্ষেত্রেও অবশ্য এমনটা ঘটেছে। এটাও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ভর্তুকির বিষয়ে বললে, ভর্তুকি বেড়ে গেলে উৎপাদন-খরচ বাড়বেই। বাজেটে ভর্তুকির বড় প্রভাব আছে। এখন বাজারে ফার্নেস তেলের দাম বেড়েছে, তাই ফার্নেসভিত্তিক বিদ্যুতের দামও বেড়ে যাবে নিঃসন্দেহে।
এ বছর বার্ষিক ভর্তুকির ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর থেকে বের হওয়ার উপায় হলো সর্বজনীন ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া। যেসব ক্ষেত্র বা যারা ভর্তুকি পাওয়ার যোগ্য, তাদেরই ভর্তুকি দিলে সমস্যা কমে যায়। সরাসরি ভর্তুকিটাও গ্রহণযোগ্য। এটা ধীরে ধীরে করতে হবে। উৎপাদনমূল্যের চেয়ে ক্রয়মূল্য বেশি হলে সমস্যা বাড়বে, এটা সবাই জানেন। ভর্তুকি কী পরিমাণ এবং কত দিন দেওয়া হবে, তা-ও ঠিক করতে হবে।
সব সময় দেখা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেই বেশি বাজেট বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা তো এখানে নয়, প্রাথমিক জ্বালানির স্বল্পতাই সমস্যার কারণ। এখান থেকে সমাধান খুঁজতে চাইলে আমাদের গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে। কয়লা উত্তোলনের দিকে নজর দিতে হবে। মোট কথা, এখন যেটা চলছে, সেটাকে ঠ্যাক দিয়ে কাজ চালানো বলা যায়। এক কথায় উচ্চমূল্যে আমরা সময় কিনছি! স্থায়ী সমস্যা সমাধানের জন্য গ্যাস ও কয়লা অনুসন্ধান জরুরি। আর উচ্চমূল্যে যদি প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি করতেই হয়, তার আগে আমাদের অর্থনীতির ভিত আরও শক্ত করতে হবে।
ড. এম তামিম: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ); অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
No comments